“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠছে আলোক-মঞ্জীর, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।”
বাঙালির সর্ববৃহৎ উৎসব
দুর্গাপুজো আসন্ন। আর এই বার্তারই জানান দেয় মহালয়ার দিন ভোরবেলায় বেতার
মাধ্যমে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের
চণ্ডীপাঠের সম্প্রসারণ। তার পরেই বরাবরের চেনা পরিচিত আবহাওয়া, পরিবেশ যেন হঠাৎই বদলে যায়। মনের ভেতর বাজতে
থাকে ঢাকের বাদ্যি।
হিন্দু সনাতন ধর্মে মহালয়ার ইতিহাস সর্বজনবিদিত। মহালয়ার মাধ্যমেই সূচনা হয় দেবীপক্ষের। পুরাণ মতে, দেবীপক্ষেই দেবী দুর্গা ব্রহ্মার কাছ থেকে মহিষাসুরকে বধ করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পুরাকালে মহিষাসুর দেবতাদের একশতবর্ষব্যাপী যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাঁদের বিতাড়িত করলে দেবতারা প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শুনে তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন এবং সেই ক্রোধে তাঁদের মুখমণ্ডল থেকে এক মহাতেজ নির্গত হলো, যুক্ত হলো ব্রহ্মার মুখমণ্ডলের তেজও। সেই সঙ্গে ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হলো। কালিকা পুরাণ মতে, আশ্বিনের শুক্লপক্ষের সপ্তমীতে হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজপুঞ্জ একত্রিত হয়ে আকার ধারণ করলো এক নারীমূর্তির। ঋষি কাত্যায়নের দ্বারা পুজিতা হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হলেন।
কাত্যায়নী ছিলেন স্বয়ং আদিশক্তি। অষ্টমীতে অলঙ্কার দশ অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে দশভূজা সেই দেবী নবমীর দিন
মহিষাসুরকে নিহত করেছিলেন। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী দেবী পক্ষেই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন দেবী দুর্গা আর তাই হিন্দুদের মধ্যে শুভ
শক্তির আরাধনায় মহালয়া তিথির গুরুত্ব অপরিসীম। অপরদিকে লোককথা অনুসারে, এই মহালয়ার দিনেই কৈলাস পর্বত থেকে
মর্ত্যধামে তথা হিমালয়ের কাছে পিতৃগৃহে যাত্রা শুরু করেন উমা তথা দেবী দুর্গা।
সঙ্গে থাকে তাঁর সন্তানেরা – লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক। শাক্ত পদাবলীতে উমার আগমন
এবং প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে রচিত হয়েছে বহু লোকপ্রিয় গান।
মহালয়ার পরেই শুরু হয়ে যায় দেবীপক্ষ। তবে তারও অনেক আগে থেকে মা দুর্গার মর্ত্যে আগমনকে কেন্দ্র করে শহরে গ্রামে, অলিতে গলিতে মহা আড়ম্বরে চলতে থাকে পুজোর প্রস্তুতি। কবে, কখন, কীভাবে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়েছিল সেই বিষয়ে হিন্দু ধর্ম অনুসারে বহু মতবাদ রয়েছে। মনে রাখতে হবে, হিন্দু ধর্ম বা সনাতন ধর্মের সূচনা একদিনে হয়নি। যুগে যুগে নানা অবতারের মাধ্যমে এই ধর্ম বর্তমান রূপ লাভ করেছে। তাই দুর্গাপূজার সূচনা ঠিক কবে, তা বলা কঠিন এবং গবেষণার বিষয়। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, ‘দুর্গা’ নামের ব্যাখ্যায় ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও ‘আ-কার’ ভয়শত্রুনাশক হিসেবে চিহ্নিত। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই ‘দুর্গা'। অপরদিকে ‘শব্দকল্পদ্রুম’ অনুসারে ‘দুর্গ’ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই দুর্গা। শ্রীশ্রীচণ্ডীর বর্ণনানুযায়ী দুর্গা সকল দেবতার সম্মিলিত এক মহাশক্তির প্রতিমূর্তি। এ পূজায় বৈদিক, তান্ত্রিক, পৌরাণিক, আনুষ্ঠানিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব ভাবের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। দুর্গাপুজোর ইতিহাস অনুসারে, পূর্বে বসন্তকালেই হতো মূল দুর্গাপুজো। তার নাম ছিল বাসন্তী পুজো। তাই বলে শরৎ কালে কি দেবী আরাধনা হতো না? উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই হতো। শরৎকালে মাতৃকা উপাসনা উপমহাদেশে বহু প্রাচীন। হরপ্পা সভ্যতার মাতৃকা দেবী ঊষার উপাসনা বা বোধন এই শরৎকালেই হত। বাংলারই চন্দ্রকেতুগড় সভ্যতা এই মাতৃকা উপাসনার ঐতিহ্য বহন করত। সেখানে সিংহ বাহিনী এই দেবী চার সহচর/সহচরী/সন্তান পরিবেষ্টিত যে মাতৃকার উপাসনা হত, তিনি মাথার খোঁপায় দশটি ক্ষুদ্র শলাকার মতো আয়ুধ ধারণ করতেন। এমনকি পাল আমলেও তাঁর রমরমা ছিল অবিরত। পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল যাঁর উপাসনা করতেন সেই চুন্দা সম্পর্কেও এই শারদীয়া পুজো বিষয়টা প্রযোজ্য। শরৎকালে চুন্দার উপাসনা হত, এবং চুন্দা/চুন্দি/চণ্ডী এঁরা কিন্তু পরস্পর সম্পর্কিত। পালসম্রাট মহীপালের সময় থেকেই ব্যাপক সংখ্যায় দুর্গা মূর্তি দেখা যায়। মহীপাল পরবর্তীতে ভবানী মন্দিরও স্থাপন করেছিলেন। এই মহীপাল এবং তাঁর পুত্র নয়পাল দুজনেই মাতৃকা উপাসক ছিলেন। আর এই পালযুগেই প্রথম দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনীর আগমন ঘটে বাংলায় এবং দশম শতকে রাজা মহীপাল ব্যাপক আকারে শুরু করেন কারণ প্রচুর দুর্গা মূর্তি এই সময়েই পাওয়া যায়, যদিও পালযুগের প্রথম দুর্গামূর্তি নবম শতকে পাওয়া যাচ্ছে। সপরিবার দুর্গার বর্তমান রূপ পাল সম্রাট মহীপালের সময় থেকেই অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকেই প্রচলিত। লক্ষ্মী সরস্বতী কার্ত্তিক গণেশকে নিয়ে দশভুজা দুর্গার মহিষমর্দিনী মূর্তি তখন থেকেই বাঙালি নির্মাণ করে আসছে। পালরাষ্ট্রের এই দুর্গা উপাসনা যে সেনযুগেও প্রচলিত ছিল, সেনযুগেরও অনেক দুর্গা মূর্তি পাওয়া গেছে।
এছাড়া, তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের আগেই বাংলায়
জোরকদমে দুর্গাপুজা প্রচলিত ছিল ধারণা করা হয়ে থাকে। কংসনারায়ণের
আগেই মল্লভূমে আদিমল্লের মাধ্যমে মল্ল রাজবংশের কুলদেবী মা মৃন্ময়ী দুর্গার
আরাধনাও এই সময়েই শুরু হয়। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন
করেন। শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রাচীন স্মৃতি আচার্য বালক ও জীকন এই সময়েই লিখেছিলেন।
এরপর একাদশ শতাব্দীতে ভবদেব ভট্ট, চতুর্দশ শতাব্দীতে শূলপাণি
এবং ষোড়শ শতকে রঘুনন্দনের দুর্গাপূজা বিষয়ক স্মৃতিগ্রন্থে শরৎকালীন সপরিবার দুর্গা
মূর্তির বিবরণ পাওয়া যায়। সেনযুগে বল্লালসেনের সময়ে রচিত মৎস্যসূক্তে দুর্গা
প্রতিমা নির্মাণের বিধিতেও আজকের সপরিবার কাঠামোরই বর্ণনা পাওয়া যায়। আবার
সেনযুগের ঠিক পরেই রচিত কালীবিলাসতন্ত্রে সপরিবার দুর্গা মূর্তির উপাসনা ও তার
পুণ্যফলাদির বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। ১৪১৫-১৪১৯ সালের মধ্যে দনুজমর্দনদেব এবং
মহেন্দ্রদেব নিজেদের চণ্ডীচরণপরায়ণ বলে গেছেন। কাজেই এঁরাও একজন সিংহবাহিনী দেবীর
উপাসনা করতেন ভাবা যেতে পারে। সুতরাং বর্তমান সপরিবার দুর্গা মূর্তি এগারোশো
বছরেরও বেশি সময় ধরে বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রচলিত।
এরই মাঝে বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলাতে থাকে। মধ্যযুগে
বৈদেশিক আক্রমণের ফলে সার্বিকভাবে বাংলা ও বাঙালি বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শুরু
হয় বাংলার ইতিহাসে অন্ধকার যুগের। আর এরই মধ্যে বাংলায় শক্তি আরাধনার এই
গুরুত্বপুর্ণ ও প্রাচীন ধারাটির পুনরুজ্জীবন করেন রাজা কংসনারায়ন। তৎকালীন
বঙ্গদেশের
রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ রায় ১৪৮০ সালে বাংলায় দূর্গাপুজোর পুনঃপ্রচলন
করেছিলেন। এইসময়, রাজা কংসনারায়ণের সভাকবি ছিলেন প্রখ্যাত রামায়ণকার
কৃত্তিবাস ওঝা। তাঁরই অনুরোধে কবি রচনা করেন’শ্রীরাম পাঁচালি'। তাই ধারণা করা যেতে পারে, সম্ভবত কংসনারায়ণের দুর্গাপুজাকে সাধারণ
জনমানসে বিখ্যাত করার লক্ষ্যেই, কবি
রামায়ণে অকালবোধণের অন্তর্ভুক্তি করে দুর্গাপুজাকে সাধারণ্যে প্রচারিত করেছিলেন।
ইতিহাসের পাতায় রাজা
কংসনরায়ণের পুজোই এখনও পর্যন্ত বঙ্গদেশের সবথেকে পুরোনো পুজো বলে মনে করা হয়। যদিও
এ ব্যাপারে দ্বিমতও রয়েছে। কংসনারায়ণ মধ্যযুগের অন্ধকারে প্রাচীন রীতিটির
পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাই তিনি অবশ্যই বাঙালির শ্রদ্ধার
অধিকারী। কিন্তু তাঁকে কোনো মতেই প্রবর্তক বলা যায় না।
শুধুমাত্র মনুষ্য সমাজেই নয়, পৌরাণিক মতে দেবতাদের মধ্যেও প্রথম দুর্গাপুজো প্রচলনের উল্লেখ রয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পাওয়া যায়,
“গোলক ধামে রাসমন্ডলে পরাৎপর
পরমাত্মা কৃষ্ণ মধুমাসে প্রীতিপূর্ণ হৃদয়ে সেই পরমাপ্রকৃতি দূর্গা দেবীর পূজা
করিয়া তাহার স্তব করিয়া ছিলেন। পরে মধুকৈটভ যুদ্ধে বিষ্ণু কর্তৃক সংস্তুতা হন, তৎকালে প্রাণসঙ্কট উপস্থিত হইলে ব্রহ্মা
তাঁহার স্তব করেন, তৎপরে
মহাঘোরতর ত্রিপুর যুদ্ধাকালে ত্রিপুরারি দেবাদিদেব তাঁহার স্তুতিবাদে প্রবৃত্ত হন, অতঃপর বৃত্রাসুর বধকালে ঘোর প্রাণ সঙ্কট
উপস্থিত হইলে দেবরাজ সমস্ত দেবগণে পরিবৃত হইয়া তাঁহার স্তুতিবাদ করেন, তদনন্তর মুনিত্রয়, মনু ও সুরথাদি মানবগণ প্রতি কল্পে সেই
পরাৎপরা পরমাপ্রকৃতির স্তব করিয়াছিলেন।”
এরপর থেকেই পৃথিবীতে
মুনিঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মনুষ্য সমাজ নানা ভাবে নানা সময়ে
দুর্গাপুজো করে আসছে। মা দুর্গা ও দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যতগুলি পৌরাণিক গল্প
প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় গল্পটি পাওয়া যায় শ্রীশ্রীচণ্ডী বা
দেবীমাহাত্ম্যম্-এ। এই গল্পটি হিন্দুরা এতটাই মান্য করে যে শ্রীশ্রীচণ্ডীর পাঠ
দুর্গাপুজোর একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। এই দেবীমাহাত্ম্যম্ আসলে
মার্কণ্ডেয় পুরাণের একটি নির্বাচিত অংশ। এর মধ্যে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি
শ্লোক আছে। এই গ্রন্থে বর্ণিত দেবী দুর্গার কাহিনীগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়
মহিষাসুর বধের কাহিনীটি যার সম্প্রসারণ মহালয়ার দিন প্রাতঃকালে বেতারে এবং
টেলিভিশনের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
মহালয়ার দিন ভোরবেলায়
বেতার মাধ্যমে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অননুকরণীয় কণ্ঠস্বরে মহিষাসুরমর্দিনী
অনুষ্ঠানের সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে একেবারে গোড়ার দিকের কিছু কথা বলতেই হয়। ১৯৩২ সালের
কথা। ওই বছর অন্নপূর্ণা এবং বাসন্তী পুজো খুব কাছকাছি সময়ের মধ্যে পড়েছিল। এই
দুই পুজোর মাঝখানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। চৈত্র মাসে বসন্তের সমাগমে
আকাশবাণীর এই বিশেষ অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা করলেন বাণীকুমার অর্থাৎ বৈদ্যনাথ
ভট্টাচার্য। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী থেকে কাহিনী নিয়ে স্তোত্র ও সঙ্গীতের সমাহারে গড়ে
তুললেন’বসন্তকুমারী’নামের একটি গীতি-আলেখ্য এবং এই গানে সুর সংযোজন করলেন পঙ্কজ
মল্লিক ও হরিশচন্দ্র বালী। ১৯৩২ সালেই দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন সরাসরি সম্প্রচারিত
অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রও কিছু অংশ পাঠ করেছিলেন। অনুষ্ঠানটির সম্পর্কে
অনেকেই প্রশংসাসূচক মন্তব্য করলে উৎসাহ পেয়ে’বসন্তেশ্বরী’র পরের বছর অনুরূপ
একখানি অনুষ্ঠান করা হয় যা’মহিষাসুর বধ’নামে ১৯৩৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে
প্রভাতী অনুষ্ঠানে সম্প্রসারিত হয়েছিল। এই মহিষাসুর বধ অনুষ্ঠান ক্রমেই জনপ্রিয়
হতে শুরু করে। একবার এই অনুষ্ঠানের মহড়াতেই সংস্কৃত চণ্ডীর স্তোত্র পাঠের পর ঠিক
একইরকম সুরে ও ছন্দে বাংলা ভাষ্যগুলিও পড়তে শুরু করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। শুভ
সূচনা হয় মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের।
আকাশবাণীতে মহালয়ার দিন
স্তোত্রপাঠ নেহাতই সাধারণ কোনো অনুষ্ঠান নয়। অনুষ্ঠানের আগের দিন থেকে পুরো
স্টুডিও ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হত। চারিপাশ ছেয়ে যেতো ধূপ-ধুনোর গন্ধে। গোটা
স্টুডিওতে যেন তৈরি হতো পুজোর বাতাবরণ। চণ্ডীপাঠের পূর্বে ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে
আসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। পরনে থাকতো নতুন থানের ধুতি, উর্দ্ধাঙ্গ অনাবৃত। বাকিরাও স্নান করে গেরুয়া
বসনে স্টুডিওতে এসে উপস্থিত হতেন। অনুষ্ঠান শুরুর আগে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলতেন, “সবাই ধ্যান করে নাও।” নৃপেন বাবু অর্থাৎ এই
অনুষ্ঠানের সর্বময় কর্তা নৃপেন্দ্র মজুমদারও সবাইকে বলতেন, “উনি যেটা বলছেন, সেটাই করো। আমরা এখানে কেউ নই। যা করার মা
নিজেই করে নেবেন।”
যেখানে মহিষাসুরমর্দিনীর
স্তোত্রপাঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছাড়া অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়, ভাবতে অবাক লাগে এই অনুষ্ঠান শুরুর আগে তাঁকে
নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময় আকাশবাণীর অনেকেরই অভিযোগ ছিল কায়স্থ
সন্তান হয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কীভাবে চণ্ডীপাঠ করবেন! তখন নৃপেন বাবু বলেন, উনিই করবেন। বেঁকে বসেন বাণী কুমারও। তিনি
স্থির করেই নিয়েছিলেন, বীরেন
বাবুকে নেওয়া না হলে তিনি স্ত্রোত্রই লিখবেন না।
শুধুমাত্র স্তোত্রপাঠই নয়, মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানে যন্ত্রশিল্পীরাও
যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বীরেন বাবুর স্তোত্রপাঠ, সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীতের মাধুর্য্য, এই দুইয়ের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় অপার্থিব এক
পরিবেশের। এই প্রসঙ্গে যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে মজার একটি ঘটনা রয়েছে।
মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানে যন্ত্রশিল্পীদের পরিচালনায় ছিলেন রাই চাঁদ বড়াল। এই
শিল্পীদের মধ্যে ধর্মের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। হিন্দু যেমন ছিলেন, মুসলিমরাও ছিলেন। এদিকে মুসলিম শিল্পীরা আবার
উর্দুভাষী। রাই বাবু তাঁদেরকে সাধ্যমতো সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে গিয়ে
বললেন, সংস্কৃত
স্তোত্রপাঠের সময় ইন্সট্রুমেন্ট সাপোর্ট দিতে হবে এবং বাংলায় স্তোত্রপাঠের সময়
কোনো ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো হবে না। এবার এইসব বোঝাবুঝির মধ্যে হয়ে গেলো এক
গন্ডগোল। অনুষ্ঠান শুরু হল। সংস্কৃতের পর বাংলায় শুরু হল স্তোত্রপাঠ। রাই বাবুর
নির্দেশানুযায়ী হিন্দু শিল্পীরা বাদ্যযন্ত্র বন্ধ রাখলেও মুসলিম বাদকরা বাজিয়েই
চলেছেন। তা দেখে তো রায় বাবু, নৃপেন
বাবু, বীরেন
বাবু সকলের চক্ষু চড়কগাছ। এরই মধ্যে ঘটে গেলো এক চমক। বীরেন বাবু উপলব্ধি করলেন
তাঁদের ওই বাজনায় সৃষ্টি হচ্ছে অদ্ভুত এক সুরেলা আবহ। তখনই তিনি গদ্য ছেড়ে সুর
করে চণ্ডীপাঠ করতে শুরু করলেন। হিন্দু যন্ত্রশিল্পীরা সেই রেশে পুনরায় বাজাতে
আরম্ভ করলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো মুসলিম বাদ্যযন্ত্রীদের বোঝার সমস্যার কারণেই
তৈরি হল এই নতুন সৃষ্টির।
মহিষাসুরমর্দিনী
অনুষ্ঠানের শুরু থেকে একটানা প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রসারিত হয়ে
এসেছে। মাঝে ১৯৪৭ সালে লাইভ অনুষ্ঠান করা যায়নি। সেই সময় সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার
কারণে কলকাতাবাসীর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। সেকারণে ওই ভোরবেলায় কলাকুশলীদের
স্টুডিওতে নিয়ে আসার ঝুঁকি নেয়নি আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া
হয় যে এবার থেকে এই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং করা হবে যাতে পরবর্তীতে এমন ঘটনার
পুনরাবৃত্তি হলে অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলে অনুষ্ঠান
সম্প্রসারণে কোনো সমস্যা না হয়। সেই থেকে রেকর্ডিংয়ের ভাবনা শুরু।
না, শিল্পীদের এই টিম নেহাতই আনকোরা ছিল না। নিজস্ব
স্থানে প্রত্যেকে নিজেদের মতো স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কিন্তু তাও ব্যর্থ হয়েছিল তাঁদের
এই সৎ প্রচেষ্টা, উঠেছিল
সমালোচনার ঝড়। মহালয়ার ভোরে চিরাচরিত মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের জায়গায় নতুন একটি
অনুষ্ঠানকে শ্রদ্ধেয় শিল্পীরা শ্রোতাদের সামনে আনতে চেয়েছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
মন্দ্রিত স্বরে সুরেলা স্তোত্র পরিবেশন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন মাধুরী
মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের প্রথম গানটি ধরেছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় – ‘আলোকের
মঞ্জীরে উঠিল রণি’/ তব চরণধ্বনি, জননী!’
মানবেন্দ্র গেয়েছিলেন – ‘সুধাতরঙ্গিনী, হে
লীলারঙ্গিনী,/ কখন
থাকো কী-যে রঙ্গে মা’। ‘নমো বরবর্ণিনী, বহু-রূপ-নামিনী…’
গানটি শোনা গিয়েছিল মান্না দে’র কণ্ঠে। প্রখ্যাত শিল্পী স্বর্গীয়া লতা মঙ্গেশকর পরিবেশন
করেছিলেন – ‘তুমি বিশ্বমাতা/ ব্রহ্মময়ী মা তুমি,/ জঠরধারিনী,/ আমার জন্মভূমি’ গানটি। শেষলগ্নে হেমন্ত বাবু নিজের
গলায় গেয়েছিলেন – ‘তোমারি করুণাধারা ঝরাল শান্তিসুধা,/ ভরিল ভুবন-মন হরষে’। এঁদের শৈল্পিক কাজের মানদণ্ড
নিয়ে কি কখনো কারুর মনে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দেবে! তখন কিন্তু দেখা দিয়েছিল। তাঁদের
প্রচেষ্টাকে মানুষ ত্যাগ করেছিল আবেগের বশবর্তী হয়ে। কারণ মহালয়ার ভোরে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্রের কণ্ঠস্বরে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের চণ্ডীপাঠ বাঙালির কাছে শুধুমাত্র কোনো
অনুষ্ঠান নয়, বাঙালির
আবেগ।
শুধুমাত্র এই অনুষ্ঠানই
নয়, মহালয়ার
সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত রয়েছে তর্পণ। তর্পণ শব্দটি এসেছে ত্রুপ থেকে। এর অর্থ
হলো সন্তুষ্ট করা। ভগবান, ঋষি
ও পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশে জল নিবেদন করে তাঁদের সন্তুষ্ট করাকে তর্পণ বলা হয়।
ভগবান ও পূর্বপুরুষের আত্মার নাম উচ্চারণ করে তাঁদের কাছে সুখ-শান্তি প্রার্থনা
করা হয়ে থাকে। পিতৃ ও মাতৃ তর্পণের সময় জল, তিল, চন্দন, তুলসীপাতা
ও ত্রিপত্রী এবং অন্যান্য তর্পণের সময় তিলের পরিবর্তে ধান কিংবা যব ব্যবহার করা
হয়। চন্দন, তিল
ও যব না থাকলে কুরুক্ষেত্র মন্ত্রপাঠের জলে তুলসীপাতা দিয়ে তর্পণ করতে হয়।
মহালয়ার দিন তর্পণের প্রচলন রয়েছে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, মহালয়ার সঙ্গে তর্পণের যোগাযোগ কিন্তু
নেহাতই কাকতালীয় নয়। এর পেছনে রয়েছে পৌরাণিক মতবাদ।
পিতৃপক্ষের অবসান ও
দেবীপক্ষের সূচনার সন্ধিক্ষণকে মাহাত্ম্য প্রদান করে মহালয়া। পিতৃপক্ষের শেষ
দিনটিতে পূর্বপুরুষকে স্মরণ করাটাই সনাতন ধর্মে প্রবহমান হয়ে আসছে এবং অধিকাংশ
সাধারণ মানুষই মহালয়ার অর্থ এবং তর্পণের প্রচ্ছন্ন কাহিনীটি না জেনেই নিয়মপালন
জ্ঞান করে এই দিনে তর্পণ করে আসছেন। মহালয়া কথাটির দুটি অর্থ বিদ্যমান; প্রথমত, ‘মহা+লয়', এর অর্থ ‘মহা’ অর্থাৎ পরমব্রহ্মে ‘লয়’ প্রাপ্তি; দ্বিতীয়ত, ‘মহ+আলয়’, ‘মহ’ শব্দের
প্রথম ও প্রধান অর্থ হল
‘উৎসব’। অর্থাৎ, উৎসবমুখর
আলয়কেই মহালয় বলা হয়। হিন্দু ধর্মে মনে করা হয় যে প্রয়াত পিতৃপুরুষদের এই সময়ে
পরলোক থেকে ইহলোকে আগমন ঘটে জল ও পিণ্ডলাভের আশায়। কথিত আছে, এই দিন পিতৃপুরুষরা মনুষ্যলোকের অনেক
কাছাকাছি চলে আসেন। পুরাণ মতে, ব্রহ্মার
নির্দেশেই এই মিলনক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছিল। তর্পণ কথার অর্থ যাতে অন্যের তৃপ্তি হয়
সেই উদ্দেশ্যে জলদান। তর্পণ তাই শুধু পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যেই নয়, সর্বভূতের উদ্দেশেই করতে হয়। জল প্রদান করে
তাঁদের তৃপ্ত করা হয় বলেই মহালয়া একটি পূণ্য তিথি।
মহালয়ার কথা আলোচনা
প্রসঙ্গে বলা যায়, প্রতি
বছরেই দুর্গাপুজোর সময় আপামর বাঙালির মনে প্রশ্ন জাগে, মায়ের এবার কিসে আগমন আর গমনই বা কিসে!
মর্ত্যে দেবীর আগমন তথা যাতায়াতের জন্য রয়েছে বিশেষ কিছু যান। দেখে নেওয়া যাক
কীভাবে দেবী দুর্গার এই আগমন ও বিদায়ের বাহন নির্ধারিত হয়।
শাস্ত্রে লেখা রয়েছে,
“রবৌ
চন্দ্রে গজারূঢ়া ঘোটকে শনি ভৌময়োঃ।
গুরৌ শুক্রে চ দোলায়াং
নৌকায়াং বুধবাসরে।।”
“রবৌ চন্দ্রে গজারূঢ়া”, অর্থাৎ রবিবার অথবা সোমবার যদি কোনো বছরে সপ্তমী পড়ে তাহলে মায়ের আগমন ঘটবে গজে বা হাতিতে। দশমীর দিনও যদি রবিবার বা সোমবার হয় তাহলেও মায়ের বিদায় হবে গজে। শাস্ত্রে বলা হয়, গজে চড়ে মায়ের গমনাগমন অতিশয় শুভ।গজগমনে সাধারণত ধরিত্রী শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে এবং সর্বত্র সুখশান্তি বিরাজ করে।
“ঘোটকে
শনি ভৌময়োঃ” শ্লোকটির অর্থ হলো সপ্তমী ও দশমী যদি শনিবার বা মঙ্গলবার হয় তাহলে
মায়ের আগমন ও বিসর্জন হবে ঘোটকে বা ঘোড়ায়।
রবিবার, সোমবার - গজ (হাতি)
শনিবার, মঙ্গলবার - ঘোটক (ঘোড়া)
বৃহস্পতিবার, শুক্রবার - দোলা
বুধবার - নৌকা
তবে মা দুর্গার মর্ত্যে আগমন যে যানেই হয়ে থাকুক না কেন, আপামর বাঙালিরা বছরভর সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে ঠিক এই সময়টার জন্য। মহালয়ার দিনে সম্প্রসারিত হয় শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের চণ্ডীপাঠ, মহালয়ার দিনে হয় তর্পণ, আর এই মহালয়ার দিনেই কুমোরটুলিতে সম্পন্ন হয় মা দুর্গার চক্ষুদান পর্ব। অবশেষে এসে পড়ে মহোৎসবের সন্ধিক্ষণ। বাঙালির মনপ্রাণ খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। বর্তমান সময়ে এই আশাই রাখি, অতিমারীর ভ্রূকুটিকে পরাজিত করে মা দুর্গার আশীর্বাদে প্রত্যেকের ঘর ভরে উঠুক অপার আনন্দে।
তথ্যঋণঃ
প্রবীর চট্টোপাধ্যায়
কমলেন্দু সূত্রধর
ও অন্যান্য সূত্র
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন