আরেকবার নামল বৃষ্টিটা। বেশ জোরেই বৃষ্টি হচ্ছে। বেরোতে পারলাম না। অফিসের গাড়ি আছে অবশ্য। কিন্তু এখান থেকে গাড়ি পর্যন্ত যেতেই ভিজে যাব। অগত্যা আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বৃষ্টি আরেকটু কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলাম।
আজ একটা ইন্টারভিউ আছে। আমাদের কাগজে ছাপানো হবে। যার সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছি তিনি 'জননী' পুরস্কারে ভূষিত হবেন। আগামীকাল তার পুরস্কার গ্রহণের দিন। তার আগে আজ তার অনুভূতি, আবেগ ঠিকঠাক তুলে ধরার জন্য এই বিশেষ সাক্ষাৎকার।
বৃষ্টিটা একটু কমতেই বেরিয়ে পড়লাম ওনার আশ্রমের দিকে। এখান থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে এক পাহাড় লাগোয়া তাঁর আশ্রম 'নন্দন'। দুপুরের একটু আগেই পৌঁছে গেলাম আমরা।
কী মনোরম জায়গা! চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। অনেকটা এলাকা জুড়ে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে আরও মুগ্ধ হলাম।এত সুন্দর সাজানো বাগান! চারিদিকে হরেক ফুলের সমারোহ। একটি কিশোর এগিয়ে এসে বলল, আপনি কি সাংবাদিক মন্দিরা দত্ত?
বললাম, হ্যাঁ।
ছেলেটি বলল, আমার সাথে আসুন।
ছেলেটির পিছু পিছু হেঁটে যাচ্ছি। শহর থেকে এত দূরে এত নয়ন জুড়ানো জায়গা আছে, এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। পাঁচিলের ভেতরের প্রতিটি গাছ সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো।চারপাশ ঝকঝকে। একপাশে ছোটো ছোটো অনেকগুলো ঘর। সঙ্গের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওগুলো কী?
ছেলেটি বলল, ওগুলো ক্লাসরুম।
একটু কৌতূহলী গলায় বললাম, এসব এত ঝকঝকে রাখে কে?
ছেলেটি একটু হাসল। বলল, আমরাই। দিদিও মাঝে মাঝে আমাদের সাথে হাত লাগায়। অনুমান করলাম, এদের দিদি নিশ্চয়ই প্রিয়দর্শিনী সামন্ত।
বললাম, বাহ্। ভীষণ ভালো লাগছে এখানে এসে।
ছেলেটি হাসল।
একটু দূর থেকে দেখতে পেলাম সাদা শাড়ী পরা একজন মহিলা এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন!কী প্রশান্ত মুখখানি! সাক্ষাৎ মা।
মহিলার একেবারে কাছাকাছি এসে চমকে উঠলাম। প্রিয়া না! প্রিয়া, মানে প্রিয়দর্শিনী রায়।
প্রিয়া আর আমি এক ক্লাসে পড়তাম। ক্লাস ফাইভ থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত একসাথে পড়েছি আমরা। সেই প্রিয়া এখানে কেন!
আমার দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়া। হাসছে। বলল, আয় ভেতরে আয়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, চিনতে পারলি আমাকে?
প্রিয়া মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলল, কেন পারব না রে! তুই তো একই রকম আছিস। বয়সটাই যা বেড়েছে।
এটা অবশ্য অনেকেই বলে। তবে একটু পাল্টেছি নিজেকে।লম্বা চুল কেটে স্টেপ করেছি। চশমা পরতে হয়। সালোয়ার, শাড়ি ওসব তেমন পরা হয়ে ওঠে না। জিন্স প্যান্ট আর টিশার্টেই আমি এখন অভ্যস্ত।তাই অনেকেই চিনতে পারে না আজকাল।
প্রিয়া আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। মাঝারি মাপের একখানা ঘর। একপাশে একটা ছোটো তক্তপোষ। তার মাথার দিকে একটা বড় জানালা। সামনের দেওয়ালে রামকৃষ্ণ ও সারদা মায়ের ছবি টাঙানো। অন্যদিকে ড. এ পি জে আবদুল কালামের ছবি। জানালা দিয়ে ওপাশের ফুলের বাগান দেখা যাচ্ছে। তক্তপোশের পাশেই দুটো কাঠের চেয়ার। একটা চেয়ার আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রিয়া বলল, বস। চা খাবি তো?
আমার চায়ের নেশা আছে। অফিসে থাকলে প্রায় প্রতি ঘন্টায় চা খাই। বললাম, হ্যাঁ, চা খাব।
আলম নামের একটি ছেলেকে ডেকে দু'কাপ চা আনতে বলল প্রিয়া। অন্য চেয়ার নিয়ে আমার পাশে বসে হেসে বলল, বল কী কী জানতে চাইছিস। তুই সাংবাদিক হয়েছিস দেখে খুব ভালো লাগছে।
বললাম, হ্যাঁ, এটাই আমার স্বপ্ন ছিল।
হাসল প্রিয়া। বলল, হ্যাঁ, বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস জব।
বললাম, সেটা ঠিক। তবে রিস্কও আছে। বাই দ্যা ওয়ে, একটা প্রশ্ন করি। এটা অবশ্য ইন্টারভিউয়ের জন্য নয়। তুই তো রায় ছিলি। সামন্ত কি তোর শ্বশুরবাড়ির পদবী?
প্রিয়া সংক্ষেপে বলল, হ্যাঁ।
আমি একটু কৌতূহলী গলায় বললাম, এখানে তাহলে? তোর বর? শ্বশুরবাড়ির লোকজন?
প্রিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বুঝলাম, কোনো একটা কষ্ট চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। একটু পরে ধীর গলায় বলল, সে অনেক কথা। তোর সাথে তো দীর্ঘদিন দেখা হয়নি। মাঝে অনেক কিছুই ঘটে গিয়েছে।
বললাম, হুঁ। বল্।
প্রিয়া বলল, কলেজে পড়তে পড়তেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। মুন্সিগঞ্জের বিখ্যাত সামন্ত বাড়িতে। ওরা সুন্দরী মেয়ে খুঁজছিল। আমাকে ওদের পছন্দ হয়েছিল।ওরা বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতেই আমার মধ্যবিত্ত বাবা এককথায় রাজি। কারণ, ওরা একটি টাকাও পণ নেবে না। দিন কয়েকের মধ্যেই হঠাৎ আমার বিয়ে হয়ে গেল। যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল সব। ফুলশয্যার রাতেই অনুভব করলাম, একটি লম্পটের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই।
বললাম, তারপর?
সামন্তরা ওখানকার নামী লোক। আমার স্বামী দেবাংশু একটি কুলাঙ্গার। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার শাশুড়ি ভীষণ সাপোর্ট করত ছেলেকে।যত দিন যেতে লাগল দেবাংশুর নোংরামি তত বাড়ছিল। আমি কিছু বলতে গেলেই গায়ে হাত তুলত। শাশুড়ি আমারই দোষ দিত। আমি নাকি ওনার ছেলেকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারছি না। তবে আমার শ্বশুর মশাই অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন।
প্রিয়ার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি।
প্রিয়া একটু থেমে ফের বলল, ইতিমধ্যে আমার পেটে সন্তান এল। এতবড় খুশির খবর দেবাংশুকে জানাতে গেলাম। মদ্যপ অবস্থায় ছিল। খবর শুনে আমার পেটে লাথি মেরে বলল এ সন্তান ওর নয়। বাচ্চাটার কিছু হল না ঠিকই, কিন্তু কয়েকমাস পর আমি একটি জড়বুদ্ধি সম্পন্ন ছেলের জন্ম দিলাম।
---তারপর?
তারপর শুরু হল চরম অত্যাচার। মা-ছেলে দুজনের অত্যাচারে আমি বিপর্যস্ত। তবে শ্বশুর মশাই খুব ভালোবাসতেন। কারোকে কিছু না জানিয়ে বেশ কিছু টাকা তিনি গোপনে আমার অ্যাকাউন্টে জমা করে দিলেন। চুপি চুপি একদিন বললেন, প্রিয়া, তুই এখান থেকে চলে যা। এরা তোকে আর তোর ছেলেকে মেরে ফেলবে। তোর শাশুড়ি দেবাংশুর আরও বিয়ে দেওয়ার মতলব করেছে। খবরটা আমিও একটু আধটু শুনেছিলাম। ছেলেটা যখন বছর দুয়েকের, শ্বশুর মশাই চোখ বুজলেন। আমি আর ওখানে থাকতে পারছিলাম না। একদিন রাতে অত্যাচার চরমে উঠল। আমি ছেলেকে নিয়ে ঘর ছাড়লাম। একটা হোমে এসে উঠলাম। একজন সদয় মানুষের সহায়তায় এই জায়গা পেলাম। শ্বশুর মশাইয়ের দেওয়া টাকার কিছু নিয়ে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য আমি একটা ইস্কুল খুললাম। চারজন শিশু ভর্তি হল। ধীরে ধীরে ইস্কুল বড় হতে লাগল। এখন এই ইস্কুলের ছাত্রসংখ্যা তিনশোর কাছাকাছি।
অবাক হচ্ছিলাম প্রিয়ার কথা শুনে। সত্যিই সে এই পুরস্কারের যোগ্য। আরও এটা সেটা গল্প করতে গিয়ে দেখলাম সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। বললাম, আজ আসি প্রিয়া। সন্ধে হয়ে আসছে।
প্রিয়া একটু অবাক হল। বলল, তুই যে উদ্দেশ্যে এসেছিলি সেটাই তো করলি না।
হেসে বললাম, যা লেখার এবার আমি লিখে ফেলব।সব জানা হয়ে গেছে।
যখন বেরিয়ে আসছি সন্ধের প্রার্থনা শুরুর ঘন্টা বাজছে।ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েগুলো লাইনে এসে দাঁড়াচ্ছে।ওরা সবাই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। প্রিয়াকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে আসছে ওরা। জড়িয়ে ধরছে প্রিয়াকে। প্রতিটি শিশুর কপালে চুমু দিয়ে আদর করছে প্রিয়া।
কী স্বর্গীয় দৃশ্য!
কেন জানি না, নিজের অজান্তেই চোখের কোন ভিজে উঠেছে আমার।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন