ঠিক মনে করতে পারছি না! চৈত্র মাস হবে হয়তো। দুপুরে বাইরে কাঠফাটা রৌদ্র। ঘরের দানবীয় গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে পাখাটা চালিয়ে সবে শুয়েছি, এমন সময়…
-ধূপ নেবেন,ধূপ…। ভালো সুগন্ধি ধূপ আনছি…।
ঘরে পাখার শব্দে একটা অস্পষ্ট কথা কানে এলেও প্রথমে ঠিক বুঝতে না পারায় কান খাড়া করে পুনরায় শোনার অপেক্ষায় রইলাম…
-বাড়িতে কেউ আছেন…? ধূপ নেবেন, ধূপ…, ভালো সুগন্ধি ধূপ আনছি…।
বিছানায় শুয়েই বললাম, - না না, আমাদের ধূপ লাগবে না।
তবু মহিলা একটু করুণ সুরে বললে, - দেখুন না বাবু, খুব ভালো সুগন্ধি ধূপ আনছি।কম দামে দিয়ে দেবো…।
পাশের ঘর থেকে গিন্নী বলে ওঠে, - বারবার বলছে যখন, একবার উঠে দেখো না কেমন ধূপ। এমনিতে ঠাকুরঘরে ধূপকাঠি কমে গেছে।
গিন্নীর হুকুম মতো ঘরের বাইরে গিয়ে দেখি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এক মাঝবয়সী মহিলা উঠোনের ধুলোয় বসে। সামনে ধূপের থলি। রোদে যেন পুড়ে গেছে ফর্সা চাঁদ বদনখানি। পোড়াতে পারেনি কপালের লাল রঙের সিঁদুরে ফোঁটাটিকে, তখনো উজ্জ্বল। কপালের ঘাম গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বেয়ে বুকে।
আমি বললাম, -ওখানে বসে কেন! বারান্দায় এসে বসুন।
-না না বাবু ঠিক আছে। দেখুন ভালো ভালো ধূপকাঠি আনছি।
-সে দেখবো, আগে বারান্দায় উঠে বসুন…।
আমার কথায় মহিলা অতি কষ্টে থলিটা নিয়ে বারান্দায় উঠে বসে। বারান্দার পাখাটা চালিয়ে দিয়ে বললাম, -একটু জল খাবেন?
মহিলার নিরুত্তরে বুঝলাম, সে শুধু ক্লান্ত নয়, ক্ষুধার্তও বটে। গিন্নীকে বলতেই এক গ্লাস জল আর ক'টা বিস্কুট এনে দিলো। মহিলা জল বিস্কুট খেয়ে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললে, -এবার ধূপকাঠি দেখুন বাবু। অনেক রকমের ধূপ আনছি…।
-তোমার বাড়ি কোথায়?
-হুগলী গাঁয়, বাঁশতলা মোড়ে।
-আচ্ছা, তোমার বাড়িতে কে কে আছে? আর তুমি কেন এই রোদে ধূপ বিক্রি করতে বেরিয়েছ?
-অনেকে আছে বাবু, অনেকে আছে! মুখপোড়া মিনসে, আমার সতীন, সতীনের দুই ছেলে মেয়ে।
-তা তোমার স্বামী কি করে?
-কি আর করবে! আমাকে ধরে ধরে মারে, আর বেশিরভাগ সময় শরীর ভালো যায় না বলে শুয়ে বসে সময় কাটায়। এতোগুলো পেট চালাতে তো হবে বাবু। তাই ধূপ বিক্রি করতে বেরিয়েছি।
-তোমাকে ধরে ধরে মারে যখন বাবা মায়ের কাছে তো চলে যেতে পারো?
-না না বাবু..এ যে মায়া। মায়ায় পড়ে আছি।ওকে ছেড়ে চলে গেলে এ বড়ো পৃথিবীতে আমার দুঃখ দেবার শেষ মানুষটিও যে আর থাকবে না। ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।যাত্রাদলে খুব ভালো বাঁশি বাজাত। সেই বাঁশির সুরে ও যে আমার মন হরণ করেছিল। মা বাবাকে না জানিয়ে পঁচিশ বছর আগে ওর হাত ধরে যে ঘর ছেড়েছি সে ঘরে আমি যাবো কিকরে বাবু? আমি গেলে ওকে দেখবে কে?আমি যে ওকে বড্ড বেশি ভালোবাসি। তাছাড়া ওর ছেলে মেয়েকে মানুষ করবে কে?
-কেন তোমার সতীন? সেও বা কেমন নারী, সব জেনে বুঝে তোমার সংসারে এলো?
-ওর কোন দোষ নেই বাবু। মিনসে ওপার বাংলায় গিয়েছিল যাত্রাদলে বাঁশি বাজাতে।আমার মতো সেও মজেছিল বাঁশির সুরে।মিনসে বলেনি তার ঘরে বউ আছে। পুরুষ মানুষের জাত তো, পুরনো ফুলে মন ভরে! বিয়ে করে নিয়ে আসে আমার সংসারে। প্রথমে অশান্তি করলেও পরে বুঝলাম ওর তো কেউ নেই, বাপ মা মরা মেয়ে। তাই সবকিছু মেনে নিয়ে রয়ে গেলাম একসঙ্গে। আমার পেটের কোন বাচ্ছা নেই। ওর পেটের বাচ্ছা আমাকে যে মা বলে ডাকে বাবু। এই মা ডাকের টানে ওদের মানুষ করতে এভাবে ধূপ বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়েছি গ্রামে গ্রামে।
গিন্নী পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনে আমাকে ঘরে ডেকে বললে, -দাও না, ওকে কিছু টাকা দিয়ে দাও। বেচারির খুব কষ্টের জীবন!
গিন্নীর কথামত দু'প্যাকেট ধূপকাঠি নিয়ে পাঁচশো টাকার একটি নোট দিয়ে বললাম, -এটা রেখে দিন।
মহিলা হাত জোড় করে বললে, -বাবু, আমি ভালোবাসার দুঃখ বেচতে আসিনি, ধূপ বিক্রি করতে এসেছি। আমার ধূপের দাম কুড়ি টাকা দিন। শুধু আশীর্বাদ করুন, আমি যেন ওকে এমন করে ভালোবেসে মরতে পারি।
আমি মহিলার মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম, এ একটা নারী জাতি বটে! অতি সাধারণ নারীর কাছে তার ভালোবাসার দুঃখ কুবেরের ধনের থেকে দামি, যা আমি পাঁচশো টাকায় কিনতে চেয়েছি!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন