নীরবে - সঞ্জয় মাহাতো

 



 না, আমি এই বিয়ে করতে পারব না” – যেন একরাশ শীতল তুষার ঝড় নেমে এল সুস্মিতার কণ্ঠ বেয়ে

গোটা বাড়ির সব উৎসাহ ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল এক মুহূর্তে। 

আপনারা প্লিজ কিছু মনে করবেন না” – অতিথিদের উপযুক্ত সম্মান জানানোর চেষ্টাটাই করছে সুস্মিতা

-    “আমার কিছু বাধ্যবাধকতা আছে”

মৃদু পায়ে বেরিয়ে গেল, যেন একটা রক্তমাংসের রোবট

বিনয়ের কোনো কমতি ছিল না। তবুও অনাহুত অতিথির দল অপমানিত বোধ করে বিদায় নিল জল অবধি গ্রহণ না করে। অনাহুতই বলতে হল, কারণ ওরা গুণী মেয়ের খবর পেয়ে উপযাচক হয়েই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল

এটা নিয়ে সতেরোটা বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করল মেয়েটা। যদি কাউকে পছন্দ থাকে তবে সেটাও তো বলতে হবে রে বাবা!” – ন’কাকি নীরবতা ভাঙলেন

বউদি, এসব কিন্তু ঠিক হচ্ছে না একদম। সহ্যেরও একটা সীমা থাকে।” – ন’কাকাও আজ আর সুস্মিতার সমর্থক নন

"এইভাবে একের পর এক অতিথিরা অপমানিত হয়ে চলে যাবে বার বার! তোমরা কিছু বলবে না মা?" – পাঁচ বছরের ছোট ভাইটাও এবার অসহিষ্ণু

তোমরা রাগারাগি করো না ছোট, চল মেয়েটার সাথে কথা বলি” – গুণী মেয়ের মনের কথা বুঝতে না পারার যন্ত্রণাটা শুধু মায়ের জন্যই তোলা থাকে। এটাই নিয়ম

সুস্মিতার শোয়ার ঘর। বাড়ির সবাই উপস্থিত। সুস্মিতার এই মুহূর্তে এখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখন। ও জানে সবাই কেন এসেছে ওর ঘরে

কেন রে মা! ছেলে পছন্দ হয়নি বুঝি?” – পাশে বসে আলতোভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কনীনিকা দেবী, সুস্মিতার মা

মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়েই অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল সুস্মিতা। ভয় পেলো হয়তো, মায়ের ঐ অসহায় চাউনির সামনে তো সব সন্তানের মনোবলই ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। কিন্তু না, সুস্মিতা মনোবল ভাঙতে দেবে না, কিছুতেই না

-“কি রে, কাউকে কি ভালোবাসিস?” – ভাই সুলভ প্রশ্নই বটে

কি উত্তর দেবে সুস্মিতা? এ প্রশ্নের উত্তর তো দেওয়া সম্ভব নয়। আবার ‘উত্তর নেই’ এই মিথ্যা কথাও বলতে পারবে না। সুতরাং, সুস্মিতা এখন একটা ‘নিরুত্তর ছবি’। সবার হাজারো অনুনয় গঞ্জনা কিছুতেই কোন জবাব পাওয়া গেল না। সুস্মিতা আজ পাথর

অতঃপর সবাই চুপ। কি চায় মেয়েটা? কেন সব সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিচ্ছে? অথৈ সমুদ্রে এই দু'টো ছোট্ট প্রশ্ন, উত্তর যে কোন গভীরে তা জানে না কেউ

- “আমি বিয়ে করবো না” – চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে এখন সবার কানে বাজছে এই নিষ্ঠুর শব্দতরঙ্গ

- “আমাকে একা থাকতে দাও, তোমরা যাও…”

দম দেওয়া পুতুলের মতো সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে

হোম টাউনে সদ্য কাজে যোগ দেওয়া বি.ডি.ও. আজ নিজের ঘরে বন্দি, একা…। দুই চোখে দু'টো নোনতা হীরের দানা যেন সমুদ্রে পরিণত হচ্ছে। ঠিক মাঝখানে ঘাস ফুলে ঘেরা সুস্মিতার দ্বীপ। সুস্মিতা দেখতে পাচ্ছে……

****** 

সেই হাইস্কুল। ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছিল বাবার হাত ধরে। তারপর শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠীদের মধ্যমণি হয়ে ও এখন নবম শ্রেণীতে। মনে কিছু পরিবর্তন আসছে বুঝতে পারছে সুস্মিতা। মাঠে চু-কিতকিত বা গোল্লা-দৌড় আর খেলতে ইচ্ছে করে না। কেমন যেন আলুথালু ব্যাপার, মন শুধু উড়ে যেতে চায় কোন এক অজানা ঠিকানায়। কৈশোর এসেছে যে…...!!

 

সীমা ম্যাডাম আর ইংরাজী পড়াবেন না। রুটিন বদল হয়েছে। একজন নতুন স্যার এসেছেন আজ, উনিই ক্লাস নাইনের ইংরাজী পড়াবেন এখন থেকে। ‘নতুন স্যার’! সবার মাঝে চাপা উত্তেজনা। নতুন কিছুর জন্য এই উত্তেজনা সবারই থাকে। কিশোর প্রাণে তো আরো বেশি

 

ঢং…!! বাংলা ক্লাস শেষ। এবার আসবেন ইংরাজী স্যার। সুমিত স্যার। হাওয়ায় ভেসে ভেসে নামটা পৌঁছে গিয়েছে ওদের কাছে, স্যার আসার আগেই

গুড মর্নিং স্যার!”- নতুন স্যারের আবাহনের জন্যই তো সবাই তৈরি ছিল আজ

ভেরি ভেরি গুড মর্নিং। হ্যাভ অ্যা প্লেজেন্ট ডে… বসো সবাই” - স্নেহভরা জাদুর পরশে সবাই বসে পড়েছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। না, সবাই না। একজন দাঁড়িয়ে আছে এখনো। সুস্মিতা, দ্য ফার্স্ট গার্ল, তাকিয়েই আছে সুমিত স্যারের দিকে

-“ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম? টেল মি…”

-“নো স্যার, আই আম ফাইন” – তন্দ্রা কাটল সুস্মিতার

-“বস, কি নাম তোমার?” – কানে নয়, একেবারে মনে গেঁথে যাওয়া স্বর

-“আমি সুস্মিতা মাহাতো” - বলেই টুক করে বসে পড়েছে সুস্মিতা। চোখের কোনায় ‘সেই’ রহস্যপূর্ণ হাসিটা ঝিলিক দিয়ে গেলো। কাঙ্ক্ষিত ছিল না মোটেই, কিন্তু এলো তো। কেন এলো? জানে শুধু নিয়তি। হয়তো এর চরম মূল্য নেবে সময়, তার নিজের নিয়মে

এরপর নিজের নিয়মে বয়ে গিয়েছে সময়। মাধ্যমিকে জেলার মধ্যে তৃতীয়, তারপর উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম। স্কুলের মুখ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করেছে সুস্মিতা। যখন যেমন প্রয়োজন বা অপ্রয়োজন, বার বার ছুটে গিয়েছে সুমিত স্যারের কাছে। সুমিত স্যারও যথাসাধ্য উজাড় করে দিয়েছেন প্রিয় ছাত্রীটির জন্য। শুধু ইংরাজী নয়, সব বিষয়ে যথাযোগ্য রেফারেন্স দিয়েছেন সব বিষয়ে, নামীদামী স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে। সুস্মিতার এই সাফল্যে তাঁর অবদান সব থেকে বেশি। এবং উনি গর্বিতও

সুস্মিতা ভর্তি হয়েছে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে, ফিজিক্স অনার্সে। নিয়মিত যোগাযোগ আছে সুমিত স্যারের সাথে। রোজদিনই ফোন করে এটা সেটা বলতে। হোস্টেলে থাকে, নতুন পরিবেশ। মানিয়ে নিতে একটু সময় তো লাগবে। হয়ত তাই রোজ ফোন করে। মাঝে মাঝে সুমিত স্যারের মায়ের সাথেও কথা বলে, কাকিমা বলেই ড়াকে

যাই হোক, স্বাভাবিকভাবেই চলছে পৃথিবী। সমাজ তৈরির কারিগররা মন দিয়েছেন আগামী প্রজন্ম তৈরির কাজে। আরো অনেক সুস্মিতা তৈরির দায়িত্ব যে ওদের হাতে

 

রবিবার সকাল। সুমিত স্যারের পড়ার ঘর। সুস্মিতা এসেছে। খুব জরুরী কথা আছে বলছিল কাল। সুমিত স্যার আকাশ পাতাল কিছুই বোঝেন নি। যাই হোক, স্নেহ করেন খুবনিশ্চয়ই কিছু রেফারেন্স বা ওই জাতীয় সাহায্য চাইবে। উনি তো বরাবর করে এসেছেন

-“স্যার, আজ একটা অন্য মতো কথা বলবো।” – অস্বাভাবিক ভাবে কণ্ঠ কেঁপে গেলো সুস্মিতার

-“কি রে?” – সুমিত বাবু অবাক

-“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। আই লাভ ইউ স্যার।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললো সুস্মিতা। খুব উত্তেজিত। জানে না কি হবে এবার। ধুকপুক ধুকপুক করছে বুক। হৃদপিণ্ডটা বুঝি এবার বাইরেই বেরিয়ে আসবে সুস্মিতার

কি বলে মেয়েটা! মেয়ের মতো করে যাকে তৈরি করেছে সে কিনা বলছে ‘আই লাভ ইউ’! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারবেন কিভাবে সুমিত বাবু!

-“যেদিন প্রথম আপনি আমাদের ক্লাসে গিয়েছিলেন সেদিন থেকেই আমি আপনাকে ভালবাসি স্যার। নিজের সব কথা আপনার কাছে নিয়ে গিয়েছি। সবসময় শুধু আপনাকে নিয়েই থেকেছি। আমার সাফল্য, সব আপনার জন্য। আপনার সব কথা শুনেছি, মেনেছি মুগ্ধ হয়ে।”

একি বলছে মেয়েটা! সুমিত বাবু শুধু অন্ধকার দেখছেন চারিদিকে। তাই তো, এতদিন ভাবেন নি। ভাবার দরকার ছিল বটে। অতজন শিক্ষক থাকতে একটা নতুন জয়েন করা শিক্ষকের কাছে ছুটে আসতো মেয়েটা! হায় রে বিধাতা! বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেননি সুমিত বাবু। নতুন চাকরি, সৃষ্টির আনন্দ... এই পরিষ্কার ছবিটা দেখতেই পাননি তো!

-“প্লিজ স্যার, আমাকে ফেরাবেন না। আমার পৃথিবীর শুরু এবং শেষ আপনার কাছেই।” – করুণ আকুতি সুস্মিতার কণ্ঠে

শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন সুমিত বাবু। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়েছেন উনি। বুঝতে পারছেন, অত্যন্ত যত্ন আর স্নেহ দিয়েই সামলাতে হবে পরিস্থিতি। উনি জানেন, কত জেদি এই মেয়েটা। শুধু ওনার উৎসাহেই একটা গ্রামের স্কুল থেকে জেলাতে স্ট্যান্ড করেছিল মেয়েটা। জেদের জন্যই

-“ঠিক আছে, তোর সব কথা আমি শুনলাম। এবার আমার কিছু বলার আছে তোকে। মন দিয়ে শুনবি বল?”

শান্ত এবং ধীর কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ঘর জুড়ে। সুমিত স্যার নন, যেন দীর্ঘ তপস্যার পর হিমালয় থেকে নেমে এসেছেন বাবা সুমিতানন্দ

বলুন” – প্রাপ্তির অনাবিল জ্যোতি খেলে গেলো সুস্মিতার চোখে মুখে। অনেক কথা বলে গেলেন সুমিত বাবু। স্কুলের প্রথম দিন থেকে সুস্মিতার শেষদিন অবধি। সুস্মিতা সব শুনেছে, মন দিয়েই শুনেছে। যত শুনেছে তত প্রাপ্তির ওই অনাবিল জ্যোতিটা কমে কমে গিয়েছে

-     “এবার তুইই বল। শিক্ষক-ছাত্রী সম্পর্কটা কলঙ্কিত হয়ে যাবে না কি?”

-     “হ্যাঁ স্যার, আর এই কলঙ্কের কালি আমি আপনার গায়ে লাগতে দেব না।”

সুস্মিতা নয়, ঠিক যেন কোন প্রস্তরমূর্তির কণ্ঠ, যান্ত্রিক কণ্ঠ! নিঃশব্দে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সুস্মিতা। আজ সে শূন্য, রিক্ত। আজ সকাল অবধি সব ছিল, দুপুরে সর্বহারা

শোন..” – স্যারের পিছু ড়াক! থমকে দাড়ালো সুস্মিতা, কিন্তু পেছন ফিরে তাকালো না

- “আজকের সমাজে তোর গুরুত্ব ও দ্বায়িত্ব অনেক। নিজ দ্বায়িত্ব থেকে পালাস না কখনও। নতুন করে ভাব, নতুনের জন্য।” - প্রিয় ছাত্রীকে শেষ উপদেশ দিলেন সুমিত স্যার

- “না, পালাবো না। নিজের সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা থেকে পালিয়ে আপনার শিক্ষার অপমান করব না কখনও।”- কঠিন সংকল্প শোনালো সুস্মিতার কণ্ঠে

- “তবে এই জীবনটা আপনাকেই সমর্পণ করেছি সেই পনেরো বছর বয়সে। নতুন কিছু আর ভাবতে পারব না স্যার। দূরেই থাকব, নিজের মতো করে। আপনাকেই ভালোবাসবো সারাজীবন।” - ছুটে বেরিয়ে গেল সুস্মিতা। দুইচোখে নোনতা হীরার দানা সাজিয়ে

***

এটাই সুস্মিতার দুনিয়া। এর বাইরে যে যেতে পারবে না তা নয়, সুস্মিতা যাবে না। নিজের কাছে নিজেই কথা দিয়েছে যে। সুমিত স্যারের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান জানিয়েছে সে, কিন্তু নিজের ভালোবাসার অপমানটাও করবে না কোনোদিন। ও জানে, সুমিত স্যারও ওর ভালোবাসাকে মর্যাদা দিয়েছেন। আর তাই কি বিয়ে করেন নি উনিও!

চোখ মুছে অ্যালবামের শেষ পৃষ্ঠায় মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে তোলা গ্রুপ ফোটোটাতে পিছনের সারির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা স্থির স্নিগ্ধ চোখদু'টির উদ্দেশ্যে দুই ফোঁটা নোনতা হীরের দানা উৎসর্গ করে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল সুস্মিতা। তৈরি হতে হবে। পাঁচটার গৌড় ধরতে হবে। কাল প্রশাসনিক মিটিং আছে কলকাতায়...।

 

   


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন