জীবনের দাবি - সৌমেন দেবনাথ


কসমেটিকসের দোকান আছে আসিফের। সৌন্দর্য বর্ধনের কোন স্নো, পাউডার, ক্রিমের অভাব নেই রুমিলার। ঘর-সংসার সামলাতে গিয়ে সাজগোজ করা হয়ে ওঠে না তার। আসিফের তাই কড়া প্রশ্ন, "লিপস্টিক কি আমি ঠোঁটে দেবো? আমাকে মানাবে?"

একান্ত বাধ্য হয়ে রুমিলা ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে এসে বললো, "কেমন লাগছে?"

আসিফ দেখে রেগে বললো, "সাজতে তোমার ভালো না লাগার কারণ কি? ঠোঁটে লিপস্টিক দিলেই কি ভালো লাগে? আমার দোকানে কত কত মেয়ে আসে, কত সুন্দর সেজে থাকে! না সাজলে তোমাদের ভালো লাগার দৃশ্যত কোন কারণ নেই।"

আসিফ বাজারে চলে গেলো। সেজেগুজে না থাকলে এমন বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হয় রুমিলাকে। স্বামীর থেকে মিষ্টি আচরণ পায় না বললেই চলে। পরপর দু'টো সন্তান হয়েছে। তাদের সামলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ছে যত তারা বড় হচ্ছে। রান্নাবান্না করা, বাচ্চাদের সামলানোর পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চেহারাটা আগের মত সুন্দর নেই। স্বামীর চোখে আগের মত সুন্দর আর সে নেই। স্বামীর বোধবুদ্ধি বাড়ছে না, বরং তার চোখের সৌন্দর্য বাড়ছে। আর তাই নানা কথা বলে রুমিলাকে।

আজ বাড়ি এসেই বললো, "তুমি নাহয় দুই সন্তানের মা। জবেদের বৌ তো তিন সন্তানের মা। জবেদের বৌকে তো দেখতে তোমার মত নির্জীব লাগে না! দিনে দিনে এত নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছো কেন?"

রুমিলা বিরক্তিবোধ করে বললো, "পরের বৌ আজীবনই সুন্দর। পরের মেয়ে আজীবনই যৌবনবতী। পরের বৌ কখনো পুরাতন হয় না। পুরাতন হয়ে যায় নিজের বৌ। প্রৌঢ় হয়ে যায় নিজের বৌ।"

রুমিলা ঘরে চলে গেলো। ছোট বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকলো। আসিফ ভাবলো, এত বেশি বলা তাকে ঠিক হচ্ছে না। মনটা যার ভালো, তার কাছ থেকে আর কিছু চাওয়া ঠিক না।

পরের দিন বাজার থেকে ফেরার পথে ভালো একটা শাড়ি কিনে আনলো আসিফ। রুমিলাকে দিয়ে বললো, "পরলে তোমাকে খুব মানাবে।"

রুমিলা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, "মানাবে না। এক বিষয় দেখতে দেখতে নতুন কিছু দেখার থাকে না। আর এক বিষয় বেশিদিন ভালো লাগে না। চোখের দোষ দিয়ে লাভ নেই, মনের দোষ। মন নতুন কিছু চায়, নবীনে ধাবিত হয় মন, মন বৈচিত্র্যে বেশি উল্লসিত হয়।"

আসিফ বোকা বোকা হাসে, "রাখো আক্ষেপ। কাল তুমি এ শাড়িটা পড়বে। বাচ্চাদের নিয়ে আমরা ঘুরতে যাবো।"

রুমিলা আসিফের এমন বাক্যে স্থির না হয়ে বলে, "মনকে নিয়ত ক্ষত করে শাড়ি, গহনা, কসমেটিকস এনে দিয়ে কি সৌন্দর্য বাড়ানো যায়? লোভী নারী যা চায় তাই আনো তুমি, আমি কি চাই তুমি তা জানোই না। সংসারটা ঠিকমত যদি করতে আমার থেকে সৌন্দর্য চাইতে না, মায়া চাইতে। সংসারটা ঠিকমত যদি বুঝতে দরদ বাড়তো, অনীহা না।"

আসিফকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রুমিলা ঘরে চলে গেলো। মনে অশান্তি থাকলে ঘর সাজাতে ইচ্ছে হয় না, নিজেকে সাজানো তো দূরের কথা। 

পরের দিন ওরা ঘুরতে যাবে। নিজের দু'টো বাচ্চাকে সাজাতে সাজাতে নিজেও একটু সাজলো রুমিলা। সাজলেও আর চোখের নীচের কালো দাগ কাটে না। কপালে টিপ দিলেও সৌন্দর্যটা আগের মত ফোটে না। রঙিন শাড়ি পরলেও লাবন্য আগের মত আসে না। স্বামী যে তাকে অপছন্দ করে তার তো কারণ আছেই। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দৈহিক সৌন্দর্য প্রাধান্য পেতে থাকলে সে সম্পর্কে মনোদ্বন্দ্ব থাকবেই। রুমিলা খুব হীনমন্যতায় ভোগে। আসিফ রুমিলাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললো, "বাহ্, খুব সুন্দর লাগছে।"

গত দু'দিন বকাঝকার কারণে আজ যে তার স্বামী তার রূপের প্রশংসা করলো এটা রুমিলার কাছে স্পষ্ট। মুখ থেকে যে কথা ঝরে তার ভেতর আন্তরিকতার ঘাটতি থাকে, মন থেকে যে কথা ঝরে তাতে থাকে স্নিগ্ধতা। আসিফের কথার ভেতর আন্তরিকতার চেয়ে যান্ত্রিকতা অনেক বেশি। সেসব কথা মনকে তৃপ্তি দেয় না। 

যাহোক, ওরা স্থানীয় একটি পার্কে ঘুরতে গেলো। রঙিন চশমা পরে ঘুরছে আসিফ, দুই সন্তানের বাবা সে যেন না, তরুণ যুবা। আর চঞ্চল দু'টো বাচ্চাকে সামলাতে সামলাতে হয়রান রুমিলা। বাচ্চাদের সাথে এই যুদ্ধটুকুই তার বাঁচার শেষ সম্বল। আশপাশের মানুষ দু'টি চমৎকার বাচ্চাকে যত না দেখছে তার চেয়ে বেশি দেখছে দুই সন্তানের মাকে। আসিফ খুব করে খেয়াল করলো ব্যাপারটা। তাই বললো, "এদিকটা থেকে চলো।"

ওরা খোলা মাঠে গিয়ে বসলো। বাচ্চা দু'টো খেলছে। এদিকেও যে দুই চারজন ছিলো, তারাও কৌণিক চোখে চেয়ে চেয়ে রুমিলাকে দেখছে। আসিফ জিজ্ঞাসা করে, "অন্যরা তোমাকে এভাবে দেখবে কেন? আর সাজবে না, আটপৌরে থাকবে।"

রুমিলা একগাল হেসে বলে, "তোমার কাছে আমার চাহিদা ফুরিয়ে গেলেও অন্যদের কাছে আমার চাহিদা শেষ হয়নি।"

আসিফ বিরক্তবোধ করে, "বাইরে আসাটাই ভুল হয়েছে।"

রুমিলা মৃদু হাসে, "বখাটেরাই অন্য নারীদের দিকে শকুন চোখে তাকায়। তুমি যখন জবেদের বৌয়ের ভেতর সৌন্দর্য দেখো ওটা বখাটেপনার চোখ। সভ্য স্বামী কখনো তার অসুন্দর বৌকেও অন্যের সাথে তুলনা করে না। সভ্য স্বামী মানে সত্যিকার অর্থেই যে স্বামী সে তার স্ত্রীকে পরীর মত দেখে। দু'টো সন্তান যে স্ত্রী তার স্বামীকে দিয়েছে সেই স্বামী তার স্ত্রীকে পরীর চেয়ে আরো সুন্দর কিছু ভাবতে জানে। বখাটেদের সাথে রঙ্গ করা যায়, সংসার করা যায় না।"

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসিফ, "আমাকে অনেক খোঁচা দাও। আমি তোমাকে যাই বলি না কেন, আমি তোমার ভাল চাই। তুমি আমাকে সুযোগ পেলেই বাঁকা কথা বলো। আমি তোমাকে ছায়া দিয়ে রাখি তুমি সেটা জানো না। আমি তোমার এক ধরণের বেষ্টনি তুমি উপলব্ধিও করো না। অভাব কি জিনিস, অনটন কি জিনিস, তোমাকে কখনো জানতে দিইনি। আমার কোন একটি কথা তোমার মনের বিরুদ্ধে গেলেই এক সপ্তাহ ধরে খোঁচাও। আমি রক্তাক্ত হই, কিন্তু আমি সেটাও বুঝতে দিইনা।"

রুমিলা স্বামীর কথাগুলো শুনে থ বনে গেলো। তাই সে আর বাঁকা কথা বলে আজকের ঘোরাটাকে নিরানন্দ করতে চাইলো না। নিষ্পলক চোখে স্বামীর দিকে চেয়ে থাকলো। পাশাপাশি থাকতে থাকতে বোঝাপড়াতে অনেক ভাটা পড়ে। পাশাপাশি থাকতে থাকতে সম্পর্কের স্রোতে শ্যাওলা জমে। ঝড়-ঝঞ্ঝা না এলে নতুন করে চেনার পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়।

পরেরদিন দোকানে গেলো আসিফ। নিয়মিত দোকানে পত্রিকা রাখে। একটা খবরে তার নজর আটকে গেলো। "প্রেমিকের হাত ধরে পালালো দুই সন্তানের মা"। খবরটা গুরুত্ব দিয়ে পড়লো সে। দোকান থেকে বাইরে এসে বাড়িতে ফোন করলো। রুমিলা কি করছে, বাচ্চারা খেলছে না ঘুমাচ্ছে খোঁজ নিলো। বিয়ের পরপর বাড়ি বারবার ফোন করতো। বাচ্চা হওয়ার পর থেকে আর তেমন ফোন করতো না৷ গুরুত্বহীনতায় গুরুত্বহীনতা বাড়ে, গুরুত্ব দিলে গুরুত্ব বাড়ে। আসিফের ফোন পেয়ে খুব খুশি হলো রুমিলা।

দোকানে এসে দেখে তার দু'জন বিক্রয়কর্মী সেই খবরটা পড়ছে আর ঐ বৌটার সমালোচনা করছে, ঐ স্বামীটার সমালোচনা করছে আর প্রেমিক পুরুষটাকে বাহবা দিচ্ছে। একজন বিক্রয়কর্মী বলে, "স্বামীটা হয়ত স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে পারতো না।"


অন্য বিক্রয়কর্মী সায় দেয় তাতে, "যৌবনের খাই না মেটাতে পারলে স্বামীর ক্যারিয়ার, সন্তানের মায়া নারী ভুলে যায়রে।"

"বয়স হয়েছে, অল্পবয়স্কা মেয়ে বিয়ে করা যাবে না। এমন কাণ্ড যে পুরুষটার জীবনে ঘটলো লোকলজ্জার ভয়ে মুখ দেখাবে কিকরে?"

ভীত-সন্ত্রস্ত হয় আসিফ। রুমিলা তাকে পছন্দ করে না। কবে না সে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। দুপুরের খাবার আনতে আর বিক্রয়কর্মীকে পাঠালো না। সে নিজেই বাড়ি এলো খেতে। খেতে বসে রুমিলার রান্নার প্রশংসা করতে থাকলো। বললো, "তোমার রান্না কচু খেলেও গলা ধরে না। করলা খেলেও তেঁতো লাগে না। তোমার রান্নার হাত খুব সুন্দর।"

রুমিলা হাসতে থাকে, "রান্নার হাত সুন্দর হয়ে কি হবে? আমি তো আর সুন্দর না।"

আসিফ খাওয়া বন্ধ করে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, "তুমি সুন্দর না, কিন্তু তুমি আমার।"

এমন বাক্য শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না রুমিলা। তার মুখে হাসি ফুটলো। খাওয়া শেষ করে দু'টো বাচ্চার গালে মুখে চুমু দিয়ে আবার দোকানে চলে গেলো আসিফ। দোকানের অবিবাহিত ঐ দুই বিক্রয়কর্মী একই বিষয় নিয়ে সারাদিন আলাপ করছে। আসিফ দুইজনকেই গরম দিয়ে থামিয়ে বেচাকেনাতে মনোনিবেশ করতে বলে। বাসায় ফেরার পথে নতুন ব্র্যান্ডের নতুন কসমেটিকস নিয়ে বাসায় আসে। তা দেখে রুমিলা বলে, "এভাবে কসমেটিকস এনে দিয়ে প্রমাণ করছো যে আমি অসুন্দরই।"

"ওভাবে ভেবো না।" বলে আসিফ। "আমাদের দোকানের নতুন কসমেটিকস আগে তুমিই ব্যবহার করবে। নতুন কসমেটিকস দোকানে এলেই তোমার কথা মনে পড়ে। এসব আমি অনেক ভালোবেসেই আনি।"

রুমিলা স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে হাত বাড়িয়ে কসমেটিকস নিলো। বললো, "ইদানিং তোমার ভেতর অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আমাকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছো, আমি কিন্তু অত গুরুত্বপূর্ণ না। আমি কিন্তু মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা ইনকাম করি না।"

আসিফ ইতস্তত করে বললো, "তুমি সংসারে এভাবে ঝগড়াটাকে জিইয়ে রেখো না। এতে কেউ শান্তি পাবো না।"

পরেরদিন পত্রিকা পড়তে গিয়ে আর একটা খবরে আসিফের নজর বাঁধে। "স্ত্রী সন্তান থাকতেও নতুন বৌ নিয়ে ঘরে এলো স্বামী"। 

খবরটা যাতে দৃশ্যমান হয় এমনভাবে পত্রিকা ভাঁজ করে বাড়িতে ফিরে বিছানার উপর ফেলে রাখে। রুমিলা পত্রিকা পড়ে এবং উক্ত খবরে নিবিষ্ট হয়। আসিফ তাকে পছন্দ করে না, কথায় কিংবা আচরণে বুঝিয়েছে। নতুন বিয়ে যে করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? মুখে হাত দিয়ে দাঁতে নখ কাটতে থাকলো। পুরুষকে বিশ্বাস করা যায় না। এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকে না কখনোই তারা। সত্যই যদি এসব খবর পড়ে তার স্বামী এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে তবে তার কি হবে, তার সন্তানদের কি হবে? তার সামাজিক সম্মানহানি কতটুকু হবে? মনে মনে শপথ নিলো সে স্বামীকে আর উল্টোপাল্টা কথা বলে রাগিয়ে দেবে না। স্বামীর প্রতিটি যৌক্তিক কথায় কথা মেলাবে।


বাড়ি থাকলেই বিয়ের পরপর আসিফ যেমন রুমিলার হাত হুটহাট ধরতো, হাত ধরে টান দিয়ে কাছে নিতো, চুল ধরতো, কান ধরতো, নাক ধরতো, দুই হাতকে বেড়ি করে জড়িয়ে ধরতো এখন ঠিক তেমনটি করে। রুমিলা হেসে নিয়ে বলে, "স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের মূলে সমাজ ভাবে দু'জনের মধ্যে কারো না কারো যৌবনে ভাটা পড়ার বিষয়টি। হাজার কারণের মধ্যে এটি একটি কারণ, নাকি এটিই মূল কারণ?"

আসিফ রুমিলাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। বলে, "দুই সন্তানের মা যদি বৃদ্ধা হয়ে যায়, দুই সন্তানের বাবা কি যুবক হয়ে যায়?"

কথাটা খুব ভালো লাগে রুমিলার। স্মিত হাসে, "এবার তবে ছাড়ো। রান্না করতে হবে।"

আসিফ নাছোড়বান্দা। বলে, "তুমি ছিলে আমার যৌবনের দাবি, এখন তুমি আমার জীবনের দাবি।"

নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো রুমিলা। মনটা আজ খুব ভালো। গুনগুন করে গান গাইছে আর রান্না করছে। আর পিছন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা শুনছে আর দেখছে আসিফ। সম্পর্কের মধ্যে কি সুন্দর জোয়ার এসে গেলো। ছোটখাটো ভুল-ত্রুটি, ইচ্ছা, চাওয়া, শখ বিসর্জন দিলেই স্বর্গীয় সুখ নেমে আসে নিজেদের মধ্যে। হৃদয়ের বিশালতা সম্পর্কের মাঝে বিরাজিত থাকলেই শত অসুন্দরও সৌন্দর্যের সংজ্ঞাকে ছাড়িয়ে যায়।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন