সকাল সাতটা। প্রাণেশ তার একমাত্র মেয়ে বিপাশাকে নিয়ে স্কুলে যায়। প্রচন্ড গরম পড়ায় স্কুলের সময় পরিবর্তন করে সকাল সাড়ে সাতটা করা হয়েছে। প্রাণেশ বিপাশার পিতা ও মাতার কাজ একাই করে থাকে। বিপাশার যখন দু'বছর বয়স তখন তার মা শিপ্রা রথীজিৎ নামের একজন হকারের সঙ্গে পালিয়ে যায়। সেই থেকেই বিপাশার সব দায়িত্ব প্রাণেশের উপর। মেয়ের কথা চিন্তা করে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের এলাকায় একটা মুদিখানার দোকান দেয় সে।
বিয়ের আগে এবং পরে শিপ্রাকে দেখে কখনো বোঝা যায়নি যে ও এমনটা করবে। চলে যাওয়ার পর প্রাণেশ জানতে পারে বিয়ের আগে থেকেই শিপ্রার রথীজিতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। লজ্জায় মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারেনি প্রাণেশ। পাড়ার অনেকে বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছিল, "কেমন মেয়েমানুষ শ্রিপ্রা! এইটুকু দুধের শিশু রেখে কেউ এমন নক্করজনক কাজ করে! ও মা, না ডাইনি!" অবনত মুখে সব কথাই তাকে হজম করতে হয়েছে। বর্তমান সময়ে সৎ মা সতীনের সন্তানের দায়িত্ব নিতে চায় না। সেই চিন্তা করেই প্রাণেশ আর বিয়ে করেনি। নিজের বলতে মেয়ে ছাড়া একজন বোন আছে তার। বছরখানেক আগে তারও বিয়ে দিয়ে দেয় সে। বাবা-মা না থাকায় দাদা বাবার কাজ করেছিল। বোন সবিতা প্রাণেশকে বিয়ে করার কথা অনেকবার বলেছে, কিন্তু সে রাজি হয়নি।
পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। বিপাশা সাত বছর বয়সে নিজের কাজ ও সংসারের অনেক কাজ করে। স্কুলে অন্যান্য বাচ্চাদের মা-দের দেখে চোখে জল আসে তার। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে, "বাবা আমার মা নেই?" প্রাণেশ সান্ত্বনা দিয়ে বলে, " আমিই তোমার মা, আমিই তোমার বাবা।" বাবার কথা শুনে মুখটা অন্ধকার হয়ে যায় বিপাশার। প্রাণেশ তাকে আরো ভালোবাসে। সে যা চায়, তাই এনে দেয় ওকে। যাতে মায়ের অভাব বিপাশা কখনো অনুভব করতে না পারে। কিন্তু মায়ের অভাব কোনো কিছুতেই যে পূরণ করা যায় না তা প্রাণেশ জানে।
একদিন বাজার করতে গিয়ে প্রাণেশের শিপ্রার সঙ্গে দেখা হয়। প্রাণেশ তাকে এড়িয়ে চলে যায়। শিপ্রা লজ্জায় মাথা নত করে থাকে। দু'দিন বাদে আবার একদিন প্রাণেশ শিপ্রাকে বিপাশার স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সেদিনও সে শিপ্রার সঙ্গে কোনো কথা বলে না। মনে মনে প্রাণেশ ভাবে, "শিপ্রা এখানে কি করছে? বিপাশাকে নিয়ে যাওয়ার কোনো মতলব নেই তো !" গেটম্যানকে সে বলে যায়, "আমি ছাড়া বিপাশাকে যেন কারো কাছে ছাড়া না হয়।" প্রধান শিক্ষিকাকেও একথা জানিয়ে যায়।
আসলে শিপ্রা তার মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য স্কুলের গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। তার নিজের মেয়ের উপর এখন আর তার কোনো অধিকার নেই, সেটা সে জানে। আর এজন্য সে নিজেই দায়ী। বিগত পাঁচ বছরে শিপ্রার জীবনে অনেক ঘটনা ঘটেছে যা হয়তো কারোকে বলা যাবে না। একটু ভুল পথ নির্বাচন সারা জীবনটাকে নষ্ট করে দেয়। আবেগের বশবর্তী হয়ে দু'বছরের বিপাশাকে রেখে প্রানেশকে ধোঁকা দিয়ে সে রথীজিতের সঙ্গে চলে গিয়েও সুখ পায়নি। পেয়েছে খারাপ মেয়ের তকমা। মাসখানেক কলকাতার একটি ভাড়া ঘরে প্রতিদিন রাত্রে রথীজিৎ তাকে কাকের মতো ঠুকরে ঠুকরে খেয়েছে, তারপর বেঁচে দিয়েছে কলকাতার নিষিদ্ধপল্লীতে। সুস্থ জীবন ছেড়ে নোংরা সমাজে প্রতিদিন তাকে দু'টো-তিনটে বাবুর যৌন চাহিদা মেটাতে হয়েছে। এখন শিপ্রা তার শরীরকে অপবিত্র মনে করে। প্রতিটি মুহূর্তে গুমরে গুমরে কেঁদেছে সে আর ভেবেছে যে কেন সে তার সোনার সংসার ত্যাগ করে এই নরকের পথে পা বাড়ালো!
একদিন রাতে এক বাবুর যৌনসুখ মেটানোর পরে শিপ্রা ইচ্ছা করে তাকে একগ্লাস জল খেতে দিয়েছিল। সেই জলে মিশিয়ে দিয়েছিল ঘুমের ওষুধ। সে ঘুমিয়ে পড়লে শিপ্রা সবার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে এসেছিল। যদিও সুন্দরী নামে একজন বারবনিতা তাকে পালাতে সহযোগিতা করেছিল। শিপ্রার কাছে তার ফেলে যাওয়া সংসারের গল্প শুনে সুন্দরীর খুব কষ্ট হয়েছিল, সহানুভূতি জেগেছিল শিপ্রার প্রতি। সেখান থেকে পালিয়ে নিজের গ্ৰামে ফিরে আসার চিন্তা করলেও পরক্ষণেই শিপ্রা ভাবে "গ্ৰামে মুখ দেখাব কেমন করে!" তাই পরদিন ভোরে গঙ্গার জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু চিত্রগুপ্তের খাতায় তার নাম ছিল না। একজন পুরুষ তাকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে বাঁচায়। শিপ্রার কাছে আত্মহত্যার কারণ জেনে বলেছিলেন, "আত্মহত্যাতেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। বেঁচে থেকে লড়াই করতে হবে। মানুষেরই ভুল হয়। গ্ৰামে ফিরে যাও। তোমার কিছু হলে সন্তানটার কী হবে, ভেবেছ একবার? স্বামীর কাছে ক্ষমা চাও। দেখবে তোমার স্বামী তোমাকে যদি সত্যি ভালোবাসে, তবে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা করে দেবে।" সেই আগন্তুক ব্যক্তির কথা শুনে মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল শিপ্রার। তাই গ্ৰামে ফিরে এসেছিল সে। কিন্তু লজ্জায় ও অনুতাপে বাড়িতে যেতে পারেনি। তাই কখনো বাজারে, কখনো স্কুলের গেটের সামনে ঘুরে ফিরে বেরিয়েছে, মেয়ে ও প্রাণেশকে একবার চোখের দেখা দেখবে বলে। ভেবেছে সুযোগ বুঝে প্রাণেশের পা দু'টো জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবে, যদি সে তাকে ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু প্রাণেশ তাকে দেখে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। নিজের বাবা-মায়ের কাছেও শিপ্রা লজ্জায় যেতে পারেনি। কী বলবে গিয়ে এতোদিন পর! প্রতিটা মুহূর্তে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় সে। বিপাশা অনেক ছোট থাকতে মাকে দেখায় তার মুখও বিপাশার মনে নেই। তাই স্কুলে শিপ্রাকে দেখেও বিপাশা চিনতে পারেনি।
দু'দিন পর একটা চিঠি লিখে প্রাণেশের বাড়িতে লেটার বক্সে ফেলে যায় শিপ্রা। প্রানেশ চিঠিটি পাওয়ার পর খুলে পড়তে লাগে। চিঠিতে লেখা ছিল – "প্রিয় প্রাণেশ, জানি তোমার সামনে আমার দাঁড়ানোর সাহস নেই। আমি তোমার সঙ্গে যা করেছি, তার কোনো ক্ষমা হয় না। আমি এখন নষ্টা মেয়ে। অপবিত্র হয়ে গেছি। ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলাম। আমি খুবই অনুতপ্ত। আমার সঙ্গে রথীজিৎ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। শুধুমাত্র তোমাদের কথা চিন্তা করে আমি এখনো বেঁচে আছি। মরার চেষ্টা একবার করেছিলাম, কিন্তু মরণ আমায় নিল না। দূর থেকে তোমাদের দেখলে আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। জানি আমাকে আজ তুমি ঘৃণা করো। আমার বিপাশাও আমাকে চেনে না। আমার কাহিনী জানলে বিপাশাও হয়তো একদিন আমায় ঘৃণা করবে। তোমরা ভালো থেকো। মেয়েকে তোমার মতো করে মানুষ করো। আজ বিকেলের ট্রেনে আমি আমাদের গ্ৰাম ত্যাগ করে চলে যাচ্ছি । আর এই অপয়া মুখ তোমাদের দেখতে হবে না। আবারও তোমার ও মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইছি। পারলে ক্ষমা করে দিও। ইতি – ঘৃণার শিপ্রা।"
চিঠিটি পড়ে প্রাণেশের দু'চোখে বারিধারা ছলছল করে ওঠে। শিপ্রার প্রতি প্রচন্ড রাগ থাকলেও নিমেষে তা জল হয়ে যায়। মেয়ের কথা চিন্তা করে মনে মনে শিপ্রাকে ক্ষমা করে দেয়। প্রাণেশ বুঝতে পারে, একটা ভুলের জন্য মানুষের জীবন কতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। তার মন বলে, মানুষেরই ভুল হয়। যে ভুল করে সে যদি তার ভুল বুঝতে পারে এবং ভুলের জন্য বারবার ক্ষমা চায়, তবে তাকে ক্ষমা করে দিতে হয়। এই ক্ষণিকের জীবনে আমাদের প্রতিনিয়ত কত ভুলই হয়, সেগুলো নিয়ে পড়ে থাকলে ভবিষ্যত জীবন দুঃখের হয়ে ওঠে। সুতরাং সব ভুলে এগিয়ে চলাই জীবন।
বিকেলবেলা মেয়ে বিপাশাকে নিয়ে প্রাণেশ স্টেশনে যায়। দূর থেকে দেখে, এক নম্বর প্লাটফর্মের শেডের নীচে শিপ্রা বসে বসে চোখের জল ফেলছে আর কাপড় দিয়ে চোখ মুছছে। প্রাণেশ বিপাশাকে বলে, "ওইযে মহিলাটি বসে আছেন, উনি তোমার মা। যাও মায়ের সাথে দেখা করো।" বাবার কথা শুনে বিপাশা দৌড়ে শিপ্রার কাছে চলে যায়। শিপ্রা হঠাৎ তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। বাঁ পাশে তাকিয়ে দেখে, একটু দূরে প্রাণেশ আকাশের দিকে চেয়ে দুখী মনে দাঁড়িয়ে আছে। বিপাশা শিপ্রাকে জিজ্ঞাসা করে, "তুমি আমার মা?" এই কথাটি শুনে শিপ্রা বিপাশাকে কোলে তুলে চুম্বন করে আর কান্নার সহিত বলে, "হ্যাঁ, আমি তোর মা। তোদের অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমায় ক্ষমা কর মা।" বিপাশাও মাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে প্রাণেশের চোখেও বারিধারা নেমে আসে।
এরপর মেয়েকে নিয়ে প্রাণেশের কাছে আসে শিপ্রা। বিপাশাকে দাঁড় করিয়ে প্রানেশের পা দু'টো জড়িয়ে ধরে কেঁদে যায়। প্রাণেশও নিজেকে সামলাতে না পেরে শিপ্রার হাত দু'টো ধরে তুলে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। প্রানেশ বলে, "এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে আছে! আমার ও বিপাশার কথা একবার চিন্তা করলে না! তুমি চলে গেলে বিপাশা চিরকালই মা-হারা হয়ে থাকত। আমি ওর মায়ের অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মায়ের অভাব শত চেষ্টা করেও একজন বাবা পূরণ করতে পারে না। তোমার অতীত নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তুমি বাড়ি চলো।" পেছন থেকে বিপাশা এসে বাবা ও মাকে জড়িয়ে ধরে। শিপ্রা অনুভব করে, প্রাণেশ কত বড় মনের মানুষ। ভালো মানুষ না হলে, ও এভাবে মেনে নিত না। শিপ্রা ভগবানের উদ্দ্যেশ্যে মনে মনে বলে, "হে প্রভু, তোমার কৃপায় আজ আমি আমার ফেলে যাওয়া পরিবার আবার ফিরে পেলাম। আমার এই পাপের জন্য তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে তুমি ক্ষমা কোরো।" এরপর প্রাণেশ, শিপ্রা ও বিপাশা পিছনের দিনগুলোর কথা ভুলে নবউদ্যমে এগিয়ে চলার জন্য স্টেশন থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন