নতুন বসন্ত - রঞ্জিত মল্লিক( কবিরুল)

 

   " বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে

           ......  ....

     মাথা নত করে রব "

 

আর কত কাল বাসুদকে মাথা নত করে থাকতে হবে ও নিজেই জানেনা। সারাজীবন বাসুদ মাথা নতই করে গেল। পরিবারের সুখের জন্য, নিজের ভাই বোন দিদিদের কথা ভেবে বাসুদ একটা বিরাট মাপের ঝুঁকি নিয়েছিল। যেটা ওর জীবনকে তোলপাড় করে দিয়েছিল। মুছে দিয়েছিল মনের অলিন্দে উপচে পড়া বসন্তের সব রং।বসন্তের ফুল ফুটেও সব ঝরে গিয়েছিল। পাঞ্জাবীতে লেগে থাকা বসন্তোৎসবের রং ফিকে হতে শুরু করেছিল।

 

আজ অনেকদিন পর ভিতরের অতৃপ্ত আত্মাটা রং খেলার জন্য পাগলামি শুরু করেছে আবার। হৃদয়ের অলিন্দ তোলপাড় করতে শুরু করেছে সে। রঙয়ের উৎসবের হারিয়ে যাওয়া মাতাল করা সুরটা বাসুদের লুঙ্গি আর পাঞ্জাবীর গা বেয়ে কেঁপে কেঁপে উঠে আল্পনা দিয়ে যাচ্ছে।

 

যে কদিন জেলে ছিল সেখানে দু-একবার বন্দীদের নিয়ে বসন্তোৎসবের আয়োজন করা হলেও, মন ভরেনি বাসুদের। কোথাও যেন একটা তাল কেটে গিয়েছে এমন ভাব!

 

একটা রং খেলার অতৃপ্ত বাসনা মনকে বড্ড পীড়া দিয়েছিল সেবার বাসুদকে। সেবার দুচোখ বেয়ে নেমে এসেছিল নোনা পানির রংয়ের ধারা। ও ভাবতেই পারেনি ওর এই সংশোধনাগারে সেবার দেবারতি বন্দীদের নিয়ে বসন্তোৎসবে আসবে।তবে দেবারতি বাসুদকে দেখে ঘাবড়ে যায়। ও বাসুদের একটা অশুভ খবর শুনেছিল।

বাসুদকে এইভাবে এখানে দেখবে ভাবতে পারেনি। দেবারতির ছোঁয়ায় সেবার বসন্ত উৎসব সংশোধনাগারে একটা আলাদা অন্য মাত্রা পেলেও বাসুদের মনের অলিন্দ সাদা আর কালোই থেকেই যায়। কোন রং লাগেনি। দেবারতিও অভিমান করে বাসুদের সাথে কোন কথা বলেনি।

 

আজ আবার বসন্ত উৎসব দুয়ারে কড়া নাড়ছে। আকাশে  বাতাসে রঙের মাতলামি। বাসুদের চনমনে রক্তে হিমোগ্লোবিনের বোহেমিয়ান শিহরণ।বেশ কিছুদিন হল বাসুদ জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। পুরানো দিনগুলো বাসুদ ভুলে যেতে যায়। হোলির রঙে নিজেকে রাঙিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চা। ফিরে আসতে চা দেবারতির প্রেমঘন কোলে। ও জানে একটা ভুল বোঝাবুঝির অবসান করতে হবে। হোলির রঙে ধুয়ে দিতে হবে সব কিছু। তবে সময় হয়ত কিছুটা লাগবে। আজ অনেক দিন পরে বাসুদ হোলি উৎসবের স্বাদ পেতে চলেছে। তাই এবারের দোলটা ও দেবারতির সাথে কাটাতে চা

 

নিজের দোষ , আর করা ভুলগুলোর জন্য পারলে দেবারতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় ব্যয় করে ফেলল বাসুদ। কালিয়াচক এসে গেছে।এখনও অনেকটা পথ।

 

 কপালের ঘামটা নিজের পাঞ্জাবীতে মুছেই বাসের জানালাতে বাসুদ আবার নিজের গাটা এলিয়ে দিল। আজ শুধু ঘাম নয় চোখ দিয়ে সমানে জলও পড়ছে। মাঝে অনেক কটা বছর ডানা মেলেছে ।

 

 পুরানো দিনগুলো ভালই ছিল। একটা সুন্দর ছন্দ ছিল , আনন্দ ছিল জীবনের মধ্যে।বাসুদ তখন অটো চালাত। একদিন বৃষ্টির দিন প্যাসেঞ্জারের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে রাস্তায়। অনেকক্ষণ পরে একজন খুবই সুন্দরী মহিলা তার অটোতে উঠল। চোখে কালো চশমা। চোখের ছানি কাটানোর পরে যেরকম চশমা পরে, সেই রকম। মেয়েটা নেমে যেতেই বাসুদ লক্ষ্য করল ব্যাগটা ফেলে গেছে। অনেক খোজাখৢঁজির পর যখন ব্যাগটা দিতে যাবে তখন বৃষ্টি থেমে সোনাঝরা রোদ্দুর উঁকি মারছে। সেই শুরু...

 

বাসুদের মনেও বসন্ত ডালপালা ছড়াতে শুরু করল। নিজের অজান্তেই প্রেমের কোকিল ডেকে উঠেছিল সেদিন মনে। তারপর মাঝে মাঝেই দেখা। দু চারটে কথা। তারপর থেকেই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক আরো নিবিড় হয়েছে। আপনি থেকে তুমিতে এসেছে। 

 

দেবারতির চোখের অনেক সমস্যা ভাল দেখতে পানা। ডাক্তার বলেছে একদিন ও অন্ধ হয়ে যেতে পারে।ব্লাইন্ড স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ও সেবার দোলের সময় শান্তিনিকেতন গিয়েছিল । একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বাসুদও সাথে গিয়েছিল। শান্তিনিকেতনের কোপাইনদীর তীরে পলাশের আর শিমুলের লাজুক আদরে হারিয়ে গিয়েছিল সেদিন দুজনের সবুজ মন। দেবারতির নেল পালিশ পরিশোভিত  ম্যানিকিউরড্ ফিঙ্গার  বাসুদের ঘামে ভেজা পরিশ্রমী হাতের স্পর্শে আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। দেবারতি বাসুদের বুকের উপর ঢলে পড়ে, সেদিন ওর গায়ের গন্ধ, শরীরের উত্তাপ নিয়েছিল। গোধূলির আলোয় দেবারতিকে সেদিন অসাধারণ লাগছিল।

 

গোধূলি শেষ তুলির টান দিয়ে চলে যেতেই আকাশে চাঁদ উঠল। চাঁদের রূপালী অহংকার ঝরে ঝরে পড়েছিল বাসুদের সাদা পাঞ্জাবীর গা বেয়ে। তার কিছুটা ওর নিকোনো উঠোনের গাল বেয়ে নামতে শুরু করেছিল।সেদিন দেবারতি বাসুদকে একগোছা পলাশ ফুল উপহার দিয়েছিল। সেই ফুল বাসুদ আজও পরম যত্নে রেখে দিয়েছে। বাসুদ দেবারতির রঙীন ঠোঁটের আঁকাবাঁকা জ্যামিতিতে এনেছিল নিজের ভালবাসার ছোঁয়া।  

 

সেইবার দেবারতি বাসুদকে আবীর মাখিয়ে দিয়েছিল। রাঙিয়ে দিয়েছিল ওর জীবন দোলের রঙে। বাসুদ পেয়েছিল একটা ফ্রেশ অক্সিজেন। সেদিন দুটি সম্প্রদায়ের দুই হৃদয় এক হয়ে গিয়েছিল। ফাগুন রঙে রেঙেছিল দুই সবুজ মন। সেইবার দুজনে খুব দোল খেলেছিল। খুব মজা করে।সেই শেষ।

 

তারপর বাসুদের আর রঙের উৎসব করা হয়নি। একটা বাজে কাজে জড়িয়ে গেল।

 

বোনের কিডনির সমস্যা ও বড়দির বিয়ের জন্য প্রচুর টাকার দরকার হয়ে পড়ল। টাকাটা ভীষণ প্রয়োন। তাই ওকে অবৈধ পথ বাছতে হল। এক দালালের পাল্লায় পড়ে বাংলাদেশ সীমান্তে গরু পাচার করতে শুরু করল।দেবারতি জানল অনেক পরে। ততদিনে বাসুদ অনেক দেরী করে ফেলেছে। ও খুব কষ্ট পেয়েছিল। সেই থেকে দুজনের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। মনের ভিতর বাসা বাঁধা পলাশ ফুল হারালো তার সকল রং।

 

দেবারতি একসময় ইসলামপুরে চাকরি করত। বাসুদ মুসলমানের ছেলে। ওর সাথে মেলামেশা, বন্ধুত্ব করার ফলে দেবারতিকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। অনেক রকম অপমান হজম করে কাজ করতে হয়েছে। তবু ওদের সম্পর্কে কোন ভাঁটা পড়েনি। সময়ের তালে এগিয়ে চলেছিল ওদের দুজনের সমীকরণ।

 

বাসুদ গরু পাচার করার ফলে দুজনের সম্পর্কের রসায়ন জটিল আকার ধারণ করে। দেবারতিকে আরো বাক্যবাণের সন্মুখীন হতে হয়। বাসুদের জেল হয়।দেবারতি তারপর আর  ইসলামপুরে থাকেনা। যতদূর জানে বদলি হয়ে গেছে।একটা অবৈধ কাজে লিপ্ত হবার জন্য বাসুদকে এখন আর কেউ পন্দ করেনা।

 

বাসুদ যখন ইসলামপুরের মাটিতে পা রাখল তখন বেলা প্রায় শেষ। দেবারতির পুরোনো ঠিকানায় বাসুদ খুব ভয়ে ভয়ে ঢুকল। দেখা পেলনা। নতুন ঠিকানাটা পেল মাত্র। ওর শরীর খুব অসুস্থ। চোখের কর্নিয়ার প্রবলেম শুরু হয়েছে। চোখের শিরাও শুকোতে শুরু করেছে। ও  এখন কলকাতায় আছে। চিকিৎসা চলছে ওর। কলকাতার ঠিকানাটা খুঁজে পেতে বাসুদকে একটু কষ্ট করতে হল বৈকি!

 

কলকাতায় অনেক কষ্টে ওর ঠিকানায় দেখা করতে গেলে ওর অভিমানী মুখ বাসুদকে ভীষণ কষ্ট দেয়। মুখ ফিরিয়ে নেয় দেবারতি। বাসুদ বুঝতে পারে অনেক দেরী হয়ে গেছে.। বাসুদের চোখের জল টসটস করে নামছে সাদা কালো দাড়ির আঙিনা বেয়ে।

 

 আজ বসন্তোৎসব। বাইরে ঝিরঝিরে বাসন্তী বাতাসের বন্দিশ। চারিদিকে মাতাল করা বসন্তের গান ভেসে আসছে - 

 

           " ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল

                       ...   .....   .....

                    .... ......   ..  ...

 

                 রাঙা হাসি রাশি রাশি

                         ....   .....   .....  "

 

দ্বার অনেকদিন ধরেই বন্ধ ছিল। তাতে অনেক ধুলো জমে ছিল। বাসুদের মনের কোণে জমা ধুলো তার চেয়েও পুরু। বাসুদ শেষ চেষ্টা করেছিল বন্ধ দ্বারটা খোলার। পারেনি। চেয়েছিল অনুতাপের চোখের জলে দোলের র মিশিয়ে বন্ধ দ্বারের চৌকাঠ ধুয়ে দিতে। অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। দ্বার ধুয়েছিল অন্য লাল  রঙে

 

দোলের দিন এক মুঠো আবীর নিয়ে বাসুদ একটু বেলায়  দেবারতির কলকাতার বাসায় আসে ওর মনে রঙের ছোঁয়া  দেবার জন্য। দেবারতির শান্তিনিকেতনে কিনে দেওয়া সেই পাঞ্জাবীটা পরেই ও এসেছে। চোখে মুখে খুশীর জ্যামিতি। ওর বিশ্বাস দেবারতি সাদরে ওর ভালবাসার আবীর প্রাণ ভরে গ্রহণ করবে। 

 

  ভুল প্রমানিত হল শেষে।

 

 দেবারতির অহংকারী আর অভিমানী মন বাসুদের জন্য সব দরজা বন্ধ করে দেয়। শতবার ডেকেও সেই মজবুত অভিমানের দুর্গ ভাঙতে পারেনি বাসুদ। ফিরে চলে যায় বাসুদ। তবে বেশীদূর  যেতে পারেনি।

 

 অভিমান ভাল তবে বেশী নয়। সেটা দেবারতি পরে যখন বুঝল তখন সব শেষ।

 

 ভগবান অতটা নিষ্ঠুর হননি, যতটা রতি হতে পেরেছিল ।  উনি বাসুদের রং খেলার হ্যাংলামোর সাধ মিটিয়েছিলেন। তবে অন্যভাবে। বাসুদ রং খেলেছিল তবে একা।মৃত্যুর সাথে।

 

দেবারতির বাড়ি থেকে ফেকাশে মুখ নিয়ে বাসুদ বড় রাস্তায় নামতেই কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। পিছন দিক থেকে আসা একটা ভারী গাড়ি বাসুদকে থেঁতলে দেয়। ওর নামাজী টুপি আর সাদা পাঞ্জাবী রক্ত আর লাল আবীরের পিপাসা মেটায়।

 

বাসুদের বুকের ভিতর জমে থাকা হাহাকার, কান্না, ভীষণ ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠা আর্তনাদ বসন্তোৎসবের জোরালো প্রাণঢালা গানের আওয়াজে চাপা পড়ে যায়।

 

বাসুদের রক্তের হোলি খেলা দেহটা যখন অ্যাম্বুলেন্সে চেপে হাসপাতালের  উদ্দেশ্যে রওনা  দেয়, ততক্ষণে দেবারতির অভিমানের মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। তবে সেদিনও বৃষ্টি নেমেছিল যেদিন ও বাসুদকে প্রথম দেখে। 

 

বাসুদের দুঃখ বিদীর্ণ প্রাণটা দুদিনের জন্য আটকে ছিল। আর তা দেবারতির জন্যে। দেবারতির রঙের ছোঁয়ার স্বাদ অবশ্য মিটল অ্যাক্সিডেন্টের দুদিন পরে। মৃত্যু পথযাত্রী বাসুদ কাঁপা হাতে ভেজা চোখে  দেবারতির সাদা কালো চুলের ক্যানভাস ভরিয়ে তুলল সিঁদুরের লাজুক আদরে।

 

হাসপাতাল সাক্ষী থাকল এক, নীরব , চাপা, ভিন্ন স্বাদের বসন্তোৎসবের।

 

বাসুদ আখতার রসুল জীবনে অবৈধ কাজ করলেও একটা পুণ্য কাজ করেছিল। মরার আগে তার ভালবাসার দেবারতিকে চোখ দুটো দান করে গিয়েছিল।বাসুদের চোখ দেবারতির প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে আনল রঙীন আলো, নতুন বসন্ত। নব রঙের ছোঁয়া।

 

 দেখতে দেখতে বছর ঘুরে এল।এক বছর পর আবার বসন্তোৎসব। রঙের উৎসব। দেবারতি আজ  জানালা খুলে দিয়েছে। আজ সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বাইরে বসন্তের ঝিরঝিরে মিষ্টি বাতাস বইছে। সেই বাতাস বসন্তের গানের ভেলায় ভেসে ওর হলুদ সবুজ  শাড়িতে এলোমেলো  আল্পনা এঁকে চলেছে।

 

              নীল দিগন্তে .... ....

               .....   .....  .... আগুণ

                    ...  ....    ....গন্তে

                     ....   ....   ....   "

 

বাসুদ নেই। তবু ওর উপস্থিতি দেবারতি অনুভব করছে ওর শরীরে , শিরায় উপশিরায়, হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনে। ছেলে মেয়েরা বাইরে রং আর আবীর খেলায় কি সুন্দর মেতে উঠেছে! দেবারতি দেখল অবাক নয়নেরাতের ঝোরো হাওয়ায় সামনের শিমুল গাছটার সব ফুল ঝরে গেছে। শুধু দুটি ফুল ফুটে আছে। দুটি পাখি ঐ ফুলের ডালে প্রেমালাপে মত্ত।দেবারতির মনে হল ওই পাখি দুটো, বাসুদ আর ওর হারানো বসন্তেরই প্রতিচ্ছবি।

 

বাসুদের চোখ দিয়ে দেবারতি আজ এক প্রেমঘন বসন্ত উৎসবের স্বাদ পেতে চলেছে। দেবারতির বহুদিনের সাদা কালো প্রায়ান্ধকারাচ্ছন্ন জীবন আজ বসন্তের রঙে রঙীন।শিমুল গাছের ডালে পাখি দুটি এখনও একে অপরকে সোহাগে ভরিয়ে তুলছে। ওদের দেখে দেবারতির তেরো বছর আগের কোপাই নদীর তীরের ঘটনা গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। বেলা বাড়তেই বাইরে শুরু হল জোর কদমে রং খেলা।পাখি দুটির দিকে একমনে চেয়ে দেবারতির মনের অলিন্দে কোকিল যেন পলাশের রাঙা লাজে নেচে উঠল। দেবারতি গান ধরল -

 

            " পলাশ ফুলে.....

           .....     .....  মহুল বন

            .. .....   ....  মান করেছে

                       ....  ....   ....  "

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন