বঙ্কিমের সিদ্ধান্ত - সৌমেন দেবনাথ

 




সবার বাড়ির আশপাশে এমন ভাঁড় প্রজাতি আছেই, খেতে পায় না, কিন্তু চোখে চশমা, কালো চশমা, ভাবের চশমা। একটা মেধাবী ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, সাইকেল চড়তে পারে না, কিন্তু এই ভাঁড় প্রজাতি মোটরসাইকেল চালায়। পকেটে টাকা নেই, কিন্তু আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। সম্মান করতে জানে না, শ্রদ্ধাবোধ নেই। শান্তশিষ্ট, ভদ্রদের এরা আবার অসামাজিক বলে। সমাজে বখাটেপনা করতে পারলেই সামাজিক হওয়া যায় আরকি! এরা ছোটখাটো ব্যবসা করে টাকার মুখ দেখলে মাটিতে পা ফেলে না। কলার উঁচিয়ে চলে, আঙুল নাচিয়ে কথা বলে। সমাজপতি হয়ে বিচার করে বেড়ায়।

বঙ্কিমের কথা বলবো বলেই এত কথা বলতে হলো। ব্যবসা করে বেশ টাকা কামিয়েছে। কাঁচের টুকরো হীরের টুকরো হয়ে গেছে। পোশাকে-আশাকে ফুলবাবু। কথা না বললে কাঁচ-কাঞ্চন বোঝা যাবে না। চেনা মানুষকে চেনা যায় না। টাকার মহিমায় মানুষ এত পরিবর্তন হতে জানে মুখ দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে মাথায় কিছু নেই। টাকা হলে মানুষের অবয়বে অতীতের চিহ্ন থাকে না, তবে আচার-আচরণে যে স্মারক ভেসে উঠে তা ডাস্টবিনের দুর্গন্ধের চেয়েও খারাপ। টাকা হয়েছে, সে ভেবে নিয়েছে তার সম্মানও হয়েছে। বিয়ে করবে, এ নিয়ে তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। মেয়ের কি থাকতে হবে তার বর্ণনার চেয়ে, মেয়ের পিতার কি থাকতে হবে তার বর্ণনা আরো দীর্ঘ।

কয়েকজনকে সঙ্গী করে মেয়ে দেখতে গেলো। ঘটকের কাছ থেকে যে সুন্দরের বর্ণনা সে শুনেছিলো তার চেয়ে বেশি সুন্দর। দেখলে যে সৌন্দর্য দেখা যায়, বর্ণনা করে তো সে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা যায় না। বিদায়ী সূর্যের হলদেটে রং-রোদ মেয়েটির শ্বেত-শুভ্র দেহকে করে তুলেছে আরো মোহনীয়। পাহাড়ের মত মৌন, চুপ করে বসে আছে। দেখলেই বোঝা যায় শান্ত, ভদ্র। খোলা হাওয়ায় কপালের এলো চুল উড়ে উড়ে বিরক্ত করছে। মুখ থেকে নিঃসৃত দু'টি একটি কথা মিষ্টির চেয়েও মিষ্টি। এমন মায়াবী চেহারার মেয়েকে দেখে কার না ভালো লাগবে! কিন্তু বঙ্কিমের ভালো লাগলো না। সবার দেখা আর তার দেখা এক না। সবার চিন্তার পরিসর আর তার চিন্তার পরিসর এক না। আপাতত দেখার বাইরে গিয়েও আরো কিছু দেখেছে সে। মামাকে বললো, মামা, মেয়ের পরিবার ভালো না। মেয়ের বাবার জমিজমা নেই। বিয়ে করলেই বৌ পাবো, কিন্তু বিয়ে করলে সম্পদ পাবো না, তা হবে না। পৃথিবী খুব নিষ্ঠুর, এক শতাংশ জমি কেউ দেবে না। রূপ থাক বা না থাক, গুণ থাক বা না থাক, টাকা থাকলে পছন্দে অদ্বিতীয়। মেয়ের বাবার টাকা থাকতে হবে, বাদবাকি বিষয় না থাকলেও চলবে।

মামা হতবাক হয়ে বললেন, বলিস কি! সংসার করার জন্য একটা ভালো মেয়েই যথেষ্ট। জীবনে একটা ভালো মেয়ে পাওয়া আশীর্বাদস্বরূপ। যার বৌ ভালো না, তার সংসারে কোথাও শান্তি নেই।

বঙ্কিম বললো, মামা, সম্পদ থাকলেই শান্তি। জীবনে যতটুকু করেছি অনেক কষ্টে। বিয়ে করে জিততে চাই, বিয়ে করে ঠকতে চাই না। বিয়ে করে যারা ঠকেছে, গোটা জীবনেও তারা তা অর্জন করতে পারেনি।

ছবির বাবা জেনে গেলেন তাঁর মেয়েকে তাঁরা পছন্দ করেননি। কেন পছন্দ করেননি তার কিছুটা আভাসও পেয়েছেন। সদ্য বড়লোক হওয়া এক বর্বরের হাতে মেয়েকে যে তুলে দিতে হলো না বাবা হিসেবে এটা যেন তাঁর পরমপ্রাপ্তি।

রোজগারের সুযোগ বেড়ে গেলে মনের ভেতরের অনুরাগ অনুভূতি ভোঁতা হতে থাকে। কাউকে ভালো লাগলেও বলতে দ্বিধা জাগে, তার নানা অসংগতি সামনে আসে। যাকে ঘিরে কোন এক সময় রূপমুগ্ধ একটা স্তবক লিখেছিলো, মনের কথা সামর্থ্য বা যোগ্যতার অভাবে বলতে পারেনি, তাকেও আর ভালো লাগে না। ভালোলাগার বহর বেড়েছে। যেখানে টাকাই শেষ কথা সেখানে রূপে কি আর মন মজে! সুন্দরে এখন মন ভরে না, সুন্দরীর স্বাচ্ছন্দ্যও থাকতে হবে। সুন্দরীর পরিবার যদি ক্ষমতার জ্যাকেটধারী হয়, তবে তো আরো ভালো। স্বচ্ছল জীবনের ঊষালগ্নে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। অহংবোধে অযাচিত কথা বলতেও দ্বিধান্বিত হয় না। টাকায় বাঘের দুধ মেলে এই জ্ঞান ধারণ করে চলে; হাড়ে, রক্তে, মাংসে অহংকার বহন করে। মনের অতল তলের জটিল রহস্য আরো জটিল করে তোলে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে কাউকেই আর গুরুত্ব দেয় না।

এবার ধনী ঘরে মেয়ে দেখতে গিয়েছে সদলে। আচারে-আচরণে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব। হীরার কণার মত দেখতে স্মারণিকেও পছন্দ হয় না বঙ্কিমের। নাম যেমন বঙ্কিম, পছন্দও তেমন বঙ্কিম। যাকে দেখে রক্তকণিকায় অজানা শিহরণ জেগে উঠলো, তাকে অপছন্দ করার নানা ফন্দিফিকির খুঁজতে থাকলো। ঘনপল্লবের নির্লিপ্ত চোখ, মিষ্টি ঠোঁটের লাজুক ভাবখানা তাকে আকৃষ্ট করলেও অজানা কারণে না না ভাবখানায় প্রকাশ করলো। হাড় খাওয়া কুকুর স্বভাবদোষে মার খেয়ে বাঁশবাগানে গিয়ে মল খায়। বঙ্কিমের হয়েছে সেই স্বভাব, কোন ভালোই তার ভালো লাগে না, কোন ভালোই তার চোখে পড়ে না। সাথে থাকা বন্ধু প্রদীপ বললো, কমনীয় মুখের স্নিগ্ধতা বড় মায়াকাড়া। বাচনভঙ্গির তীক্ষ্ণতাও অনিন্দ্য। অপছন্দের কারণ কোথায় পাস?

বঙ্কিম বলে, মেয়ে দেখতে আসা মানে মেয়েই দেখা না। সুন্দর বলে পছন্দ করবো, সুন্দর তো বুনোফলও। কমনীয় বলেই অগ্রাধিকার পাবে, বুনোফুলও কি কমনীয় নয়? যান্ত্রিক যুগ, হার্দিক আর আত্মিক হৃদয় দিয়ে চলে না। পৌরাণিক যুগে পরী দেখে মানুষ হতবাক হতো। আধুনিক কালে বৈষয়িক বিষয়ও লক্ষ্য করতে হয়। যেমন সম্পদশালী ভেবে এসেছিলাম তেমন সম্পদশালী এরা নয়।

প্রদীপ আশ্চর্য হয়ে বলে, সংসারের তাগিদে তুই তবে মেয়ে দেখতে আসিসনি, এসেছিস সম্পদের তাগিদে? এই লোভ, এই লিপ্সা, এই মোহ কখনো শুভ ফুল দেবে না। সম্পদ হয় সবার আশীর্বাদে।

বঙ্কিম জানে না অল্পে অনেক স্বাদ। সে জানে না কখনো-সখনো না চাইলেই বেশি মেলে, চাইলেই কমে। স্বপ্নীল রাজ্য গড়া আর স্বপ্নীল রাজ্য পাওয়া এক কথা না। স্বপ্নীল রাজ্য পাওয়ার এই নিচু আশা নীচুতার সামিল। আত্মতৃপ্তিই আত্মোন্নতি ঘটায়। অন্যের সম্পদ প্রাপ্তির এই নিম্নচিন্তা সুস্থতার প্রতীক না।

এরপর আবারও সে মেয়ে দেখতে গেলো। ভীষণ আশা, বিচিত্র আর বৈচিত্র্যময় আশা নিয়ে সে মেয়ে দেখতে যায়। তার পছন্দের মধ্যে দূরদর্শী চিন্তার মিশেল থাকে। মেয়ের চারিত্রিক গুণাবলীর চেয়ে অন্যান্য পারিপার্শ্বিক বিষয়ে তার সন্নিগ্ধ নজর থাকে। অন্যের চোখের দেখাকে সে ক্ষীণ আলোয় পুকুর দেখা বোঝে, নিজের চন্দ্রালোকপ্লাবিত চোখের দেখাতে মহাসমুদ্রের বালুও দেখে থাকে। সিঁথি যেমন লাবণ্যমাখা, তেমন মাধুর্যে সেরা, তেমনি কমনীয় ও মোহনীয়। দেখলেই মৃত মানুষের মত চোখ অপলক হয়ে যায়। কারো জন্য পয়সা পথে পড়ে থাকে না, এমন মেয়েও কারো জন্য পড়ে থাকবে না। যে যত দ্রুত দখলে নিতে পারবে, সে জিতে যাবে। কিন্তু যার নাক সিঁটকানো স্বভাব তার নাকে কেবল দুর্গন্ধই যায়। যার চোখে ময়লা সে ময়লাই দেখে। যার মন পচা, সে পচাই দেখে। লোভে যার হৃদয় ঠাসা তার মুগ্ধতা বলে কিছু নেই। প্রদীপের বিস্ময়মাখা প্রশ্ন, কি এবার পছন্দ তো?

বঙ্কিম বলে, মেয়ে তো সুন্দর, মেয়ের বাবাও সম্পাদশালী। কিন্তু মেয়ের বাবার রাজনৈতিক শক্তি নেই। রাজনৈতিক শক্তিহীনতায় সম্পদ ভোগে তৃপ্ততা থাকে না। ভীতি নিয়ে সম্পদ টিকিয়ে রাখা যায় না।

প্রদীপের আশ্চর্য হওয়ার আর কিছু বাকি থাকলো না। বললো, কি ভাবিস এসব! অন্যের সম্পদে এত নজর ভালো না। সম্পদই যারা চেনে তারা চির অসুখী। শক্তি দিয়ে যারা বাঁচতে চায় তারা শক্তিবান, ধনবান; মনবান না। সামর্থ্য অনুযায়ী বাঁচতে শিখতে হয়, শক্তি প্রয়োগে বাঁচাকে বাঁচা বলে না। বুদ্ধি দিয়ে বাঁচতে হয়, বোধ নিয়ে বাঁচতে হয়। বোধবুদ্ধিসম্পন্নরা শক্তিশালীদের চেয়ে বাঁচে মানে-সম্মানে। বিবেকের জয়, এমন শক্তির ক্ষয়। জ্ঞান চিরস্থায়ী, এমন শক্তি নশ্বর, অতি নশ্বর।

বঙ্কিম এসব কথায় কর্ণপাত করলো, দৃষ্টিপাত দিলো, কিন্তু সে যে ধারাপাত সারাদিন মনে জপে তা থেকে বের হলো না। মামা, কাকা আর প্রদীপকে নিয়ে সে স্থান ত্যাগ করলো। মামা ফেরার পথে বললেন, পছন্দের লাগাম টান। ভালোলাগারও সীমা থাকা দরকার। সহজে পাওয়া গেলে তার মর্ম বুঝি না। পাবো না যখন তখন আক্ষেপের শেষ থাকবে না।

বঙ্কিমের উক্তি, চারিদিকে মণিমুক্তায় ঠাসা, একটি মণি খুঁজে নেয়া খুবই সহজ। আমি হীরা-চুনি-পান্নার সাথে শক্তি, সাহস, সামর্থ্যও খুঁজছি। বাঁচতে এখন বল বেশি প্রয়োজন। বাঁচতে এখন বাহু প্রয়োজন। বাঁচতে এখন বিবেক কম প্রয়োজন।

কাকাও একথা শুনে থমকে গেলেন। বঙ্কিমের চিন্তায় এত অসুস্থতা বিরাজ করছে ভেবে মূর্ছা গেলেন। বললেন, মানুষ সুখের জন্য ভালো মন-মানসিকতার একটা মেয়ে খোঁজে। একটি শুদ্ধ মেয়ে একটি পরিবারকে শুদ্ধ করে তোলে।

বঙ্কিম বলে, ভালো মন-মানসিকতা বলে কোন কিছু নেই। উজ্জ্বল মন-মানসিকতার উপর গ্যালভানাইজিংয়ের প্রলেপ পড়ে যায় টাকা না থাকলে। সুখের জন্য সংসারী বৌ এখন খোঁজে না কেউ। অসংসারী বৌও টাকা দেখলে সংসারী হবে, সুখ বিলাবে। আপাতত চোখের দেখা সৌন্দর্যের মধ্যে কোন সুন্দর নেই। আমার আয় আছে, আমার ঘরে আসতে চায় অনেকেই। ঘরে চিনি থাকলে পিঁপড়ে আসে। চিনি না থাকলে পতঙ্গও আসবে না। যার টাকা আছে তার মান আছে। যার জ্ঞান আছে তার কোন মান নেই। সমাজ বদলে গেছে। পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার সাথে চিন্তা-চেতনারও পরিবর্তন ঘটানো দরকার।

সবাই চুপ হয়ে গেলো। প্রদীপ বাইরের মানুষ। কথা বলা তার ঠিক না। দামী কথায় চিঁড়ে ভেজে না। নীতিকথায় সবাই বেজার। উচিত কথায় সম্পর্ক নষ্ট হয়। সে মনে মনে ভাবতে থাকে, মানুষের মন কত বিচিত্র, মানুষের সেই বিচিত্র মনে কত বিচিত্র ভাবনা।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। চাওয়ার বাড়বাড়ন্তর জন্য মনের ঘরটা আজো ফাঁকা বঙ্কিমের। সে এক ধ্যান ধারণ করে আছে, অনায়াসে যা পাওয়া যায় তার মূল্য থাকে না। বিচক্ষণ মানুষ সে, বুঝে শুনে কাজ করবে। মুহূর্তের ভুলে সে জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করতে চায় না। আবার এটাও সত্য, রঙিন চোখে মাত্রাতিরিক্ত স্বপ্ন থাকলে ফুল চিনতে গিয়ে কাঁটায় জোটে। নিজের প্রতি শতভাগ বিশ্বাস আছে বলেই বলে, শকুন চোখকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও বৈজ্ঞানিক চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না।

এবার সাথে প্রদীপ যেতে চাইলো না। মানী মানুষের সাথে না গেলে মান থাকে না, এ কারণেই প্রদীপের এই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু বঙ্কিম প্রদীপকে সাথে নেবেই। এবার সাথে আরও এক বন্ধু আমির গেলো। আমিরের দৃঢ় সিদ্ধান্ত, বঙ্কিমকে এবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। মেয়েপক্ষের বাড়ি গিয়ে পৌঁছালো। সম্পদ অঢেল, রাজনৈতিক শক্তিও যৎসামান্য নয়। তথাগতকে দেখে তেমন পছন্দ না হলেও বঙ্কিম রাজি হয়ে গেলো। প্রদীপ বললো, রাজনৈতিক প্রভাব আছে যাদের ক্ষমতার পালাবদল হলে তাদেরই দুর্ভোগ হয় অনেক।

প্রদীপকে আমির থামিয়ে দিলো, এভাবে বলিস বলেই ওর বিয়ে হয় না। এখানেই বঙ্কিম বিয়ে করবে, কথা পাকাপাকি করেই ফিরবো। বিয়ের সিদ্ধান্তে বেশি ভাবলে বিয়ে হয় না। 

মামা বললেন, আমির, মেয়েটাকে তেমন চলনসই মনে হচ্ছে না। বঙ্কিমের তুলনায় বেশ ছোট। দেখতেও একটু শ্যামলা। বঙ্কিমের সাথে মানাবে না।

আমির বেশ রাগতস্বরে বললো, আর কত মেয়ে দেখবেন? সব পাবেন না একত্রে। একটি মানুষ সব নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। আল্লাহ সবাইকে সব দিবেন না। কিছু খুঁত থাকবে, নিখুঁত কিছুই নেই। সব পূর্ণতা একের ভিতরে থাকবে না। কেউ সম্পূর্ণ না। মেনে নিতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে। দোষ দেখলে দোষ বেরই হবে, ত্রুটি দেখলে ত্রুটি বেরই হবে। শুধু চিন্তাভাবনার ভেতর পজিটিভিটি আনেন, দেখেন সব সুন্দর। চোখ মেললে সুন্দর দেখা যায় না, দৃষ্টি মেলতে হয়। হৃদয়ের চোখের উন্মীলন না হলে দেখাটা দেখায় থাকে, দর্শন হয়ে উঠে না।

কাকাও আমিরের সাথে একমত। বললেন, মেয়ের বাবা মায়ের সাথে আমাদের রাজি হওয়ার কথাটা জানিয়ে দিই।

মেয়েপক্ষ ছেলেপক্ষের রাজি হওয়ার বিষয় জানলো। মেয়ের পিসি এসে বঙ্কিমের বাবা সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। বঙ্কিমের লেখাপড়া সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। বঙ্কিমের ব্যবসা কি, কিভাবে উন্নতি করলো তা জানতে চাইলেন। বঙ্কিম উত্তর দিতে কম আগ্রহ দেখালো। এমন একটা ভাব সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। মেয়ের পিসি সবার সামনে বলে ফেললেন, ছেলের ভেতর উগ্রতা আছে। ঘাড়তেড়া অনেক। অবাধ্যও। ব্যবহারে অহমিকা, দাম্ভিকতা বেশ।

বঙ্কিম অপ্রস্তুত ছিলো এমন কথা শুনবে। সে নিজেকে যোগ্য ভাবে, তাই কারো তীর্যক কথা সহ্য করতে পারে না। বললো, ছোট থেকে বড় হয়েছি সংগ্রাম করে। এমন তীর্যক কথা শোনার জন্য নয়।

পিসি বললেন, গরীব থেকে ধনী হলে মানুষ ছোটই থাকে। তোমার অসভ্য আচরণ তার উজ্জ্বল প্রমাণ। পকেটের দীনতা কাটলেও মনের দীনতা কাটে না। কোন ঘরে বিয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছো? শিক্ষা থাকলে সাহস পেতে না। অশিক্ষিত, মূর্খ; টাকা রোজগার করেছো বলেই মর্যাদাবান? হীন মানসিকতা ধারণ করো, আবার এসেছো এই বাড়ি বিয়ের উদ্দেশ্যে? আমাদের বাড়ি মাসিক বেতনে রান্নার চাকরি করে যে তারও তোমার চেয়ে অনেক টাকা। মূর্খ!

বঙ্কিম কিছু বলতে চাচ্ছিলো। আশেপাশে কয়েকজনের হাতে লাঠি দেখে থমকে গেলো। আমির বঙ্কিমের হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। বাকিরাও পিছন পিছন দ্রুত ফিরলেন। বঙ্কিম ক্ষুব্ধ খুব, এমন আচরণ পাবে যা তার কাছে আশাতীত ছিলো। আমির বললো, স্তর পরিবর্তন করতে নেই। নিচু, মধ্যম, উঁচু স্তরের কথা এমনিতেই আসেনি। নিজের স্তর নিজেকেই মাপতে হয়। নিজের স্তর মাপতে ভুল হলে এমন আচরণই জোটে।

বঙ্কিম বললো, শক্তি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিলো! শক্তি আছে বলে এভাবে অসম্মান করবে? গৃহের কুকুরকেও তো কেউ এভাবে তাড়ায় না! তবে আমার মাত্রাতিরিক্ত আশা করা ঠিক হইনি। নিজের ওজন নিজেকেই মাপতে হয়। নিজের ওজন না মেপে চাঁদ ধরতে গেলে হাতে ফোসকায় পড়ে। আমার জন্য মামা, কাকা আপনারা; প্রদীপ, আমির বন্ধু তোরা অপমানিত হলি।

প্রদীপ মনে মনে বলতে থাকলো, বঙ্কিম বন্ধু, তুমি নিজেকে আগে চেনো, তুমি নিজেকে যা ভাবো তুমি তা নও। তোমার গণ্ডিতে তুমি সেরা, তোমার গণ্ডির বাইরে তুমি নগণ্য, কত নগণ্য তা তুমি নিজেও জানো না।

এরপর বঙ্কিম দীর্ঘদিন বিয়ের নাম মুখে আনেনি। বয়স থেমে নেই। নিজের প্রয়োজন যতটা না, সমাজের মুখ বন্ধ করাটা তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিয়েটা তাই করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রদীপকে ডাকলে কাজের অজুহাত দেখিয়ে সে যেতে রাজি হলো না। আমিরও যেতে চাইলো না। স্বভাবে দোষ আছে যাদের তাদের সাথে মানুষ বেশি মিশতে চায় না। নাও বলতে পারে না, তাই নানা অজুহাত দেখিয়ে নিজেদেরকে রক্ষা করে। দুই চারজন সম্মানিত মানুষ সাথে না থাকলে মেয়েপক্ষের বাড়ি ওজন কমে যায়। দাদুকে সাথে নিলো, আর সাথে নিলো বড় বোনের ছেলেকে। সিঁথিদের বাড়ি গেলো। কিন্তু গেট খুললো না কেউ। এই অমানবিক আচরণে বিস্মিত হয়ে গেলো বঙ্কিম। বিড়ম্বনায় পড়লো ওরা। রবিন বললো, মামা, এভাবে অপদস্ত হবো ভাবিনি।

বঙ্কিম বললো, ঊন বাসনা থাকলে অপদস্ত হতে হয় কম। যৎ আশাতে মান হারানোর ভয় কম। প্রাপ্যতায় হাত বাড়ালে প্রাপ্ত হয়। প্রত্যাশার ডালপালা বেশি হয়ে গেলে ন্যূন ঝড়েও পতন হয়।

দাদু বললেন, বোধোদয় হলো তবে। নিজেকে জানার মত আনন্দ আর নেই। নিজের সক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে গেলে অপ্রত্যাশিত আচরণ পেতে হয় না। প্রাপ্তির জন্য আহাজারি করতে হয় না, প্রাপ্য যা তাই পাবে। প্রাপ্যের অধিক পাবে না। তুমি যাকে যোগ্য ভাবছো, তার কাছে নেহাতও হতে পারো তুমি। তোমার যোগ্য যে তোমার কাছে আসবেই সে।

ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলো সবাই। উলোট-পালোট হতে থাকলো বঙ্কিমের ভেতর। নিজের আশার যে ঘুড়িটা উর্ধ্ব আকাশে উড়তো, রশি টেনে তাকে ভূমিতে নামালো। যত সহসায় সব কিছু সে পাবে ভেবেছিলো, তত সহসায় সব মেলে না বুঝে গেছে সে। চারিদিকের মণিমুক্তার ছড়াছড়ি থেকে একটি মুক্তাকে সে যত সহজে কুড়িয়ে নেবে ভেবেছিলো বাস্তবে তত সহজ না। নিজেকে যত সে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভেবেছিলো, আসলে সে তত স্বয়ংসম্পূর্ণ না। পুকুরের মাছ নদীতে গেলে থৈ পায় না, গ্রামের মানুষ শহরে গেলে রাস্তা পায় না। হঠাৎ কিছু রোজগার করতে জানা মানুষ ধনাঢ্যদের মাঝে গেলে নেহাত হয়ে যায়। উর্ধ্বের নজর অধতে নামালো বঙ্কিম। গরীব বাবার মেয়ে ছবির কথা মনে পড়লো তার। ছবির বাবা তাকে ফেরাবেন না এই অটল বিশ্বাস তার আছে। সাথে কাউকে পেলো না, এবার সে একা গেলো। ছবির বাবাকে বললো, আপনার মেয়েকে আমার পছন্দ।

ছবির বাবা বললেন, ছবি পড়ছে, পড়বে। একটি শিক্ষিত ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবো। হোক সে গরীব। শিক্ষিত ছেলের মন বড় হয়।

বঙ্কিম বলে, আমার ঘরে আপনার মেয়ে সুখেই থাকবে। আমার রোজগার ভালো, নগদ টাকাও আছে!

পাশ থেকে ছবির মা বললেন, ছবির বাবা, ছেলের বয়স বেশি।

ছবি এসে বললো, বাবা, অশিক্ষিত আর বয়স্কর সাথে বিয়ে দেবে বলেই কি এত কষ্ট করে আমায় মানুষ করছো?

বঙ্কিম আর একটি কথাও না বাড়িয়ে পিছটান নিয়ে চলে এলো। একরত্তি মেয়ের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে বুঝে গেছে, সে কত বেশি নগণ্য। নিজের পছন্দের কথা ভাবতে ভাবতে সে ভুলেই গিয়েছিলো অন্যেরও পছন্দ আছে। সে ধরে রেখেছিলো, অন্যের মতামত তার অর্থের গরমে তার দিকেই ধাবিত হবে। প্রত্যেকের মত প্রত্যেকের মত। নিজের যেমন চাওয়া থাকে অন্যদেরও তেমন চাওয়া থাকে।

বাইরে ঘটক এসে বঙ্কিমকে ডাকছেন। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। গ্রাম্য বাজারের মুদি দোকানদারের মেয়ের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব। এ খবর শোনামাত্রই বঙ্কিম মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে থাকলো। অতি প্রত্যাশিতদের পতন হয়, তাই বলে এত পতন!


ছবি আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন