বঙ্কিম এসব কথায় কর্ণপাত করলো, দৃষ্টিপাত দিলো, কিন্তু সে যে ধারাপাত সারাদিন মনে জপে তা থেকে বের হলো না। মামা, কাকা আর প্রদীপকে নিয়ে সে স্থান ত্যাগ করলো। মামা ফেরার পথে বললেন, পছন্দের লাগাম টান। ভালোলাগারও সীমা থাকা দরকার। সহজে পাওয়া গেলে তার মর্ম বুঝি না। পাবো না যখন তখন আক্ষেপের শেষ থাকবে না।
বঙ্কিমের উক্তি, চারিদিকে মণিমুক্তায় ঠাসা, একটি মণি খুঁজে নেয়া খুবই সহজ। আমি হীরা-চুনি-পান্নার সাথে শক্তি, সাহস, সামর্থ্যও খুঁজছি। বাঁচতে এখন বল বেশি প্রয়োজন। বাঁচতে এখন বাহু প্রয়োজন। বাঁচতে এখন বিবেক কম প্রয়োজন।
কাকাও একথা শুনে থমকে গেলেন। বঙ্কিমের চিন্তায় এত অসুস্থতা বিরাজ করছে ভেবে মূর্ছা গেলেন। বললেন, মানুষ সুখের জন্য ভালো মন-মানসিকতার একটা মেয়ে খোঁজে। একটি শুদ্ধ মেয়ে একটি পরিবারকে শুদ্ধ করে তোলে।
বঙ্কিম বলে, ভালো মন-মানসিকতা বলে কোন কিছু নেই। উজ্জ্বল মন-মানসিকতার উপর গ্যালভানাইজিংয়ের প্রলেপ পড়ে যায় টাকা না থাকলে। সুখের জন্য সংসারী বৌ এখন খোঁজে না কেউ। অসংসারী বৌও টাকা দেখলে সংসারী হবে, সুখ বিলাবে। আপাতত চোখের দেখা সৌন্দর্যের মধ্যে কোন সুন্দর নেই। আমার আয় আছে, আমার ঘরে আসতে চায় অনেকেই। ঘরে চিনি থাকলে পিঁপড়ে আসে। চিনি না থাকলে পতঙ্গও আসবে না। যার টাকা আছে তার মান আছে। যার জ্ঞান আছে তার কোন মান নেই। সমাজ বদলে গেছে। পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার সাথে চিন্তা-চেতনারও পরিবর্তন ঘটানো দরকার।
সবাই চুপ হয়ে গেলো। প্রদীপ বাইরের মানুষ। কথা বলা তার ঠিক না। দামী কথায় চিঁড়ে ভেজে না। নীতিকথায় সবাই বেজার। উচিত কথায় সম্পর্ক নষ্ট হয়। সে মনে মনে ভাবতে থাকে, মানুষের মন কত বিচিত্র, মানুষের সেই বিচিত্র মনে কত বিচিত্র ভাবনা।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। চাওয়ার বাড়বাড়ন্তর জন্য মনের ঘরটা আজো ফাঁকা বঙ্কিমের। সে এক ধ্যান ধারণ করে আছে, অনায়াসে যা পাওয়া যায় তার মূল্য থাকে না। বিচক্ষণ মানুষ সে, বুঝে শুনে কাজ করবে। মুহূর্তের ভুলে সে জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করতে চায় না। আবার এটাও সত্য, রঙিন চোখে মাত্রাতিরিক্ত স্বপ্ন থাকলে ফুল চিনতে গিয়ে কাঁটায় জোটে। নিজের প্রতি শতভাগ বিশ্বাস আছে বলেই বলে, শকুন চোখকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও বৈজ্ঞানিক চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না।
এবার সাথে প্রদীপ যেতে চাইলো না। মানী মানুষের সাথে না গেলে মান থাকে না, এ কারণেই প্রদীপের এই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু বঙ্কিম প্রদীপকে সাথে নেবেই। এবার সাথে আরও এক বন্ধু আমির গেলো। আমিরের দৃঢ় সিদ্ধান্ত, বঙ্কিমকে এবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। মেয়েপক্ষের বাড়ি গিয়ে পৌঁছালো। সম্পদ অঢেল, রাজনৈতিক শক্তিও যৎসামান্য নয়। তথাগতকে দেখে তেমন পছন্দ না হলেও বঙ্কিম রাজি হয়ে গেলো। প্রদীপ বললো, রাজনৈতিক প্রভাব আছে যাদের ক্ষমতার পালাবদল হলে তাদেরই দুর্ভোগ হয় অনেক।
প্রদীপকে আমির থামিয়ে দিলো, এভাবে বলিস বলেই ওর বিয়ে হয় না। এখানেই বঙ্কিম বিয়ে করবে, কথা পাকাপাকি করেই ফিরবো। বিয়ের সিদ্ধান্তে বেশি ভাবলে বিয়ে হয় না।
মামা বললেন, আমির, মেয়েটাকে তেমন চলনসই মনে হচ্ছে না। বঙ্কিমের তুলনায় বেশ ছোট। দেখতেও একটু শ্যামলা। বঙ্কিমের সাথে মানাবে না।
আমির বেশ রাগতস্বরে বললো, আর কত মেয়ে দেখবেন? সব পাবেন না একত্রে। একটি মানুষ সব নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। আল্লাহ সবাইকে সব দিবেন না। কিছু খুঁত থাকবে, নিখুঁত কিছুই নেই। সব পূর্ণতা একের ভিতরে থাকবে না। কেউ সম্পূর্ণ না। মেনে নিতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে। দোষ দেখলে দোষ বেরই হবে, ত্রুটি দেখলে ত্রুটি বেরই হবে। শুধু চিন্তাভাবনার ভেতর পজিটিভিটি আনেন, দেখেন সব সুন্দর। চোখ মেললে সুন্দর দেখা যায় না, দৃষ্টি মেলতে হয়। হৃদয়ের চোখের উন্মীলন না হলে দেখাটা দেখায় থাকে, দর্শন হয়ে উঠে না।
কাকাও আমিরের সাথে একমত। বললেন, মেয়ের বাবা মায়ের সাথে আমাদের রাজি হওয়ার কথাটা জানিয়ে দিই।
মেয়েপক্ষ ছেলেপক্ষের রাজি হওয়ার বিষয় জানলো। মেয়ের পিসি এসে বঙ্কিমের বাবা সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। বঙ্কিমের লেখাপড়া সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। বঙ্কিমের ব্যবসা কি, কিভাবে উন্নতি করলো তা জানতে চাইলেন। বঙ্কিম উত্তর দিতে কম আগ্রহ দেখালো। এমন একটা ভাব সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। মেয়ের পিসি সবার সামনে বলে ফেললেন, ছেলের ভেতর উগ্রতা আছে। ঘাড়তেড়া অনেক। অবাধ্যও। ব্যবহারে অহমিকা, দাম্ভিকতা বেশ।
বঙ্কিম অপ্রস্তুত ছিলো এমন কথা শুনবে। সে নিজেকে যোগ্য ভাবে, তাই কারো তীর্যক কথা সহ্য করতে পারে না। বললো, ছোট থেকে বড় হয়েছি সংগ্রাম করে। এমন তীর্যক কথা শোনার জন্য নয়।
পিসি বললেন, গরীব থেকে ধনী হলে মানুষ ছোটই থাকে। তোমার অসভ্য আচরণ তার উজ্জ্বল প্রমাণ। পকেটের দীনতা কাটলেও মনের দীনতা কাটে না। কোন ঘরে বিয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছো? শিক্ষা থাকলে সাহস পেতে না। অশিক্ষিত, মূর্খ; টাকা রোজগার করেছো বলেই মর্যাদাবান? হীন মানসিকতা ধারণ করো, আবার এসেছো এই বাড়ি বিয়ের উদ্দেশ্যে? আমাদের বাড়ি মাসিক বেতনে রান্নার চাকরি করে যে তারও তোমার চেয়ে অনেক টাকা। মূর্খ!
বঙ্কিম কিছু বলতে চাচ্ছিলো। আশেপাশে কয়েকজনের হাতে লাঠি দেখে থমকে গেলো। আমির বঙ্কিমের হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। বাকিরাও পিছন পিছন দ্রুত ফিরলেন। বঙ্কিম ক্ষুব্ধ খুব, এমন আচরণ পাবে যা তার কাছে আশাতীত ছিলো। আমির বললো, স্তর পরিবর্তন করতে নেই। নিচু, মধ্যম, উঁচু স্তরের কথা এমনিতেই আসেনি। নিজের স্তর নিজেকেই মাপতে হয়। নিজের স্তর মাপতে ভুল হলে এমন আচরণই জোটে।
বঙ্কিম বললো, শক্তি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিলো! শক্তি আছে বলে এভাবে অসম্মান করবে? গৃহের কুকুরকেও তো কেউ এভাবে তাড়ায় না! তবে আমার মাত্রাতিরিক্ত আশা করা ঠিক হইনি। নিজের ওজন নিজেকেই মাপতে হয়। নিজের ওজন না মেপে চাঁদ ধরতে গেলে হাতে ফোসকায় পড়ে। আমার জন্য মামা, কাকা আপনারা; প্রদীপ, আমির বন্ধু তোরা অপমানিত হলি।
প্রদীপ মনে মনে বলতে থাকলো, বঙ্কিম বন্ধু, তুমি নিজেকে আগে চেনো, তুমি নিজেকে যা ভাবো তুমি তা নও। তোমার গণ্ডিতে তুমি সেরা, তোমার গণ্ডির বাইরে তুমি নগণ্য, কত নগণ্য তা তুমি নিজেও জানো না।
এরপর বঙ্কিম দীর্ঘদিন বিয়ের নাম মুখে আনেনি। বয়স থেমে নেই। নিজের প্রয়োজন যতটা না, সমাজের মুখ বন্ধ করাটা তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিয়েটা তাই করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রদীপকে ডাকলে কাজের অজুহাত দেখিয়ে সে যেতে রাজি হলো না। আমিরও যেতে চাইলো না। স্বভাবে দোষ আছে যাদের তাদের সাথে মানুষ বেশি মিশতে চায় না। নাও বলতে পারে না, তাই নানা অজুহাত দেখিয়ে নিজেদেরকে রক্ষা করে। দুই চারজন সম্মানিত মানুষ সাথে না থাকলে মেয়েপক্ষের বাড়ি ওজন কমে যায়। দাদুকে সাথে নিলো, আর সাথে নিলো বড় বোনের ছেলেকে। সিঁথিদের বাড়ি গেলো। কিন্তু গেট খুললো না কেউ। এই অমানবিক আচরণে বিস্মিত হয়ে গেলো বঙ্কিম। বিড়ম্বনায় পড়লো ওরা। রবিন বললো, মামা, এভাবে অপদস্ত হবো ভাবিনি।
বঙ্কিম বললো, ঊন বাসনা থাকলে অপদস্ত হতে হয় কম। যৎ আশাতে মান হারানোর ভয় কম। প্রাপ্যতায় হাত বাড়ালে প্রাপ্ত হয়। প্রত্যাশার ডালপালা বেশি হয়ে গেলে ন্যূন ঝড়েও পতন হয়।
দাদু বললেন, বোধোদয় হলো তবে। নিজেকে জানার মত আনন্দ আর নেই। নিজের সক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে গেলে অপ্রত্যাশিত আচরণ পেতে হয় না। প্রাপ্তির জন্য আহাজারি করতে হয় না, প্রাপ্য যা তাই পাবে। প্রাপ্যের অধিক পাবে না। তুমি যাকে যোগ্য ভাবছো, তার কাছে নেহাতও হতে পারো তুমি। তোমার যোগ্য যে তোমার কাছে আসবেই সে।
ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলো সবাই। উলোট-পালোট হতে থাকলো বঙ্কিমের ভেতর। নিজের আশার যে ঘুড়িটা উর্ধ্ব আকাশে উড়তো, রশি টেনে তাকে ভূমিতে নামালো। যত সহসায় সব কিছু সে পাবে ভেবেছিলো, তত সহসায় সব মেলে না বুঝে গেছে সে। চারিদিকের মণিমুক্তার ছড়াছড়ি থেকে একটি মুক্তাকে সে যত সহজে কুড়িয়ে নেবে ভেবেছিলো বাস্তবে তত সহজ না। নিজেকে যত সে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভেবেছিলো, আসলে সে তত স্বয়ংসম্পূর্ণ না। পুকুরের মাছ নদীতে গেলে থৈ পায় না, গ্রামের মানুষ শহরে গেলে রাস্তা পায় না। হঠাৎ কিছু রোজগার করতে জানা মানুষ ধনাঢ্যদের মাঝে গেলে নেহাত হয়ে যায়। উর্ধ্বের নজর অধতে নামালো বঙ্কিম। গরীব বাবার মেয়ে ছবির কথা মনে পড়লো তার। ছবির বাবা তাকে ফেরাবেন না এই অটল বিশ্বাস তার আছে। সাথে কাউকে পেলো না, এবার সে একা গেলো। ছবির বাবাকে বললো, আপনার মেয়েকে আমার পছন্দ।
ছবির বাবা বললেন, ছবি পড়ছে, পড়বে। একটি শিক্ষিত ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবো। হোক সে গরীব। শিক্ষিত ছেলের মন বড় হয়।
বঙ্কিম বলে, আমার ঘরে আপনার মেয়ে সুখেই থাকবে। আমার রোজগার ভালো, নগদ টাকাও আছে!
পাশ থেকে ছবির মা বললেন, ছবির বাবা, ছেলের বয়স বেশি।
ছবি এসে বললো, বাবা, অশিক্ষিত আর বয়স্কর সাথে বিয়ে দেবে বলেই কি এত কষ্ট করে আমায় মানুষ করছো?
বঙ্কিম আর একটি কথাও না বাড়িয়ে পিছটান নিয়ে চলে এলো। একরত্তি মেয়ের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে বুঝে গেছে, সে কত বেশি নগণ্য। নিজের পছন্দের কথা ভাবতে ভাবতে সে ভুলেই গিয়েছিলো অন্যেরও পছন্দ আছে। সে ধরে রেখেছিলো, অন্যের মতামত তার অর্থের গরমে তার দিকেই ধাবিত হবে। প্রত্যেকের মত প্রত্যেকের মত। নিজের যেমন চাওয়া থাকে অন্যদেরও তেমন চাওয়া থাকে।
বাইরে ঘটক এসে বঙ্কিমকে ডাকছেন। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। গ্রাম্য বাজারের মুদি দোকানদারের মেয়ের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব। এ খবর শোনামাত্রই বঙ্কিম মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে থাকলো। অতি প্রত্যাশিতদের পতন হয়, তাই বলে এত পতন!
ছবি আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন