গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণের সমস্যা অনেক মহিলার ক্ষেত্রেই
দেখা যায়। অনেকক্ষেত্রে এটি
অতি স্বাভাবিক ঘটনা আবার অনেকসময় এটি চিন্তার কারণও হতে পারে। প্রতি
৪ জন গর্ভবতীর মধ্যে ১ জনের রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় রক্তপাত
অত্যন্ত জটিল সমস্যার ইঙ্গিতবাহী হয়, তাই এই ধরণের ঘটনায় দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ করা
প্রয়োজন।
প্রথম ট্রাইমেস্টার চলাকালে রক্তক্ষরণ
গর্ভাবস্থার সূচনাকালের ১২ সপ্তাহের মধ্যে ২০% মহিলার
রক্তক্ষরণ হতে দেখা যায়। এটি বিবিধ কারণে হতে পারে –
·
গর্ভসঞ্চারের
প্রথম ৬ থেকে ১২ দিনের মধ্যে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর গাত্রে প্রোথিত হয়ে যায়। এইসময়
ছিঁটেফোঁটা রক্ত যোনি থেকে নিঃসৃত হতে পারে। এটি কয়েক
ঘন্টা থেকে কয়েক দিন স্থায়ী হতে পারে।
·
গর্ভসঞ্চারের
প্রথম ১২ সপ্তাহ মূল চিন্তার কারণ থাকে গর্ভপাত। রক্তক্ষরণ এই সময়কালে গর্ভপাতের সম্ভবনাকেও নির্দেশ করতে
পারে। তাই ডাক্তারের
পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। তবে ৯০% ক্ষেত্রে
রক্তপাত হলেও মহিলাদের গর্ভপাত ঘটে না। রক্তক্ষরণ ছাড়াও গর্ভপাতের আরো কিছু লক্ষণ
হল তলপেটে ব্যাথা হওয়া এবং যোনির মধ্য দিয়ে টিস্যুর বাইরে বেরিয়ে আসা।
·
গর্ভাবস্থায়
জরায়ুর গ্রীবাদেশে অধিক পরিমাণে রক্ত প্রবাহিত হয়। এরফলে
সহবাস বা প্যাপ টেস্টের সময় জরায়ুর গ্রীবাদেশ স্পর্শ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে এই রক্তক্ষরণ নিয়ে কোন চিন্তার কারণ
নেই।
·
যোনিতে
কোন সংক্রমণ বা যৌনরোগ (ক্ল্যামাইডিয়া, গনোরিয়া, হারপিস) দ্বারা
সংক্রমিত হলে অনেকক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ হতে দেখা যায়।
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে রক্তক্ষরণ
গর্ভাবস্থায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে অধিক
পরিমাণে রক্তক্ষরণ, মা এবং শিশুর কোন সমস্যাকে নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে রক্তক্ষরণের কারণ-
·
অমরা
বা প্লাসেন্টা যদি জরায়ুর নীচের দিকে অবস্থান করে এবং জন্ম নালিকাকে আংশিক বা
সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে রাখে, তবে রক্তক্ষরণ ঘটতে পারে। ২০০ জনের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা যায়। এই সমস্যাকে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বলে। সাধারণত এটিতে ব্যাথা
হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ মেডিক্যাল তত্ত্বাবধান প্রয়োজন।
·
১% ঘটনায়
প্রসবের আগে বা প্রসবের সময় অমরা জরায়ু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় অমরা এবং
জরায়ুর মধ্যবর্তী অংশে রক্ত জমা হয়ে যায়। এই ধরনের অমরা বিচ্ছিন্নকরণ মা এবং শিশু উভয়ের জন্যই
ক্ষতিকর। এর আরো
আনুষাঙ্গিক লক্ষণগুলি হল পেটে ব্যাথা, যোনি থেকে জমাট রক্ত নিঃসরণ, জরায়ুর
নমনীয় হয়ে যাওয়া এবং পিঠে ব্যাথা।
·
পূর্বে
সি-সেকশনে করা হলে কিছু ক্ষেত্রে সেটি পরবর্তী গর্ভাবস্থায় উন্মোচিত হয়ে রক্তক্ষরণ
ঘটাতে পারে। এটিও প্রাণ সংকটের
কারণ হতে পারে। তাই এইক্ষেত্রে
অবিলম্বে সি-সেকশন করা প্রয়োজন।
·
কিছু
বিরল ঘটনায় গর্ভস্থ শিশুর নাভিরজ্জু অথবা অমরা জন্ম নালিকায় উন্মোচিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে শিশুর প্রাণ সংশয় ঘটতে পারে। এরফলে শিশুর অত্যধিক হারে রক্তক্ষরণ ঘটে এবং অক্সিজেন ঘাটতি
দেখা যায়। একে ভাসা প্রিভিয়া বলে।
·
গর্ভাবস্থার
শেষের দিকে যোনি থেকে রক্তক্ষরণ হলে এটি অনেকসময় প্রসবের সংকেত হতে পারে। প্রসবের কিছুদিন বা সপ্তাহ আগে জরায়ুর মুখের দিকে যে
মিউকাস থাকে সেটি যোনির কাছে চলে আসে। এর সাথে রক্তও নিঃসৃত হতে পারে। প্রসবের ৩৭ সপ্তাহ আগে এটি দেখা দিলে সত্ত্বর ডাক্তারের
সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ এটি প্রিটার্ম ডেলিভ্যারির সংকেত হতে পারে।
অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হলে কি করা উচিৎ
অস্বাভাবিক হারে রক্তক্ষরণ হলে সর্বাগ্রে ডাক্তারের সাথে
যোগাযোগ করা উচিৎ। তাছাড়া সঙ্গে সঙ্গে একটা প্যাড ব্যবহার করতে হবে যার
দ্বারা রক্তক্ষরণের হার পরিমাপ করা সম্ভব। এর পাশাপাশি লক্ষ্য রাখতে হবে যে রক্তের
রং কেমন আছে ( লাল, গোলাপি, বাদামি) এবং রক্ত জমাটবদ্ধ নাকি তরল।
রক্তক্ষরণের সময় সহবাস এবং টেম্পুন ব্যবহার অনুচিত।
নিম্নোক্ত লক্ষণগুলি দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ইমারজেন্সিতে
গিয়ে যোগাযোগ করা প্রয়োজন –
- · তলপেটে প্রবল ব্যথা
- · অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ
- · যোনি থেকে স্রাব নিঃসরণ এবং সেটিতে টিস্যুর উপস্থিতি।
- · মাথা ঘোরা এবং ক্লান্তিভাব
- · ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি জ্বর
- ·
টিস্যু
বা শরীরকলা বা বাঁধা জমাট রক্তের নির্গমন
- ·
মলত্যাগ
ও প্রস্রাবের সময় ব্যাথা
এগুলি গর্ভপাতের বা মিসক্যারেজের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মহিলার যোনি রক্তপাত হলে, তাঁকে সম্পূর্ণরূপে এবং অবিলম্বে পরীক্ষা করা উচিত।
রক্তপাতের কারণ এক্টোপিক গর্ভধারণের মত কিছু জটিলতা থেকে হেমোরেজিক শক হতে পারে। দেহ থেকে 20%-এর বেশী রক্তক্ষয় হলে হেমোরেজিক শক হয়। রক্তের
ক্ষয়ের ফলে হৃৎপিণ্ড শরীরের রক্তকে পাম্প করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয় ।
প্রতিরোধ
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হওয়া রোধে কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরী:
·
রক্তপাত বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া।
·
রক্তপাত হওয়ার সময় ট্যামপুনের
পরিবর্তে প্যাড ব্যবহার করতে হবে।
·
রক্তপাত হওয়ার সময় যৌনতা এড়িয়ে যাওয়াই উচিত।
·
ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে, প্যারাসিটামলের মত হালকা ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
·
অবস্থার যে কোনও পরিবর্তন ডাক্তারকে অবিলম্বে জানাতে হবে।
·
যদি রক্তপাত এবং খিঁচুনি গুরুতর হয়, তাহলে শুধুমাত্র তরল পান করা
উচিত।
·
যতক্ষন সম্ভব পা
একটু উঁচু জায়গায় রাখতে হবে।
·
বেশি ওজনের জিনিস তোলা এড়িয়ে যেতে হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন