অফিস পিকনিকের সান্ধ্য আসর জমে উঠেছে। আসর জমাতে উদ্যোক্তারা কুইজ কম্পিটিশনের পর সবার পছন্দের গানের লড়াইয়ের প্রস্তাব রাখতেই সবাই একযোগে বলতে শুরু করল এবার মা মেয়ের জোরদার কম্পিটিশন হবে। যদি বা সবক্ষেত্রে কোনো পাত্তাই না পেয়ে নিজেকে রেডিও আর্টিস্ট বলা কাকলিদি ভেবেছিলেন এইবার তিনি বাজিমাৎ করবেন, কিন্তু তার মধ্যে মা মেয়ে কোথা থেকে এসে পড়ল তিনি বুঝতেই পারলেন না। এখানে তো আর কেউ বলেনি একবারও তাঁরা সঙ্গীতশিল্পী। যদিও বুঝতে একদমই বেশী সময় লাগল না। উঃ, এবার যেন সত্যিই অসহ্য লাগছে সবার এই একপেশে আদিখ্যেতা। কি আছে ঐ সামান্য একজন মহিলার মধ্যে। হ্যাঁ, দেখতে সুন্দর ঠিকই। তাতে নয় পুরুষদের আদিখ্যেতা মানা যায়, কিন্তু এতো ছেলে বুড়ো, কচি-কাঁচা, এমনকি তাদের মায়েরাও অর্থাৎ মহিলামহলও তার অনুগতই শুধু নয়, যেন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। অথচ, মহিলার স্বামী এমন কিছু উঁচু পোস্টে কাজ করেন না বা অফিস ক্লাবের সেক্রেটারিও নন। একজন পাতি অফিসারের বৌয়ের এতো কিসের পপুলারিটি? এরকম অফিসারদের আরো কজন বৌও তো আছেন এখানে উপস্থিত, কই তাঁরা তো তেমন পাত্তা পাচ্ছেন না। বরং উল্টে তাঁরাও এঁকেই খাতির করছেন, গুণগান করছেন, যেন অনুগত প্রাণ।
মৌসুমি সবটাই বুঝতে পারছিল। তাই
সবাই মিলে গান গাওয়ার কথা বলতেই বলল,"না গো, আমার শরীরটা
তেমন ঠিক লাগছে না। আর তাছাড়া আমি গান জানিও না। আজ আমাদের মাঝে এমন স্বনামধন্য
একজন রেডিও আর্টিস্ট উপস্থিত থাকাকালীন আমি গান গাইলে উনি হেসেই ফেলবেন। এতোগুলো
বাচ্চা ছেলেমেয়ে আছে , ওরা গাক। আমি এবার
শ্রোতা।" অফিস ক্লাবের উদ্যোক্তারা তো বটেই, তাদের
ছেলেমেয়েরা, এমনকি বৌয়েরাও নাছোড়বান্দা হয়ে
পড়ল। হেনস্থা করার এক মোক্ষম সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কাকলিদিও বললেন, "আরে গাওই না।
সবাই যখন এতো করে বলছেন। আর এটা তো আর কোনো আসল বড়ো পোগ্রাম নয়। তাহলে নয় তুমি
গাইতে পারতে না। এটা তো জাস্ট খেলা। সবাই তোমার
গানের এতো প্রশংসা করছে, আমিও একটু শুনি। আমি তো এবার
প্রথম এলাম এই পিকনিকে। গাও, গাও।" এরপর সোনাইও বলে বসল," মা না গাইলে
আমিও গাইবো না।" বাধ্য হয়ে মানতেই হলো মৌসুমিকে। গানের লড়াই শুরু হতেই
কাকলিদি বুঝতে পারলেন, কেন এতোক্ষণ সবাই এতো প্রশংসা
করছিলেন। সত্যিই মা ও মেয়ের ধারেকাছে টেকা মুশকিল হচ্ছে সবার।
এদিকে কাকলিদির হেড়ে বেসুরো
গলার গান শুনে সবার মনে শুধু প্রশ্নই জাগলো না, ইতিউতি হাসি
মশকরাও শুরু হয়ে গেল আড়ালে আবডালে। কাকলিদি সবটাই দেখতে ও শুনতে পাচ্ছিলেন আর ততো
রাগে জ্বলছিলেন। মনে মনে পণ করলেন কিছুতেই হেরে গেলে চলবে না, ময়দান ছাড়া
যাবে না কিছুতেই। তাই তিনি যা জানেন না, তাও গাইতে
লাগলেন, হিন্দি, বাংলা, আধুনিক, ফিল্মি, অ্যালবামের
গান সবই। কিন্তু তিন রাউন্ডের পর হঠাৎই
মৌসুমির গান না মনে পড়ায় সে আউট হয়ে গেল। সবাই হতবাক হয়ে গেল। যদিও ততোক্ষণে আরো
অনেকেই আউট হয়ে গিয়ে কম্পিটিশন হচ্ছিল মূলত কাকলিদির সাথে সোনাইয়ের। শেষপর্যন্ত
বিজয়ী হলো সোনাই-ই। যদিও কাকলিদির বক্তব্য ছিল "ঘ" দিয়ে গান হয় না। আর
আবোলতাবোল গান তিনি গান না। শ্যামলবাবু আর মৌসুমি দুজনেই ওনাকেই কেন জানি সমর্থন
করলেন এবং তাই মেনে নিয়ে যৌথ বিজয়ী ঘোষণাও করতেও বাধ্য
হলেন উদ্যোক্তারা। কাকলিদি আর সোনাইকে যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করা হল। সোনাই কিছু বলার
আগেই ওর হয়ে সবাই খুব প্রতিবাদ করলো
এমন ভুল সিদ্ধান্তর। আর শ্যামলবাবু ও মৌসুমির প্রতিও অনর্থক সমর্থন করার জন্য
যথেষ্ট উষ্মা প্রকাশ করলেন সবাই। আর তার সাথেই সোনাইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করলেন
সক্কলেই। কাকলিদি অন্তত এই এক জায়গায় মৌসুমিকে হারাতে পেরে খুব খুশী মনে খেতে
বসলেন পাত পেড়ে রাতে। এমনকি তাঁর পুরস্কারের দাবিও জানিয়ে রাখলেন। এমন সময় শুনতে
পেলেন এক বৌদিভক্ত দেওর বলছে, "আচ্ছা মৌবৌদি, সত্যি বলোতো, তুমি গান
ভুলে গেছিলে? যার গানের এতো স্টক, সে গান ভুলে
গেল!" মৌসুমি কিছু বলার আগেই সোনাই বলে উঠল," আমি জানি, মা কেন গান
গাইল না আর, যাতে আমি জিতি। আমি তো মার গান
শুনেই শিখেছি, গান এতো ভালোবেসেছি। আজও মা যদি
সত্যিই গাইত, তাহলে আমি মায়ের কাছে হেরে
যেতাম। তাই না মা?" মৌসুমি আনন্দে সোনাইকে বুকে
জড়িয়ে ধরে বলল, "দূর, আমি কি তোর
মতো এখনকার গান এতো জানি? পুরোনো গান শুনে সবাই বোর হয়ে
যেত। আর তোর জেতাটাই যে আমার জেতা। আমার নিজের জয়ের স্বাদ এর কাছে অনেক ফিকে
রে।" দেওরটি বলে উঠল, " হুঁ, এবার বুঝলাম
সবটা। তবে বোঝার আরো কিছু বাকি আছে, যেটা সোনাই
বোঝেনি। কিন্তু আমরা সবাই বুঝেছি, আর শ্যামলদাও। সত্যিই বৌদি
এইজন্যই তোমায় এতো শ্রদ্ধা করি, ভালোলাগে তোমায় সবার। সবাই
তোমায় এতো ভালোবাসে।"
শ্যামল এতোক্ষণ ওদের সবকথা শুনছিল আর ভালোলাগার আবেশে আর
গর্বে বুকটা ভরে উঠছিল। মৌসুমি, " ওরেবাবা, যথেষ্ট হয়েছে, অনেক রাত
হয়েছে, চলো চলো খাওয়ার আয়োজন
করি।"
কাকলিদির সবটা শুনে যেন খিদেটাই মরে গেল। তিনি বুঝলেন, যে বাজি তিনি
জিতেছেন ভাবছিলেন এতোক্ষণ, সেই বাজিটাই তিনি গো হারান
হেরেছেন মৌসুমির কাছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন