- এই জগা! দে, দে। পুরোটাই দেড়শতে হয় কিনা দেখ।
- না বাবু! এটা হয় নাকি? তিনশো লাগবে।
- কেন !গত পরশু তো বড় মাছটা দিব্যি দিয়ে দিয়েছিলি!
- বাবু! আপনার সাথে এতদিনের সম্পর্ক কোনোদিন খারাপ মাল দিয়েছি?ওটা কম দামে ছেড়ে দিয়েছিলাম? গতবারের মাছটার ওজন কত ছিল?
- এক কেজি থেকে একটু বেশি। রতনবাবু বিরক্ত হয়ে জানালেন।
- তাহলে বুঝুন।আজকেরটা যে দুই কেজি। একেবারে দিশী। নিয়ে যান।
সত্যি! এত বড় কাতলা মাছ দেখে বেশ লোভ হচ্ছিলো রতন বাবুর। বাজারে এসে জগার দোকানে একবার প্রথমেই দাম জিজ্ঞাসা করে সারা বাজার ঘুরে রীতিমত দাম-দস্তুর করেই আবার ফিরে এসেছেন। আজ অন্য দোকানেও কাতলা মাছের দাম বেশ চড়া।দাম খুব খারাপ বলেনি জগা। তাও চাপ দিয়ে যতটা কমিয়ে নেওয়া যায়!
- আরে! রতন যে! কি নিলে?
রতন বাবু মহা ফ্যাসাদে পড়লেন। পাড়ার বয়স্ক লোক মোহন।তার থেকেও বড়,একবার দেখলে আর রক্ষা নেই।এর আগেরবার দেখা মাত্রই তার দেখে রাখা মাছ চোখের সামনে নিয়ে চলে গিয়েছিল।কিছু বলা যায়নি।রতনবাবু কাতলাটাকে একটু আড়াল করে দাঁড়ালেন।
- কি আর নেবো! খুব দাম।মনেহয় খালি হাতেই ফিরতে হবে। এক গাল হেসে রতন বাবু উত্তর দিলেন। দাঁত বের করে হেসে মোহন বাবু চলে গেলেন।
মাছওয়ালা জগন্নাথ, এখনও জুলুজুলু চোখে রতনবাবুর দিকে তাকিয়ে আছে।কখন মাছটা নেবে।আজ বেশি আনতে পারেনি।পুঁজিপত্তর কম।দুটো কাতলা,আর একটা রুই।সেই কোন সকালে উঠে বাওড় যেতে হলো।প্রায় তিন মাইল। ভোর চারটায় পৌঁছাতে হলো।এখন বেলা দশটা।খুব ক্লান্ত লাগছে আজ।বয়স হচ্ছে।তিন জন মেম্বার বাড়িতে।সবাই জোয়ান।অন্ন জোগানো যে কি কষ্ট ,যে করে সেই জানে।আর এই করোনা এসে ব্যবসা শেষ করে দিল।কবে আবার সব বন্ধ করে দেবে কে জানে। এখন বাড়ি বাড়ি মাছ পৌঁছে যাচ্ছে।বাজারে কেউ আসতেও চায়না।দাম পড়ে যাচ্ছে।আনা নেওয়ার খরচা বাদ দিয়ে যে টুকু লাভ,বাড়ি গিয়েই খতম।
"বাবু! নিয়ে নেন।এই লাস্ট মাছটা
বিক্রি করে বাড়ি মুখো হই।বাজার নিয়ে গেলে তবে বাড়িতে উনুন জ্বলবে।"
"দে।দে।আর জ্বালাস নে।তোদের এই এক কথা। লাভ কমে যাবে। তাই দুই পয়সাও কম নিবি না।"বিড়বিড় করে রতনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন।মনে মনে সন্দেহটা রয়েই গেলো।অনেক টাকা ঠকে গেলেন বোধহয়।
পকেট থেকে পাঁচশো টাকার কড়কড়ে নোট দিলেন।
"ভালো করে কেটে ধুয়ে ,পরিষ্কার করে দে।"
মাছটা প্যাকেট বন্দী হবার পর জগা চারখানা একশো টাকার নোট ফেরত দিল।রতনবাবু দু’বার
গুনলেন। বেশি মনে হলো।ফেরত দেওয়ার কথা একশো টাকা।
তাড়াতাড়ি আড়াল করেই পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটা
মারলেন।
বাড়ি ফিরে ব্যাগ রেখে রসিয়ে গিন্নিকে বলতে হবে।তারপর খাওয়ার টেবিলে সবাইকে বলবেন। যথা ভাবা,তথা কাজ।মাছটা খুব সুস্বাদু।সবাই প্রসংশা করলো।সঙ্গে সকাল বেলার কাহিনী বলতেই ডবল প্রশংসা। মেয়েটা একটু প্রতিবাদ করতেই,রতনবাবু বলে উঠলেন,"কোনোদিন বাজারে যাস?জানিস এরা কি রকমভাবে খদ্দেরের পকেট কাটে?"
যাক দু,দিন চলে যাবে।জগা বলেছিল - দাম তো বেশি বাবু। তাও প্রথমে চারশো বলে দিয়েছি,তাই দিয়েন।
কয়েকদিন জগাকে লুকিয়ে চলতে হবে।দেখলেই যদি ডেকে জিজ্ঞাস করে,তাহলেই লাভের গুড় পিঁপড়ে খাবে।
পাক্কা এক সপ্তাহ পর বাজারে এসে জগার গলিতে পা রাখলেন রতন
বাবু।জগা, না আবার ডাক দেয়।একটু লজ্জা
করতেও লাগলো। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলেন জগা নেই।অন্য
একটা ছেলে বসে আছে।তাড়াতাড়ি সবজির গলিতে ঢুকে বিনোদের
দোকানে আলু কিনতে কিনতে জিজ্ঞাসা করলেন, " জগা তো
কোনদিন বন্ধ করে না।কোথায় গেলো আজ?" মনে মনে ভাবলেন এই ফাঁকে জেনে নেওয়া যাবে জগা,বাজারে
সেইদিনের কথা কিছু বলেছে কিনা।
- "ও আর আসবেনা।দেখছেন না,ছেলে এসেছে।" বিনোদ জানালো।
- "কেনো! অন্য ব্যাবসা ধরলো?" রতনবাবু ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন।
- "না।এক সপ্তাহ হলো জগা মারা গেছে।প্রায় দু’বচ্ছর ক্যান্সার।ডাক্তার বলেছিল একবার বোম্বের টাটা হসপিটালে যেতে।বাজার কমিটি অনেকদিন ধরেই হেল্প করছিল।কত আর করবে!জগা ঘটি বাটি বেচে ওখানে যেতে পারবেনা।তাই গঙ্গায় ঝাঁপ দিল।দু’দিন পর বডি পাওয়া গেল।" বলতে বলতে বিনোদের গলা ধরে এলো।
- "কবে যেনো বললি?" রতনবাবু চিৎকার করে উঠলেন।
রতনবাবু মনে মনে হিসাব করে নিলেন।আজ সোমবার,তার মানে গত সপ্তাহের সোমবারে ঘটনাটা ঘটেছিলো।
- "কেনো এর মধ্যে বাজারে আসেননি? মঙ্গলবার বন্ধ ছিল বাজার।" বিনোদ এর কথায় রতনবাবুর সম্বিৎ ফিরে এলো।
তিনি তখন তেলে ঝলসে আয়েশ করে, চারশো টাকার মাছ মাত্র একশ টাকা দিয়ে খাচ্ছিলেন।
জীবনে প্রথমবার ভীষণভাবে ঠকে গেলেন রতনবাবু।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন