ঠাকুরবাড়ির পুলি - পায়েস - বাণী মিত্র


 সপরিবারে কবিগুরুর ভোজন

 

এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;
নতুন চালের রসে রৌদ্রে কত কাক
এ-পাড়ার বড়ো, মেজো, ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের
ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত

 

ঋতু বৈচিত্রে ভরা বঙ্গদেশে শীতকাল মানেই লেপমুড়ি দিয়ে আরামের ঘুম, রোদ্দুরের তাত গায়ে মেখে শিহরণ জাগানো রহস্য উপন্যাস পড়া এবং অবশ্যই নতুন পাটালির গন্ধ জড়ানো পিঠে পুলিতে কামড় বসানো। শীতকালের সাথে বাংলার পিঠে পুলি উৎসব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।  যতই মাছ-ভাত মোগলাই খাবার খাওয়া হোক না কেন , শেষপাতে আয়েশ করে পিঠে খেলে তবেই পেটে সয়! পিঠে খাওয়ার প্রতুল আয়োজন বাঙালির হেঁশেলে বহুযুগ ধরেই অব্যাহত। তা সে ভাপা , পাকানো  বা পুলি  – যে ধরণেরই হোক না কেন। চন্দ্রপুলি, গোকুল, চিতোই, চই, চুঙ্গা পিঠা, পাটিসাপটা, মুগের পুলি, দুধপুলি, চুষির পায়েস, সরু চাকলি,  অ্যাস্কেপিঠা, রসপুলি, গদাপিঠা, মোহনবাঁশি, ক্ষীরপুলি, মুগসামলি ইত্যাদি নানা স্বাদের পিঠা  ছাড়াও বিবিয়ানা, জামাই-ভুলানা


প্রভৃতি আরো হরেকরকম মনোহারী আঞ্চলিক পিঠের চল গোটা বঙ্গদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছেযা বঙ্গনারীর একটি অন্যতম হস্তশিল্পের নমুনাও বলা যায় সেই আবহমান কাল থেকে হেমন্তের শেষে অঘ্রাণের ফসল কাটার সময় এলে কাটা ফসলের গন্ধে নতুন চালের গন্ধ মিশে নবান্নের শাঁখ বেজে ওঠে ঘরে ঘরে। এই জন্যই মকর সংক্রান্তিতে অনেকে পিঠে সংক্রান্তি বা তিলুয়া সংক্রান্তি নামেও অভিহিত করেন। মকর সংক্রান্তির স্নানের সাথে সাথে এই সময় পৌষলক্ষ্মী পুজো, বনাই পুজো, আউনি-বাউনি  ব্রত, দধি সংক্রান্তির ব্রত প্রভৃতি পালন করা হয়। এই সমস্ত ব্রতের উপাচার রূপে পিঠে পুলির ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।


ঈশ্বর গুপ্তের ‘পৌষ পার্বণ’ কবিতায় পল্লীবাংলায় পৌষ পার্বণ ঘিরে যে আনন্দময় ছবি আঁকা আছে, কালের নিয়মে তা কিছুটা অন্যরকম হলেও, সাদা আলপনায়, পিঠেপুলি সাজিয়ে আজও সেখানে আহ্বান করা হয় পৌষলক্ষ্মীকে। শহরেও কমবেশি সব বাড়িতেই শীতে পিঠেপুলি হয়। সেখানে নতুন গৃহিনীদের এখন আর সে ভাবে মা ঠাকুমাদের কাছে পিঠে তৈরি শেখারও দরকার পড়ে না। মা ঠাকুমাদের জায়গা নিয়েছে আন্তর্জালের জগততাতে পিঠে পুলির মিষ্টত্ব এক বিন্দুও কমেনি।

 

বাংলা সাহিত্য ও শিল্পে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অবদান অনস্বীকার্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই পরিবার বাংলা তথা ভারতকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করে আসছে। শিল্পের তালিকায় রন্ধন শিল্পের ক্ষেত্রেও ঠাকুর পরিবারের অবদান দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঠাকুরবাড়ির খাবার প্রসঙ্গে কথা উঠলে কবিগুরুর প্রসঙ্গ ওঠা অবশ্যম্ভাবী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খাদ্য রসিক রূপেও পরিচিত মহলে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন লেখক – লেখিকাদের লেখায় এই বিষয়ে বহু তথ্য ও গল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। ঠাকুরবাড়িতে রান্না নিয়ে যেখানে রীতিমতো এক্সপেরিমেন্ট চলত, সেখানে পিঠে-পায়েস নিয়ে চলবে এ আর বিচিত্র কী! জোড়াসাঁকোর বাড়িতে পিঠে পায়েস সারা শীত জুড়ে হলেও পৌষপার্বণ উপলক্ষে সেটা আলাদা জায়গায় পৌঁছে যেত। সরলা দেবী লিখেছেন, ‘পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠে গড়া- সেটা একটা বিরাট অনুষ্ঠান।’  জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, পৌষ পার্বণে রাশীকৃত পিঠে গড়তে হত বলে সেদিন বৈচিত্র তত থাকত না। বেশিরভাগ হত রাঙা আলুর পুলি ও সেদ্ধ পিঠে। তবে নানা পিঠে তৈরির ব্যাপারে নানা জনের খ্যাতি ছিল। মৃণালিনী দেবী খুব ভালো চিঁড়ের পুলি করতে পারতেন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা চারুবালা দেবীর তৈরি দুধপুলি ছিল খুব সুস্বাদু।

ঠাকুর বাড়িতে ছেলেরাও এ সব কাজে পিছিয়ে ছিলেন না। তারাও নিত্যনতুন পরীক্ষায় মেতে উঠতেন।  একবার শীতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পায়েস রান্না করেছিলেন। কিন্তু সে পায়েস খেতে বসে সবাই চুপ। মহর্ষি সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, পায়েস কেমন হয়েছে। কেউ আর বলতে পারেন না। শেষে একজন বললেন, ভাল তবে একটু ধোঁয়ার গন্ধ।’ পায়েস একটু ধরে গিয়েছিল, এক্সপেরিমেন্টের ফল। কিন্তু মহর্ষি বললেন, পায়েসে একটু ধোঁয়াটে গন্ধই আমার পছন্দ। ঠাকুরবাড়ির পিঠের তালিকা চিত্রা দেবের লেখায় রয়েছে। নতুন পিঠের মধ্যে সেখানে রয়েছে, আঁদোসা, কচুর পিঠে, লাউয়ের পুলি, খইয়ের পুলি এইসব।  লীলা মজুমদারের “রান্নার বই”-এ পেঁয়াজ-পায়েসের উল্লেখ আছে। লীলা মজুমদারকে প্রথম খাইয়েছিলেন এবং তৈরির পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির পূর্ণিমা ঠাকুর

আজ সর্বজয়ার পঞ্চব্যঞ্জনে ঠাকুর বাড়ির কিছু পিঠে পুলির হদিস দেওয়া রইল।

 

কমল পুলিঃ



উপকরণঃ

১. খোয়া ক্ষীর – ১ কাপ

২. এলাচ গুঁড়ো – ১/২ চামচ

৩. চিনি – ২ কাপ

৪. দুধ – ২ কাপ

৫. নারকোল কোরা – ১ ১/২ কাপ

৬. ময়দা – ২ কাপ

৭. ঘী – প্রয়োজন অনুযায়ী

৮. জল – ৩ কাপ

 

প্রণালীঃ

১. খোয়া ক্ষীর, ১ চামচ চিনি ও এলাচ গুঁড়ো একসাথে ভালো করে মিহি করে মেখে নিয়ে ছোট ছোট বলের আকারে কেটে নিতে হবে।

২. চওড়া পাত্রে দুধ ভালো করে ফুটে উঠলে এর মধ্যে নারকোল কোরা ও ময়দা ধীরে ধীরে মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করে নিতে হবে।

৩. গরম থাকা অবস্থাতেই এই মণ্ডকে ভালো করে মেখে নিতে হবে। অল্প অল্প করে ঘী মিশিয়ে নরম করে মেখে, এর থেকে টুকরো কেটে নিয়ে বাটির আকৃতি বানিয়ে নিতে হবে।  

৪. এই বাটির মধ্যে একটা করে ক্ষীরের বল দিয়ে ভালো করে পাকিয়ে পুলি বানিয়ে নিতে হবে।

৫. কড়াইতে ঘী গরম করে হালকা আঁচে পুলি বাদামী করে ভেজে নিতে হবে।

৬. আলাদা করে জল ও চিনি মিশিয়ে এক সুতোর চিনির রস তৈরি করে নিতে হবে।

৭. এর মধ্যে পুলি দিয়ে ভালো করে রস মাখিয়ে ৫-৭ মিনিট রেখে পরিবেশন করতে হবে।

 

হেমকণার পায়েসঃ

 


উপকরণঃ

.  আমণ্ড বাদাম  - ১০০ গ্রাম
. খোয়াক্ষীর - ২টেবিল চামচ
. গোবিন্দভোগ চালের গুঁড়ো-  ১টেবিল চামচ
. দুধ - ১/২ লিটার
. এলাচ গুঁড়ো
. কেশর
. কনডেন্স মিল্ক
. চিনি (স্বাদ অনুযায়ী)

৯. কাজু বাদাম – ১০০ গ্রাম

১০. কিশমিশ – ২০ গ্রাম

১১. ঘি – ২ চামচ

 

প্রণালীঃ


১) বাদাম গুঁড়ো করে তাতে খোয়াক্ষীর আর চালের গুঁড়ো দিয়ে মিক্সিতে পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে।

২) এরপর ওই পেস্টটা থেকে গোল গোল আকারের বল তৈরি করে তাতে চালের গুঁড়ো মাখিয়ে নিতে হবে।

৩) গুঁড়ো দুধ মিশিয়ে পুরো দুধ ঘন করে তাতে এলাচ গুঁড়ো, চিনি, কেশর মিশিয়ে নিতে হবে

৪) এবার তৈরি করা বলগুলো দিয়ে হালকা ফুটিয়ে কনডেন্স মিল্ক মিশিয়ে নামিয়ে নিতে হবে

৫) তারপর ওপর দিয়ে বাদামকুচিপেস্তা কুচি দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে

 

পেঁয়াজের পায়েসঃ

 


উপকরণ:

১. দুধ -  ১.৫ লিটার
২. পেঁয়াজ - ৫টা মাঝারি মাপের বা ছোট পেঁয়াজ ১০ টা
৩. চিনি - ২০০ গ্রাম / কনডেন্স মিল্ক
৪. কাজু - ২৫ গ্রাম
৫. আমন্ড / কাঠ বাদাম - ২৫ গ্রাম
৬. পেস্তা - ২৫ গ্রাম
৭. খোয়া ক্ষীর - ৫০ গ্রাম
৮. কেওড়া জল - ১ চা চামচ
৯. গোলাপ জল - ১ চামচ
১০. গোলাপের তাজা পাপড়ি – ৮ / ১০ টা


প্রণালীঃ

১.  ছোট আকারের পেঁয়াজ গোটা বা মাঝারি আকারের পেঁয়াজ আধা করে নিয়ে জলে ফুটতে দিতে হবে। ফুটে গেলে জল ফেলে দিতে হবে। এটি চারবার করতে হবে। শেষবারে পেঁয়াজ জল দিয়ে ধুয়ে ওতে ১/২ চা চামচ গোলাপজল দিয়ে ফুটিয়ে জল ঝরিয়ে রেখে দিতে হবে।

২. এবারে দুধ ফুটিয়ে ১/২ লিটার করে নিতে হবে, এতে চিনি / কনডেন্স মিল্ক ও খোয়া ক্ষীর দিয়ে আরো কিছুক্ষন ফুটতে দিতে হবে। পরে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে

৩. এবারে ঘী দিয়ে পেঁয়াজ ভাজতে হবে। পেঁয়াজ স্বচ্ছ করে ভাজা হয়ে গেলে ঘন করা দুধে মিশিয়ে ফোটাতে হবে। তাতে গোলাপজল ও কেওড়াজল মিশিয়ে দিয়ে দিতে হবে

৪. এবার কাঠবাদাম,পেস্তা,  কাজুবাদাম ও গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন