পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় যে কোনও কাজের ক্ষেত্রে নারীর অবদানকে বরাবরই অবহেলা করা হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে কোনও কর্মকাণ্ডের ইতিহাস রচনায় পুরুষের উপস্থিতি যত সদর্পে ঘোষিত হয়, নারী ঠিক ততধিক মাত্রাতেই উপেক্ষিতা রয়ে যায়। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলে জানা যাবে সীমিত সুযোগ – সুবিধা ও বহুবিধ শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও নারী নিজ গৌরবে প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই সমস্ত বাধা অতিক্রম করে স্বমহিমায় নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছে। তাও বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইতিহাস তাঁদের অবদান উপেক্ষা করেছে, উজ্জ্বল করেছে পুরুষের ভূমিকাকে।কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর চেয়ে কম অবদান রেখেও হয়েছে পুরস্কৃত, মহিমান্বিত।কালে কালে ইতিহাস পুরুষকেই চিনেছে, জেনেছে, স্মরণ করেছে। নারী হারিয়ে গেছে অতীতের ধুলোধূসরিত অন্ধকারে। নারীর অবদান স্বীকৃত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীর একজন সাহায্যকারী বা উৎসাহদাত্রী হিসেবে। বহু নারীর নেতৃত্বে বড় বড় কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলেও, মূল্যায়ন তো দুরের কথা মুছে দেওয়া হয়েছে তাঁর নাম। তেমনই অতীতের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক নারী হলেন ফাতিমা বেগম – ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের প্রথম নারী পরিচালক।
সভ্যতার অগ্রগতিতে
সবচেয়ে রঙিন অধ্যায় সম্ভবত চলচ্চিত্র শিল্পের উদ্ভাবন। এর সূচনাকাল উনিশ শতকের
সূচনাতেই। ১৮২৫ সালে ফ্রান্সের পারিতে লুই ও
অগুস্তু লুমিয়ের-এর প্রথম সিনেমাটোগ্রাফ প্রদর্শিত হয়।তারপরেই চলচ্চিত্র শিল্পের জয়ধ্বজা ওড়া শুরু। ভারতের
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রাথমিক পর্বে নারীরা ব্রাত্য ছিলেন। ধীরে ধীরে যুগ বদলের
সাথে সাথে পরিস্থিতিরও বদল ঘটে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে নারীর প্রবেশ ঘটে।
প্রায় একশো বছরের ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সমস্ত ছুঁৎমার্গ
ভেঙে ভারতীয় চলচ্চিত্রে বর্তমান নারী পরিচালকদের ভিত
গড়ে দিয়েছিলেন যিনি, তাঁকে মনে রাখেনি কেউই।তাই পাওয়া
যায়না তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও।তিনি হলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম নারী পরিচালক
– ফতিমা বেগম।
পারিবারিক ইতিহাসঃ
ফাতিমার তিন কন্যা
তিনি হুমায়ূন ধনরাজগীর ও দুরেশ্বরশ্বর ধনরাজগীরের দিদিমা ছিলেন। তিনি মডেল রিয়া পিল্লাইয়ের প্রপিতামহী ছিলেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
ভারতীয় চলচ্চিত্রে মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ফাতিমার অবদান অনেক। চলচ্চিত্রে অভিনয় এবং পরিচালনা করে মহিলাদের শুধুমাত্র জীবিকা গড়ে তোলার নতুন দিশাই তিনি দেখাননি, ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর জড়তাও কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেন।
সেযুগে ভারতীয় চলচ্চিত্রে নারীর
প্রবেশাধিকার ছিল না।। পুরুষরাই নারীর বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে অভিনয় করতেন। অত্যন্ত প্রয়োজনে
গুটি কয়েক নারী অভিনয়ের জগতে প্রবেশ করলেও সামাজিকভাবে তাঁদের বহিষ্কার করা হত। সেই
পরিস্থিতিতেই অল্প কয়েকজন নারী শিল্পীর মধ্যে অন্যতমারূপে অবস্থান করতেন ফাতিমা বেগম।
তিনি শুধু অভিনয়েই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি।দুঃসাহসে ভর করে তিনি হাতে ক্যামেরাও তুলে নিয়েছিলেন। মাত্র চার বছরের চলচ্চিত্র জীবনে তিনি নির্বাক চলচ্চিত্রের নায়িকা থেকে পরিচালনায় হাত দেন। এর পাশাপাশি অবশ্য অভিনয়ও করতেন।
তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন উর্দু মঞ্চে। পরে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। তাঁর অভিনীত
প্রথম চলচ্চিত্র ছিল আর আরদেশির ইরানি পরিচালিত “বীর অভিমন্যু” (১৯২২)। তিনি তার
আত্মপ্রকাশ করেই হয়ে উঠেছিলেন বিশাল
এক নারী তারকা। ফাতিমা বেগম অত্যন্ত ফর্সা ছিলেন এবং গাঢ়
মেক-আপ করতেন। তার এই মেক-আপ সাদা- কালো চলচ্চিত্রের
জন্য খুব উপযুক্ত প্রমাণিত হয়।ফলে চলচ্চিত্র জগতে তাঁর জনপ্রিয়তা
বৃদ্ধি পায়। তাঁর থেকেই এই ধরণের মেক-আপের প্রচলন শুরু হয়।
অভিনয়
শুরুর চারবছর পর ১৯২৬ সালে তিনি ‘ফাতিমা ফিল্মস’ গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে ১৯২৮
সালে “ভিক্টোরিয়া ফাতিমা ফিল্মস” নামে
পরিচিত হয়।ফাতিমা বেগম রূপকথাধর্মী কাল্পনিক চলচ্চিত্রের নতুন ধারার অগ্রগামী
ছিলেন। তাঁর ছবিতেই প্রথম ট্রিক ফটোগ্রাফি এবং স্পেশাল এফেক্ট বিপুলভাবে ব্যবহৃত হতে
থাকে। তিনি কোহিনুর স্টুডিও ও ইম্পিরিয়াল স্টুডিওতে নিয়মিত অভিনেত্রী ছিলেন। তিনি নিজে
অভিনয়ের সাথে সাথে পরিচালনা, চিত্রনাট্য রচনা ও প্রযোজনা করতেন।
তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘বুলবুল-এ পারিস্তান’। সুপারহিট এই চলচ্চিত্র ছিল প্রথম দেশীয় চলচ্চিত্র যেখানে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছিল। তখনকার যুগে আর্থিক দিক থেকে
উচ্চ বাজেটের চলচ্চিত্র ছিল
এটি। প্রচুর স্পেশ্যাল এফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছিল। এর আগে আর কোনও চলচ্চিত্রে
এত স্পেশ্যাল এফেক্ট
ব্যবহার করা হয়নি।
এর পর ১৯২৯ সালে ‘গডেস অব লাক’ নামে একটি চলচ্চিত্রও তিনি পরিচালনা করেন। ১৯৩৮ সালের ‘দুনিয়া ক্যায়া হ্যায়?’ ছিল তাঁর শেষ অভিনীত চলচ্চিত্র।
ফাতিমা বেগম তাঁর অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন অনেকটাই দেরিতে। তিনি অভিনয় শুরু করার আগে তাঁর তিন মেয়ে নির্বাক চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম ফিল্ম ‘বীর অভিমন্যু’-তে তাঁর সঙ্গে তাঁর তিন মেয়েকেও স্ক্রিন শেয়ার করতে দেখা যায়।কোনও পরিবারের সমস্ত সদস্যই একসঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করছেন চলচ্চিত্র ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম ঘটনা ।
১৯৮৩ সালে ৯১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুশয্যায় তাঁর মেয়ে জুবেইদা তাঁর পাশে ছিলেন।জুবেইদা ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র “আলাম আরা” -র নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন।
চিত্রসৌজন্যঃ আন্তরজাল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন