ওল্ড ইজ গোল্ড - তপন তরফদার





আমরা বলে থাকি কিন্তু মন থকে কি বুড়ো হাবড়াদের মানুষের পর্যায়ে মনে করি? না করলেও ওদের দেখানো পথ থেকে সরে আসতে পারিনা  সেই পুরানো পন্থায়। অনেক ক্লাব এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়। সফলও হয়। ওই রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী এক সাথেই পালন করে - নিজেরা সংস্কৃতির কত গভীরের ধারক ও বাহক তার প্রমাণ করে। যা হয় তাই হচ্ছে। এই রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায়, পাড়ার পৃথুলা মাসিমা পারমিতা লালপাড় তসরের শাড়ি, ঘিয়ে রঙের হাতকাটা ব্লাউজ, শ্যাম্পু করা কোঁকড়ানো চুল উড়িয়ে গেয়ে চলেছেন –


আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, আমারে দেবালয়ের প্রদীপ কর......।

এই সঙ্গীত সন্ধ্যায়। যা হয় তাই হচ্ছে। অনেক শ্রোতারা গান শুনতে এসেও ওদের কান গানটাকে মেশিনগান মনে করে  কি সব আজেবাজে গাইছে বল নিজেদের জীবনের সমস্যার গান কানে কানে গেয়ে চলে। অনেক প্রবীণ  শ্রোতা অবশ্য ব্যতিক্রমী। যেমন ওই দ্বিজপদ স্যার ও স্বপন স্যার। দুজনেই আজকের অনুষ্ঠানের মান্যগণ্য বোদ্ধা দর্শক। দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। দুজনেরই সাহিত্য - সংস্কৃতি অন্ত প্রাণ। সারাজীবন ধরে যত পেরেছেন বই কিনেছেন।

বটতলা ক্লাবের অনুষ্ঠানের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান অতিথিদের বক্তব্য শেষ হয়ে এই গানা-বাজনা, নৃত্য-নাট্য শুরু হয়েছে। পারমিতার গানের ঝর্নাধারা কলকল গতিতে এগিয়ে চলেছে। মানুষ দ্বিজপদ-স্বপনের বাক্য বিনিময় চলছে নীচু স্কেলে।

দ্বিজপদ স্যার বললেন – আমার গীতবিতানটা একটু উইয়ে খেয়ে নিয়েছে।

 স্বপন স্যার বলেন – “ আর পারিনা আমারটাও টেষ্ট করেছে তার থেকেও বেশি  বিপত্তি কি হয়েছে জানো - মল্লিকা - আমার পুত্রবধু ফরমান দিয়েছে ওই বইয়ের জঞ্জাল রাখা চলবে না। সব মার ঝাড়ু মার ঝেঁটিয়ে বিদায় কর! এখন কি করি বলতো ! অত সুন্দর সুন্দর মূল্যবান  বই সব ঝেঁটিয়ে বিদায় করবো?”

 দ্বিজপদ স্যার বলেন –“ আমার অবস্থা তোমার মতোই। আমার সব বই চিলেকোঠার ঘরে তুলে দিয়েছে। খুব খারাপ লাগছে - সব বই নষ্ট হয়ে যাবে

যা হয় তাই হচ্ছে। জ্যৈষ্ঠের জ্যাঠা গরমে গলায় মধু ঢেলে চোখ বুজে ভাবে বিভোর হয়ে পারমিতা মাসিমা মনে মনে ভাবছেন সব শ্রোতাদেরই সুরের জালে আষ্টেপৃষ্ঠেই বেঁধে ফেলেছে, নিশ্চিত মধুভরা গলার গান উপোভোগ করে দর্শকরা বুঁদ হয়ে গেছে

এই সব ক্ষেত্রে যা হয় তাই হচ্ছে। বটতলা ক্লাব শ্রোতাদের আপ্যায়নের জন্য লাল চা, থিন অ্যারারুট বিস্কুট বিশেষ করে সামনের সারির  নীল-সাদা কাপড় পরানো চেয়ারে যারা বসার সুযোগ পেয়েছে তাদের পল্টু আর ঘোঁতন দুজনে মিলে চা-বিস্কুট বিলোচ্ছে। ঘোঁতনের কানে বাদুড়ের মত অতি সূক্ষ্ম  শব্দকনাও কানের রাডারে ধরা পড়ে যায়। ঘোঁতন বলে – জ্যেঠু, বইগুলো লাইব্রেরীতে দান করে দিন না।

যা হয় তাই হল। প্রবীণ দুজনের মুখেই তৃপ্তির হাসি সানন্দে বলেঅতি উত্তম প্রস্তাব।

বইগুলো প্রাণ পাবে। তার সঙ্গে মহান দাতা হিসাবে পরিচিতি হলেও হতে পারে ওই একটি  বিষয়ে সবাই  এক  , সবাই  চায়   “নাম হবে।

এবার কিন্তু যা হয় তাই হল না অর্থাৎ দ্বিজপদ ও স্বপনের মনের মত হল না। এই গোবিন্দপুর মফঃস্বলে চারটে লাইব্রেরি ছিল। তিনটে সাত বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে - তালা খোলার লোকই নেই। জগদানন্দ স্মৃতি পাঠাগারের তালা খোলা হয় - সামান্য কয়েকজন ওই দৈনিক সংবাদপত্র পড়তে আসে। লাইব্রেরিয়ান প্রমথকে লাইব্রেরিতে বইদান করার কথা বলতেই গম্ভীর গলায় প্রমথ বলে - বই রাখার কোন জায়গাই নেই। এখন সবাই ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে সেখানে ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে থাকার জায়গাই অপ্রতুল - বাবাকে রাখতে পারেনা বই তো দূরের বস্তু। এখন চালু লোকেরা পুরানো বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে আর ছেলে মেয়ের পড়ার বই ছাড়া সব বই লাইব্রেরিতে চালান করে দিয়ে তথাকথিত দাতা হয়ে মহান কাজ করছে। আমি সামনের মাসে রিটায়ার করব। আমার বদলে এখনো কোন লোক ঠিক হয়নি। শোনা যাচ্ছে সরকার ওই লাইব্রেরিয়ান পদটাই তুলে দেবে

স্বপনের স্বপ্ন ভঙ্গ হল। দ্বিজপদর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে পূর্ণজন্ম পেল। এ সমাজের কি হবে - যখন ভাবনা চিন্তায় মশগুল ওই সময়ে যা হয় তাই হল। সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রায় যা হয় একজনের আবির্ভাব হয় - যে মহাসংকটের থেকে মুক্ত করে মহা আনন্দের দরজা খুলে দেয়। ওখানে যা হয় এখানেও তাই হল। পাড়ার ঘোঁতন আর পল্টু দ্বিজপদ স্যারকে বলে - সুন্দরবনের কুলতলীতে বনবিবি গ্রন্থাগারে আপনার বইগুলো দিয়ে আসব। ওরা আপনার বইগুলো কাঁচের আলমারিতে রাখবে - আলমারির উপর দাতা হিসাবে আপনার নাম ঠিকানা জ্বলজ্বল করবে। দাতা দ্বিজপদ বেলুনের মত ফুলে উঠলো বইতো দিলই সঙ্গে ওদের হাতে রাহা খরচ বাবদ কিছু টাকাও গুঁজে দিল

যা হয় তাই হল। ঠিক তিন মাসের মাথায় অস্কার ওয়াইল্ডের গল্পটার কথা মনে পড়ে গেল। গল্পটা নাতনিকে বোঝাতে হবে গল্পটা ঝালিয়ে নিতে হবে তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাওয়ার মত মনের অবস্থা হয়ে গেল। দ্বিজপদ স্যার  লজ্জায় কাউকে কিছু না বলে কলেজ স্ট্রিটে ঢুঁ মারলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটে ঢোকার বাঁ দিকেই রতন বিশ্বাসের পুরানো বইয়ের দোকান। দ্বিজপদ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে গেলেনঅস্কার ওয়াইল্ডের …”। চোখ চলে যায় সাজানো র‍্যাকের দ্বিতীয় থাকে। বইটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। রতন বইটা দ্বিজপদর হাতে দেয়। দ্বিজপদ বইটা খুলেই দেখে সেই সবুজ কালি দিয়ে লেখা ‘শুভ উপবীতধারী প্রিয় ছাত্র দ্বিজপদকে, -  -সুনির্মল চক্রবর্তী’ - সই এর নিচে রাবার স্টাম্প মারা “প্রধান শিক্ষক, বেনাচিতি হাইস্কুল”

দ্বিজপদর মুখের পট পরিবর্তন দেখে যা হয় তাই হল। অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া বিক্রেতা বলে – ওল্ড ইজ গোল্ড

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন