শেষটুকু বোঝা দায় - সন্দীপ মুখোপাধ্যায়

 


দিলীপ প্রেমে পড়লো। বেশ ভালো রকম ভাবে। মুশকিল হল, মেয়েটি জানেই না সে কথা। দিলীপ বেঁটে। ভয়ানক বেঁটে। মেয়েটি তার থেকে অল্প লম্বা। বন্ধুরা দিলীপ কে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো, 'এই প্রেমেতে লাভ নেই, মেয়েরা তার চেয়ে উচ্চতায় ছোট ছেলে পছন্দ করবে না। তার উপর তুই সেরকম কিছু করিস না। একটা চাকরি কর অন্তত, তাহলেও নয় আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করতে পারি'মেয়েটা মাধ্যমিক পাশ দিয়েছে। দিলীপ শুধু সপ্তম। এইভাবে হয়? কোন দিক থেকেই খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না কিন্তু দিলীপ সে সব কথা শুনলে তো? তার জেদ। সে মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেবেই। এই সরস্বতী পূজাতেই দেবে

 

মেয়েটির নাম লক্ষ্মী। নাম সার্থক। সে সত্যি খুব লক্ষ্মী মেয়ে। তার বাবা গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। মেয়ে কে খুব বেশি পড়াশুনো করাতে পারেন নি, খুব ছোট বয়সে লক্ষ্মীর মা মারা যাওয়ায়

 

সেদিন সরস্বতী পূজা। বন্ধুরা বারণ করা সত্ত্বেও দিলীপ সকাল সকাল পাঞ্জাবী আর পাজামা পরে লক্ষ্মীদের পাড়ার পূজাতে রওনা দিলো। দিলীপ কে কোনভাবেই একা ছাড়া যাবে না। সেই জন্য সঙ্গে তার বিশেষ বন্ধুরাও রইলো।অঞ্জলি শুরু হবেদিলীপ এতক্ষণ একদম পিছনের দিকের একটি আসনে বসে ছিল। লক্ষ্মী যেই হাতে ফুল পাতা নিয়ে অঞ্জলি দিতে এগোল, দিলীপ তার খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে গেলো। অঞ্জলি আগে দিয়ে নিক। তারপরে সাহস করে বলে ফেলবে সে। অনেক ভিড়ের মধ্যে দিলীপ লক্ষ্য করে কিছু ফুল পাতা লক্ষ্মীর দিকেও ছুঁড়ে দিয়েছিল। তা লক্ষ্মী টের পায়নি। পাওয়ার কথাও না

 

পূজা শেষ হল। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে প্রসাদ খাচ্ছে। লক্ষ্মী তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে এক ধারে বসে আছে। কম কথা বলে সে। বেশি হাসে। দিলীপ নজর রেখেছে। যেই না লক্ষ্মীর বন্ধুরা এদিক ওদিক ছিটিয়ে যাবে, এগিয়ে যাবে দিলীপ। সবার সামনে মনের কথা বলা যায়?

 

তুমি লক্ষ্মী তো? আমি দিলীপ। পাশের গ্রামে থাকি। দেখি তোমায় স্কুল যেতে রোজ। তুমি দেখনি আমায়?” লক্ষ্মী চুপ করে তাকিয়ে আছে, কোন কথা বলছে না। মুখ গম্ভীর। পাশে অল্প বিস্তর ঢাকের আওয়াজ হচ্ছে

 

দিলীপ আবার বলে “ তোমার নাম লক্ষ্মী তো? আমি দিলীপ। আমি তোমায় কিছু বলতে চাই লক্ষ্মী। বলবো? তুমি রেগে যাবে না তো?”

 

লক্ষ্মী একরকম ভাবলেশ হীন মুখ করেই বসে আছে। খুব যত্ন করে ফল খাচ্ছে। এবার একটু রাগ হল দিলীপের। হতে পারে সে বেঁটে, হতে পারে সেভেন পাশ। তাই বলে উত্তর করা যায় না একটা?

 

“ তুমি উত্তর করছ না কেন? লক্ষ্মী আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমায় খুউউব খুব ভালো লাগে আমার। তুমি আমার বন্ধু হবে? হবে বন্ধু?”

 

এইবার লক্ষ্মী হি হি করে হেসে ওঠে। সে একটা বাসন্তী রঙের শাড়ী পরে এসেছে। কি মিষ্টি যে লাগছে। দুটো বিনুনি করেছে। মাথায় একটা কালো রঙের টিপ। দিলীপ এইবার খুশি হয়। হেসেছে মানে তার মনে ধরেছে এই কথাটা। সে জানে লক্ষ্মী কম কথা বলে, কিন্তু সে যে এতো লাজুক কে বলবে। 

 

“হবে বন্ধু? হবে? লক্ষ্মী, বন্ধু হবে আমারযাবে আমার সাথে? যাবে? আমার গ্রামে যাবে? যাবে?”

 

লক্ষ্মী হাতের ফলের না খাওয়া অংশ গুলো নিয়ে খুব যত্ন করে উঠলো নিজের জায়গা থেকে। সেগুলো কে একটা কোনে রাখল। শাড়িটা একটু ঠিক করে নিলো। এইবার মস্ত জোর গলায় মিতা ও মিতা, একবারটি আসবি এদিকে বলে তার এক বন্ধুকে ডাকল। মিতা দৌড়ে এলো। দিলীপ দাঁড়িয়ে। বহুবার প্রশ্ন করেও সে কোন উত্তর পায়নি। ভারি দুঃখ পেয়েছে সে। মনটাও খারাপ লাগছে। 

 

“ মিতা এই ছেলেটা অনেক ক্ষণ ধরে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছিলো। তুই ওকে উত্তর দিয়ে দিবি শুনে একটু?” এই বলে লক্ষ্মী দিলীপের দিকে তাকিয়ে  দাদা, তুমি ওকে বলো কি জিজ্ঞেস করবে।ও উত্তর করবে” 

 

দিলীপ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে। এতো দেমাক? তার বন্ধুকে ডেকে বলছে উত্তর করতে। এত চেঁচিয়ে বলাতেও সে বলছে আবার বলতে। 

 

“ না থাক লক্ষ্মী। আমি চলি। তোমার উত্তর পাওয়া হয়ে গেছে আমার” এই বলে দিলীপ হাঁটা দিলো। 

“ দাদা, দাদা, লক্ষ্মী জন্ম কালা। শোনে না কিছুই। অল্প অল্প মুখের নাড়াচাড়া দেখে বুঝতে পারে। আপনি ওকে কি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমায় করতে পারেন আমি ওকে বোঝাতে পারবো।“ 

 

দিলীপ থমকে গেলো। কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। দ্রুত বেগে সে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। লক্ষ্মীর বন্ধুর এই কথা শুনে স্থির হল। নিজেকে গুছিয়ে নিলো একটু। চোখের কোণে যে অল্প জল এসেছিল তা নিমেষের মধ্যে মুছে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল দিলীপ, মিতার দিকে তাকিয়ে বলল 

 

“ ওকে জিজ্ঞেস করো, ও আমাকে বিয়ে করবে? আমার ওকে ভারি ভালো লাগে। ও রাজি হলে আমি ওড় বাবার সাথে কথা বলবো” 

 

মিতা নামের মেয়েটি সেদিন লক্ষ্মীকে এই প্রশ্ন করেছিলো কিনা জানা নেই। করে থাকলেও, লক্ষ্মী কি উত্তর করেছিলো, আমরা জানি না। শুধু লক্ষ্মীর গ্রামে কান পাতলে শোনা যায়, লক্ষ্মীর যমজ বাচ্চা হয়েছিলো এই ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পরে। তাদের দুজনেই সম্পূর্ণ ভাবে শুনতে পায়। কিন্তু ডাক্তারের একটাই চিন্তা। বয়স অনুপাতে উচ্চতা বাড়ছে না একদম।    

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন