দুনিয়াটা প্রেমের বশ। প্রেম দিয়ে জয় করা যায় জগৎটাকে। 'প্রেম' শব্দটি খুব ছোট হলেও এর মধ্যে নিহিত রয়েছে অসীম শক্তি। হাতিয়ার দিয়ে যা সম্ভব নয়, তা প্রেম দিয়ে সম্ভব। ভালোবাসাই পারে মনের যত মলিনতা সব দূর করে মনকে পবিত্র বন্ধনে বাঁধতে। প্রাচীনকাল থেকে প্রেমের সাধনায় মানুষ যেমন জীবনকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছে, তেমনি আবার প্রেমের মানুষকে না পাওয়ার জন্য জীবনকে অবলীলায় বিসর্জন দিয়েছে। সত্য যুগ থেকে শুরু করে কলি যুগ পর্যন্ত প্রেমই জীবনের সত্য হয়ে উঠেছে। সত্য যুগের লক্ষী-নারায়ণ, ক্রেতা যুগের রাম-সীতা, দ্বাপর যুগের রাধা-কৃষ্ণ ও কলিযুগের প্রেমের ঠাকুর চৈতন্যদেব জগৎবাসীকে বড় শিক্ষা দান করেছেন। সকলেই সবকিছুর উর্ধ্বে ভালোবাসা বা প্রেমকে রেখেছেন। প্রেমধন বিতরণ করেছেন জগৎবাসীকে। মারামারি হিংসা-বিদ্বেষ নয়, প্রেমই পারে সকল অবস্থায় সকল সম্পর্ককে অটুট রাখতে। তাই কোনো একটি বিশেষ দিনকে 'প্রেম দিবস' হিসেবে গ্রহণ করা ঠিক নয়। প্রতিটা দিনই মানুষ চাইলে প্রেমের দিবস হিসেবে গণ্য হতে পারে। তবুও ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিনটির কথা উঠলে প্রেমের দিবসের কথা মনে পড়ে। সুপ্ত প্রেমগুলি সব জেগে উঠে। না বলা কথা প্রকাশ করার জন্য মন আঁকুপাঁকু করে। সারা বছর মোবাইল, চিঠি আরো অনেক মাধ্যমে প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেও এই দিনটিতে সকলেই স্বশরীরে বিভিন্ন মজাদার অনুভূতির সঙ্গে কাটাতে চান।
Saint Valentine, depicted in an 1853 engraving by Cibera. Credit: Alamy
১৪ই ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে সঙ্গে 'ভ্যালেন্টাইন্স ডে'ও বলা হয়। এটি একটি বার্ষিক উৎসবের দিন। যে দিনটি ভালোবাসা ও অনুরাগের মধ্য দিয়ে সকলে কাটান। প্রথমদিকে এটি সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক একজন শহীদ খ্রিস্টান পাদ্রীকে সম্মান জানাতে খ্রিস্ট ধর্মের মানুষরা উৎসব পালন করতেন। পরবর্তীকালে লোক ঐতিহ্যের ছোঁয়ার মধ্যে দিয়ে এটি বিভিন্ন দেশে ধীরে ধীরে প্রেম ও ভালবাসার সংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক একটি আনুষ্ঠানিক দিবসে পরিণত হয়। তবে পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ এই দিনটিকে 'প্রেম দিবস' হিসেবে গ্রহণ করেননি। সেখানে 'ভ্যালেন্টাইন্স ডে' পালন করাও নিষিদ্ধ। যুব সমাজকে পশ্চিমা সংস্কৃতির কুপ্রভাব থেকে রক্ষার্থে ২০০৮ সালে ভালোবাসা দিবস নিষিদ্ধ করে ইরান। ২০১৭ সালে এই দিবসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় পাকিস্তানে। এছাড়াও এই দিবসটিকে পালনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, সৌদি আরব ও কাতারে। তবে ইউরোপের সংস্কৃতিকে বরাবরের মতো গ্রহণ করে সমগ্র ভারতবর্ষে ১৪ই ফেব্রুয়ারি 'ভ্যালেন্টাইনস ডে' বা 'প্রেম দিবস' হিসেবে গ্রহণ করা হয়। প্রতিটি শহরের ও গ্রামের যুবক-যুবতীদের মধ্যে এই দিনটি নিয়ে উন্মাদনা অনেক বেশি। তবে অন্য বয়সের মানুষের মধ্যেও যে একেবারে উত্তেজনা দেখা যায় না, তা কিন্তু নয়।
ইউরোপ মহাদেশের প্রায় সমস্ত দেশে এই দিনটি খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হয়। রাষ্ট্রীয় ছুটিও থাকে। ইংরেজি নতুন বছরের রেশটাকে ধরে এই দিনটি তাদের আবালবৃদ্ধবণিতার কাছে আরো রঙিন হয়ে ওঠে।পার্কে,রাস্তায়,অলিতে-গলিতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভিড় উপচে পড়ে। ভারতবর্ষেও এই ছবি খুব একটা কম দেখা মেলে না।
গোলাপ ফুল এই দিনটিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সহজলভ্য গোলাপ ফুলের বাজার সেদিন অগ্নিমূল্য থাকে। পঞ্চাশ থেকে একশো টাকাও কোথাও কোথাও প্রতি পিস গোলাপ বিক্রি হয়। ভালোবাসার মানুষকে সেই টাকা দিয়েও গোলাপ ফুল দিতে কার্পণ্য করেন না প্রেমিক- প্রেমিকারা।
শুধু ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিনটি নয়, সারা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই ভালোবাসার মানুষদের ভালোবাসার লেনদেন চলতে থাকে। প্রথম শুরু হয় ৭ই ফেব্রুয়ারি দিনটি দিয়ে। এই দিনটিকে বলা হয় 'রোজ ডে'। এই দিনই প্রথম 'প্রেম দিবস'-এর আগে প্রেমিক-প্রেমিকারা গোলাপ ফুল দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করেন। ভালবাসার প্রতীক হিসেবে লাল গোলাপ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একগুচ্ছ গোলাপ দিয়ে ভালোবাসার কথা স্বীকার করা, এক অসাধারণ অনুভূতি সৃষ্টি করে প্রেমিক- প্রেমিকার মধ্যে। তবে সবাই যে লাল গোলাপ দেন, তা কিন্তু নয়। অনেকে পছন্দ মতো নীল, হলুদ, বেগুনি গোলাপ ফুলও দিয়ে থাকেন। গোলাপের বাজার দর সারা ফেব্রুয়ারি জুড়েই বেশ চড়া থাকে।
৭ই ফেব্রুয়ারির পর ৮ই ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বলা হয় 'প্রপোজ ডে' বা 'প্রস্তাব দিবস'। নতুন ভালবাসার সূত্রপাত এই দিনেই। এই দিনে দুচোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে যুবক-যুবতীরা একে অপরকে প্রপোজ করেন। তবে সবার প্রস্তাবই যে গ্রহণ করা হয়, এমন কিন্তু নয়। ৯ই ফেব্রুয়ারি 'চকলেট ডে'। এই দিনে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য প্রেমিক-প্রেমিকেরা একে অপরকে চকলেট উপহার দেন। বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু চকলেট বাজারে পাওয়া যায়। এই চকলেট শরীরে শক্তি প্রদান করে। ১০ই ফেব্রুয়ারি 'টেডি ডে'। বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর টেডি উপহারস্বরূপ দান করে একে অপরের মনে ভালোবাসার বন্ধনকে আরো মজবুত করেন। এই দিনের সুযোগে একশ্রেণীর দোকানদাররা খুব ভালো বেচাকেনা করেন। যুবক-যুবতীরা অর্থের দিকে না তাকিয়ে প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে টেডি কেনেন।
এরপর ১১ই ফেব্রুয়ারি আসে 'প্রমিস ডে', অর্থাৎ 'কথা দেওয়ার দিন'। এই পৃথিবীতে যদিও কথা দিয়ে কেউ কথা রাখে না, তবুও কথা না রাখার বিষয় এই দিনটার জন্য ভুলে যায় প্রিয় মানুষেরা। তারা একে অপরকে সারা জীবন একসাথে হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলার কথা দেন। কথা দেওয়ার গুরুত্বটা এই দিন সকলেই অনুভব করেন। ১২ই ফেব্রুয়ারি দিনটি প্রেমিক- প্রেমিকার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটাকে বলা হয় 'কিস ডে'। আগেকার ভালোবাসার সঙ্গে বর্তমানের ভালোবাসার এক বিরাট ব্যবধান। এখনকার প্রেমিক- প্রেমিকারা আর চোখে চোখ রেখে লজ্জার প্রেম করে না। সবকিছুতেই তারা খোলামেলা। ইউরোপের সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে একে অপরকে কিসের মধ্যে দিয়ে দিনটি পালন করার চেষ্টা করেন। তবে আমাদের দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপের দেশগুলিতে এই দিনগুলি খুবই নিয়মের সাথে পালিত হয়।
১৩ই ফেব্রুয়ারি 'হাগ ডে' অর্থাৎ 'আলিঙ্গন দিবস'। প্রেমিক-প্রেমিকারা বিভিন্ন পার্কে এই দিনটিতে ঘুরতে যান। একে অপরকে আলিঙ্গন করে ভালোবাসার সম্পর্ককে আরও মজবুত করেন। এখনকার দিনে দৈহিক সম্পর্ক ছাড়া কোনো প্রেমই গাঢ় প্রেমে পরিণত হয় না। একে অপরের প্রতি তেমন টানও থাকে না।
এরপর আসে সেই বহু প্রতীক্ষিত 'ভ্যালেন্টাইন্স ডে,' অর্থাৎ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। প্রেমের দিবস হিসাবে সমগ্র পৃথিবীর সাথে সাথে বাঙালিরাও পালন করেন। ভালোবাসা বিনিময় করা হয় লাল গোলাপের সাথে সাথে বিভিন্ন কার্ড, চকলেট ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রীর দ্বারা। শুধুমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকা নন, বন্ধু-বান্ধবী, স্বামী-স্ত্রী, মা ও সন্তান, ছাত্র ও শিক্ষক এবং পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে ফুল, কার্ড, মিষ্টি ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রীর দ্বারা এই দিনটি পালন করেন। এই 'ভালোবাসা দিবস' বা 'প্রেম দিবস' পালন করার জন্য সামাজিক গণমাধ্যম খুব বড় একটা ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন ফুলের দোকান, ফ্যাশন হাউজ, উপহারের দোকান, বেকারি ও ফাস্টফুড দোকানগুলোতে বিশেষ কিছু অফার চলে। তাছাড়া টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল গুলোতে 'ভালোবাসা দিবসের গান' ও 'ভালোবাসা দিবসের নাটক' ইত্যাদি প্রচার করে থাকে। শুধুমাত্র যুবক-যুবতীরাই নন, সব বয়সের মানুষই এই প্রেম দিবসের উৎসবে মেতে ওঠেন। পরিবারের সদস্যের সঙ্গে ও সম লিঙ্গের মানুষের সাথে বর্তমানে এই দিনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন মানুষ।
একবিংশ শতকে 'ভালোবাসা দিবস' পৌঁছে গেছে মানুষের হৃদয়ের গভীরে, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে নানা বৈচিত্র লক্ষণীয়। চীনে ভালোবাসা দিবসকে বলা হয় 'কিক্সি ফেস্টিভেল', যেটি উদযাপিত হয় চন্দ্রপঞ্জিকার সপ্তম মাসের সপ্তম দিনে। ফিনল্যান্ডে এর নাম 'ইস্তাভানপাইভা', যার অর্থ 'বন্ধুত্বের দিন', লাতিন আমেরিকাতেও এই দিবস উদযাপিত হয় বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার দিন হিসেবে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রীস, জাপান সহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে দিনটি উদযাপিত হয়।
চিত্র সৌজন্য ঃ আন্তরজাল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন