ফাঁপা দেওয়াল - নাসির ওয়াদেন

 


।।এক।।


ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব কিছুটা কমে গেলেও মিহি কুয়াশার চাদর জড়ানো প্রকৃতির গায়ে গতরে একটা মিষ্টি রোদ এসে হামলে পড়ছে রাস্তার উপর। সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ শুঁকে রাস্তার উপর  উড়ে গেল এক দল বনটিয়া। মফস্বল শহরের এক প্রান্তে ঈশান কোণে রূপালী রঙের আবরণ গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি বাড়ি। সামনের লালমোরামের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়বে একটা বড় গেট। গেট বলতে অর্গলহীন এক উন্মুক্ত দুয়ার, তার দু'পাশের দেওয়াল এসে থমকে দাঁড়িয়েছে কিছুটা ফাঁক রেখে। ফাঁকা জায়গায়  লোহার কিংবা কাঠের কোন গেট বসানো নেই। সেই ফাঁক-পথে গলিয়ে সব সময়ে যে-কোন প্রাণীর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নেই। লালমোরাম বিছানো রাস্তার দু'পাশে মখমলের মতো নরম ঘাসে, সারি সারি বাহারি ফুলে গাছ বসানো। দক্ষিণমুখো গেট দিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে অখিল। সামনে তাকিয়ে দেখে মাঠের মাঝে একটা শ্যামলা রঙের জার্সি গাই অবাধে ঘুরে ঘুরে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। ভিতরে প্রবেশ করেই একবার নোটিশ বোর্ডে চোখ রাখে। না, তেমন কিছু চোখে পড়ল না তার। কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগটা সোজা করে নিয়ে হাঁটতে লাগল ক্যাম্পাসের ভিতরের দিকে। ক্যাম্পাসের ভিতরে যেখানে রাস্তাটা দু'টো ভাগ হয়ে গেছে, সেখানে এসে একটু দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ ভাবল

-- " এবার কোন দিকে যাবে?"

পশ্চিমমুখো রাস্তার দিকে হাঁটলে সোজা গিয়ে খেলার মাঠ থেকে ঢুকে পড়বে আর দক্ষিণমুখো হাঁটলে বামদিকে দোতলা বিল্ডিং, লম্বা সারি । মাঝখানে সিঁড়ি, সেখান দিয়ে দোতলায় যাওয়ার রাস্তা । এই কমপ্লেক্সের কিছুটা পরেই রাস্তাটা পূর্বদিকে টার্ন নিয়েছে। সেখানের ডানদিকে 'এল' আকৃতির বিল্ডিং, বিজ্ঞান ভবন।  সায়েন্সের ক্লাসগুলো হয় এখানেই । তারও দক্ষিণদিকে এগিয়ে গেলে পাবে ল্যাবরেটরি রুম। নীচে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর দোতলায় বায়োলজির ল্যাবরেটরি রুম রয়েছে

পশ্চিমমুখো রাস্তার দিকে পা বাড়ালো অখিল, সামনে কিছুটা গিয়েই দাঁড়িয়ে বাম হাতের কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকালো। ডানদিকে আরও একটা দোতলা কমপ্লেক্স, একেবারে বিল্ডিংয়ের মাঝামাঝি অফিস ঘর। তার পশ্চিমে মেয়েদের কমন রুম । অখিল মনে মনে ভাবে, কমনরুম তো উভয়ের ঘর, তাহলে সেটা মেয়েদের জন্য স্পেশাল কেন?


উচ্চমাধ্যমিক  পাশ করে  কলেজে পা দিয়েছে অখিল। মফস্বল পাড়া-গাঁ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়তে আসা। ভর্তি হওয়ার এই তিন মাসের মধ্যেই অখিল যেন একটা নতুন পৃথিবীর টুকরো টুকরো বিশ্বাস-গন্ধ টের পাচ্ছে মনের গভীরে। মফস্বলের অজ পাড়া-গাঁয়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। স্কুলের বিল্ডিং বলতে একটা অফিস ঘর, পাশেই একটি মেয়েদের কমনরুম আর অফিসের দু'পাশে দু'টো রুম। একটু দূরে রাস্তার অপর প্রান্তে লম্বা খড়ের চালের চারখানা ক্লাসরুম। ওখানেই ফাইভ থেকে এইট, ওখানেই তাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে। ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর থেকে এসে দেখে এই শহরের আবহাওয়া, জল ও বায়ুর কত তফাৎ , বৈচিত্র্যময়, বিস্তর পার্থক্য তা এই এলাকার একমাত্র কলেজটিতে পড়তে না এলে দেখতেই পেত না। অফিসের সামনে একটা হাতলওয়ালা টিউবওয়েল, সেখানেই ছেলেমেয়েরা নিত্য প্রয়োজনীয় পানীয় জল পান করে। মেয়েদের কমনরুম পেরিয়ে পশ্চিমদিকে একটু হাঁটলে পাশাপাশি দুটো টয়লেট, একটি ছেলেদের, অন্যটি মেয়েদের


খুব লাজুক, নিরীহ ও শান্ত প্রকৃতির ছেলে অখিল। মেয়েদের দেখলেই কেমন শামুকের মতো গুটিয়ে যায়। লজ্জাবতী গাছকে মাঠের আলে জন্মাতে দেখেছে সাদা-গোলাপি বা দিল্লিকা লাড্ডু রংয়ের রোঁয়া-ওঠা গোল গোল ফুল, গায়ে ছোট ছোট কাঁটা পায়ে বেঁধে যায় অনেক সময়, জ্বালাও করে ব্যথা হয়। অখিলকে বন্ধুরা বলে লজ্জাবান ছেলে। সে মেয়ে হলে লজ্জাবতী হতে পারত; কিন্তু বিধাতা যেহেতু তাকে পুরুষ করে দিয়েছে, গোঁফে হালকা কালো চুলও গজিয়েছে। লজ্জা পায়, জড়সড়ো হয়ে যায়। রাখে হরি মারে কে, এই তত্ত্বে বিশ্বাসী সে, যদি না বিধাতা পুরুষের নির্দেশে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা-র বেড়াজালে না ফেলে দেয়


হালকা কুয়াশার চাদর বিছানো কলেজের পরিবেশ ধীরে ধীরে সূর্যের আলোতে পরিষ্কার আর ধবধবে সাদা হতে শুরু হয়েছে। কয়েক পা এগিয়ে  পশ্চিমমুখী হয়ে সেই আধফোটা কৃষ্ণচূড়া গাছের আলো-ছায়ার তলায় এসে দাঁড়ালো। কাঁধের ব্যাগটা মাটির উপর রেখে সবুজ ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে পা থেকে জুতো জোড়া খুলতে লাগলো। মোজা পায়েই বসে পড়লো গাছটার নিচে

তখনও সঙ্গীরা কেউ কলেজে এসে পৌঁছায়নি। আজ তার ডাউন লোকাল গাড়িখানি ঠিক সময়ের পূর্বেই স্টেশনে পৌঁছে গেছে। গত কয়েকদিন ধরে ঘন কুয়াশার ফলে ট্রেনগুলো দেরি করে চলছিল। একদিন স্টেশনে ঘেরাও কর্মসূচি চালালো কিছু মানুষ। এদের মধ্যে ব্যবসায়ী যেমন আছে, হকার আছে, ডেইলি প্যাসেঞ্জার আছে আর কলেজে ছাত্রছাত্রীরাও। দেরি করে গাড়ি চলা এই লাইনে একটি মস্ত ফ্যাশন। লুপ লাইনে লোকাল গাড়ি সংখ্যাও হাতে গোনা, ফলে একটা গাড়ি মিস হলে আট-নয় ঘন্টা গাড়ির আর কোন ব্যবস্থা নেই। তাই যাত্রীদের সময় ধরে ঘর থেকে বের হতে হয়,নইলে গাড়ি হুস করে বেরিয়ে যাবে


যাই হোক, সেদিন গাড়িটা যে নির্ধারিত সময়ের আগেই ষ্টেশনে এসে পৌঁছবে তা অনেকের কাছেই বিস্ময়। অখিলেরা গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের দিকে এগুতে লাগলো। হাঁটাপথে পাঁচ মিনিট গেলেই কলেজ চত্বর। সেখানে পৌছে গাছতলায় বসে একটু বিশ্রাম নেওয়া আর কি

-- "কি হে অখিল, আজকে যে খুব তাড়াতাড়ি... "

-- "আর বোলো না ভাই, গাড়িটা একদম বিফোর টাইমে প্লাটফর্মে ইন করল। তাই নেমে সোজা কলেজে। তা, তুমি কখন এলে?"

হাতঘড়িটার দিকে এক পলক দেখে নিয়ে মানস বলল, "এই মিনিট পাঁচেক হবে। আমাদের বাসপথে যাতায়াত। বাসটা একটু লেট করেই এল।"

-- "আচ্ছা!"

-- "তোমার ক'টা থেকে ক্লাস শুরু?" , শুধালো মানস

অখিল দাঁড়িয়ে জুতো জোড়া গলাতে গলাতে বলল, " এই যে এগারোটা থেকে ফার্স্ট পিরিয়ডএনসি দত্তের ক্লাস। তারপর এসপি স্যারের। আজকে তৃতীয় পিরিয়ডটা অফ আছে।"

-- " ঠিক, ঠিক, চতুর্থ পিরিয়ডে একটা কমন ক্লাস আছে অলোক স্যারের, রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অনার্স-পাস উভয় কোর্সের ছেলেমেয়েদের একসাথে হবে। তিনের বি রুমে, দোতালায় পূর্ব দিকের বিল্ডিংয়ে, জানি।"

অখিল যেদিনে কলেজে ভর্তি হয়েছিল তার পরের দিনেই নোটিশ বোর্ড থেকে ক্লাশ রুটিন লিখে নিয়েছে। সেই রুটিনের খাতা দেখে বলল, হ্যাঁ ভাই, এখন অফিস বিল্ডিং এর গ্রাউন্ড ফ্লোরের সাত নম্বর রুমে আমার অনার্সের ক্লাস

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, 'এই দেখো এখন বাজে দশটা পঞ্চান্ন। চলো, দেরি হয়ে যাবে। স্যার কিন্তু খুব পাংচুয়াল মানুষ, ঠিক সময়েই ঢুকবে।'  

ব্যাগখানা কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে বাম হাতে জুতার ধুলো মুছে দাঁড়ালো অখিল । কৃষ্ণচূড়ার কয়েকটি পাতা আর ফুল পাপড়ি ঝরে পড়লো তাদের দুজনের মাথার উপর

    ।।দুই।।
   
এস পি স্যারের ক্লাস থেকে বেরোনোর সাথে সাথেই একদল ছাত্র হুড়মুড় করে সেভেন বি ক্লাস রুমে ঢুকে পড়ল। সামনের বেঞ্চে দক্ষিণমুখী হয়ে বসেছিল অখিল। সর্বসাকুল্যে তাদের ক্লাসে মাত্র দশজন ছেলে আর একজন মেয়ে। মফস্বল শহরের, মহকুমার একমাত্র কলেজে এর চাইতে বেশি ছাত্র-ছাত্রী অনার্সে প্রত্যাশা করা যায় না। তার উপর বিদেশী ভাষার সাবজেক্ট। মাতৃভাষার সাবজেক্টে অবশ্য সিট ভর্তি হয়ে গেছে। অখিল মাতৃভাষা নিয়েই পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু পরিবারের পরামর্শে ইংরেজি সাবজেক্ট নিয়েই তাকে পড়তে হচ্ছে। অখিল সেবারে কলা বিভাগে প্রথম ডিভিশনে উত্তীর্ণ হয়েছিল। সম্ভবত শুধু মহকুমায় নয়, জেলাতেও টপার ছিল। সেজন্যই যেকোনো সাবজেক্টে অনার্স পেতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। অবশ্য চারটি সাবজেক্টেই সে এডমিশন টেস্ট দিয়েছিল। ভর্তির পরীক্ষায় চারটিতেই উত্তীর্ণ হয়েছিল। তাই সব বিভাগের শিক্ষকই চেয়েছিলেন, সে যেন তাঁদের সাবজেক্টেই ভর্তি হয়


বরুণ আরেক বন্ধু, তারা দুজনেই পাশাপাশি বসে ক্লাশ করে। তারা পাশাপাশি বসে এস পি স্যারের "দি হিস্ট্রি অফ দা এনসেন্ট পিরিয়ড" চ্যাপ্টারের কবি জিওফ্রে চসার-এর "দি ক্যান্টারবেরি টেলস" এর কাহিনী শুনছিল। মধ্যযুগীয় সাহিত্যে 'ক্যান্টারবেরি টেলসে'র কাহিনী খুবই মজার ও চমকপ্রদ। চসারের ইচ্ছে ছিল একদল তীর্থযাত্রীর মুখে জীবন্ত চরিত্রের নানা প্রকার অভিজ্ঞতা ও বাস্তববাদের মিশ্রণে গল্প তৈরি করা। তাই তীর্থযাত্রীদের মুখ থেকে যার বাস্তব গল্প শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে, সেই গল্পকারকে  একটা ডিনার খাওয়ানো...

অখিল, বরুণকে কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে হুড়মুড় করে একদল ছেলে ঢুকে পড়ল ক্লাস রুমে। অখিল বিরক্ত হলো কিছুটা; কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলল না। মনটাকে স্বাভাবিক করে তাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো


প্রতীম এসে দাঁড়াল অখিলের সামনে। হাঁফ ছেড়ে মৃদুস্বরে বলল, "কি অখিল ,শুধু ক্লাস করলেই হবে। চলো, কমন ক্লাসে যেতে হবে। একটা ক্লাস লেকচার আছে। সামনেই কলেজ নির্বাচন, তুমিও একজন ক্যান্ডিডেট। এভাবে লুকিয়ে থাকলে চলবে?"


  -- "না,না, ওসব কথা বলছো কেন ভাই? আমি লুকোতে যাব কেন? এইতো সবেমাত্র ক্লাস শেষ হলো। স্যার বেরিয়ে গেলেন, এবার বইপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ব।" 


-- " হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। সেকেন্ড বিল্ডিং-এর ওপর তলায় পাঁচ নম্বর রুমে বাংলার কমন ক্লাস। স্যার যাওয়ার আগেই লেকচার সেরে নিতে হবে।"


অখিল মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও, মুখে কোনরকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করল না। বিরক্তি মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করছে, কেন যে তাকে জোর করে শেয়ার পদে দাঁড় করালেন স্যার। অভিষেক স্যারের কথা ফেলতে পারবে না। রাজনীতি টাজনীতি তার মাথায় ঢোকে না। তাছাড়া, তার এখন রাজনীতি করা সাজে না, তবে নমিনেশন পেপার যখন দিয়েই ফেলেছে, তখন ছুঁচো গেলার মতো গিলতেই হবে। সাপ খিদের সময় খাবার ছুঁচোকে সামনে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। টুক্ করে গিলে নেয়, তখন ছুঁচোর গন্ধে সাপের ল্যাজে-গোবরে অবস্থা, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। তখন সাপ না পারে গিলতে, না পারে উগলাতে। অখিলের দশাও ঠিক এইরকম। মনে মনে ভাবে, কি রে বাবা! পাড়া-গ্রাম থেকে এলাম কলেজে পড়তে, যেমন তেমন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে পরিবারের মুখে দু'গ্রাস অন্ন তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকবে নয়তো, এখানে এসেই রাজনীতির বেড়াজালে আটকে পড়েছে, এই ফাঁদ থেকে কিভাবে বের হবে তার চিন্তাই এখন মাথায় বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে


  -- "চলো, চলো", বলে একরকম জোর করে বেঞ্চ থেকেই টেনে তুলল, দেরি করলে বেশি সময় পাওয়া যাবে না, টাইম লস ইজ এভরিথিং লস

হ্যাঁ, তাই। হঠাৎ মনে পড়ল তার বাবার বন্ধু সুধাংশু কাকুর কথাতিনি বলতেন, 'মানি লস ইজ নাথিং লস, টাইম লস ইজ সামথিং লস। ক্যারেক্টার লস ইজ এভরিথিং লস।'

অখিল অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিরক্তি কাঁধে নিয়ে ক্লাশ-রুম থেকেই বেরিয়ে গেল ওদের সাথে

।। তিন ।।  

কলেজ থেকে ফেরার রাস্তায় যে দোতলা বাড়িটা সবুজ মেরুন রংয়ের বাহার নিয়ে সৌন্দর্য ছড়িয়ে শহরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের একপাশে, তার একধারে রেল কলোনি, অন্যদিকে পিচঢালা রাস্তা, মাঝে বাহু উঁচু করে বাড়িটা গৌরব ঘোষণা করছে। জমকালো বাড়িটার পাশ দিয়ে যে পথিকই যাক না কেন, একবার আড়চোখে বাড়িটাকে দেখে নিতেই হবে, না দেখলে মনখানা খুঁতখুঁত করবে, রাতে ঘুমই আসবে না। এক স্বপ্নপুরী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে পথিককে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একবার করে তাকিয়ে দেখে পথিকজন। বাড়ির মাথায় বটের ছায়ার মতো নীল আকাশের বুকে কিংবা সবুজ বনানীর মধ্যিখান দিয়ে সরীসৃপের খসখস শব্দে গমনের সাথে সাথে, বসন্তের মিষ্টি বাতাস আর ব্রাহ্মণির কুলু কুলু স্বরধ্বনি মনকে স্নিগ্ধ করে। যদি কেউ ফুল না ভালবাসে, আতরের সুগন্ধিকে  দুর্গন্ধ মনে হয়, তবে সে কিন্তু মানুষকেও খুন করতে পারে। এ কথা কবিদের কলমে বারবার উঠে এসেছে। তাই যারা ফুল ভালোবাসে, প্রেম ভালবাসে, তারা মানুষকে ভালোবাসতেই পারবে

আজ অখিলের ট্রেন ধরার তাড়া নেই। একটু আগেই ক্লাস হয়ে গেছে তার। সেজন্যই সে একলা ধীরগতিতে, শম্বুক চালে হেঁটে চলেছে রেল কলোনির ধার ঘেঁষে সরু পিচ ঢালা রাস্তার উপর দিয়ে। মাথার উপরে নীল আকাশ, পাখিদের কিচিরমিচির ডাক উড়ে বেড়ানো, অনতিদূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের থোকা থোকা ফুলের শোভা, সৌন্দর্যময় দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছে এই চরাচরভূমিতে

বাড়ির পশ্চিমদিকে একটা জানালা আজ খোলা। অখিল প্রতিদিনে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে একবার করে উপভোগ করে বাড়িটার সৌন্দর্য। প্রেম, ভালবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা সবকিছুই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে এই রহস্যপুরীতে, তাতে চোখ নিমিলিত থাক আর বিস্ফারিত থাক তার সুন্দর কায়া মানুষকে ভীষণ আকৃষ্ট করবে। অখিল একবার চোখটা বুলিয়ে নিতে চাইল বাড়িটার উপর। হঠাৎ চোখজোড়া আটকালো গিয়ে খোলা জানালার ভিতরে।  এক স্বল্পবয়সী কিশোরী বসে আছে জানালার ভিতরে, বাইরের দিকে চোখ মেলে, চোখে কালো কাজল, মুখে প্রসাধনী, ঠোঁট লাল টুকটুকে। দূর থেকে অখিলের অনুমান বয়স সতেরো-আঠারো হবে। পাতলা ছিপছিপে চেহারা, টিকালো নাক। নাকের ডান দিকে নোলক, কানে হালকা ডিজাইনের সোনার দুল আর গলায় ঝকঝকে একখানা হার, সোনারই হবে, কন্ঠ থেকে ঝুলে রয়েছে বুকের ঠিক মাঝখানে


অখিলের চোখ গিয়ে আটকালো সেখানেই। সঙ্গে সঙ্গে চোখকে সরিয়ে নিলো, মনে হলো সে কিছুই দেখেনি। তারপর হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে। ইস্টিশন আর কয়েক মিটার দূরে, সেখানে পৌঁছে তিন নম্বর প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে, একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে পড়ল

এমন সুন্দরী মেয়ে সে আগে কখনো দেখেনি, কোন এক পরীকন্যা বুঝি ডানা মেলে উড়ে এসে বসে আছে খাঁচার ভিতর

অখিলের ভিতরে মানুষটা বলে ওঠে," কি হে! অখিলেশ্বর সরকার। তোমার বুঝি মন লেগেছে ওর পানে..."

আহা! কি দেখলাম আজ ! এক অপরূপ সৌন্দর্যময়, ফুলের পাঁপড়ি মেলা সদ্যোজাত ফুল, নিখুঁত তুলতুলে এক পল্লবকান্তি

-- "সে কি ! তুমি তো নিরীহ শান্ত বয়, তাহলে সামান্য এক কুমারী মেয়েকে দেখেই তোমার প্রেম গড়িয়ে পড়লো?"

ছি! ছি! সত্যিই তো তাই, সে বামন হয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলা স্বপ্ন দেখছে কি মনে করে


মনে পড়ে যায় সিতাংশু কাকার কথা। সিতাংশু প্রামাণিক, বাবার বাল্যবন্ধু, তিনি খুব আপডেটেড মানুষ। অখিল যেদিন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল ভালো নাম্বার নিয়ে, সেদিনে তার ইচ্ছে ছিল কবিগুরুর বিশ্বভারতীতে ভূগোলে অনার্স নিয়ে পড়বে। এ সময়ে ভূগোলের চাহিদা খুব বেশি। তাছাড়া ভূগোল নিয়ে পড়ার সুযোগও একমাত্র ওইখানেই

একটা অ্যাডমিশনের ফর্ম তুলে এনেছ, সেটা জমাও দিয়েছিল। কিন্তু, ওই পর্যন্ত ব্যাস! তারপর তার নাম লিস্টে উঠেছিল কিনা খোঁজ নেয়নি অখিল। সিতাংশু কাকার কথাগুলো তার মাথার ভিতর কিল কিল করে, মগজের পোকাগুলো নড়েচড়ে ওঠে। একদিন বৈঠকখানার ঘরে বসে চা খাচ্ছিল সিতাংশু কাকা আর তার বাবা

--" কি অনিমেষ, তোমার ছেলেকে কোথায় পড়াচ্ছ ?"

-- "কোথায় আর পড়াতে পারবো ভাই? নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরোয়, তাদের ছেলেদের কপালে কি আর উচ্চশিক্ষা থাকে?"

--" তবে!"

--" তবে!",  বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন সিতাংশু

-- "ছেলে বলছে, ভূগোল নিয়ে পড়বে, কারণ, ওই সাবজেক্টের নাকি টিচার নেওয়া হচ্ছে। চাকরির সুযোগও বেশি তাতে। সেই জন্যই... "

 

বাজ পড়লে মানুষ যেমন চমকে উঠে, ঠিক তেমনি সিতাংশু চমকে উঠলো। চমকে উঠে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ালো। তারপর বলল, মানে ওই বিশ্বভারতী! ওইখান ছাড়া তো আর আশেপাশে কোথাও কোন কলেজে ভূগোল পড়ানো হয় না

-- "ঠিক বলেছ, অখিল তো সে কথাই বলছিল। বিশ্বভারতী থেকে একটা ফর্ম তুলে নাকি জমাও করেছে"বলে থামলো অনিমেষ

সিতাংশু কাকুকে জোর গলায় বলতে শোনা গেল,"না, না, অনিমেষ। তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু, তাই বলছি, বিষয়টি খুব যুত ঠেকছে না।"

-- "যুত থাকছে না মানে?"

--" মানে; তুমি ছেলেকে ওখানে ভর্তি করো না। একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে।"

অনিমেষ সরকার বিস্ময় প্রকাশ করে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে, "বুঝতে পারলাম না তো সিতু?"

-- "ওখানে পড়লে ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে বুঝতে পারছ না? বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা নামেই হয়, বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা প্রেম করে, ছেলেকে পড়াতে পাঠালে সার্টিফিকেটের বদলে বউকে সাথে নিয়ে ঘরে ফিরবে। তাই বলি ভাই, ওকে অন্য কোন কলেজে পড়াও..."

সেদিনে তারা আরো অনেক কিছু কথা ফিসফিস করে বলছিল। এই কথাটা শুনেই অখিলের মনে ভয়ানক রাগ জমে উঠেছিল। সব ছেলেরাই বুঝি প্রেম করতে চায়, কি যে বলে কাকা। অখিল তো সেরকমই নয়, তার লক্ষ্য সামনের দিকে হাইস্কুল কিংবা কলেজে পড়ানো। মামার ইচ্ছে অখিল বহরমপুর কলেজে পড়ুক, বাবাও তাই বলেন। কিন্তু সেসব কথা খারিজ করে দেয় অখিল। সিদ্ধান্ত নেয়, ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরের কলেজেই সে পড়বে। তবে ভূগোল নিয়ে নয়, ইংরেজি নিয়ে। ইংরেজি সাবজেক্ট এর চাহিদা তো আছেই


-- "কি অখিল! এখানে একাই বসে, গাড়ি বুঝি লেটে চলছে।" হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলে বকুল । বকুল তার স্কুল জীবনের সহপাঠী, ক্লাসমেট, এখানে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে

-- "এইতো ভাই! অনেকক্ষণ আগে এসেছি। এসে শুনলাম, গাড়ি এক ঘন্টা লেটে চলছে। তাই প্লাটফর্মের এই নির্জন প্রান্তে বসে একটু বই নাড়াচাড়া করছি।"

-- "তোমাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে, কোন কিছু অঘটন ঘটেছে নাকি?" জিজ্ঞাসা করে বকুল

ঘটেছে তো, এখনো ঘটে চলেছে। এ কথা মুখ ফুটে বলতে পারল না অখিল। কেবল নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "ধ্যুর, কি যে বলো বকুল, আমার আবার কি ঘটবে মনে? গরিবদের মন বলে কিছু থাকে না, যাদের শুধু চিন্তা কি করে মানুষ হতে হবে , কি করে একটা চাকরি জোগাড় করে পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো গ্রাসাস্বাদনের ব্যবস্থা করতে হবে, তারই নিরন্তর চিন্তা, তাই না বল?"

-- "ঠিকই বলেছ অখিল। সমাজের ভেতরে দুটো শ্রেণি আছে। একশ্রেণী খেতে পারে না আর একশ্রেণী খেতে পায় না।"

'হ্যাভ আর হ্যাভ নটস্' কথাটা এস পি স্যার পড়ার সময় বারবার বলছিলেন। এই কথাটা মনে পড়ে অখিলের, সত্যিই তো তারা এখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, সমাজে একরকম টাকা দিয়েই তো মূল্য নির্ধারণ করা হয়। টাকা থাকলে মান্নি-গুন্নি হওয়া যায়। সম্মান মেলে, মোড়ল, মোড়ল, বলে লোকে ডাকে। পাড়াগাঁয়ে তো এ রকমই চল সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়
তিন নম্বর প্লাটফর্মে আপ ট্রেনখানি হুস্ হুস শব্দ করতে করতে ঢুকে পড়ল


।। চার ।।

সারারাত ঘুমোতেই পারলো না অখিল। চোখের সামনে সেই অষ্টাদশী-কিশোরী, যার মোলায়েম মুখখানা তীব্র শীতেও খোল, চাদর, লেপ, কম্বল  দিয়ে ঢুকে পড়ে মনের বিছানায়। যে কিনা মেয়েদেরকে আশেপাশে দেখলে জড়সড়ো হয়ে দূরে দূরে সরে থাকতো, সেই অখিলের মন এক দুরন্ত যৌবন বাতাসে ঢেউ খেলে যায়। সে কি তবে কাপুরুষ থেকে ক্রমশ পুরুষ হয়ে উঠছে, পরিণত হচ্ছে, মন কি বুঝতে পারে না। লেজি বিড়াল থেকে তেজী ঘোড়া হয়ে টগবগ করে ছুটছে। ফুটছে মন বলে যে বস্তুটা আছে, সেটা মাইন্ড। স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্নমেদুর ভালোবাসার ভাসমান মেঘ। শরতের খন্ড খন্ড সাদা মেঘ আকাশের নীল রং চাপা দিয়ে বসন্তের শাল গাছের ফুলে ফলে ডালে ঝুলে যাচ্ছে

তার মা রাতের বেলায় খাবার দিতে দিতে তাকে জিজ্ঞেস করে, "কিরে খোকা? তোর শরীর টরীর খারাপ নাকি? কেমন যেন মনমরা লাগছে?"

-- "কি যে বল মা, আমার আবার মনখারাপ হবে কেন? আমি ঠিক আছি।" খেতে খেতে বলে অখিল


ট্রেন থেকে নেমে একই পথ দিয়ে কলেজে যাওয়া ওর নিত্যদিনের কাজ। কোনদিন বন্ধুরা সাথে যায়, আবার কোন কোন দিন একা একা হেঁটেও। কলেজে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায়, বাড়িটার কাছে। চোখদুটো আটকে যায়। সঙ্গীরা কেউ সাথে নেই, একপশলা হালকা বৃষ্টি হয়ে গেছে ঘন্টাখানেক আগে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া, পথ ঘাট জনবিরল। হয়তো কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টির জন্যই মানুষ ঘরদোর থেকে বেরোতে দেরি করছে। বাস, গাড়িও চলছে কম সংখ্যায়। মাঝে মাঝে ট্রেনের শব্দ কানে ভেসে আসছে দূর থেকে


হঠাৎ জানালার পাল্লা দুটো খুলে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই সুন্দরী অপ্সরী। ঘরের ভেতর থেকে একটা কাগজের টুকরো ছিটকে পড়ল অখিলের গায়ের উপর। তারপর পড়ে গেল সামনের রাস্তার উপর। ঝুপ করে জানালাটা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। এতক্ষণে জানালাটা নির্বাক চোখে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে


রাস্তার উপর থেকে কাগজের ঢিলটা তুলে নিল অখিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে কেউ কোথাও দেখছে কিনা। না কারো দেখা পেল না। টুক্ করে প্যান্টের পকেটে গলিয়ে হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে জোরকদমে ‌

।। পাঁচ ।।

স্টুডেন্ট ইউনিয়নে বসে আছে অখিল, একটু আগে আগেই সে এসেছে । সংসদের অন্য সদস্যরা তখনও পৌঁছায়নি। মানস এসে দাঁড়াল অখিলের পাশে

বলে, "দেখ ভাই অখিল, তোর উপর নির্ভর করছে আমার জি এস হওয়া। তুই যদি চাস তাহলে আমি জি এস হতে পারব।"

অখিল বলে, " ভুল করছিস মানস, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, একসাথে একই ক্লাসে পড়ি। তোর সাথে আমার আত্মা জুড়ে আছে। কিন্তু আমার কথার কি মূল্য আছেতুই বল, অভিষেক স্যার আছেন, তিনি আমাদের হেড। তিনি যা বলবেন, যা চাইবেন, সেটাই না হবে।"

-- "সে তো জানি, তবে তোর প্রতি স্যারের আলাদা একটা ইম্প্রেশন আছে, সেটা সবাই জানে। তাছাড়া গত টার্মে আমি এ জি এস ছিলাম। এবার তো আমার হক । তাই না? তুই বল ?",  বলেই থামলো মানস

-- "জানি না রে, রাজনীতির মারপ্যাঁচ আমি বুঝি না। দেখ, আমি পাড়া-গ্রাম থেকে চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে কলেজে পড়তে এসেছি, নেতা হওয়ার ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা আমার কোনটাই নেই। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা মানায় না আমাদের মত গরিব ছেলেদের, আর রাজনীতি হলো বিশাল এক সমুদ্র, আমরা হচ্ছি ছোট ছোট ডিঙি। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খোঁজ নেওয়া আমাদের ক্ষ্যাপামি। বল তাই কিনা?"

-- "ঠিক আছে তুই তাহলে ভোটাভুটি হলে আমাকেই ভোটটা দিস। তারপর যা হবার তাই হবে--",  দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলল মানস

-- "কথা দে আমাকে।" বলেই অখিলের দিকে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল

অখিল চুপ করে গেল খানিকক্ষণ। তারপর হাত বের করে মানসের হাতটা ধরে বলল, 'দেখ ভাই, আমি কিন্তু দলের প্রার্থীকেই সমর্থন করব। দল যে নামের প্রস্তাব দেবে আমি সেই প্রার্থীকেই ভোট দেবো। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবো না।'
   
আশাহত হলো মানস, মুখখানা ফ্যাকাসে ও বিষন্ন হয়ে গেল। চোখে মুখে ক্লান্তির ছায়া নেমে আসে। বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে শেষে তীরে এসে তরী ডুবে যাবে !
শুকনো কণ্ঠে বললো-- দেখিস ভাই, বন্ধু বলেই তোকে বললাম। অন্য কেউ হলে বলতাম না। মরা বাঁচার চাবিকাঠি কিন্তু তোরই হাতে, তুই যতই চালাকি করে বল না কেন, তুই কিন্তু লাউয়েরই ডগা...

আরো কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিল মানস, ততক্ষণে হুড়মুড় করে সংসদে নবনির্বাচিত অন্য সদস্যরা ঢুকে পড়ল ইউনিয়ন অফিসে। মানস চুপ করে গেলে অখিল হাত ছেড়ে বাঁচলো
কি জানি কি করে বসতো? হয়তো সমর্থনও করে দিতে সম্মত হতো। বন্ধু বলে কথা। যার নুন খাবে তার তো গুণ গাইতেই হবে


অভিষেক স্যার তখনো ইউনিয়ন রুমে আসেননি। সকলেই উৎসুক হয়ে বসে আছে। একাদশ দ্বাদশ শ্রেণি থেকে তিনজন করে ছয় জন, ফার্স্ট ইয়ার ,সেকেন্ড ইয়ার থেকে পাঁচজন করে দশ জন আর থার্ড ইয়ারের তিনজন এবং সায়েন্স ও কমার্স থেকে আরো দশ জন মোট ঊনত্রিশ জনের সংসদ। তাদের মধ্যে তিনজন মহিলা, রূপালী, নিকিতা আর রৌশুনারা এসে পৌঁছেছে। ওরা ডানদিকের বেঞ্চে বসে আছে। থার্ড ইয়ারের মনোতোষ আর রসুন মিয়া সবেমাত্র এসে পৌঁছালো, এখনো কয়েকজন আসতে বাকি


ঠিক তখনই অভিষেক স্যার হন্তদন্ত হয়ে ইউনিয়ন অফিসে ঢুকলো। পৌঁছাতেই সকলেই নিমেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল । স্যার সকলকে হাত নেড়ে বসতে বললেন, তারা একে একে বেঞ্চে বসে পড়লো। এখন সবাই নিজের নিজের আসনে বসে আছে। এক গম্ভীর নিস্তব্ধতা জাল বিছিয়ে দিল অনেকের মনের মধ্যে। এতক্ষণ যে নানা শব্দের স্বর আসছিল বাতাসে ভেসে, হরেকরকম সুর ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয়ে কলেজের ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলসবাই চুপচাপ, একদম যাকে স্টিল সাইলেন্স বলে। পিন পড়ার শব্দও যেন শোনা যাবে সেই মুহূর্তে


ইউনিয়ান রুমের সামনের টেবিলে রঙিন চাদর বিছানো, তার উপর একটি ফুলদানি, তাতে হরেক রকম ফুলের শোভা, একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে তার মধ্য থেকে। বসন্তের হিমশীতল বাতাসে শীতের শিহরণ কেটে গরম বাতাসের আভাস জানান দিচ্ছে পশ্চিম দিকে হাওয়া

মহিতোষ তৃতীয় বর্ষের একজন প্রতিনিধি। টেবিলের পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন অধ্যাপক অনিমেষ চট্টোপাধ্যায়। এবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে খালি গলায় মহিতোষ বলতে লাগলো, সম্মানীয় স্যার, শ্রী অভিষেক চট্টোপাধ্যায় মহাশয়, উপস্থিত সদ্যনির্বাচিত সংসদ সদস্যবৃন্দ ও আজকের এই মঙ্গলময় মুহূর্তে, আমি কলেজের ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সকলকে স্বাগত জানাচ্ছি। বড়দের শ্রদ্ধা, প্রণাম ও ছোটদের ভালোবাসা আর আন্তরিক অভিনন্দন রইল। আমি,,,,,
কাগজের মন্ড থেকে দুমড়ানো মোচড়ানো চিঠিখানা পড়ার পর থেকেই অখিলের মন খচখচ করছে। মনকে কিছুতেই কনসেনট্রেট করতে পারছে না। এক স্বপ্নের মায়াজালে তার মন থমকে গেছে, আটকে পড়েছে। কে এই চিঠির প্রেরক? কেনই বা লিখল এমন ভাষায় পত্র? একে তো প্রেমপত্র বলা যায় না, আবার না তাও নয়। একথাও বলা যাবে না। কি উদ্দেশ্যে এই কয়েকটা লাইন লেখা হয়েছে? কি বলতে চেয়েছে পত্রলেখিকা?



মাথা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, ঝিমঝিম করে উঠছে। ইউনিয়নের রুমে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন সভাপতির কথাগুলো কানের বাইরে দিয়ে চলে যাচ্ছে। দূরে, আরো দূরে, শনশন করে বইছে বাইরে বাতাস। গনগনে রোদে গলে যাওয়া হাসি মাঠের ঔজ্জ্বল্যকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। বারবার ভেসে উঠছে তার চোখের পর্দার উপর সুন্দরী কচি মেয়েটির মুখ। হাতের শব্দ-ছুরিটা বুকের ডান পাশে হৃৎপিণ্ডটা বিঁধে ফেলছে, অনাথ মনকে একটু চুপ করে, বক্তার কথা শোনার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই পারছে না

-- ''কলেজের সবাই চায়, আমিও চাই তোমাকেই দেখতে। .... ।" পালক

--না, কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কি এর ঠিক অর্থ? কে এই পালক? কি বোঝাতে চাইছে মেয়েটি? কেনই বা এক অপরিচিতা কিশোরী তাকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করছে! না, কিছুই তার মাথায় আসছে না

অভিষেক স্যারের ডাকে সম্বিত ফিরল অখিলের। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অখিলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, অখিল, এখানে আসো, আমার কাছে আসো ... 
      
--ঠিক আছে স্যার, বলে অখিল মাথা নেড়ে জানালো । তার মুখ থেকেই স্যার ' অফিস বেয়ারার ' প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে চায়। সেই বিভিন্ন পদে সদস্যের নামের প্রস্তাব করবে

        ছয়

একটা স্বপ্নের চারাগাছ প্রভাতী আলোর স্নিগ্ধ উত্তাপ মেখে একটু একটু  কচি পাতা মেলে উঠছিল, সেই কিশলয় কি মুহূর্তের মধ্যেই ভাঙচুর হয়ে ধুলোয় মিশে যাবে! একদিকে স্বপ্নের নতুন  চারাগাছ হালকা হিমশীতল বাতাসে ডানা ছড়িয়ে নীল আকাশে উড়ছিল, অন্যদিকে, নিজের বাক-ছুরি দিয়ে হত্যা করতে হচ্ছে তাকেই। কোন পথে হাঁটবে অখিলেশ্বর সরকার
সত্যিই, যদি সে একজন জাদুকর হতো তাহলে, নিজেকে অধিষ্ঠিত করত জাদুকর হিসেবে। জুনিয়ার পি সি সরকার হয়ে 'ফুস' মন্তর দিয়ে তার ভালবাসাকে একটি ধুলোর দেওয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলতো। যেন তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ফাঁপা দেওয়াল। প্রেম, স্নেহ আর আত্মমর্যাদার বালি, পাথ‌র ও সিমেন্টের মশলা দিয়েই ভরাট করতো সেই দেওয়াল


     মাথার উপর মন্থর গতিতে ঘুরে চলেছে ফ্যানটি, হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো, হয়তো লোডশেডিং হয়েছে। দরদর করে মাথার সমস্ত ঘাম মুখ বেয়ে শরীরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। একেই তো বলে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যের পথে ঝাঁপ দেওয়া, এটাই তো অগ্নিপরীক্ষা
টেবিলের পাশে উঠে এলো, শুরু করলো তার ভাষণ, "বন্ধুগণ .... 

একটা মিষ্টি কোকিলের ডাক-সুরে ভাসতে থাকলো ইউনিয়নের রুমের ভিতর

তুমি বেঁচে গেলে, বেঁচে গেলে ..... 

 



চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন