তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিল সবিতা l
পাঁচ বাড়ি কাজ সারতে অনেক দেরি
হয়ে গেল l শেষের বাড়িটাতে
বেশি দেরি হল l আগের দিন ছুটি
চেয়েছিল l বলেছিল, ‘মাসিমা, কাল দোল, ছোট ভাইটাকে নিয়ে
রঙ খেলব l কাল আর আসব না l’
ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল বসাক গিন্নি l —’থাকিস তো ফুটপাতে, তায় আবার দোল? ছুটি নিতে পার, তবে আর কোনদিন কাজে আসতে হবে না l টাকাও আর পাবে না l’
অগত্যা আসতে হয়েছে l ভাইটা হয়তো হাপিত্যেশ করে বসে আছে রঙ খেলবে l কাল রাতে এনজিওর দিদিরা এসে আবির রঙ সব দিয়ে গেছে l ওই দিদিরাই তাদের ‘আলোর পরশ’ ইস্কুলে ভাইকে ভর্তি করে
নিয়েছে l আর জামাপ্যান্ট
দিয়েছে l সবিতাকে বলেছে, রাতের বেলা হাতের কাজ শেখার যে কর্মশালা হয়, সেখানে ভর্তি করে নেবে l লোকের বাড়ি এঁটোবাসন মেজে, ঘর মুছে আর ক’পয়সা পায় l ভোরবেলা উঠে কাগজ প্লাস্টিক কুড়িয়ে কিছু পায় l কষ্ট করে ভাইবোনের চলে যায় l
পার্কের পাশের ফুটপাথে পরপর
দু'টো স্ট্যাচু আছে, তার মাঝখানে একটু
ছাউনির মত, সেখানেই থাকে l বাবা মারা গেছে ছ’বছর হয়ে গেল l দেনার দায়ে বাস্তুভিটে যখন চলে গিয়েছিল, বাবা নামখানার গ্রামের বাড়ির পাট চুকিয়ে তাকে আর মাকে
নিয়ে কলকাতায় চলে এসে দেশপ্রিয় পার্কের লাগোয়া এই ফুটপাতে আশ্রয় নেয় l শিয়ালদা ইস্টিশনে মোট বইত l এখানে আসার পর ভাই হয় l কিন্তু ভাইকে ফেলে উলটো ফুটের একটা লোকের সঙ্গে মা যেন কোথায় চলে গেল l আর ফিরল না l বাবা ক’দিন গুম মেরে থাকার পর মদ খেতে শুরু করল l এখানে ওখানে পড়ে থাকত, শেষে একদিন বাসের চাকার তলায় চলে গেল l তখন ওই কুসুম বৌদি হাত ধরে বাবুদের বাড়িতে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল l প্রথম প্রথম ভাইকে সঙ্গে নিয়েই কাজে যেত l সে সব কথা ভাবলে এখনও চোখে জল আসে l
সবিতা আরও জোরে হাঁটে l বয়স বাড়ছে তার, শরীর জানান দিচ্ছে l খোলা ফুটপাতে আর
থাকা যাবে না l ভাবছে টাকা জমিয়ে
বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া নেবে l ভাইকে মানুষ করবে l একটা দমকা বাতাসে
আচমকা অনেকগুলো লাল শিমুল ফুল ঝরে পড়ল পিচ রাস্তায় l সবিতা কুড়িয়ে নিল ভাইকে দেবে l আজকে খুব দোল খেলবে পার্কের সব বাচ্চাদের সঙ্গে l
কাছাকাছি আসতে সবিতা দেখল
পার্কের একপাশের ফুটপাতে ভিড় l ওর বুকটা অকারণ ছ্যাঁৎ করে উঠল l কাছে গিয়ে দেখে ভাই ফুটপাথে পড়ে আছে l চোখ বন্ধ l গোটা প্যান্ট
রক্তে ভেসে যাচ্ছে l জড় হওয়া ফাটা, কানু, মঙ্গল ওদের কাছে জানতে চাইল, ভাইয়ের এ অবস্থা কেন?
ওরা বলল, ‘একদল ছেলে মদ খেয়ে রঙ মেখে ভূত হয়ে পার্কে এসে হইহই
করছিল l আমাদের ডেকে
লজেন্স দিল, তারপর একসময়
বিট্টুকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল l ওরা ইংরেজিতে কথা বলছিল সবিতাদি l অনেক পরে আবার হুস করে গাড়ি নিয়ে এসে বিট্টুকে ফেলে দিয়ে চলে গেল l’
সবিতা অসহায়ের মত ভাইকে কোলে
তুলে নিয়ে এনজিও দিদির অফিসের দিকে ছুটল l তার বুকে হাহাকার, চোখ ফাটা জল l
এনজিওর ডাক্তারবাবু রক্তাক্ত বিট্টুকে পরীক্ষা করে গম্ভীর গলায় বলল, ‘অ্যানাল রেপ l একে এক্ষুণি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে l আর পুলিশকে জানাতে হবে l’
বাইরের পৃথিবীতে তখন ইংলিশ
মিডিয়াম স্কুলে পড়া বাবু-কলকাতার ছেলেমেয়েরা অন্য দোল খেলায় ব্যস্ত!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন