২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। বেলা প্রায় ৩টে।
আগের দিনই ঢাকা এসেছেন তিনি। স্ত্রী আমেনা আর তার একমাত্র সন্তান বাদল, কদিন আগেই মাত্র জন্ম হলো তার। কিন্তু এ সুখকর ঘটনার সাথে কাটাকাটি হতেই যেন আমেনার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ল। শাশুড়িকে ভর্তি করানো হয়েছে গতকাল ঢাকা মেডিক্যালে। এক আত্মীয়ার বাড়ীতে রাতটা কাটিয়ে এখানে চলে এসেছেন শাশুড়ির সেবা করতে।
অসুস্থ শাশুড়ির জন্য কিছু ফলমূল কিনতে বেরিয়ে পড়েন আব্দুল জব্বার। মেডিক্যাল কলেজের গেটের বাইরে আসতেই দেখলেন বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করবার দাবিতে অনবরত শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে ছাত্র-জনতা। ফল আনবার কথা ভুলে গেলেন জব্বার। চলে গেলেন মিছিলের একদম সামনের দিকে। কিন্তু এরপরেই সব অন্ধকার। হঠাৎ পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি করে বসলো, আর তার প্রথমদিকের শিকার হলেন আব্দুল জব্বার। লুটিয়ে পড়লেন কিছু বুঝে উঠবার আগেই। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো মেডিক্যাল কলেজেই, যেখান থেকে তিনি এসেছিলেন। কিন্তু সেদিন রাতেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেলেন তিনি, বয়স মাত্র ৩৩।
সেদিন শুধু আব্দুল জব্বারই গুলিবিদ্ধ হননি। পুলিশের ছোঁড়া একটি গুলি ছুটে যায়
হোস্টেলের ১২ নং শেডের বারান্দায়, যেখানে ছিলেন আবুল বরকত। সেখানেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। তিনি
অবাক হয়ে তার ক্ষতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,
“আরে,
আমার দেখি গুলি লেগেছে…”। সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ
পাশ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলেন। তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি
বিভাগে, কিন্তু রাত আটটায় তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। বয়স ছিল মাত্র ২৫।
আরো যারা শহীদ হয়েছিলেন এই ভাষা আন্দোলনে তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস সালাম।
পেশায় তিনি ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয় বিভাগের পিয়ন, থাকতেন নীলক্ষেতের কোয়ার্টারে। ২১ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল
কলেজের সামনের রাস্তায় তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিক্ষোভে অংশ নেন এবং পুলিশের
এলোপাথাড়ি গুলিতে তিনি লুটিয়ে পড়েন, মারা যান দেড় মাস পর,
এপ্রিলের সাত তারিখে,
২৭ বছর বয়সে।
১৯৫২ সালে জগন্নাথ কলেজের হিসাব বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন রফিকউদ্দিন
আহমদ। ২১ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলি এসে
সরাসরি আঘাত হানে আন্দোলনরত রফিকের মাথায়। ছয়-সাত জন ধরাধরি করে তাকে এনে রাখেন
ঢাকা মেডিক্যালের অ্যানাটমি হলের পেছনের বারান্দায়। ১৭ নং রুমের পূব দিকে তার লাশ
পড়ে ছিল। ড. মশাররফুর রহমান খান তার ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে কুড়িয়ে নিয়ে আসেন। রাত
তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ রফিককে সমাহিত করা হয়। তার
বয়স হয়েছিল মাত্র ২৬।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্নেল এস. ডি. আহমদ এর ভাষ্যমতে,
“দুপুর প্রায় পৌনে তিনটা হবে। বিনা ওয়ার্নিংয়ে পুলিশ
ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করল। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম,
ফাঁকা গুলি, পুলিশ বোধ হয় ছাত্র-জনতার বিরাট সমাবেশ ভেঙে দিতে ভয় দেখাতে
ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছে। পরক্ষণেই বুঝলাম, আসল গুলিই ছুঁড়ছে। আমি ছিলাম তখন টিনের চোঙ্গা হাতে আমাদের
হোস্টেলের ১৫ নম্বর ব্যারাক বরাবর ফুলার রোডের ধারে। আমার অবস্থান থেকে প্রায় তিন
গজ দূরে ভিড়ের মধ্যে ২০-২২ বছরের একটি ছেলে রক্তঝরা একটা মাথার খুলির ওপরের অংশটা
বাটির মতো হাতের তালুতে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগল,
“এই দেখুন,
পুলিশের নৃশংসতা!” তাকিয়ে দেখলাম,
বাটির মতো মাথার খুলির অংশটিতে রয়েছে রক্তময় কিছু মাথার
ঘিলু। কী নিদারুণ এই দৃশ্য! পরে জানা গেল,
এটা ছিল শহীদ রফিকের মাথার খুলির অংশ।”
একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা সবাই জানলেও, খুব কম মানুষ জানেন বাইশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা। সেদিন সকাল
দশটার দিকে রঘুনাথ লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়েন শফিউর
রহমান, তিনি ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের হিসাব রক্ষণ শাখার কেরানী। নওয়াবপুর রোড পার হবার
সময় পুলিশ গুলি চালায়। পিঠে
গুলিবিদ্ধ হন শফিউর। সরকারি
অ্যাম্বুলেন্সে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালে। সেখানে ডক্টর অ্যালিন্সন তার
অপারেশন করেন, বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার বৃদ্ধ বাবা-মা,
স্ত্রী আর কন্যা। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় তিনি মারা যান,
৩৪ বছর বয়সে। কিন্তু মারা যাবার পর তার লাশ পুলিশ আত্মীয়দের
কাছে হস্তান্তর করেনি। অহিউল্লাহ নামের একজন ৮/৯ বছর বয়সী শিশুও মারা যায় পুলিশের
গুলিতে।
কিন্তু কেন হয়েছিল এই ভাষা সংগ্রাম? তার চেয়েও বড় কথা, উর্দু ভাষাই বা কেন রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়েছিল?
মোঘল সুলতানদের আমল থেকে আরবি-ফারসি ভাষা প্রচলিত হয়ে যায়,
যা কিনা ‘ইসলামিক ভাষা’ নামে পরিচিত ছিল। সেই উনিশ শতকের
মাঝ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের মাঝে উর্দুকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা
চালানো হয়, যার পেছনে ছিলেন স্যার খাজা সলিমুল্লাহ,
স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রমুখ। ইন্দো-আর্য পালি-প্রাকৃতের
অপভ্রংশ উর্দু গড়ে ওঠে ফার্সি, আরবি আর তুর্কি ভাষার প্রভাবে। যেহেতু আরবি হরফে লেখা,
তাই তার একটা ইসলামিক গুরুত্ব সর্বদাই ছিল। অন্যদিকে প্রায়
একই রকম ভাষা হলেও হিন্দি লেখা হতো ভিন্ন হরফে। অন্য দেবনগরী হরফের ক্ষেত্রেও একই
কথা- এগুলোকে হিন্দুত্বের বৈশিষ্ট্য বলে ধরে নেওয়া হত। বাংলাও এই আওতার বাইরে
পড়েনি।
সর্বভারতীয় পর্যায়ে ভাষার প্রশ্নটি সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৯২৯ সালে
নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে, তাতে ভারতের
রাষ্ট্রভাষা রূপে হিন্দিকে সুপারিশ করা হয়। কংগ্রেসের সকল মহল এই সুপারিশের সাথে
একমত হলেও সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে উত্থাপিত হয় এক তুমুল বিতর্ক। ১৯৩৭ সালে মুসলিম
লীগের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে ভারতীয় মুসলিমদের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ উর্দু
করবার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যেখানে বাংলার সমর্থকগণ তীব্রভাবে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
করেন।
১৯৪০
সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রচুর বিতর্ক অনুষ্ঠিত
হযেছে। শেষে মহাত্মা গান্ধী যে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে এলেন তাও বিতর্কিত হয়ে
ওঠে। তিনি বললেন, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দুস্থানী,
দেবনাগরী বর্ণমালায় লিখিত হলে তা হবে হিন্দি আর আরবি
বর্ণমালায় লিখিত হলে তা হবে উর্দু। এতেও বিতর্কের অবসান হয়নি। সর্বভারতীয় পর্যায়ে
যখন হিন্দি ও উর্দুর পক্ষে জোর প্রচারণা চলছিল সমগ্র ত্রিশের দশকব্যাপী, সেই
সময় বঙ্গদেশ থেকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা রুপে বাংলা ভাষার দাবি ক্ষীণকণ্ঠে পেশ করা
হয়। প্রফুল্ল কুমার সরকার এক সভায় ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাভাষার দাবি
উপস্থাপিত করে বলেন,
“একদিকে মানভূম সিংভূম,
সাঁওতাল পরগণা, পূর্ণিয়া, ভাগলপুর, অন্যদিকে শ্রীহট্ট,
গোয়ালপাড়া, কাছাড় পর্যন্ত বাংলার আসল সীমানা। এ বিস্তৃত ভূখন্ডে প্রায়
৭ কোটি ৩০ লাখ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। হিন্দি ভাষীর সংখ্যা এর চেয়ে বেশি নয়...।
সাহিত্যের দিক থেকেও বাংলা ভারতের সমস্ত প্রাদেশিকী সাহিত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”
এই পরস্থিতিরই ব্যাখ্যা দিয়ে ‘দৈনিক আজাদ’- পত্রিকার সম্পাদকীয়তে(২৩ ফেব্রুয়ারি,
১৯৩৭) লেখা হয়,
“এই রাষ্ট্রনৈতিক হুজুগের স্রোতে একদিকে বাংলার হিন্দুরা
আত্মবিস্মৃত অবস্থায় ভাসিয়া চলিয়াছেন, বাংলার সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে পরদেশীদের হাতে তুলিয়া দিতে।
বাংলার মুসলমানও এই হিন্দির প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ হইয়া অগত্যা
উর্দুকে অবলম্বন করার জন্য ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষার যে বিরাট
সর্বনাশ এই সমস্ত রাজনৈতিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার অন্তরালে লু্কাইয়া আছে,
বাংলার হিন্দু বা মুসলমান কেহই সে সম্বন্ধে চিন্তা করার
অবকাশ পাইতেছি না।”
মোটকথা, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত বাঙালিরা আত্মবিস্মৃত হয়েই থাকে।
যাই হোক, এরপর দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে অখণ্ড ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যায় ভারত ও
পাকিস্তানে। দু’পাশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান আর মাঝে হিন্দুপ্রধান ভারত।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর, পাকিস্তানের মোট ৬.৯ কোটি মানুষের মাঝে ৪.৪ কোটি মানুষই ছিল
পূর্ব বাংলার। তখন থেকেই মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ বলতে থাকেন,
“পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে
উর্দু।” কেবল একটি রাজনৈতিক আর ইসলামিক দিক থেকে সমৃদ্ধ ভাষা হবার দৌলতে উর্দুকে
বেছে নেওয়া হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। সকল যুক্তিতেই বাংলাভাষীদের উপর
উর্দু চাপিয়ে দেওয়া ছিল বিশাল একটা অন্যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
১৯৪৭ সালের জুলাইতে কামরুদ্দীন আহমদ প্রতিষ্ঠিত ‘গণ আজাদী লীগ’ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার করার পক্ষে প্রস্তাব
দেয়। এই সংস্থার ইশতেহারে বলা হয় “বাংলা
হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” তারা এ নিয়ে প্রচারণাও চালায় অনেক,
কামরুদ্দীন আহমদের এ উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাজউদ্দীন
আহমদ, মহম্মদ তোয়াহার মতো জনা কয় বামপন্থী নেতা। এটা ছিল মূলত রাজনৈতিক দিক থেকে
সাংগঠনিক প্রয়াস, রাষ্ট্রভাষা বাংলার
বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই ওই প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
একই সময় আতাউর রহমান, শহীদুল্লা কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রমুখ প্রগতিবাদী রাজনৈতিক কর্মী কলকাতায় বসেই পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক যুব সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। তারা অবশ্য দেশ বিভাগের পর ঢাকায় এসে স্থানীয় গণতন্ত্রী, প্রগতিবাদী যুবক ও দু-একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন, যেমন—মহম্মদ তোয়াহা, নাজমুল করিম, অলি আহাদ, তসন্দুক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ, এ ছাড়া কামরুদ্দীন আহমদ তো ছিলেনই। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে অনেক সরকারি বাধাবিপত্তির মুখে যে কর্মী সম্মেলন হয়, তাতে গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামের সংগঠনের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়। সেখানে যুবকদের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও উন্নতির ঘোষণার পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিও উচ্চারিত হয়।
তখনকার পত্রিকায় বাংলা ভাষার পক্ষে বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখি করতে লাগলেন,
যেগুলোর মধ্যে আব্দুল হক এবং ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর
লেখা দুটো উল্লেখযোগ্য। তবে তারা মূলত বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষার করার পক্ষে
লিখেছিলেন। ১৫ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক কাজী
মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কাশেমের তিনটি প্রবন্ধের একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়।
তমদ্দুন মজলিশ দ্বারা প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: বাংলা না উর্দু?’
শীর্ষক এই পুস্তিকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য উদাত্ত
আহবান জানানো হয়। ড. এনামুল হক পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপেক্ষিতে ‘উর্দু ও
বাংলা’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন,
“উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানীদের মরণ- রাজনৈতিক,
রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র
ধরিয়া শাষন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় পশ্চিম
পাকিস্তানী উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র।”
কিন্তু ১৯৪৭ এর নভেম্বরে পুরো ঘটনা পাল্টে যায়,
যখন শাসকরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালিদের ভাষা
বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুর সাথে ইংরেজিতে লেখা খাম,
পোষ্ট কার্ড, ডাকটিকেট, রেল-টিকেট, মানি অর্ডার ফর্ম ইত্যাদি ছেপে চালু করে দেয়। পাকিস্তানের
কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের তদানীন্তন সচিব গুডউইন ১৫ নভেম্বর তারিখে
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়াদি সম্পর্কে একটি সার্কুলার
প্রেরণ করেন। এ সার্কুলারে ঐ পরীক্ষার জন্য সর্বমোট ৩১টি বিষয় দেওয়া হয়,
যার মধ্যে নয়টি ছিল ভাষা;
এ সকল ভাষার মধ্যে হিন্দি,
উর্দু, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি এমনকি ল্যাটিন ও সংস্কৃতও স্থান পায়,
কিন্তু স্থান পায় না পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা
বাংলা। এই মর্মে, ১৭ নভেম্বর বাংলাকে পূর্ববঙ্গের সরকারী ভাষা করার দাবি
জানিয়ে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নিকট এক স্মারকলিপি পেশ করা হয়। তখন তমদ্দুন
মজলিশ পূর্ব বাংলার গণপরিষদের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার আর নুরুল আমিনের সাথে
মিটিং করে, এরপর মুখ্য মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথেও দেখা করে;
যেন সাধারণ পরিষদকে এ ব্যাপারে অবহিত হয়।
এরই মধ্যে ২৭ নভেম্বর তৎকালীন রাজধানী করাচীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে অংশগ্রহণের পর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী
হবিবুল্লাহ বাহার এবং আবদুল হামিদ ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়
বিমানবন্দরে সাংবাদিকদেরকে বলেন যে, উপরোক্ত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এর প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর
দুপুর দুটোর সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ,
জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও অন্যান্য কলেজসহ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক প্রতিবাদ সভা করে এবং উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে
অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার দাবি জানায়। প্রসঙ্গত,
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এটাই
সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্র সভা। বাংলাদেশের অন্য সকল আন্দোলনের মত ভাষা আন্দোলনের
সূতিকাগারও তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই ছাত্রসভাটি শেষ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে ছাত্ররা মিছিল
সহকারে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে সেক্রেটারিয়েট ভবনে উপস্থিত হয়।
সেক্রেটারিয়েট থেকে তারা মন্ত্রী নুরুল আমিন এবং হামিদুল হক চৌধুরীর বাসায়
উপস্থিত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। এরপর মিছিলটি প্রধানমন্ত্রী
নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে উপস্থিত হয়। ইতিপূর্বে প্রাদেশিক মন্ত্রী মোহাম্মদ আফজাল
এবং নূরুল আমিন বাংলা ভাষার দাবি সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও নাজিমুদ্দিন সে
ধরনের কোন প্রতিশ্রুতি দিতে অসম্মত হন। সে সময় তিনি অসুস্থ থাকার অজুহাতে
ছাত্রদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অক্ষমতা জানান এবং সেই সঙ্গে তাদের কাছে পাঠানো একটি
লিখিত নোটে বলেন যে, মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ও পার্লামেন্টারি পার্টির মতামত
না জানা পর্যন্ত তিনি ভাষার প্রশ্নে কোন সুনির্দিষ্ট মত প্রকাশ করতে পারবেন না।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া
এই কমিটির আহবায়ক ছিলেন। এর নেতারা ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের
শিক্ষমন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে এক বৈঠক করে ডাকটিকিট-মুদ্রা ইত্যাদিতে বাংলা না
থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ফজলুর রহমান তাদের আশ্বাস দেন যে এগুলো ঘটেছে ‘নিতান্ত
ভুলবশত’।
“পূর্ব বাংলার অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে,
একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।”
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও ধীরেন্দ্রনাথের দাবীকে ভর্তসনা করে বলেন,
“এখানে এ প্রশ্নটি তোলাই ভুল হয়েছে। এটি আমাদের জন্য এক
জীবনমরণ সমস্যা। আমি অত্যন্ত তীব্রভাবে এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করি এবং
আশা করি যে এ ধরনের একটি সংশোধনী প্রস্তাবকে পরিষদ অগ্রাহ্য করবেন। প্রথমে এই
প্রস্তাবটির উদ্দেশ্য নির্দোষ বলে আমি ভেবেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মনে হয়,
পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি
সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই
এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।”
ফলাফল হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল হলো(পরবর্তীতে তাকে ১৯৭১
সালের ২৯ মার্চ কুমিল্লায় তার নিজের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পুত্রসহ এবং
নির্মমভাবে হত্যা করা হয়)।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিলের প্রতিবাদ করে তমদ্দুন মজলিশ।
মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়। ১১ মার্চ, ১৯৪৮ তারিখে সাধারণ ধর্মঘটের ঘোষণা করা হয়। ভোরবেলা ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে আসে। ছাত্ররা মিছিল নিয়ে
মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসার দিকে যেতে থাকে,
হাই কোর্টের কাছে যেতেই তাদের বাধা দেওয়া হয়। তখন মিছিল দিক
পরিবর্তন করে সচিবালয়ের দিকে যেতে থাকে। এ সময় হঠাৎ পুলিশ মিছিলে অতর্কিতে হামলা
চালায়। আহত হন এ. কে. ফজলুল হক সহ অনেকেই। এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান,
শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করলে ঢাকায় ১৩ মার্চ ধর্মঘট
পালিত হয় এবং সংগ্রাম পরিষদ ঐ ধর্মঘট ১৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত
গ্রহণ করে, কারণ ঐ দিনটি ছিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার
তারিখ। শুধু ঢাকাই নয়; বগুড়া, রাজশাহী, যশোর, খুলনা সহ অনেক জেলায় এই হরতাল পালিত হয়।
এদিকে ‘কায়েদে আজম’ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তান সফরের দিন এগিয়ে
আসতে লাগল। তাই খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাব দিলেন আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনার।
আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে জানলেও অনেকে জানতে পারেননি। কারাগারে আটকদের
সম্মতিতে একটি ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত
হয়। এদিকে অন্যরা এ ব্যাপারে না জানায় কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। কিন্তু জানতে পারার
পর ছাত্ররা একে ষড়যন্ত্র হিসেবে ধরে নেয় এবং এ ব্যাপারে খাজা নাজিমুদ্দিনের স্পষ্ট
মন্তব্য চায়। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন মুখ খোলেননি। ১৫ই মার্চ ভাষা-আন্দোলনের
বন্দী ছাত্র ও কর্মীদের মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯ মার্চ, ১৯৪৮। জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। যার হাত ধরে পাকিস্তানের সৃষ্টি, সেই জিন্নাহর এই প্রদেশে এটাই ছিল প্রথম আর শেষ ভ্রমণ। ২১ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে(অধুনা সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) এক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ভাষা আন্দোলন মুসলিমদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা কখনোই ক্ষমা পাবে না-
“Let
me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be
Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead you is really the enemy
of Pakistan. Without one state language, no nation can remain tied up solidly
together and function. Look at the history of other countries. Therefore, so
far as the state language is concerned, Pakistan’s shall be Urdu.”
জিন্নাহর এই কথায় তাৎক্ষনিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্রসহ জনতার
একাংশ। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গিয়ে
জিন্নাহ বাংলা ভাষার সন্মান রক্ষায় আন্দোলনরত ছাত্র,
শিক্ষকসহ এ দেশের মানুষকে পাকিস্তানের শত্রু ও বিশ্বাসঘাতক
হিসেবে অপমানিত করেন। জিন্নাহ ভাষা সমস্যাকে ‘ভারতের দালালি’ বলে অখ্যায়িত করেন। তাঁর ভাষায়,
“Our
enemies, among whom I regret to say, there are still some Muslims, have set
about actively encouraging provincialism in the hope of weakening Pakistan and
thereby facilitating the re-absorption of this province into the Indian
Dominion.”
এরই সাথে তিনি আবারও স্পষ্ট করে জানিয়ে রাখলেন,
“Urdu
and Urdu alone shall be the state language of Pakistan.”
ছাত্ররা এইদিন প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিলেন। যখন জিন্নাহ উর্দুর ব্যাপারে তার
অবস্থানের পুনরুল্লেখ করেন, তখন ডিপ্লোমা ডিগ্রি গ্রহণ করতে সেখানে উপস্থিত থাকা ছাত্র
আব্দুল মতিন চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়ান এবং জোরে বলে ওঠেন,
“না,
এটা হতে পারে না!",
এ. কে. এম আহসান প্রমুখ উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে “না,
না।” বলে চিৎকার করতে থাকে। জিন্নাহ তার জীবনে কোনো দিন এই
পরিস্থিতির মুখোমুখি হন নি। তিনি কিছু সময় চুপ করে থাকলেন। তারপর আবার কথা বলা
শুরু করলেন। এই প্রতিবাদকে তিনি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উল্লেখ করলেন। জিন্নাহর এই
ঢাকা সফর তাই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে কেবল একটি ব্যর্থ মিশন হিসেবেই নয় বরং এই সফর
পূর্ব বাংলার মানুষকে প্রকৃতপক্ষেই অসন্তুষ্টি এবং অবিশ্বাসের এমন একটি পর্যায়ে
নিয়ে গিয়েছিল যেখান থেকে ফিরে আসা দুরূহ ছিল।
২৪ তারিখই জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে মিটিং করেন,
সেখানে তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে করা চুক্তিকে ‘চাপের
মুখে করা চুক্তি’ বলে উড়িয়ে দেন। জিন্নাহ কঠোর ভাষায় তাদেরকে শাসিয়ে দেন,
“যে কোন অসাংবিধানিক আন্দোলন কঠোর
হস্তে দাবিয়ে রাখা হবে।” অনেক তর্কের মাঝে শেষ হয় সভা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে
ছাত্ররা তার কাছে স্মারকলিপি দেয়। মিটিং এর মাঝে জিন্নাহ চ্যালেঞ্জ করে বসলে,
“উর্দু ভাষা কত সমৃদ্ধ,
বাংলাভাষী বিখ্যাত কাউকে কি দুনিয়া কোনো দিন দেখেছে?”
পাকিস্তানের জাতির জনকের এহেন জ্ঞানের অভাব ছাত্রদের স্তম্ভিত করে। তারা আর
নিজেদের ধরে রাখতে পারেনি। জিন্নাহ আদৌ কাজী নজরুল ইসলাম,
বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম
শুনেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলেন তারা। জিন্নাহ থতমত খেয়ে কোনো উত্তর দিতে পারলেন না।
সুদীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মজীবনে এই প্রথম জিন্নাহ এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন,
যেখানে তাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। কোথাও কোথাও বলা
হয়েছে যে, জিন্নাহকে একপেশে ব্রিফিং দেওয়া হয়েছিল পূর্ব বাংলা নিয়ে। বলা হয়েছিল,
বাংলার দাবি কেবল কিছু ষড়যন্ত্রকারী হিন্দু,
কমিউনিস্ট আর পাকিস্তানবিরোধী বিপথগামীদের চাল। ২৮ মার্চ
জিন্নাহ ঢাকা ত্যাগ করেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা তিনি রেডিওতে সেই একই কথা বলেন,
বাংলার কোনো স্থান নেই। এই ভাবে ১৯৪৭-৪৮ সালে সমগ্র দেশের
ছাত্র ও জনগণের সমর্থিত বিরাট সম্ভাবনাময় ভাষা আন্দোলনের দুঃখজনক পরিসমাপ্তি ঘটে।
জিন্নাহ চলে যাবার পর ছাত্রলীগ আর তমদ্দুন মজলিশ এর সভা হয়। পরবর্তীতে তমদ্দুনের
এই ভাষা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়াতে তারা কমিউনিস্টদের দায়ী করে এবং আন্দোলন থেকে সরে
আসে।
১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ মারা গেলেন। তখন খাজা নাজিমুদ্দিন পদোন্নতি পেয়ে
জিন্নাহর পদ পেয়ে গেলেন, হলেন পাকিস্তানের ২য় গভর্নর জেনারেল। নুরুল আমিন হয়ে গেলেন
বাংলার মুখ্য মন্ত্রী, যদিও আসল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের হাতেই ছিল।
১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে দশ দিনের সফরে লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান আসেন।
২৭ তারিখ তাকে একটি সংবর্ধনা দেয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (DUCSU)। রাষ্ট্রভাষা
সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসুর সহ-সভাপতি লিয়াকত খানকে একটি স্মারকলিপি দেওয়ার
সিদ্ধান্ত হয় যেখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার প্রস্তাব থাকে। এ মানপত্রটি পাঠ
করেন ইউনিয়নের তৎকালীন সেক্রেটারি গোলাম আযম। আসলে এটি পাঠ করার কথা ছিল ইউনিয়নের
ভাইস প্রেসিডেন্ট অরবিন্দ বসুর। কিন্তু লিয়াকত আলীকে ভাষা আন্দোলনের দাবি সংবলিত
মানপত্র পাঠ একজন হিন্দু ছাত্রকে দিয়ে করালে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এবং
মুসলিম লীগ সরকার এ নিয়ে নানা প্রকার বিরূপ প্রচারণা শুরু করবে এ আশংকা থেকেই একজন
মুসলমান ছাত্র হিসেবে সেক্রেটারি গোলাম আযমকে সেটা পাঠ করতে দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য
লিয়াকত আলী খান একটুও পাত্তা দেন নি এই দাবিতে।
১৯৪৮ সালের পর বাংলা ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লেও পাকিস্তানের শাসক
শ্রেণির বাংলা ভাষা বিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। বাংলা ভাষাকে সমূলে উৎপাটন করাই
ছিল এ প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য। এ জন্য আরবি হরফে বাংলা লেখার আজগুবি এক প্রস্তাব নিয়ে
হাজির হয় তারা। এ কাজে বাংলাভাষী কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান দালালের
ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান
শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বললেন,
“এখন থেকে ইসলামের স্বার্থে বাংলাকে আরবি হরফে লিখতে হবে,
এই হিন্দুয়ানি হরফ বাদ দিয়ে। কারণ প্রত্যেক বাংলা অক্ষর
কোনো না কোনো হিন্দু দেব দেবীর সাথে সম্পর্কিত।”
তার মতে, পাকিস্তান আর দেবনগরী হরফ এক সাথে থাকতে পারে না। অবশ্যই বাংলাকে কুরআনের
ভাষার সাথে সম্পর্কিত করতে হবে। অতএব, বাংলা ভাষার নেমে আসে উপর রাষ্ট্রীয় খড়গ,
শুরু হল বাংলার ‘ইসলামিকরণ’। বাঙলার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটা
নতুন পরিচিতি দেবার জন্যে অনেক মুসলিম কবি সাহিত্যিক উঠে পড়ে লেগেছিলেন। একটা
দৃষ্টান্ত দিলে এই পরিস্থিতির গভীরতা অনুমান করা যাবে। আরবি
হরফ প্রচলন ও মুসলমানি বাংলা সৃষ্টির প্রচেষ্টায় মদনমোহন তর্কালঙ্কারের
শিশুশিক্ষামূলক ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’
কবিতাটিকে চরম বিকৃত করে কবি গোলাম মোস্তফা লিখলেন,
“ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি
হররোজ আমি যেন নেক হয়ে চলি
হুকুম করেন যাহা মোর বুজুর্গানে
আমি যেন সেই কাম করি দিলে জানে।”
এমনকি, ১৯৫১ সালে সৈয়দ আলী আফসান সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার এবং জাতীয়
সংহতির জন্যে রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করা যেতে পারে মন্তব্য করছিলেন। শুধু
রবীন্দ্রনাথ নয়, নজরুলের কাব্যে যেসব ‘অবাঞ্ছিত অংশ’ আছে,
সেগুলোও বাদ দেবার কথা উঠেছিলো। ১৯৫৮ সালের পরে গানের
বাণীতে ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ – যেমন ‘পূজা’, এমন কি ‘জননী’ থাকলে সে গান রেডিওতে গাওয়া যেত না। কবি কাজী নজরুল ইসলামের
কবিতাও এর থেকে রেহাই পায়নি। তাঁর কবিতা ‘চল্ চল্ চল্’ এর “সজীব করিব মহাশ্মশান” চরণের সংশোধনে “সজীব করিব
গোরস্থান” কথাটি লেখা হল।
যাই হোক, “এখন থেকে আরবি হরফে বাংলা লিখতে হবে”- এই মতের বিরুদ্ধে বরাবরের মতোই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হলো,
প্রতিবাদলিপি দেওয়া হলো। ফজলুর রহমানের এই
ঘোষণার প্রতিবাদে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের
ছাত্রছাত্রীরা মোস্তফা নূর উল ইসলামের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন ।
৯ মার্চ, ১৯৪৯ তারিখে পূর্ব বাংলা সরকার একটি কমিটি গঠন করে- ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’। এর প্রধান ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খান, অন্য ১৬ সদস্যের মাঝে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ছিলেন। ৬ ডিসেম্বর কমিটি রিপোর্ট দেয়। বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করতে মন্ত্রণালয়কে দেওয়া সে রিপোর্টে বলা ছিল, হয়তোবা বাংলাকে আরবি হরফে লেখা যাবে, কিন্তু সেটা ২০ বছরের আগে নয়। পরে অবশ্য সরকার বাংলাকে ইংরেজি হরফে লিখবার প্রস্তাবও দেয়, তাও যেকোনো প্রকারে ‘হিন্দুয়ানি’ দূর করা দরকার তাদের কাছে। তবে এগুলোর কোনোটাই সফল হয়নি।
কিন্তু ১৯৫০ এর এপ্রিলে পূর্ব বাংলার জেলায় জেলায় ২০টি শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন
করে, সেখানে
আরবি হরফে বাংলা লেখা শেখানো শুরু হয়! অনেক বড় অংকের টাকা খরচ করা হয় এর জন্য।
পাঠ্যবইগুলো আরবি হরফে প্রিন্ট করতে বলা হয়। বলা হয়,
যারা এভাবে লিখবে, সেসব লেখককে পুরস্কৃত করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা
বিভাগের ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করেন, প্রশ্ন তুলেন ডক্টর শহীদুল্লাহও। জনমত বিরুদ্ধে যায় দেখে
পরে এ প্রকল্প বাতিল করা হয়।
১৯৪৯ সালের ১লা জানুয়ারি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বললেন,
“বাংলা ভাষাই বাংলার হিন্দু মুসলিমের ঐক্যের মাধ্যম। এটাই
আমাদের বাঙ্গালিত্বের পরিচায়ক।”
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আরও বলেন, “বাংলার জন্য আলাদা একটা একাডেমি খোলা উচিৎ।” তার এই কথা
প্রবলভাবে নিন্দিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। মজার ব্যাপার হলো,
১৯৫৫ সালে ঠিকই বাংলা একাডেমি খোলা হয় এবং
সেটা এমন এক জায়গায়, যেখানে বাংলাবিরোধীর আস্তানা ছিল- খোদ খাজা নাজিমুদ্দিনের
বাসস্থান ‘বর্ধমান হাউস’। এখন সেটাই বাংলা একাডেমি।
প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫শে জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭শে
জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহর কথারই
পুনরুক্তি করে বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু” এবং “উর্দু
হরফে বাংলা লিখনের প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হচ্ছে” বলেও উক্তি করেন। নাজিমুদ্দিনের
বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯শে জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং
৩০শে জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্র ও নেতৃবৃন্দ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা করার
সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠিত হয়। সভায় আরবি হরফে বাংলা লেখার সরকারী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০শে জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘটে সমর্থন দেওয়া হয়। পরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এছাড়া, পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। সভা শেষে প্রায় দশ হাজার ছাত্র ছাত্রী এক বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হতে বের হয়ে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবন হয়ে হাইকোর্টের সম্মুখ দিয়ে নবাবপুর রোড, পাটুয়াটুলি, আর্মানিটোলা ও নাজিমুদ্দিন রোড অতিক্রম করে। ছাত্রছাত্রীগণ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’ প্রভৃতি স্লোগান দেয়।
২০
ফেব্রুয়ারি বুধবার ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারার আদেশ জারী করে এক মাসের
জন্য ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা প্রভৃতি নিষেধ করেন। আদেশ জারির কারণস্বরূপ তিনি
বলেন যে,
“একদল লোক শহরে সভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের প্রয়াস পাওয়ায় এবং তদদ্বারা
জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হওয়ার আশংকা থাকায় এই ব্যবস্থা অবলম্বিত
হয়েছে।”
এমতাবস্থায়, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪, নবাবপুর রোডে অবস্থিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয়
কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা
অনুষ্ঠিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা না
করা প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ও বাগবিতণ্ডার পর রাত নয়টার দিকে ভোটাভুটির দ্বারা
সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফজলুল হক হলের প্রতিনিধি শামসুল আলম,
যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ,
মেডিক্যাল কলেজ ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম মওলা ও ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের
পক্ষে ভোট দেন। যুবলীগের মোহাম্মদ তোয়াহা ভোট দানে বিরত ছিলেন। বাকি সবাই (১১জন )
১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে ভোট দেয়। এভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত জয়
যুক্ত হয়।
কিন্তু, অলি আহাদ(শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ইনিও ১৯৪৭-৪৮ এর ভাষা আন্দোলনে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন) পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দেন। অলি আহাদ বলেন, “১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে একুশ তথা ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না।” অলি আহাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সভাপতি আবুল হাশিম প্রশ্ন তুললেন যে, “ছাত্র সমাবেশ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে বাতিল করে তাহলে তো সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে।” সভাপতির কথার পর অলি আহাদ উঠে দাড়িয়ে হাসতে হাসতে বলেন, “আমি সভাপতির কথা বুঝতে পারছি এবং সেই জন্যই তো বলছি, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটকে প্রস্তাব হিসেবে না নিয়ে তা মত হিসেবে ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠদের ভোটকে দুইটা মত হিসেবে উপস্থিত করে আগামীকালের ছাত্র সমাবেশের ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়াটা হবে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত।” সভাপতি মৃদু হেসে বলেন, “I appreciate Oli Ahad’s point.”
সে রাতে হল-হোস্টেলগুলিতে ছাত্রদের চোখে ঘুম ছিল না। গভীর রাত পর্যন্ত তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন। কেউ কেউ অন্যান্য ছাত্রাবাসের। ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, যাতে তারা একুশের সকালে আমতলার সভায় হাজির হন। এসব আলোচনার মূল কথা ছিল একটাই, ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্তে নিশ্চিত থেকে নির্ধারিত কর্মসূচি পালন এবং সর্বোপরি অ্যাসেম্বলি ঘেরাও করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব নিতে এম. এল. এ. দের বাধ্য করা।
২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১২ টার মধ্যে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিচ্ছিন্নভাবে
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে হাজির হয়। প্রায় সাড়ে ১২টার সময় বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাঙ্গণে গাজিউল হকের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক আবদুল মতিন আন্দোলনের পূর্বাপর পর্যায় ও ১৪৪
ধারা প্রবর্তনের ফলে উদ্ভূত বিশেষ সংকটজনক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেন এবং সাধারণ
ছাত্রছাত্রীদের উপরেই ১৪৪ ধারা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন।
তখনই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে
শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালানের জন্য বক্তৃতা দেন। কিন্তু আন্দোলন সম্পর্কিত
ছাত্রদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি তার সহকর্মীগণসহ সভা থেকে
বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলেন।
অতঃপর ব্যাপকতর পর্যালোচনার পর ভাষার দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য
পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরপর ছাত্র-যুবনেতাদের
দু-একজনের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক
আবদুল মতিনের মূল প্রস্তাব, “এ মুহূর্তে ১৪৪ ধারা ভেঙে নির্ধারিত কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে
না গেলে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে, ভাষার দাবি কোনো দিনই অর্জিত হবে না।” উপস্থিত ছাত্রদের
সমর্থনে এমন সিদ্ধান্তই বহাল থাকে। ছাত্রসভায় সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা অমান্য করার
গুরুত্ব রাজনীতি-সচেতন ছাত্ররা ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন। সেই পথ
ধরে সচেতন ছাত্রসমাজ চলতে চেয়েছে বলেই ‘একুশে'কে ‘ঐতিহাসিক একুশে'তে পরিণত করা সম্ভব হয়েছিল।
ছাত্ররা সুদৃঢ় আত্মসচেতনতায় ঐক্যবদ্ধভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে অভিমত ঘোষণা করে। এ সময় ছাত্রনেতা আবদুস সামাদ প্রস্তাব করলেন, ছাত্ররা দশজন দশজন করে বের হবে, লক্ষ্য অ্যাসেম্বলি হল, আপাত গন্তব্য কাছাকাছি অবস্থিত মেডিক্যাল ব্যারাক প্রাঙ্গণ। এটা এক ধরনের সত্যাগ্রহ, এতে একদিকে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করা হবে, অপরদিকে ব্যাপক আকারের গোলযোগ এড়ানো সম্ভব হবে। ছাত্ররা এ প্রস্তাব মেনে নিলো শেষ পর্যন্ত। সঙ্গে সঙ্গে সভা ভঙ্গ করে দশজনী মিছিল বের করার জন্য ছাত্ররা “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই", “রাজবন্দীদের মুক্তি চাই”, “পুলিশি জুলুম চলবে না”, “চলো, চলো, অ্যাসেম্বলি চলো” ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে গেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতকে বিবেচনা করার আহবান জানাতে থাকে।
পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারিদিকে প্রাচীর তৈরি করে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন
এবং উপাচার্য সে সময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে
প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে চাইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস বর্ষণ করে ছাত্রদের
সতর্ক করে দেয়। কাঁদানে গ্যাসের আক্রমণ এতটাই প্রবল ছিল যে,
গোটা এলাকা ধুলো ও ধোঁয়ায় একাকার হয়ে যায়। গ্যাসের
জ্বালায় ছাত্রদের অনেকে বেলতলার পুকুরে রুমাল ভিজিয়ে চোখে চেপে ধরতে থাকে। কিছু
সংখ্যক ছাত্র দৌড়িয়ে গিয়ে রাস্তার অপর পাশের ময়দানে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং কিছু
সংখ্যক ছাত্রকে দৌড়িয়ে মেডিকেল কলেজের দিকে যেতে দেখা যায়। কিন্তু বাকিরা ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের
বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ
বন্ধ করতে এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করতে বলেন। উপাচার্যের
অনুরোধক্রমে ছাত্ররা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে শুরু করে। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করে
রাস্তায় বের হলেই ১৪৪ ধারা অমান্য করা হয়েছে বলে পুলিশ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে
এবং বহু ছাত্রকে মোটরে করে সুদূর তেজগাঁও নিয়ে ছেড়ে দেয়। আবদুস সামাদ,
হাবীবুর রহমান শেলী,
আলী আজমল, আনোয়ারুল হক খান প্রমুখ ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। মোট ৬২ জনকে
পুলিশ গ্রেফতার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক রাখে। এই ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুদ্ধ
হয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পুনরায় শুরু করে। এই সময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কিছু
মহিলা তাদের এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে।
এদিকে মেডিক্যাল কলেজের সামনে সমাবেশের প্রস্তুতি চলছিল। বেলা ২টার দিকে আইন
পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা পথরোধ করে পরিষদে রাষ্ট্রভাষা
সম্পর্কে আলোচনা করার ও পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য অনুরোধ
জানায়। কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে,
যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয়,
তারা আইন সভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। এ সময়
রাস্তায় ছাত্রদের সমাবেশ হতে থাকে। পুলিশ জনতাকে চলে যেতে বললে তারা যেতে অস্বীকার
করে। এরপর পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে ও লাঠিচার্জ করে এবং ছাত্ররা পুলিশের
উপর প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করতে থাকে। ছাত্ররা যতই স্লোগান দেয় মিছিলে একত্রিত হয়,
ততই পুলিশ হানা দেয়। কয়েকবার ছাত্রদের উপর কাঁদুনে গ্যাস
ছেড়ে তাড়া করতে করতে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। হোস্টেল প্রাঙ্গণে
ঢুকে ছাত্রদের উপর আক্রমণ করায় ছাত্ররা বাধ্য হয় ইট পাটকেল ছুড়তে। একদিকে ইট
পাটকেল আর অন্যদিক থেকে তার পরিবর্তে কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠিচার্জ আসে।
শেষ পর্যন্ত পুলিশের বেপরোয়া আক্রমণ থেকে মাথা বাঁচিয়ে ছাত্রদের ব্যারাক
প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। তখন বেলা দুপুর। ব্যারাক প্রাঙ্গণে পৌছে
ছাত্রদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে অ্যাসেম্বলি ভবন ঘেরাও। আইনসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা
বিকেল তিনটায়। বেলা গড়াতে শুরু করলে অছাত্র অনেককেই জমায়েত হতে দেখা যায়,
রাষ্ট্রভাষার দাবি তখন আর ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
দাবি আদায়ের লড়াইটা হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতা সবারই,
২২ ফেব্রুয়ারির গণআন্দোলনে যা পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে
আত্মপ্রকাশ করে।
আইনসভার অধিবেশনে যোগ দিতে অনেক সদস্যই ব্যারাকের সামনের রাস্তা দিয়ে যাবেন,
ছাত্রদের এমন ধারণা ভুল ছিল না। মেডিক্যাল
কলেজের কয়েকজন ছাত্র তাই সহজেই মানিকগঞ্জের এম. এল. এ. আওলাদ হোসেনকে
হোস্টেলে নিয়ে আসে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব তোলার শর্তে তিনি মুক্তি
পান। ছাত্ররা মন্ত্রী হাসান আলীর গাড়িও আটক করে,
কিন্তু পুলিশ তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। বিরোধীদলীয় সদস্য
নেলী সেনগুপ্ত ছাত্রদের দাবি উপেক্ষা করে দ্রুত চলে যান। এসব ঘটনার মধ্যেই সমবেত
ছাত্র-জনতার চেষ্টা চলে হোস্টেল-সংলগ্ন পরিষদ ভবনের সামনের রাস্তায় পৌছানোর।
কিন্তু লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের আক্রমণে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। পুলিশের
কঠিন বাধার মুখে ছাত্রদের একমাত্র পুঁজি বহু উচ্চারিত স্লোগান— “রাষ্ট্রভাষা
বাংলা চাই”,
“পুলিশি জুলুম চলবে না” ইত্যাদি। আন্দোলনের
প্রচারকাজে সাহায্য করতে একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে মেডিকেল কলেজ ইউনিয়নের উদ্যোগে
২০ নম্বর শেডের ১ নম্বর কক্ষে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। প্রচারকাজে ব্যবহার
করা হয় কলেজ ইউনিয়নের নিজস্ব মাইক-স্পিকার। প্রচারের সার্বক্ষণিক দায়িত্বে
থাকেন মেডিকেলের কয়েকজন ছাত্র। মাত্র দুই দিনের আয়ু নিয়ে এই কন্ট্রোল রুম
আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি হয়ে উঠেছিল। গুলিতে ছাত্র-অছাত্র হত্যার খবর
এখানকার প্রচারের কল্যাণেই মুখে মুখে গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল,
এমনকি পৌছেছিল পরিষদ ভবনেও।
৩টার দিকে পুলিশ তখন ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এরপরের ঘটনা লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে। ঘটনাস্থলেই আবদুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন আহমদ শহীদ হন। আর ১৭ জনের মতো আহত হন। তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে রাত আটটার সময় আবুল বরকত শহীদ হন। হোস্টেল প্রাঙ্গণে সমবেত ছাত্রদের কেউ ভাবতে পারেনি, বিরাজমান পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি চালাতে পারে। সে জন্যই কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটার আওয়াজ শুনতে শুনতে গুলির আওয়াজে জনা কয়েক ছাত্র চেঁচিয়ে ওঠে, “ফাঁকা আওয়াজ, ফাঁকা আওয়াজ”। কিন্তু ওগুলো যে ফাঁকা আওয়াজ নয়, তা বোঝা গেল কয়েকজনকে গুলির আঘাতে পড়ে যেতে দেখে, বিশেষ করে, ১৪ নম্বর ব্যারাকের সামনে মাথায় গুলি লাগা ছাত্রটিকে(ভাষাশহিদ রফিকউদ্দিন আহমেদকে) দেখে। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘আত্মরক্ষার জন্য’ পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে চলে বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে, মোট ২৭ রাউণ্ড গুলি চলেছিল সেদিন। বরকত, জব্বার, রফিক ছাড়াও ফুলার রোডে পুলিশের গুলিতে অজ্ঞাতনামা কিশোরের মৃত্যু এবং তাকে পুলিশের তুলে নেওয়ার ঘটনা দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত হয়। এবং খেলার মাঠের পশ্চিমে রাস্তায় সমবেত জনতার ওপর পুলিশের গুলিতে অন্তত আরও একজন যে শহীদ হয়েছিলেন, তা তৎকালীন মাদ্রাসাছাত্র লোকমান আহমদ আমীমীর ভাষ্যে জানা যায়। সাদা শার্ট ও পায়জামা পরা ওই যুবকেরও পরিচয় মেলেনি, যদিও তাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বলে লোকমান আহমদ জানান।
পরিষদ ভবনেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশসহ একাধিক পরিষদ সদস্য প্রতিবাদে সোচ্চার হন এবং মুখ্যমন্ত্রীকে ঘটনাস্থলে যেতে দাবি জানান। মুখ্যমন্ত্রীর অস্বীকৃতিতে তারা অধিবেশন বর্জন করে হোস্টেল প্রাঙ্গণে চলে আসেন এবং রক্তের ছাপ, দেয়ালে বুলেটের আঘাত-চিহ্ন ঘুরে ঘুরে দেখেন। মাওলানা তর্কবাগীশ কন্ট্রোল রুমের মাইকে হত্যাকারী সরকারের পদত্যাগ দাবি করে বক্তৃতাও দেন, অথচ তিনি নিজে ছিলেন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্য। আরও যারা পরিষদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে হোস্টেলে আসেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনোরঞ্জন ধর, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ। তবে, ভাবতে অবাক লাগে যে, ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতের সভায় যেসব ছাত্র-যুবা ও রাজনৈতিক নেতা ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাঙার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তাদেরই কেউ কেউ একুশের কালো সন্ধ্যায় চোখের জলে ভিজে শহীদদের প্রতি সমবেদনা জানাতে এসেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে “হঠকারী পদক্ষেপ” হিসেবে চিহ্নিত করে।
অন্ত্যেষ্টির শেষে, আন্দোলনকারীরা প্রথমে স্থির করে রফিকউদ্দিন ও আব্দুল
জব্বারের দেহ নিয়ে শোকমিছিল করা হবে, চরম আত্মদানেও বুঝি মাতৃভাষার প্রতি তাঁদের দায় শেষ হয়নি,
আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রদের তাই
প্রবল ইচ্ছা, তারা যেন মিছিলে ছাত্র-জনতার সঙ্গী হন। কিন্তু,
ছাত্রযুবা নেতৃত্ব সেদিন অর্থাৎ ২১শের রাতে রফিক-জব্বারের
মৃতদেহ রক্ষা করতে অসফল হয়। ছাত্রদের চোখ এড়িয়ে গভীর রাতে রফিক-জব্বারের মরদেহ
গুম করে ফেলে পুলিশ। সেদিনই গভীর রাতে বিবেকহীন সরকারের প্রতিনিধিদের উদ্যোগে ওই
শহীদদের শেষ আশ্রয় জোটে আজিমপুর কবরস্থানের গণকবরে,
তাদের স্বাভাবিক সমাধিস্থকরণের সমস্ত দাবি অগ্রাহ্য করে।
২২শে ফেব্রুয়ারি খুব ভোরে মেডিকেল কলেজের দুই তরুণ ছাত্র আলমগীর ও আমির আহসান ওই
সমাধির ওপর থেকে রক্তমাখা কিছু কাপড়চোপড়ের অংশ নিয়ে এসে সেই অপকর্মের হদিস জানায়।
আন্দোলন চলতেই থাকে। পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি প্রায় হাজার লোকের এক
শোভাযাত্রা বের হয়। শোভাযাত্রায় কর্মী ও যুবকগণ শহীদদের রক্তাক্ত জামা-কাপড় লাঠির
অগ্রভাগে বেধে বিক্ষোভ করতে থাকে। “শহীদ স্মৃতি অমর হোক”, “খুনি নুরুল আমিনের বিচার চাই”, “রক্তের বদলে রক্ত চাই”- স্লোগানে
শোভাযাত্রা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পথ পার্শ্বের জনতা এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে
বিক্ষুব্ধ ভাবে তাদের অনুসরণ করে। ২২শের বিস্ফোরক পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার
সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে বাধ্য হয়, জারি করে সান্ধ্য আইন। তবু অবস্থা আয়ত্তে আসেনি। মিছিলে
মিছিলে ছয়লাপ শহরে সেদিন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল,
অনেকটা ওই কবিতার পঙক্তির মতো,
“আজ হরতাল। আজ চাকা বন্ধ।” সত্যি,
ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে রেলের চাকা বন্ধই ছিল। সেদিন
শুধু বাজারহাট, দোকানপাটই বন্ধ থাকেনি, অফিস-আদালতের কর্মচারী এবং কারখানার শ্রমিক (অবশ্য অবাঙালি
বাদে) সবাই বিনা আহ্বানে মিছিলে শামিল হয়েছে,
বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে।
ক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল ঢেউ লক্ষ করেও পুলিশ - ই. পি. আর. বাহিনী তাদের
ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। শোভাযাত্রার মাঝখানে পুলিশ হঠাৎ লাঠিচার্জ করার পরও
জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে না পেরে গুলি চালায়। এখানেই হাইকোর্টের কেরানী শফিউর রহমান
শহীদ হন। তারই সাথে শহিদ হন রিকশাচালক আবদুল আউয়াল,
কিশোর অহিউল্লাহ, তাঁতীবাজারের যুবক সিরাজউদ্দিন এবং নাম না-জানা আরও কয়েকজন,
যাদের সামরিক যানে ও পুলিশ ভ্যানে তুলে নিতে দেখা গেছে।
শোভাযাত্রার এই অংশ সদরঘাট এলে পুনরায় তাদের উপর লাঠিচার্জ করা হয়। মিছিল মিটফোর্ড হয়ে চকবাজার দিয়ে মেডিক্যাল হোস্টেলে গিয়ে শেষ হয়। এইদিন জনসাধারণের বিভিন্ন অংশ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে দলবদ্ধ হয়ে শোভাযাত্রা বের করে ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। আন্দোলনরত মানুষরা সরকারপন্থী সংবাদপত্র মনিং নিউজ পত্রিকার ছাপাখানা ‘জুবিলি প্রেস’ পুড়িয়ে ছাই করে দেয়, ভাষাপ্রেমী তরুণদের ক্ষোভ প্রকাশ পায় এভাবেই। তারা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি প্রেসের কাছে আসতে দেয়নি। এর কারণ রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে মর্নিং নিউজ-এর সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার ও মিথ্যা খবর পরিবেশন, এককথায় আন্দোলনের বিরোধীতা। একুশের ঘটনার প্রতিবাদে দৈনিক আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। গভর্ণর ও স্পিকারের কাছে লেখা পদত্যাগপত্রে তিনি পুলিশি অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করে লেখেন,
“বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করায়
ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে তাহার প্রতিবাদে আমার সদস্যপদ হইতে
পদত্যাগ করিতেছি । যে নুরুল আমিন সরকারের আমিও একজন সমর্থক- এ ব্যাপারে তাহাদের
ভূমিকা এতদূর লজ্জাজনক যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল
থাকিতে লজ্জাবোধ করিতেছি।”
২৩শে ফেব্রুয়ারি, শনিবারও যথারীতি স্বতঃস্ফূর্ত পূর্ণ হরতাল, মিছিলে-স্লোগানে সরব ঢাকা আন্দোলনের অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে। ১৪৪ ধারার মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে রাজপথে জনতার ঢল। তা সত্ত্বেও পুলিশের লাঠিচার্জ ও রাতের কারফিউ অব্যাহত থাকে। বহু মিলিটারি শহরের রাস্তাগুলিতে টহল দিতে থাকে। সেক্রেটারিয়েটসহ সকল অফিস আদালতে ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। সেদিনও বাঙালি রেল কর্মচারীদের ওপর গুলি চলে এবং অভাবিত ঘটনা যে, গুলি চালাতে অস্বীকার করায় পুলিশের একাংশের অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়, গ্রেপ্তার হন এক হাবিলদারসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। একুশের আবেদন ছিল এতটাই গভীর, এতটাই হৃদয়স্পর্শী।
শুধু নিরক্ষবলয়ই নয়, ডানপন্থী অনেক সংগঠনই তখন পুলিশি জুলুমের নিন্দায় সোচ্চার
হয়ে ওঠে। যে সব রাজনীতিবিদ এতদিন ভাষা আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন তাঁরা (যেমন এ.কে.
ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ) ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘সিভিল লিবার্টি কমিটি’ বা ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা কমিটি’ নামে একটি সমিতি গঠন করে ভাষা
আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ পরিষদ থেকে
পদত্যাগ করেন, তাঁর অনুগামী হয়ে একাধিক মুসলিম লীগ সদস্য দলত্যাগ করেন। শামসুদ্দিন আহমদের
নেতৃত্বে গঠিত হয় আইন পরিষদে নতুন বিরোধী দল।
১২ নম্বর শেডের সামনে এবং হোস্টেলের হাঁটাচলার রাস্তাটার পাশে স্মৃতিস্তম্ভ
তৈরির স্থান ঠিক হয়। জায়গাটা বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থান থেকে সামান্য দূরে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রগণ তাদের কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে নিজ হস্তে একরাত্রির
মধ্যে ১০ ফুট উচ্চ ও ৬ ফুট চওড়া একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। কারফিউর রাত।
গেটের বাইরে রাস্তায় সশস্ত্র টহলদারি। এর মধ্যেই সাহসী ছাত্ররা খাওয়াদাওয়া শেষে
রাত ১০টা থেকে কাজ শুরু করে দেন। হোস্টেলে উপস্থিত প্রায় সবাই একটুখানি হলেও কাজে
হাত লাগিয়েছেন, এমনকি হোস্টেলের বয়-বাবুর্চিরাও। কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে মানববন্ধনের মতো করে
দাড়িয়ে হাতে হাতে ইট টানা, হাসপাতালের স্ট্রেচারে বালি আর সিমেন্ট বহনের মতো কাজ সবই
ছাত্রদের শ্রমে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরের মধ্যে স্মৃতিস্তম্ভের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল।
তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ যুক্ত করা হয়েছিল,
যাতে লেখা ছিল ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। এটি উদ্বোধন করেন
আন্দোলনে শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। দু-তিন
দিনের মধ্যেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে ওঠে আন্দোলনের জন্য নতুন প্রেরণা। তখনো
ঢাকায় হরতাল চলছে, পথে পথে মিছিলও চলছে। এসব দেখেশুনে হয়তো শাসকশ্রেণীর টনক
নড়ে। আন্দোলনে নতুন করে উদ্দীপনার উৎস স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়
পাকিস্তান সরকার।
ঠিক আড়াই দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি শেষ বিকেলে স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে
ফেলার কাজ শেষ করে সশস্ত্র পুলিশ। সেদিন শেষ বিকেলে হঠাৎ আসা একদল সশস্ত্র পুলিশ
মেডিকেল হোস্টেল ঘিরে ফেলে। অন্যরা ট্রাক ভর্তি সরঞ্জাম নিয়ে ভেতরে ঢোকে। রাইফেল
হাতে কয়েকজন পুলিশ উপস্থিত ছাত্রদের দিকে তাক করে বসে থাকে। এবারও সশস্ত্র
পুলিশের সঙ্গে নিরস্ত্র ছাত্রদের পক্ষে লড়াই করা সম্ভব ছিল না। তাই বাঁচানো
যায়নি মমতায় গড়া শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি। অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু
করার ছিল না তাদের। তাদের চোখের সামনে স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে টুকরো টুকরো করে ট্রাকে
তুলে নিয়ে চলে যায় পুলিশ। মাটি খুঁড়ে শেষ ইটটিও তুলে নেয় তারা। পেছনে পড়ে
থাকে ধোঁয়া আর ধুলো, সেই সঙ্গে স্মৃতি।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইসলামপুর রোড ও ঢাকা রেল স্টেশনের আর. এম. এস. অফিসের নিকট
জনতার উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ফলে কয়েক ব্যক্তি আহত হয়। এরই মধ্যে শহরের নানা
স্থানে সরকারের সমালোচনামূলক নানা নতুন ধরণের প্রচারপত্র বিলি করা হয়। অন্যদিকে,
২১ ও ২২শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সরকারও আন্দোলনের বিপক্ষে
জোর প্রোপাগান্ডা চালাতে থাকে। তারা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে যে,
কমিউনিস্ট ও পাকিস্তান বিরোধীদের প্ররোচণায় ছাত্ররা পুলিশকে
আক্রমণ করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এদিনকার বেতার-বক্তৃতায়দাবী করেন, পাকিস্তান ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে রয়েছে দেশি-বিদেশি
রাষ্ট্রদ্রোহী চক্র, রয়েছে তাদের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ, রয়েছে
ভারতীয় মদদ। এরই সাথে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন অনির্দিষ্টকালের জন্য আইনসভার
অধিবেশন স্থগিত করে দেন।
২৫ ফেব্রুয়ারি সোমবারও ঢাকা শহরে সর্বত্র পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এ অবস্থায়
সরকারের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের সূচনা সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক হল ও জগন্নাথ কলেজে পুলিশ – ই. পি. আর. সেনাদের যৌথ হামলায়। সেনা ছাত্রদের
প্রচারযন্ত্র ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। পুলিশ তিনবার যুবলীগ অফিসে হানা দেয়। তবে,
ক্রমাগত ধর্মঘটে অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের আর্থিক সংকটের আশংকা
থাকায় ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত
অপরাপর প্রতিষ্ঠানের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে।
এরই মধ্যে, আন্দোলনে সক্রিয় নেতাদের কে সম্পুর্ণ অবজ্ঞা করে ২৫শের দুপুরে মেডিক্যাল
কলেজের হোস্টেলে কমিটি বৈঠকে বসে। অনেক তর্কবিতর্কের পর সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীকে
৯৬ ঘন্টার চরমপত্র দেওয়ার প্রস্তাব নেওয়া হয়। সরকারের কাছে রাষ্ট্রভাষা
সম্পর্কিত ৯ দফা দাবীর উপস্থাপনা করে ও সরকারকে সেই দাবি মেনে নেওয়ার জন্য ৫ মার্চ
অবধি সময় দেওয়া হয় এবং ৫ মার্চ প্রদেশের সর্বত্র শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া
হয়। ঐ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে নতুন আন্দোলনের কর্মসূচী নেওয়া হবে বলে
সরকারকে হুমকিও দেওয়া হয়।
পরিবর্তে সরকারও ২৬শে ফেব্রুয়ারি জেল-জুলুমের নীতি অবলম্বন করে। পুলিশ এমনকি
চারজন গণপরিষদ সদস্যকে (আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ,
খয়রাত হোসেন, মনোরঞ্জন ধর ও গোবিন্দলাল ব্যানার্জী) জননিরাপত্তা আইনে
গ্রেফতার করে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেক রাজনীতিবিদ ও নেতা গ্রেফতারী ও
জেল-জুলুম এড়ানোর জন্য আত্মগোপন করেন।
আন্দোলনকারীদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন প্রাদেশিক
পরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার একটি সুপারিশ পাকিস্তান
গণপরিষদের বিবেচনার জন্য প্রেরণের একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেন। তাছাড়া সরকারকে
নির্দোষ প্রমাণের জন্য তিনি প্রদেশবাসীর উদ্দেশে রেডিওতে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি
প্রমাণ করতে চান যে,
“রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি আসল প্রশ্ন নয়,
ইহার পশ্চাতে সরকারকে বানচাল করার জন্য বিদেশী দালাল ও
অন্যান্যদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নিহিত আছে।”
এর মধ্যে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি
হওয়ায় সবাই তখন আত্মগোপনে। এ অবস্থায় আন্দোলন চলতে পারে না। নেতৃত্বের প্রতি
জনসাধারণের পর্যাপ্ত আস্থার অভাবে আন্দোলনে ধীরে ধীরে ভাটা আসতে থাকে। ঢাকা শহরে
এই আন্দোলন তাই স্তিমিত হয়ে আসে মূলত ২৭ ফেব্রুয়ারির পর থেকে। চলে খুব ধীরপায়ে
৫ মার্চের হরতাল পর্যন্ত। এরপর ৯ মার্চ শান্তিনগরের বৈঠক থেকে সংগ্রাম পরিষদের মূল
নেতাদের গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় আন্দোলন শেষ হয়ে আসে। এরই মধ্যে ২৫
ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং
ছাত্রদের হল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়।
১৬ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সেদিন ছাত্ররা সমাবেশ করে। কেন্দ্রীয়
সর্বদলীয় কর্মপরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি স্মরণে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও দিবসটি পালনে
সম্মত হন, প্রস্তাবটি তিনিই উত্থাপন করেছিলেন।
১৯৫৩ সালের, ১৮ই ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের উদ্দেশ্যে
প্রশাসনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী সারা
দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসের
ছাত্ররা শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী
ফজলুর রহমান বলেন যে, “বাংলাকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চায়,
তারা দেশদ্রোহী”। তার এই বক্তব্যে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে
কালো ব্যাজ দেখায়। সাধারণ মানুষের মাঝে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা সম্বলিত
স্মারক ব্যাজ বিলি করা হয়।
পরবর্তী দুবছর ভাষার প্রশ্নে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা
প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’
নামক একটি নির্বাচনী জোট গঠিত হয়। উক্ত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী ইস্তেহার হিসেবে যে
২১ দফা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে তার অন্যতম ছিল বাংলাকে অন্যতম
রাষ্ট্রভাষা করার অঙ্গীকার, ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা,
২১ ফেব্রুয়ারির শহীদদের জন্য একটি শহীদ মিনার নির্মাণ ও
শহীদদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান। এই নির্বাচনে পূর্ববাংলার
যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে এবং মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে।
মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষার আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং সে
অনুসারে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের মিটিংয়ে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি
অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশের আলোকে ৯ মে ১৯৫৪ তারিখে
পাকিস্তান গণপরিষদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে পাকিস্তানের সরকারী ভাষা হবে উর্দু
ও বাংলা।
“পার্লামেন্টের সদস্যগণ ইংরেজি ছাড়া উর্দু ও বাংলাতে
বক্তব্য রাখতে পারবেন”,
গণপরিষদের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালে সংবিধানে
অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এইভাবে বাংলাভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক
স্বীকৃতি লাভ করে। অবশেষে, ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রায় দশ বছর পর বাংলা পাকিস্তানের
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি।
সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়,
“The state language of Pakistan shall be
Urdu and Bengali”।
আবারো শহীদ মিনার বানানো হয় নতুন করে ১৯৫৭ সালে। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম উদ্বোধন করেন শহীদ মিনার। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী ভেঙে ফেলে শহীদ মিনার, কিন্তু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার পুনর্নিমাণ করে সেটি। ভাষা আন্দোলনের পর জাতীয়তা নিয়ে সচেতনতা বেড়ে ওঠে। ১৯৬৭ সালে আইয়ুব খান মন্তব্য করেন, “পূর্ব পাকিস্তানে এখনো হিন্দুয়ানি প্রভাব রয়ে গেছে।”
ভাষার সংস্কৃতি প্রত্যেক জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মাতৃভাষা তার ইতিহাস,
ঐতিহ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ,
রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জন,
সাবলীল জীবনযাপন এবং স্বনির্ভর জাতিসত্তার পরিচিতির প্রধান
নিয়ামক। এসব ক্ষেত্রে বাঙালিরা স্বভাবতই আবেগপ্রবণ। তাই যখন প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা
বাংলার ওপর আক্রোশ সংঘটিত হয়েছে; তখনই তারা আপ্লুত হয়েছে। আর সংগত কারনেই বাঙালিরা রুখে
দাঁড়িয়েছে। সেসময় সাংস্কৃতিক চেতনা এতটাই প্রখরতা লাভ করেছিল যে,
মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কঠিন আন্দোলন সংগ্রামে
দুর্গম পথ পরিক্রমে; বাঙালি জাতি হয়ে উঠেছিল বদ্ধ পরিকর। যার মর্ম উপলব্ধির
মধ্যেই একুশের চেতনার মাহাত্ম্য নিহিত। এর স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১
ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে,
যা ওপার বাংলায় একই সাথে শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। বস্তুত, মাতৃভাষার
জন্য এমন রক্তঝরা আন্দোলন বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষার নেই।
তাও একটা সন্দেহ, একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সেই
বিশ্ববিদিত গানটি কি মনে আছে?-
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?”
ঠিক এই লাইনের শেষে যে প্রশ্ন আছে, সেই প্রশ্ন কি আজ কোনভাবে বাস্তব হয়ে গেছে?
আমরা কি সত্যিই অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছি?
মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু দিবসেই আটকে না থাকুক,
ছড়িয়ে পড়ুক তার মহিমা দেশ-দেশান্তরের প্রতিটি মানুষের
জীবনে ও চেতনায়। মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা উজ্জীবিত হোক বারবার।
তথ্যসূত্রঃ-
একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস - আহমদ রফিক
ভাষা আন্দোলন -
আহমদ রফিক
একুশের সংকলন - গাজীউল হক
পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি(প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড) - বদরুদ্দীন উমর
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি- আবদুল হক
রোর বাংলাঃ একুশে
ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা সেই ঘটনাগুলো – আব্দুল্লাহ
ইবন মাহমুদ
সংগ্রামের নোটবুক
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন