জীবনের ইতিকথা - গৌতম রায়

  


অনুপপুর গ্রামটা ছোট। গ্রাম থেকে একটু দূরে বেশ কয়েকটা ধানকল আর তেলকল আছে। সাধারণ কুলি মজুররাই গ্রামটাতে থাকে। সারাদিন খাটুনির পর নদীর ধারের দিশি মদের দোকানটায় বসে এক বোতল না খেলে দিনুর মনে হয় শরীরটায় ঠিক মতন যুত আসছেনা। রাত বাড়লে যখন নেশার ঘোরটা বেশ ঘন হয়, আশপাশের ভিড়টাও পাতলা হয়ে আসে। তখন টলমল করতে করতে গুটি গুটি পায়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ঘরেতে মন বসে না। প্রায় দশবছর হল বিয়ে হয়েছে। ছেলেপুলে হয়নি। শান্তিটা আজকাল কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। রাতটা যে কিভাবে কেটে যায় কিছু মনেই থাকে না। ভোরের দিকে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায় অবশ্য। বিছানায় শান্তিকে দেখতে না পেয়ে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। অবশ্য একটু বেলায় ওর হাঁকডাকে ঘুম ভেঙে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে রাস্তার কলে স্নান সেরে খেয়ে নিয়ে তৈরী হয়ে নেয়। কারখানার দ্বিতীয় ভোঁ বেজে গেলে তো সেদিনের হাজিরা কেটে যাবে। বৌ ততক্ষণে টিফিনের ব্যাগটা রেডি করে দরজার কাছে রেখে দিয়েছে।

কারখানায় একমুহূর্ত বসার উপায় নেই। ম্যানেজার বাবুর চোখ সারাক্ষণ চারিদিকে ঘুরছে। ধান বয়লার থেকে বার হবার পর সেগুলো সিমেন্টের বাঁধানো জায়গার ওপর ছড়াতে হবে। তারপর শুকিয়ে গেলে আবার বস্তায় ভরতে হবে। বস্তা আবার রাতে বাইরে রাখা যাবে না। গোডাউনে ঢুকিয়ে তবেই ছুটি। ছোটবেলা থেকে করে এসে দিনুর এগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে। কেমন ঘোরের মধ্যে কাজগুলো করে যায়। তাছাড়া ওকে কেউ বকাবকিও করে না। মাঝে মাঝে ম্যানেজারবাবু ঘরের মধ্যে থেকে হাঁক পারে, ‘কিরে আওয়াজ নেই কেন, ঘুমোচ্ছিস নাকি?’ অন্যরা কাজ চলছে বটে বলে হাসাহাসি করলেও দিনু চুপচাপই কাজ করে যায়।

ধানগুলো ভিজে দেখে দিনু উল্টেপাল্টে দিচ্ছিল। এমন সময় টিফিনের ভোঁ বেজে উঠল। বেলচাটা পাশেই রেখে দিয়ে দিনু হাত ধুতে চলে গেল। ফিরে এসে টিফিনকৌটো খুলে মেলে রাখা ধানের পাশেই বসে পড়ল। টিফিনকৌটো খুলতে খুলতে দিনু দেখল পাশের বাড়ীর সাধনও বসে পড়ল।

-      “হ্যাঁরে দিনু তোর বৌ ভোর রাতে কোথায় যায় বলতো?”

 

দিনু খাবারটা মুখে তুলতে গিয়েও নামিয়ে রাখল। মনে পড়ল, ঠিক তো, ক’দিন আগে ভোর রাতে ঘুম ভেঙে বৌকে তো পাশে দেখতে পায়নি! সাধন কোন উত্তর না পেয়ে খাবার খেতে শুরু করে দিল। দিনু কিছুক্ষণ খোলা টিফিন কৌটোটার দিকে তাকিয়ে থেকে, কি ভেবে বন্ধ করে উঠে পড়ল। খাওয়ার ইচ্ছেটাও কেমন যেন আর নেই। খাবারশুদ্ধ টিফিন কৌটোটা অফিস ঘরের কোনায় রেখে দিয়ে বস্তা নিয়ে বাইরে চলে এল। নভেম্বরের দুপুরেও রোদ বেশ চড়া। এরই মধ্যে ভেজা ধানগুলো বেশ শুকিয়ে এসেছে। পাশে রাখা বেলচাটা দিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করতে লাগল। নরম ধানগুলো এরই মধ্যে কেমন শক্ত হয়ে এসেছে। যত সময় যাচ্ছে ততই সব আলাদা হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যের বাঁধনটাও অদ্ভুতভাবে ছাড়া ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। দিনুর চোয়ালটা একবার শক্ত হয়েই আবার সাধারণ হয়ে গেল। মেলে রাখা ধানগুলোর পাশেই বসে পড়ল। কতক্ষণ বসে ছিল মনে নেই। হঠাৎ সাধনের কথায় হুঁশ ফিরে এল। “কি রে, ধান তো শুকিয়ে গেছে! বসে আছিস কেন?”

  

শীতের শুরুর বিকাল। দিন এরই মধ্যেই বেশ ছোট হয়ে এসেছে। কারখানার বাইরেটা শালিকের চিৎকারে ভরে আছে। পাখীগুলো ঝগড়াও করে, আবার কিছুক্ষণ পরেই কাছে চলে আসে। টিফিনটা আজ খাওয়া হয়নি। খাবারগুলো নিশ্চয়ই এতক্ষনে খারাপ হয়ে গেছে। দিনু ব্যাগ থেকে টিফিনকৌটোটা বার করে ভাতগুলো রাস্তার পাশে ঢেলে দিল। ঝটাপটি করতে করতে সবকটা ভাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখন আর কোন ঝগড়া নেই। সবাই খেতে ব্যস্ত। পাখীগুলোর চিৎকার হঠাৎ থেমে গেল। দিনু আর পেছনে না তাকিয়ে রাস্তার পাশের কলে টিফিন কৌটোটা ধুয়ে ঝোলায় ভরে নিল।

সকালের পর আর খাওয়া হয়নি। খিদেটা এবার বোঝা যাচ্ছে। দিনু হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে চলল। গ্রামের একমাত্র শুঁড়িখানাটা তো ওখানেই। জায়গাটা ফাঁকা। বাড়িঘর কম। নদীর ঘাট একটু এগোলেই দেখতে পাওয়া যায়। তবে ঘাটে যাওয়ার রাস্তাটা অন্য দিকে। তাহলেও, এদিকটায় গাছপালা আছে অনেক। ওগুলোর তলা তো আর কিছুক্ষণ পর থেকেই গমগম করতে শুরু করবে। সবার হাতেই ধরা থাকে শালপাতা, আর তাতে ছোলাসেদ্ধ, নুন আর লঙ্কা। বোতল কখন শেষ হয়ে যায় বোঝাও যায় না। হ্যাঁ, তবে তারপর মনটা বেশ ফুরফুর করে। দু’-একজন বকবক করে ঠিকই, তবে বেশিরভাগই নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে।

আজকে দিনু একটু আগেই চলে এসেছে। ভিড় এখনও সেরকম ভাবে জমেনি। রোজকার মত কয়েকটা ছেলে ছোলা বিক্রি করছে। দিনু দু’ঠোঙা ছোলা নিয়ে একটা ফাঁকা গাছ দেখে তার তলায় বসে পড়ল। ছেলেটা পয়সা নিতে নিতে বলল, “কি হল? বোতল নিলে না? দাও পয়সা দাও, এনে দিচ্ছি।“ ছেলেটার নাম বিলু, দিনুর চেনা। ওর বাবাও ঐ চালকলে কাজ করে। বিলুর মা মারা যাওয়ার পর গ্রামেরই একজনকে বিয়ে করেছে। লোকে বলে আগে থেকে আলাপ ছিল। ওই নাকি বিলুর মাকে মেরে ফেলেছে। তারপর থেকে বিলুর ওপর অত্যাচার বেড়ে গেছিল। কিছুদিন পর বিলুকেও ঘর থেকে বার করে দিল ওর সৎমা।

বোতলের পয়সা দিতে দিতে দিনু জিজ্ঞাসা করল, “তুই এখন কোথায় থাকিস রে? এসব বানাস কোথায়?”  ছোলার ঝুড়িটা পাশে নামিয়ে রেখে বিলুও পাশে বসে পড়ল। মদের দোকানের চালাটার দিকে হাত দেখিয়ে বলে উঠল, “ঐ বারান্দায় থাকি।“

 

-      “ সেকিরে! কুকুরে সব টেনে নিয়ে যাবে তো। এই ছোলা কে বানিয়ে দিচ্ছে? সেদ্ধই বা করছিস কোথায়?”

সামনের গাছতলার দিকে হাত দেখিয়ে বিলু বলে উঠল, “ওই দেখ আমার হাঁড়ি। কাঠ এখানেই পেয়ে যাই। এখন আর ছোলাসেদ্ধ করতে আর অসুবিধা হয় না। কেউ মারেও না, বকেও না।“

 

ন্ধকারের মধ্যেও দিনু দেখতে পেল বিলুর চোখটা জলে চকচক করছে। দিনু বলে উঠল, "তোর এখানে ভয় করে না?”

-      “ প্রথমের দিকে খোলা বারান্দায় রাতে থাকতে একটু ভয় লাগত। তবে এখন ঠিক হয়ে গেছে।” বলে বিলু কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। “কুকুরগুলোরও তো খিদে পায়। যা লাভ হয় তাতে আমাদের ভালই চলে যায়।“ বিলু উঠতে যাচ্ছিল।

দিনু হাত ধরে ওকে আবার বসিয়ে দিল। “ নারে, আজকে আর ওসব খেতে সায় দিচ্ছে না। তোকে বোতল আনতে হবে না। বরঞ্চ আরেকটা ঠোঙা ছোলা দে।“

বিলু ছোলা বানাতে বানাতে বলল, “এ নেশা বড় খারাপ গো। শরীরের সাথে মনকেও একেবারে খেয়ে নেয়। আমার বাবাকে যেমন খেয়ে নিয়েছে। নতুন মা তো এখন বাড়ীতেই সব ব্যবস্থা করে রাখে। তাই বাবা এখানে আর আসে না। আচ্ছা একটা কথা বলব তোমায়। আজতো তুমিও ওসব খাওনি। মনে হয় বুঝতে পারবে।“

দিনু ফাঁকা শালপাতার ঠোঙাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিলুর দিকে চাইল। “তুমিও কি তোমার বৌকে মেরে ফেলবে?”  অন্ধকারে দিনুর মুখটা বোঝা গেল না। সাধনের কথাটা মনে এসে গেল।

এতদিনের পুরনো শুঁড়িখানার পরিবেশটাকে আজকে দিনুর কাছে কেমন অন্যরকম লাগছে। গাছতলার নিচে বসে থাকা লোকগুলো সবাই তো তার নিজের পরিচিত বন্ধুবান্ধব। কিন্তু আজ কেন ওদের কেমন অন্যরকম লাগছে? মানুষগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে কতগুলো দোমড়ানো মোচড়ানো কাগজের টুকরো। কারখানার অফিসের মনুবাবুর ফেলে দেওয়া কাগজগুলোর মত। লোকটা বয়সের ভারে বেঁকে গেছে। চোখের ভারী চশমা দিয়ে লিখতে গিয়ে বোধহয় ভুল করে। তাই কাগজগুলো প্রায়ই মুড়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে। মোচড়ানো কাগজগুলো হাওয়ায় এদিক ওদিক উড়ে যায়। যে সামনে থাকে তাকেই বলে ওঠে, ‘ কাগজগুলো ঝেঁটিয়ে বাইরে করে দে, নাহলে ওতে একটু জল ছিটিয়ে দে।‘ রোজই দিনু সকালে ডিউটিতে এসে ভেজা মোচড়ানো কাগজগুলোকে দরজার পাশে পড়ে থাকতে দেখে।

দিনুর মনটা ছোটবেলার দিনগুলোয় চলে গেল। মনুবাবুর কোঁচকানো মুখটা কেমন আস্তে আস্তে টানটান হয়ে গেছে। কারখানার পাশের রাস্তাটা পেরোলেই তো ওর বাড়িটা। মা তো ওই বাড়িতেই ঝাড়ামোছার কাজ করত। সব কাজই করতে হত। দুপুরে মনুবাবু কারখানা থেকে এসে খাওয়া দাওয়ার পর ছুটি মিলত। সন্ধ্যাবেলায় আবার যেতে হত রান্না করে দেওয়ার জন্য। বাবা কারখানায় সারাদিন থাকত আর সন্ধ্যে হলে সেই নদীর ধারে। বাড়ী আসতে আসতে কত রাত হত মনেই পড়ে না। দিনুর সারাদিন এর ওর বাগানে নয় জঙ্গলেই কেটে যেত। দুপুরবেলায় শুধু মায়ের সঙ্গে দেখা হত। খেতে দিয়ে পাশে বসে বলত,  “কবে তুই বড় হবি বলতো? তুই চাকরী পেলে আর আমাকে কাজে বেরোতে হবে না। ঘরে বসে শুধু তোর জন্য নানারকম খাবার বানাবো। কাজ থেকে ফিরে আসলে আমি তোকে সব তৈরী করে খাওয়াব। “

ধীরে ধীরে মা আরও দেরী করে আসতে লাগল। রাতে দিনু শুয়ে পড়ত। মা ডেকে তুলে খাওয়াত। বাবাকেও তারপর থেকে কেমন ছন্নছাড়ার মত লাগত। সকালে সেই যে কারখানায় যেত, ফিরত অনেক রাতে। কোন কোন দিন আবার কেউ ধরে ধরে ঘরে দিয়ে যেত। এদিকে মায়ের শরীরটাও মাঝে মাঝে খারাপ হতে লাগল। মনুবাবুর বাড়ির কাজে যাওয়াটাও কমে যেতে লাগল। দিনুরও তারপর থেকে বাইরে ঘুরতে আর ভাল লাগত না। মায়ের কাছেই বসে থাকত। মা শুয়ে শুয়েই দিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিত আর ধরা গলায় বলত, “আর ঘুরে বেড়াস না রে। কারখানায় গিয়ে একটু কাজ টাজ দেখ। আমি মনুবাবুকে বলে দিয়েছি। উনি তোকে ভেতরে ঢুকতে দেবে।“

 

সেদিন মায়ের শরীরটা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সকাল থেকে কথাও বলছিল না। কয়েকবার ডেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। দিনুর মনের মধ্যে কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। দৌড়ে কারখানায় চলে গেল। সামনে মনুবাবুকে দেখতে পেয়ে মায়ের কথা বলতে উনি বললেন, “তুই যা ঘরে, আমি দেখি ডাক্তার পাই কিনা।“ দৌড়ে ঘরে এল দিনু। দেখে সাধনের মা আর পাড়ার আরও কয়েকজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মায়ের চোখদুটো বন্ধ। কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। সাধনের মায়ের দিকে তাকাতে ও দিনুর হাতটা ধরে বাইরে চলে এল। গ্রামে কোন ডাক্তার নেই। একজন মুরুব্বী গোছের লোক আছে। সে নাকি আগে হাসপাতালে কাজ করত। দিনু দেখল, বাবা তাকে নিয়ে আসছে। লোকটা ভেতরে ঢুকে একটু পরেই বাইরে চলে এল। পেছনে বাবাও চলে এল। “পেটের বাচ্চাটা মরে গেছে অনেকক্ষণ, তাও সদর হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।“

 

তারপর থেকে দিনুর জীবন থেকে কি যেন একটা হারিয়ে গেছে মনে হল। গাছের পিয়ারাগুলোকে দেখেও পাড়তে ইচ্ছে করত না। আনমনে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে দিনু জঙ্গলের মধ্যে চলে এসেছিল বুঝতেই পারেনি। একটা গোঙ্গানির আওয়াজ পেয়ে একটু ভেতরে গিয়ে দেখে মনুবাবু পড়ে আছে আর চারিদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। হতবম্ভ হয়ে দিনু দৌড়ে বাইরে এসে কারখানায় খবর দিল। সেদিনের পর থেকে দিনু বাবার আর কোন খোঁজ পায়নি। প্রথমের দিকে সাধনের মা খাবার দিয়ে যেত। হঠাৎ বিলুর গলার আওয়াজে দিনুর সম্বিত ফিরে এল। “এই নাও তোমার বাকি পয়সা। তুমি তো বোতলের পয়সা দিয়েছিলে।" হাতটা সরিয়ে দিয়ে দিনু উঠে পড়ে বলল, "ওটা তুই রেখে দে।“

        

আশেপাশের গাছের তলাগুলো দেখে দিনুর মনুবাবুর কাগজের ডেলাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। নিজে থেকেই একটা মনের মধ্যে একটা হাসি চলে এল। দিনু আনমনে নদীর দিকে হাঁটতে লাগল। অন্ধকারের মধ্যেও ছোটবেলার প্রিয় জঙ্গলটাকে দেখে মনটা একটু খুশি খুশি হয়ে উঠল। আরেকটু এগিয়ে নদীর ধারে চলে এল দিনু। অন্ধকারে জলের ঢেউ চোখে না পড়লেও ঠান্ডা হাওয়া মুখে এসে পড়ছে। মাথাটা কেমন শান্ত লাগছে। বিলুর কথাগুলো মনে আসলে মনটা আবার কেমন অশান্ত হয়ে যাচ্ছে। না, আজ আর কোন চিন্তা নয়। নদীর পাড় ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। দূরে নদীর পাড়ে কালো কালো নৌকোগুলো দেখা যাচ্ছে। সারাদিন মাঝির হালের ঠেলায় কাজ করে যেন শ্রান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। নদীর ঢেউয়ে ধীরে ধীরে দুলছে। ঠিক যেন গাছের তলায় বসে থাকা লোকগুলোর মত। সকাল হলেই তো এগুলো আবার পারাপার করতে লেগে পড়বে। সকালে ডিউটির কথা মনে এসে গেল। নাহ, মন যেন আটকে গেছে মনে হচ্ছে এখানে। দিনু আরও এগিয়ে চলল।

একটা আলো জ্বলছে মনে হচ্ছে না! এত রাতে কে নদীর ধারে আলো জ্বালায়! দিনু এগিয়ে চলল। একি, এ তো সাধু মনে হচ্ছে। সাদা দাড়ি বুক ছাড়িয়ে নেমে এসেছে। লাল টকটকে কাপড় ধুনীর আগুনে যেন আরও লাল লাগছে। সাধু নয়, এ তো তান্ত্রিক। মাঝে মাঝে বোতল থেকে জলের মত কি আগুনে ঢালছে আর তাতে আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে। এ তো সেই দিশি। না খেয়ে আগুনে ঢালছে কেন। দিনু কিছু না বুঝে ধুনীর পাশে বসে পড়ল।

কতক্ষণ বসেছিল মনে নেই। ধুনীর আলো নিভে আসছে। নিভন্ত আলোয় দিনু দেখতে পেল সাধু একদৃষ্টে দিনুর দিকে তাকিয়ে আছে। সম্বিত ফিরে পেতে দিনু হাত জোড় করে সাধুকে নমস্কার করল।

-      “কিরে বেটা, সংসার ছেড়ে রাতে এই শ্মশানে কেন?“

সাধুর জলদগম্ভীর স্বর শুনে দিনু চমকে উঠে দেখল এতো গ্রামের শ্মশান। হাঁটতে হাঁটতে এতদূর চলে এসেছে। সাধু আবার বলে উঠলেন, “সংসার এক মায়ার জায়গা রে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব শক্ত। এ হল শিকারীর জাল। যত ছটফট করবি ততই জড়িয়ে যাবি। নে এটা খা, মন শান্ত হবে।" বলে বোতলটা বাড়িয়ে দিল দিনুর দিকে। বহুদিনের অভ্যেস। হাতটা বাড়িয়ে দিল। পরক্ষনেই কি ভেবে হাত সরিয়ে নিল। দিনু বলে উঠলো, “সাধুবাবা, এ তো আরও সর্বনেশে। তাইতো আমি আজ থেকে ঠিক করেছি এ জিনিস আর খাব না। এর জন্যই সংসারও ভেঙ্গেচুরে ছারখার হয়ে যায়।“ সাধু হা হা করে হেসে উঠল। “তাইতো একে বলি দিচ্ছি রে। মনের মধ্যে জমে থাকা যত রাগ হতাশা দৈন্য আছে সব এই আগুনে বলি দিতে হবে। তবেই চৈতন্য হবে। যা বাড়ী যা। তোর সাংসারিক জীবনের অনেক কিছু এখনও দেখা বাকী আছে।“

রাত শেষ হয়ে আসছে। অমাবস্যার পরের একফালি চাঁদ মাঝ আকাশে দেখা যাচ্ছে। অবসন্ন শরীরে দিনু হাঁটতে হাঁটতে বাড়ীর দিকে এগোতে থাকল। রাস্তার কুকুরগুলো দু'-এক বার ঘেউ ঘেউ করে চলে গেল। অন্ধকারের মধ্যে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। এ কি! এত রাতে শক্তির বাড়িতে আলো জ্বলছে কেন! শক্তি দিনুর দুটো বাড়ি আগেই থাকে। একাই থাকে। একটা ছোট মুদিখানার দোকান আছে ঘরেরই দাওয়াতে। দিনুতো সারাদিন বাড়ি থাকে না। দোকানদারী যা কিছু করতে হয়, ওর বৌই করে। তাছাড়া কাছেপিঠের মধ্যে ওর দোকানই ভরসা। কিন্তু দোকান তো রাত আটটায় বন্ধ করে দেয়। অবশ্য জরুরী কোন দরকার থাকলে ও দোকান খোলে। কিন্তু এত রাতে কে এল ওর বাড়িতে? জানালাটার পাশে এসে দিনু দাঁড়াল। কারা ফিসফিস করে কথা বলছে যেন ভেতরে। এ তো ওর বৌয়ের গলা। তাহলে কি সাধনের কথাটাই ঠিক! দিনু আরেকটু জানালার কাছে ঘেঁসে দাঁড়াল। এবার কথাগুলো অনেক স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

-      “ যাক, আর তোমাকে রোজ রোজ লুকিয়ে আসতে হবে না। কিন্তু কোথায় গেল, তার কোন খোঁজও তো পাওয়া গেল না। কারখানায় যে গিয়েছিল তা তো সাধনের কাছেই শুনেছি।“

এবার দিনুর এতদিনের পরিচিত গলা আবার শোনা গেল। “ওসব এখন বাদ দাও। আজকের দেওয়া খাবার খাওয়ার পর বাড়িতে ফিরে আসার ক্ষমতা আর থাকে নাকি! এখন আমাদের মধ্যে যে আসছে তার কথা ভাব।“

একটা ভয়ংকর আগুন যেন মাথার মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। পকেট থেকে দেশলাইটা বার করে একটা কাঠি বার করল। খড়ের চালের বাড়ি শুকনো খটখটে হয়ে আছে। একটা আগুনের ফুলকিতেই সমাধান হয়ে যাবে। হঠাৎ মায়ের শেষদিনের মুখটা মনে পড়ে গেল। মা তো ভাইটাকে নিয়েই চলে গেল। ওর তো কোন দোষ ছিল না।

দেশলাইটার দিকে একবার দেখে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধীরে ধীরে ফেরত চলে এল। পিছন ফিরে একবার অন্ধকারের মধ্যে নিজের এতদিনের বাড়ীটা দেখে দিনু আবার শ্মশানের দিকে চলতে শুরু করল। সাধুবাবাকে এখনই ধরতে হবে। অনেককিছু কথা বলার আছে যে। দূরে হরিবোলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শ্মশানযাত্রীরা বোধহয় শেষবারের মত তাদের কোন প্রিয়জনকে নিয়ে যাচ্ছে।

পুবের আকাশে আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। আবার একটা নতুন দিন আসছে। দিনু তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল। ওকে যে আজ অনেক দূর যেতে হবে!



চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন