কমর আলি মোড়লের বাড়ির বাইরে একটা প্রশস্ত
খালি জায়গা পড়ে আছে। ওটাই তাঁর পালাঙ্গা। আগে গরু, ছাগল, মোষ বাঁধা এবং বিভিন্ন শস্য মাড়া কাজে
জায়গাটা ব্যবহার করা হলেও এখন খালিই পড়ে থাকে। বাড়িতে এখন কোন গবাদিপশু নেই। আগের মতো
চাষ আবাদও নেই। কে করবে? ছেলেরা বাড়িতে কেউ থাকে না। দুটো ছেলে দুটোই বিদেশে থাকে। বড় ছেলে মেরিন
ইঞ্জিনিয়ার, জাপানে থাকে। ছোট ছেলে দুবাই। এক-দু বছর অন্তর বাড়ি আসে। কিছুদিন থাকে তারপর
আবার চলে যায়। বাড়িতে থাকা বলতে তাঁরাই মোটে দুটো মানুষ। তিনি আর তাঁর স্ত্রী
পারভিন বিবি। তাছাড়া তাঁরও এখন বয়স হয়েছে। তিনি কি আর আগের মতো খাটতে পারবেন? তাছাড়া
খাটার আর দরকারও নেই। সুতরাং ছেলেদের কথা মতো সব জমি তিনি ভাগে দিয়ে রেখেছেন। ওখান
থেকে যা ফসল পান দুটো মানুষ খেয়ে ফুরাতে পারেন না। বাড়তি ফসল গরিব মানুষদের মধ্যে
বিতরণ করে দেন। ফলে পাড়ার ছেলেরা এখন এখানেই সব খেলাধূলা করে। সকাল, দুপুর, বিকাল, সাঁঝ
মানা নেই। সবসময় চিৎকার, চেঁচামেচি আর হৈহল্লা। তিনি বাড়িতে কান পাততে পারেন না। তবু কোন ছেলেকে তিনি
বকাঝকা করেন না। বকাঝকা করলে ছেলেরা খেলবে কোথায়? এখান ছাড়া পাড়ায় যে আর কোত্থাও খেলার জায়গা
নেই। দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের প্রচুর ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়ে পাড়ায়
ছেলেদের খেলার জায়গা হারিয়ে গেছে। ছেলেদের খেলার জায়গা দূরে থাক, পাড়ায়
এখন বসার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। সুতরাং খেলছে খেলুক বলে তিনি চুপ করে থাকেন। খিদে
না পেলে কেউ বাড়ি যায় না। গেলেও খেয়ে আবার তক্ষুনি চলে আসে। পাড়ার ছেলেদের কাছে
এটা একটা খেলার মাঠ।
তিনি সব ছেলেদের চেনেন। প্রতিদিন দেখছেন
বলে সবার নামও জানেন এবং কে কেমন ছেলে, কার কী রকম ব্যবহার এ-ও জানেন। একটা ছেলে
বাদে ওনার চোখে সবাই মোটামুটি ভালো ছেলে বলা যায়। কেউ কারও সাথে কাজিয়া ঝামেলা করে
না। সবাই মিলেমিশে খেলা করে। শুধু ওই একটা ছেলেই সবাইকে বিরক্ত করে...তাকে এখনই
থামানো দরকার। নাহলে বড় হয়ে ছেলেটা বখাটে ছেলে হয়ে যেতে পারে। তার যা আচরণ, দেহভঙ্গিমা
আর মনোভাব। আর সেটা হয়ে গেলে সমাজের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর; সেটা
হতে দেওয়া যাবে না। কারণ, তিনিও এই সমাজেরই একজন মানুষ। তার দ্বারা তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তাই
যেভাবে হোক ছেলেটাকে শোধরাতে হবে। কিন্তু শোধরাবেন কীভাবে?
একদিন তিনি ছেলেটার বাড়ি গিয়ে তার মায়ের
সঙ্গে দেখা করেন, 'আমি সাদ্দামের ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। তোমার হাতে কি সময় আছে?'
'আছে। বুলেন!' সাদ্দামের
মা উত্তর দেয়।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, 'সাদ্দাম
কোন ক্লাসে পড়ে?'
'পাঁচ কিলাসে।'
'স্কুল যায়?'
'কই যায়? দিনরাত খেলা করে বেড়ায় আর পাড়ার ছেলেধের
সাথে মারামারি করে...'
'এর জন্য ওর বাপ ওকে কিছু বলে না!'
'অর বাপ সবসময় বাড়িতে থাকে না। সারাদিন
গাঁয়ে গাঁয়ে হকারি করে বেড়ায়...'
'কিন্তু তুমি তো বাড়িতে থাকো, তুমি
কিছু বলো না ওকে! তুমিও তো কিছু বলতে পারো।'
'তো বুলি ন্যা! কত মার যে মারি তা-ও অকে
শুধরাতে পারি ন্যা। ছেলেডা সাহু ডাকাত হয়েছে। বড়ো হয়ে কী যে করবে কে জানে!'
'তাহলে তো খুবই মুশকিল!' তিনি
চিন্তায় পড়ে যান এবং ছেলেটাকে একদিন কাছে ডাকেন, 'সাদ্দাম, শোন!'
সাদ্দাম কাছে যায়, 'কী, বুলেন!'
তিনি শুধান, 'তুই কী খেতে বেশি পছন্দ করিস!'
সাদ্দাম কিছু সময় দম ধরে থেকে উত্তর দেয়, 'ক্যাডবেরি
বেশি পছন্দ করি।'
'ঠিক আছে; আমি তোকে রোজ ক্যাডবেরি কিনে দিব। তুই
খাবি; কিন্তু কেন কিনে দিব একবার জানতে চাইলি না?'
'ক্যানে কিনে দিবেন?'
সাদ্দামকে এর উত্তরে তিনি জানান, 'তুই
হলি খুব ভালো ছেলে। তুই কারও সাথে কাজিয়া ঝামেলা করিস না, কারও
সাথে মারামারি করিস না। তোর ব্যবহার এবং কথাবার্তা আমাকে খুবই ভালো লাগে। তাছাড়া
আমি শুনেছি, তুই পড়াশোনাতেও খুব ভালো। তাই আমি ঠিক করেছি, তোকে আজ থেকে আমি রোজ ক্যাডবেরি কিনে দিব।
ভালো ভালো ক্যাডবেরি। দামি দামি ক্যাডবেরি। ভালো ছেলে হওয়ার পুরস্কার দিব। এই নে, আজ
দুটো ক্যাডবেরি দিলাম। আবার আগামীকাল দুটো দিব। তার পরের দিন আবার দুটো দিব...তার
পরের দিন আবার দুটো দিব...এভাবে দিনের পর দিন আমি তোকে ক্যাডবেরি কিনে দিতেই থাকব।
তোকে দিব বলেই আজকের ক্যাডবেরি দুটো কিনে রেখেছিলাম...'
পরের দিন থেকে ক্যাডবেরির কাজ দেখে তিনি
আশ্চর্য হন!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন