সময়টা ১৯৬১ সালের ১৯ই মে। রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। আসামের শীলচর রেলওয়ে স্টেশনে সমবেত হয়েছে নারী পুরুষ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ। মধ্যরাত পেরিয়ে সকাল হল, সকাল গড়িয়ে দুপুর। ট্রেন চলাচল বন্ধ। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাইফেল ও টিয়ার গ্যাস নিয়ে পুলিশ প্রস্তুত। সমবেত জনতার "মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ" স্লোগানে মুখরিত আকাশ বাতাস। তাদের দাবী, আইন সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত অসমীয়া ভাষার (আসাম প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা) সমমর্যাদা দেওয়া হবে ততক্ষণ তারা এই সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। শেষপর্যন্ত অধৈর্য প্রশাসন প্রথমে টিয়ার গ্যাস চালায়। সমবেত জনতাকে তবুও ছত্রভঙ্গ করা যাচ্ছে না। এবার করণীয়? এবার পুলিশের হাতে উঠলো রাইফেল। দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে আসা মিছিলে গুলি চালায় তারা। লুটিয়ে পড়ে এগারো জন। কিন্তু এর ফলে ছত্রভঙ্গ হওয়া তো দূরের কথা, জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। অগত্যা পিছু হঠতে হয় পুলিশকে। তবে ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। সেই এগারো জনের রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে শিলচরের রাজপথ। তাদের মধ্যে ষোলো বছর বয়সের একটি মেয়েও ছিল। নাম কমলা ভট্টাচার্য, বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম নারীশহীদ।
সংগ্রাম শুরু শৈশবেই :
কমলা তখন পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে খেলে, জলে ঝাঁপিয়ে, কাঁচা আম পাড়ার পর নুন দিয়ে জারিয়ে খেয়ে ভারি মজা। সঙ্গে রয়েছে মা আর দুই দিদির বকাবকি। তবে তাতে কমলার ভ্রূক্ষেপ নেই। হঠাৎই একদিন চারপাশটা কেমন বদলে গেলো। যে মাঠে তারা কতো হইহই করে এক্কাদোক্কা, বৌবাসন্তী, লুকোচুরি খেলেছে, বেশ কিছুদিন হল সেখানে কেউ আসে না। বন্ধুরাও আর চোখে পড়ে না। রাস্তায় লোক নেই। পাড়ার মনোহর দাদার মুদির দোকানটা বন্ধ। কমলার নিজেদের বাড়িটাও কেমন কেমন লাগে। ঘরদোর থমথমে, বাবা মা মৃদুস্বরে নিজেদের মধ্যে কীসব আলোচনা করছে, দিদিরা বাক্সপ্যাঁটরা গোছাচ্ছে। কমলা দেখে শোনে, কিন্তু অতশত বোঝে না। সবাই খুব ব্যস্ত। কমলা তখন ছোট বোনটার কাছে যায়। মঙ্গলার বয়স মোটে দু'বছর। কিছুক্ষণ খেলে ওর সঙ্গে, তারপর ইতিউতি চায়। মনের মধ্যে প্রশ্নের পাহাড়। দিদিদের কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলেই ধমক খাচ্ছে।
অবশেষে ঘর থেকে বাবা বেরিয়ে এসে বলেন, "মা কমলা, কাল আমরা এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। অন্য জায়গায়।"
"বেড়াতে যাবো বাবা?" কমলার চোখেমুখে খুশি।
"না মা, আমরা একেবারে চলে যাচ্ছি। শ্রীহট্টের এবাড়িতে আর ফিরবো না।" বাবার গলাটা যেন ধরে আসে। নাকি কমলার মনের ভুল!
কমলা বিহ্বল হয়ে পড়ে। আর ফিরবো না! এসব কী বলছে বাবা! কেন ফিরবো না! কোথায় যাবো! আর বন্ধুরা!
মেজদিদি প্রতিভা আশ্বস্ত করে, "নতুন জায়গায় আরো কত বন্ধু হবে দেখবি।"
পরদিন রাতের আঁধারে ঘুমচোখে বাবা রামরমণ ভট্টাচার্য, মা সুপ্রবাসিনী দেবী, দুই দিদি আর তিন ভাইয়ের সঙ্গে ঘর ছাড়ে কমলা। ছোট্ট মঙ্গলা মায়ের কোলে ঘুমে অচেতন। শ্রীহট্ট থেকে হাঁটতে হাঁটতে সকলে এসে পৌঁছায় পাশেই আসামের শিলচরে। সেটা ১৯৫০ সাল। শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে নতুন করে সংসার পাতা হল। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। পরিবারে এতগুলো মানুষ। কাজের বড়োই প্রয়োজন। সকলের মুখে খাবার তুলে দিতে বাবা উদয়াস্ত খাটেন।
সেই পাঁচ বছর বয়সে এক ধাক্কায় কমলা যেন অনেকটা বড়ো হয়ে গেলো। তার জন্ম হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ১লা জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন শ্রীহট্ট তথা বর্তমান সিলেট জেলায়। ভিটেমাটি, ঘরবাড়ি, খেলার মাঠ, বন্ধু সবকিছু ছেড়ে এলো সে। বুঝতে শিখলো দেশভাগ। বাবার সঙ্গে শিলচরে এলেও কমলার পিতৃবিয়োগ হয়েছিল শৈশবেই। সন্তানদের নিয়ে সুপ্রবাসিনী দেবী অকূলপাথারে। তখন এগিয়ে এলো কমলার দুই দিদি, সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিল তারা। বড়দিদি বেণু নার্সের চাকরি পেয়ে গেল, কিন্তু প্রশিক্ষণ নিতে যেতে হবে সেই শিমূলগুড়ি। বেণু যেতে ভরসা পায় না। মেজদিদি প্রতিভা সাহস যোগালো, "তুই যা, আমি ঠিক চালিয়ে নেবো।" সত্যিই চেষ্টা করে একটা স্কুলে শিক্ষিকার কাজ জুটিয়ে নিল প্রতিভা। তার স্বল্প আয়ের উপর নির্ভর করে কোনরকমে টিকে গেলো পরিবারটা।
মেধাবী কমলার আত্মনির্ভরতা :
দিদিদের সংগ্রাম দেখে কমলা উপলব্ধি করেছিল লড়াই করে বাঁচতে হবে। সেই মানসিকতাই তার জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল। কমলার শিক্ষাজীবন শুরু হয় শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউট থেকে। সুপ্রবাসিনী দেবীর পক্ষে তাঁর সন্তানদের জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার সামর্থ্য ছিল না। তবে কমলা সেরকম কোনোকিছুর দাবিও কোনোদিন করেনি। শুধু একবার স্কুলের কাজের জন্য কমলা বড়দিদির কাছে একটা ডিকশনারি চেয়েছিল। কিন্তু কেনার পয়সা নেই। বোন লেখাপড়ার জন্য একটা মাত্র জিনিস চাইলো, সেটা দিতে পারলো না! বেণুর দু'চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কমলা ব্যস্ত হয়ে দিদির চোখ মুছিয়ে দিল, "কাঁদিস না দিদি, আমি অন্য মেয়েদের কাছ থেকে চেয়ে নেবো।"
বড়দিদির মন সায় দেয় না, "তাদের বই তাদের কাজে লাগে, তোকে দেবে কেন?"
কমলা আশ্বস্ত করে, "কিচ্ছু ভাবিস না। আমি দিনকয়েকের জন্যে এনে যা যা দরকার সব লিখে নেবো, তাহলেই হবে। চাই না আমার ডিকশনারি।"
এভাবেই কমলা সহপাঠীদের কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তক ধার করে লিখে লিখে নিয়ে পড়াশোনা চালাতো, কিন্তু কখনোই হাল ছেড়ে দেয়নি। ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসে। ইচ্ছা ছিল পরীক্ষার পর ফলাফল প্রকাশ পাওয়ার আগের সময়টুকুতে টাইপরাইটিং শিখে নেবে। তারপর কলেজে গিয়ে একদিন গ্র্যাজুয়েট হবে। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে। দু'চোখ ভরা স্বপ্ন কমলার। কিন্তু তার সংক্ষিপ্ত জীবনের মতোই অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার স্বপ্নও।
মোদের গরব মোদের আশা :
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে ভারতের আসাম রাজ্যে বসবাসকারী স্থানীয় অসমীয়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পূর্ব বাংলা থেকে অভিবাসিত বাঙালিদের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল। ধীরে ধীরে আসামের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালিরা প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে শুরু করলে এই দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নেয়। এমনকি বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ও বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে “বাঙা খেদা” প্রচারাভিযান চালানো হয় এবং বাঙালিদের উপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটতে থাকে।
এমন একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই ১৯৬০ সালের ১০ই অক্টোবর আসামের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে উত্তর করিমগঞ্জ থেকে নির্বাচিত বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস তীব্র আপত্তি তুলে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। কিন্তু অসমীয়া জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অসমীয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা করা হয় এবং অন্তবর্তী সময় পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের বিধান রেখে সেই বছরের ২৪শে অক্টোবর প্রস্তাবটি “Assam (Official) Language Act, 1960” নামে আইন হিসেবে আসামের বিধানসভায় পাস করানো হয়।
কমলার মতো আসামের অন্যান্য বাঙালিরাও এই আইন মেনে নিতে পারেনি। সেইমত ১৯শে মে সকাল থেকে শুরু হয় হরতাল। শিলচর রেলস্টেশন, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ সহ একাধিক এলাকায় সকাল থেকেই হরতালের সমর্থনে শুরু হয় পিকেটিং। আন্দোলনের জেরে বন্ধ হয় যায় রেল চলাচল। এদিকে, অশান্তির আঁচ করে আগে থেকেই অসম সরকারের পক্ষ থেকে বরাক উপত্যকাজুড়ে মোতায়েন করা হয় আধাসেনা। হরতালকে বানচাল করতে ও আন্দোলনকে প্রতিহত করতে জায়গায় জায়গায় গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনকারীদের।
এলো সেই দিন :
১৯শে মে-এর সকালে কমলা পিকেটিং-এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। স্নান সেরে পরে নেয় মেজদিদির একটি শাড়ি। এমনসময় ২০-২২ জনের একটি মেয়েদের দল তাদের বাড়িতে আসে কমলাকে নেওয়ার জন্য। মা উদ্বেগ প্রকাশ করলে তারাই কমলার মাকে বুঝিয়ে রাজি করায়। কমলার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে ছোট বোন ও ভাই মঙ্গলা ও বকুল, সঙ্গী হয় বড়দির ছেলে বাপ্পাও। দুপুরবেলা কমলার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেই গিয়ে হাজির হন রেলস্টেশনে। বকুল ও বাপ্পাকে একবার পুলিশ ধরেছিল, আবার ছেড়েও দিয়েছে। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসে কমলা। বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় মাকে।
সকালটা নির্বিঘ্নেই কাটে। বিকেলে পুলিশ প্রশাসন ঘিরে ফেলে স্টেশন। সমবেত জনতার ওপর আচমকা আক্রমণ হানে। রাইফেলের বাঁট দিয়ে, ব্যাটন দিয়ে বেধড়ক মার। মঙ্গলার ওপর এসে পড়ে রাইফেলের আঘাত। মঙ্গলা মাটিতে পড়ে যায়। আর্তনাদ করে ওঠে, "দিদি, আমায় বাঁচা!" বোনের বুকফাটা আর্তনাদে কমলা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োয় যেখানে মঙ্গলা পড়ে আছে। পৌঁছোনোর আগেই একটা বুলেট তার চোখের মধ্যে দিয়ে ঢুকে সটান মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ। মাতৃভাষাকে ভালোবাসার মূল্য চুকিয়ে দিল ষোলো বছরের কমলা তার নিজের জীবন দিয়ে। ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র মহিলা ভাষাশহীদ।
আর মঙ্গলা? প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল সে, কিন্তু বাকি জীবনটা কাটাতে হয়েছিল না বাঁচার মতো করেই। মঙ্গলাকে সেদিন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মারাত্মকভাবে আহত মেয়েটির জ্ঞান ফিরতে লেগেছিল টানা এক মাস, তারপর সে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাকি জীবনটা মঙ্গলা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়েই কাটিয়ে দেয়।
না, বাঙালি তাঁদের মনে রাখেনি। শুধু তাই নয়, অনেক আবার বাংলা ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেও পিছপা হয় না। কিন্তু সেদিনের শহীদদের এই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাঁদের সংগ্রাম বর্তমানে বাঙালি মনে রাখুন বা না রাখুক, তাঁদের আত্মদানের ফলশ্রুতিতে আসামের প্রাদেশিক সরকার বাংলা ভাষার মর্যাদাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। বাংলা ভাষাকে সেখানে দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবসে আমরা ১৯শে মে দিনটির কথাও একবার নাহয় মনে করি। মনে করি সেইসব ভুলে যাওয়া মানুষদের, প্রথম নারী ভাষাশহীদ কমলা ভট্টাচার্যকে, তাঁর সতীর্থদের, চিরজীবনের মতো প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া ছোট্ট মেয়ে মঙ্গলাকে, যাঁরা মাতৃভাষাকে আগলে রেখেছিলেন নিজের মায়ের মতো করেই।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন