৪. দেবী রঙ্কিণী
রাজস্থানের ধারানগরীর শাসক ছিলেন রাজা বীরবর সিংহ। একদিন রাতে এই বীরবর সিংহ ও তাঁর রাজপুরোহিত রামদেব ওঝা দুজনেই একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটা যেমন আশ্চর্যজনক তেমনই অস্বস্তিকরও বটে। তিনি দেখলেন, তাঁর রাজপরিবারের কুলদেবী মাতা কঙ্কালি রেবানদীর তীরবর্তী এক জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি গুহায় পড়ে আছেন। দেবী কঙ্কালী তাঁদের আদেশ দিলেন, সেখান থেকে দেবীকে উদ্ধার করে রাজবাটীতে স্থাপন করতে। স্বপ্নাদেশ পেয়ে অভিভূত বীরবর সিংহ ও তাঁর রাজপুরোহিত দেবীকে গুহা থেকে রাজবাড়িতে নিয়ে আসেন ও মন্দিরে স্থাপন করে মহাসমারোহে তাঁর পূজার প্রচলন করলেন।
এই বীরবর সিংহের দুই ছেলে- পৃথ্বী সিংহ ও জগদ্দেও প্রমার। বীরবরের মৃত্যুর পর যথারীতি সিংহাসনে বসলেন বড় ভাই পৃথ্বী সিংহ। এতে জগদ্দেও প্রমার অসন্তুষ্ট হন। দাদার কাছে তিনি রাজ্যের অর্ধভাগ দাবী করলেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সিংহাসনের দ্বন্দ্ব ক্রমে যুদ্ধের রূপ নিলো। যুদ্ধে হার হল জগদ্দেও প্রমারের। রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে ভাগ্যান্বেষণে বেরলেন। বৃন্দাবন, কাশী, মথুরা ইত্যাদি তীর্থে ভ্রমণ করতে করতে দিন এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো।
নানা তীর্থ ঘুরে জগদ্দেও প্রমার পুরীর জগন্নাথধামে উপস্থিত হলেন। সেখানে একরাত্রে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, নীল বস্ত্র পরিহিতা এক অসামান্যা সুন্দরী দেবী তাঁর দিকে সস্নেহে তাকিয়ে আছেন। দেবী বললেন, “রাজকুমার, তুমি আমার সঙ্গে এসো, আমি তোমাকে সোনার নদীর তীরে রাজ সিংহাসনে বসাবো।” তারপর দেবী উত্তর দিকে যেতে লাগলেন। রাজকুমার জগদ্দেও পরদিনই দেবীর নির্দেশে উত্তর দিকে যাত্রা করলেন। কালক্রমে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে ধবলভূমি (এখনকার ধলভুম) অঞ্চলে উপস্থিত হলেন।
এই ধবলভূমি অঞ্চলেই রজকদের একটি রাজ্য ছিল; রাজ্যের অধিপতি ছিলেন ভীষণ অত্যাচারী। রজক প্রজারা প্রায়ই বিদ্রোহ করতো, সে কারণে রাজকুমার সেই রাজ্যে উপস্থিত হলে প্রজারা তাঁকে যুদ্ধনেতা হিসেবে বরণ করে নেয়। রজকরাজার বিরুদ্ধে তাঁর প্রজারা যুদ্ধ ঘোষণা করেন, জগদ্দেওর রণনৈপুণ্যে তাঁরা অনায়াসে জয়ী হয়। প্রজারা জগদ্দেওকেই নিজেদের রাজা হিসেবে মেনে নেন। রাজা জগদ্দেও কালক্রমে ধবলভূমি অঞ্চলের ছোটোবড়ো সকল রাজ্যকেই নিজের দখলে আনেন। কালক্রমে তিনিই ধবলভূমির একচ্ছত্র সম্রাটে পরিণত হন।
ধবলভূমি অধিকার করার পর জগদ্দেও নিজের নাম পরিবর্তন করেন। রাজ্যের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি নাম নিলেন ধবলদেব। আর জগন্নাথ দর্শনের পর তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, তাই নিজের নামের সঙ্গে জগন্নাথ নামটাও জুড়ে নিলেন। তাঁর নতুন নাম হল- জগন্নাথ ধবলদেব।
রাজ্যলাভের পর, তিনি আবার ধারানগরী ফিরলেন। পিতৃভূমিতে পৌঁছে তিনি প্রথমে গেলেন তাঁদের কুলদেবী কঙ্কালীর কাছে। জগদ্দেও দেবীকে প্রার্থনা করলেন, দেবীকে তিনি নিজ রাজ্য ধবলভূমিতে নিয়ে যেয়ে চান। দেবী রাজি হলেন একটা শর্তে। ধারানগরী থেকে ধবলভূমি পর্যন্ত দেবী কঙ্কালী জগদ্দেও প্রমারের অনুগমন করবেন, কিন্তু পুরো রাস্তায় জগদ্দেও একটি বারের জন্যও যেন পিছনে না তাকান। কিন্তু শর্তপূরণ করতে পারলেন না কৌতূহলী জগদ্দেও প্রমার। যাত্রাপথে একসময় এক অদ্ভুত শব্দ শুনে রাজা পিছনে তাকান। তারপর-
“শব্দ শুনি নরপতি পশ্চাতে ফিরিলা,
কঙ্কালী দেবীর মুর্তি দেখিতে পাইলা,
মহাবেশে মহাকালী মহুল তলায়,
বৃক্ষ অন্তরালে আছে উলঙ্গিনী প্রায়,
দেবী বলে নরপতি স্মর পুর্ব কথা,
আর না যাইবো আমি রহিলাম হেথা,
মহুল বৃক্ষের তলে বিশ্রাম আমার,
মহুলিয়া নামে গ্রাম হইবে প্রচার,
আজি হতে নাম মোর হইলো রংকিনী,
যাও রাজা এবে তুমি নিজ রাজধানী।”
অতঃপর রাজা সেই ‘মহুল’ বা মহুয়া গাছের তলাতেই দেবীর পাষাণ মুর্তি ও একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। দেবীর নাম পরিবর্তিত হল ‘কঙ্কালি’ থেকে ‘রংকিনী’ আর স্থানটার পরিচয় হল মহুলিয়া(টাটানগরের কিছু আগে গালুডি স্টেশনের নিকটবর্তী একটি গ্রাম) নামে। পরবর্তীতে জগদ্দেও প্রমারের রাজধানী ধলভুম থেকে ঘাটশিলায় স্থানান্তর করা হয়। কয়েক শতাব্দী পর দেবী রঙ্কিণী মহুলিয়া থেকে ঘাটশিলায় মন্দিরান্তরিত হন। মহুলিয়া, ঘাটশিলা ও ধবলভূমির একসঙ্গে নাম হয় ‘রঙ্কিণীভুম’ নামে। সেই থেকে দেবী রঙ্কিণী ধলভুম রাজের কুলদেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। এখনও তাঁদের জমিদারীর কাগজ ও চিঠিপত্রের উপরে “শ্রীশ্রীরামচন্দ্র রংকিনী চরণ শরণম” লিখে মঙ্গলাচরণ সম্পন্ন করা হয়।
দেবী রঙ্কিণীর বিগ্রহ, ঘাটশিলা
বাংলার বর্ধমান, মেদিনীপুর, হুগলী প্রভৃতি জেলার পল্লী অঞ্চলে রঙ্কিণীর পূজা পার্বণ্ নিয়মিত ভাবে অনুষ্ঠিত হয়। আশ্চর্যজনক ভাবে, রঙ্কিণী দেবীর পূজা এখনও যেসব গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়, বেশিরভাগ গ্রামের নামে কোন পার্থক্য নেই, সেইসব গ্রামেরই নাম একই। যেমনঃ- বর্ধমান জেলার ‘মৌলা’ গ্রামে দেবী পূজিত হন। আবার মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার এক গ্রামেও তাঁর পূজা হয়, তারও নাম ‘মৌলা’। বিনপুর থানায় এক রঙ্কিণী দেবী আছেন, গ্রামের নাম ‘মৌলা’। নন্দীগ্রাম থানায় একটি ‘মৌলা’ গ্রাম আছে, সেখানেও রঙ্কিণী দেবী পূজিত হন। একই নামের একাধিক গ্রাম থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু আশ্চর্য হল, ‘মৌলা’ নামের সঙ্গে রঙ্কিণী দেবীর অবস্থানের সম্পর্ক। ধারনা করা হয়, ‘মহুলিয়া’ নামটিই অপভ্রংশে ‘মৌলা’তে পরিণত হয়েছে। এমনকি, বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলিতেও ‘মৌলা’ ও রঙ্কিণী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়-
“মৌলায় রঙ্কিণী বন্দো জোড় করি পাণি।
ভাণ্ডার হাটে বন্দিলাঙ সাবিত্রী গোসানি।।”
- কালিকামঙ্গল, কবিশেখর বলরাম।
বা,
“মৌলায় রঙ্কিণী বন্দো শুদ্ধ হয়্যা মন।
বালিডাঙায় বটেশ্বরী বন্দিব চরণ।।”
- ধর্মমঙ্গল, রূপরাম চক্রবর্তী।
এছাড়াও, ধর্মমঙ্গলের ঢেকুরপালা খ্যাত ইছাই ঘোষ দেবীর সেবক ছিলেন বলে জানা যায়। সিমুলার রাজকন্যা কানড়া বিপদে পড়লে দেবী তখন তাঁর পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন-
“রঙ্গিণী(রঙ্কিণী) উড়িলা রণে রূধিরলোচনা।
…
রক্ষ রক্ষ রঙ্গিণী রঙ্গিণী রণ মাঝে।
রণ রণ রেব উরি রাখ দশভুজে।।”
কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যেও রঙ্কিণীর উল্লেখ পাওয়া যায়-
“রাজার সনে হৈল রণ রক্ষা নাহি আর।
রঙ্গিণী করহ রক্ষা তবে সে উদ্ধার।।”
রঙ্কিণী যে বঙ্গসমাজে একেবারেই অপরিচিতা অথবা উপেক্ষিতা ছিলেন না, মঙ্গলকাব্যের কবিদের এইসব উল্লেখ থেকে তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায়। ঘাটশিলা ছাড়া তারকেশ্বরের ‘মহুয়া’ গ্রামে দেবী মূর্তিতে পূজিত হন। মাটির তৈরী এই মূর্তি অতি সুদর্শনা, ত্রিনয়নী, হস্তে নানাবিধ প্রহরণ, গলায় মুণ্ডমালা, পদতলে শবরূপী শিব। সিংভুমের কদমাপল্লী ও কেরাগ্রামে, জামশেদপুর, ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড়, গড়বেতা ইত্যাদি অঞ্চলেও রঙ্কিণীর পূজা হয়ে থাকে। বরাকরে দেবী রঙ্কিণী আবার কল্যাণেশ্বরী নামে বিখ্যাত।
বাংলায় রঙ্কিণীর পূর্ণ বিগ্রহ অতি বিরল, দু-এক স্থানে এঁর মুণ্ডমূর্তি দেখা যায়, অন্যত্র বা বেশির ক্ষেত্রেই রঙ্কিণীর প্রতীক রূপে পোড়া মাটির হাতি ঘোড়া পূজিত হয়। মূলত, কালির ধ্যানমন্ত্রে এমনকি কালিমূর্তিতেও রঙ্কিণী পূজিত হন। তবে, দেবীর জন্য বিশেষ ভাবে রচিত ধ্যানমন্ত্রও দু’এক স্থানে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ভক্তদের ধারণা, রঙ্কিণী ভয়ঙ্কর দেবী, রক্তমুখী, রক্তবর্ণা, নররক্ত পিপাসু- তবে পশুপক্ষীর রক্তেও তিনি কিছু তুষ্ট হন। দেবীর পূজায় আমিষ-নিরামিষ উভয়প্রকার নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়, তবে পশুপক্ষী বলি আবশ্যিক অনুষঙ্গ।
অন্যান্য লৌকিক দেবতার মত রঙ্কিণীর বিশেষ পূজার সময় মকর সংক্রান্তিতে কিন্তু ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে কোনোকোনো মন্দিরে বিশেষ কোনো তিথি অনুসারে তাঁর বার্ষিক বা বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বহু স্থানে বিশেষত সীমান্ত বাংলার পল্লী বিশেষে ইনি অভিভাবিকা রূপে বিরাজ করেন্, সে সকল জনপদে অন্য কোনো শক্তিদেবী পূজিত হননা। ওই সকল অঞ্চলে মহামারীর প্রাদুর্ভাব হলে গ্রামবাসীরা বারোয়ারী ভাবে রঙ্কিনীর পূজা করে ত্রাণ পাবার বিশ্বাসে, পুরোহিতরা রঙ্কিণীর প্রসাদ গ্রামের বিতরণও করেন।
বাংলার লৌকিক দেবী হিসেবে খ্যাতনামা হলেও, রঙ্কিণী পূজার উৎপত্তি মূলত ছোটনাগপুর অঞ্চলে, বিশেষ করে ঘাটশিলার রঙ্কিণী দেবী সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়।
ঘাটশিলার রঙ্কিণী বিগ্রহটি কালো পাথরের উপর উৎকীর্ণ। দেবীর মস্তকের জটা বক্ষে পৃষ্ঠে প্রসারিত, জটার কয়েকটি চূড়াকারে কপালের উপর স্থাপিত। দেবী দ্বিনেত্রী ও অষ্টভুজা, উপরের দুই হস্তে একটি হাতি ধারণ করে আছেন, ওপর হস্তে প্রহরণ আছে, কিন্তু সিঁদুরের আতিশয্যে তা পুর্ণাঙ্গ ভাবে বোঝা যায় না। তিনি শববাহনা, সংস্কৃত ভাষায় রচিত দেবীর নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র ধ্যানমন্ত্রও বর্তমান-
“রক্তাঙ্গীং ধৃত শূল মুণ্ড ডমরুং পাত্রং করৈর্বিপ্রতীম।
নাগদ্বন্দ্বকরদ্ব্যাং শব হৃদারূঢ়ং নৃমুণ্ডাবলী।।
মালাং দানবনাশিনীমসিকরাং নাগত্বগাচ্ছাদিতাম।
দেবীমঞ্চভুজাং মুখার্পিতকরাং ধ্যায়েৎ সদা রঙ্কিণীম।।”
ঘাটশিলার মন্দিরে রঙ্কিণীর নিত্য পূজা হয়; সকল কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি তাঁর পূজার প্রশস্ত দিন, এছাড়া বিশেষ পূজা হয় জন্মাষ্টমী, সীতাষ্টমী ও জিতাষ্টমীতে। এর মধ্যে জিতাষ্টমীর পূজা সর্বাপেক্ষা আড়ম্বরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়, পূজা উপলক্ষে এক পক্ষকাল ব্যাপী মেলাও বসে দেবী মন্দির ঘিরে। জিতাষ্টমীর মহাপূজার অনুষঙ্গ হিসেবে এক বীভৎস পরব অনুষ্ঠিত হত, এর নাম ‘বিঁধা পরব’ বা ‘বেঁধা পরব’। বেঁধা পরবের আদিম রূপ বর্তমানে লোপ পেয়েছে; লোকের রুচির পরিবর্তনে বা শাস্ত্রীয় প্রভাবে নয় - আইনের নির্দেশে।
রঙ্কিণী মন্দির, ঘাটশিলা
বেঁধা পরবের দিন ধলভুমের সামন্তরাজা রঙ্কিণীর মন্দিরে উপস্থিত থাকতেন, মন্দির প্রাঙ্গনে একটি মঞ্চে তাঁর আসন হত, ওই মঞ্চের নীচে দুটি পুরুষ মহিষকে আদিবাসীরা নিয়ে আসতো, আর তাঁদের ঘিরে থাকতো শত শত বলিষ্ঠ, সশস্ত্র আদিবাসী সাঁওতালরা। ঢাক, ঢোল, মাদল, রামশিঙ্গা উৎকট শব্দে বেজে উঠতো; রাজা সেই সময় মন্দের উপর থেকে পরপর কয়েকটি শানিত অস্ত্র ওই মহিষ দুটিকে লক্ষ করে ছুঁড়ে মারতেন। এরপর আদিবাসীরা টাঙ্গি, বর্শা প্রভৃতি দিয়ে মহিষ দুটিকে আঘাত করতো, যতক্ষণ না তারা ক্ষতবিক্ষত দেহে মাটিতে সংজ্ঞা হারিয়ে লূটিয়ে পড়তো। মহিষদুটির মুমূর্ষু কালে রাজপুরোহিত এসে খাঁড়া দিয়ে তাঁদের মস্তক ছেদন করতেন। রক্তাক্ত মুণ্ড দুটি দেবী রঙ্কিণীকে উৎসর্গ করা হত।
ঘাটশিলার দেবী বাংলার মেদিনীপুরের ওড়গন্দা গ্রামেও পূজা নিতে আসেন। ওড়গন্দা ‘ভৈরবভূমি’ নামেও পরিচিত, এখানে ভৈরবের বিরাট প্রস্তরমূর্তি আছে। ঘাটশিলার রঙ্কিণী হলেন এই ওড়গন্দা গ্রামের ভৈরবের ভৈরবী। ভক্তদের বিশ্বাস, ঘাটশিলার বেঁধা পরব সম্পন্ন করে দেবী এখানে আসেন। ঘাটশিলার বেঁধা পরবের শেষাঙ্ক হিসেবে এখানে ‘পাতা বেঁধা’ পরব অনুষ্ঠিত হয়। জিতাষ্টমীতে হয় বেঁধা পরব, আর পাতা বেঁধা হয় দশমী তিথিতে। ওই দিন দেবী রঙ্কিণীর আগমন উপলক্ষে মহিষ ও পশুপক্ষী বলি হয়, পূজা করেন আদিবাসী সমাজের প্রধানরা। ওড়গন্দার রঙ্কিণী পূজার স্থান আড়ম্বর ও সমারোহের দিক থেকে ঘাটশিলার ঠিক পরেই। তবে বর্তমানে এই পূজার খ্যাতি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
দেবীর কাছে নরবলি হওয়াটাও আশ্চর্যজনক ছিলনা। মাত্র ১৮০ বছর আগেও ঘাটশিলার রঙ্কিণী দেবীর কাছে নরবলি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্র বাউলের ‘ধলভুম বিবরণ’ থেকে জানা যায়,
“একবার কতকগুলি লোক ডেপুটি কমিশনার হেজ সাহেবের কাছে মিথ্যা অভিযোগ করিয়াছিল যে, মহারাজা অষ্টম জগন্নাথ ধবলদেব আপন কুলদেবী শ্রীশ্রী রংকিনী মাতার নিকট নরবলি প্রদান করিয়াছেন। তদনুসারে হেজ সাহেব সদলে মোহুলিয়া রংকিনী মন্দিরে প্রবেশ করিয়া নানারূপ অনুসন্ধান করেন ও রাজাকে নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেন।”
অবশ্য স্থানীয় আদিবাসীগণের ধারণা নরবলি দেওয়া হত না, দেবী স্বয়ং নরহত্যা করে তাঁর পিপাসা মেটাতেন। কিন্তু অন্যান্য কাগজপত্রে রঙ্কিণী দেবীর নিকট নরবলির প্রমাণ পাওয়া যায়। মহুলিয়া গ্রামেরই উপকায়স্থ পরিবারের বসবাস। জনশ্রুতি হল, তাঁরাই আগে নরবলির উপাদান(অর্থাৎ মানুষ) জোগান দিতেন। এমনকি বাংলার বর্ধমানের রঙ্কিণী দেবীর কাছেও নরবলি হত, এমনই তথ্য পাওয়া যায় তৎকালীন সংপাদপত্রে-
“…সম্বাদ প্রভাকর পত্র হইতে সমুদায়িক পত্রে প্রকাশ পাইতেছে যে, বর্ধমানের শ্রীশ্রী রঙ্কিণীশ্বরী দেবী অর্থাৎ মৃত্তিকা কিম্বা পাষান-খুদিতা মূর্তির নিকটে একটা নরবলি হইয়াছে, কিন্তু তাহা কে করিয়াছে তাহার নির্ণয় এ-পর্য্যন্ত হয় নাই।…. সাধারণ লোকেদের মধ্যে এমত জনরব উপস্থিত হয়াছে যে, তথাকার কোন প্রধান লোক নরবলিতে লিপ্ত আছেন এবং আমরা আরও জানি, এই রঙ্কিণী দেবীর নিকট পূর্বেও বিস্তর নরবলি হইয়াছে।” [সমাচার দর্পণ, ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৭ সাল]
১৮৩৭ সাল পর্যন্ত যদি কলকাতার কাছে বর্ধমানে রঙ্কিণী দেবীর কাছে বরবলি হয়ে থাকে, তাহলে তার আগে, মহুলিয়ার মন্দিরেও নরবলি হত, তাতে সন্দেহ নেই।
শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলিতে রঙ্কিণীর উল্লেখ পাওয়া যায় না। বহুস্থানে এই দেবীর পুজায় শাস্ত্রীয় বিধান অনুসৃত হলেও পূজাচারে কয়েকটি অনুষঙ্গে ও দেবীর আকৃতির মধে এমন কোনো কোনো লক্ষণ দেখা যায়, যাকে শাস্ত্রসম্মত বলা যুক্তিযুক্ত নয়। দেবীর মূর্তি ও ধ্যানমন্ত্রাদি স্থানভেদে পরিবর্তিত হতে দেখা যায়, এক অঞ্চলে ইনি বহুজনপূজ্যা হলেও অন্যত্র অজ্ঞাত। এঁর প্রাধান্য অঞ্চলেও একই তিথি বা কালে পূজা অনুষ্ঠিত হয়না। এই সব লক্ষন দেখে মন্তব্য করা যায় রঙ্কিণী দেবীর পূজা প্রাচীন, বহুজনপূজ্যা এমনকি, কয়েকটি সামন্ত রাজ-পরিবার স্বীকৃত হলেও, ইনি শাস্ত্রীয় দেবী নন।
তাহলে, দেবী আসলে কে? এখানে বলে রাখি, ‘রংক’ শব্দের অর্থ নির্ধন ও লোভী। এই শব্দের সঙ্গে স্ত্রীলিঙ্গবাচক ‘-ইনী’ প্রত্যয় যোগ করে ‘রংকিনী’ নামটি প্রতিপাদিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। সেই সূত্রে ‘রংকিনী’ কথার অর্থ হয় ‘দরিদ্রা’ বা ‘লুব্ধা’। আবার ওড়িয়াতে ‘রংক’ উন্মাদ বা মত্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘রণ’ বা যুদ্ধ থেকে ‘রণকিনী’ এবং তাঁর থেকে ‘রঙ্কিণী’ কথাটি এসেছে বলেও অনেকে মনে করেন। অর্থাৎ, ‘রণকিনী’ বা ‘রঙ্কিণী’র অর্থ ‘যুদ্ধপ্রিয়া’ও হতে পারে।
পাল আমলের চর্চিকা বিগ্রহ
দেবী রঙ্কিণীর সাথে পালযুগে পূজিত চর্চিকাদের বিশেষ মিল পাওয়া যায়। চর্চিকা আসলে দেবী চামুণ্ডারই একটি রূপভেদ। চর্চিকা ও রঙ্কিণী- দুজনের মধ্যেই কিছু চোখে পড়ার মতো মিল পাওয়া যায়। দুজনেই সাধারণত অষ্টভুজা, দুজনেই শবের ওপর অধিষ্ঠিতা, নৃমুণ্ডমালিনী, ভীষণদর্শনা ও রক্তপিপাসু। চর্চিকার দেহ শীর্ণ এবং তিনি ক্ষুধাতুরা। দেবী রঙ্কিণী নিজেও দরিদ্রা, তাছাড়া তাঁর নামের অর্থই লোভাতুরা। যুদ্ধপ্রিয়া রঙ্কিণীর মতোই চর্চিকাও ছিলেন যুদ্ধমাতৃকা; এমনকি পালযুগে রাজা নয়পালের সময় ‘জয় চর্চিকা’ পালসেনার রণধ্বনি ছিল। পালবংশের শাসনামলে চর্চিকা উপাসনা প্রসার পায়, বিশেষ করে মহীপাল পুত্র নয়পাল চর্চিকার ভক্ত ছিলেন এবং তাঁকেই জগন্মাতা রূপে উপাসনা করতেন। সম্ভবত তাঁর সময়েই অর্থাৎ একাদশ শতক নাগাদ দেবী চর্চিকাই ঘাটশিলার রাজবংশে রঙ্কিণী নামে প্রতিষ্ঠিত হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পালযুগের অন্যতম প্রধানা বৌদ্ধদেবী তারার চারজন সহচরী বা যোগিনী থাকত - ডাকিনী, শাকিনী, রাকিনী(পাঠভেদে লাকিনী) ও হাঁকিনী। এই রাকিনীই মূলত দেবী রঙ্কিণী।
[আগামী পর্বে সমাপ্য]
তথ্যসূত্রঃ-
1.
পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি – বিনয় ঘোষ
2.
বাংলার দেবতা, অপদেবতা ও লোকদেবতা – মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী
3.
বাংলার লৌকিক দেবতা – গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন