দোলযাত্রার বাহারি ঠাণ্ডাই - বাণী মিত্র



  
“ আজকে দোলের হিন্দোলায়
আয় তোরা কে দিবি দোল ।
ডাক দিয়ে যায় দ্বারে ওই
হেনার কুঁড়ি আমের বৌল । "
   
--- কাজী নজরুল ইসলাম



বসন্তের শুরু ঘোষিত হয় বসন্তপঞ্চমীর শুভ দিনে, দেবী সরস্বতীর বন্দনার মধ্যে।প্রকৃতির রঙিন ঋতুর বাহার পূর্ণতা পায় দোল উৎসবের মাধ্যমে। দোলপূর্ণিমার ইতিহাস বহুকালের, উৎসবের দুই অংশের একটি পালনকর্তা বিষ্ণুর আর অন্যটি মহাদেব শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। পরমেশ্বরের দুই রূপের দুই ঘটনার উৎসবও চলে দু’দিন ব্যাপি। বাঙালি তথা ভারতীয় অন্যান্য যে কোনও উৎসবের মতই এই উৎসবেও আহার ব্যঞ্জনের প্রাচুর্য উল্লেখযোগ্য। দোলের বিশেষ খাবারের মধ্যে মট – ফুটকড়াই, ভাজা মিষ্টি এবং ভাঙ মেশানো সিদ্ধি বা ঠাণ্ডাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। রঙ খেলার সাথে সাথেই চলে মুখ মিষ্টির পালা। বসন্তের মৃদু দখিনা বাতাসে গরমের তাত থেকে আরামের জন্য ঠাণ্ডাই অর্থাৎ ভাঙ মেশানো শরবতের চাহিদা সব সময়েই বেশি থাকে। বলা হয়ে থাকে এই শরবতেরও ধর্মীয় গুরুত্ব আছে।

পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, সমুদ্র মন্থনের দেবাদিদেব মহাদেব নিজের কণ্ঠে যে গরল ধারণ করেন তা অত্যন্ত গরম ছিল। ফলে হলাহলের গরম জ্বালা থেকে মুক্তি পেতে শিব ভাঙ সেবন করেন। ভাঙকে শীতল বলে মনে করা হয়। কথিত আছে, শিব পূজায় ভাঙ নিবেদন করলে ভগবান শিব প্রসন্ন হন। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, হোলির দিনে ভগবান শিব ও বিষ্ণু বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে ভাঙ সেবন করা হয়। কথিত আছে, ভক্ত প্রহ্লাদকে হত্যার চেষ্টাকারী হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করার জন্য ভগবান বিষ্ণু নরসিংহের রূপ ধারণ করেছিলেন। কিন্তু হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করার পর তিনি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন। তাকে শান্ত করতে ভগবান শিব শরভ অবতার বা শরভেশ্বর রূপ গ্রহণ করেন। হোলির দিনে ভাঙ খাওয়ার এটিও একটি কারণ বলে মনে করা হয়।

কলকাতার বিভিন্ন বনেদী বাড়ির দোল উৎসবেও সিদ্ধি খাওয়ার রীতি ছিল। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত “ জোড়াসাঁকোর ধারে” বইয়ে ঠাকুর বাড়ির দোল আড়ম্বরের বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁদের দেউরি দোলের ভিড়ে গমগম করত, সবাই লাল আবীরে রাঙা হয়ে থাকতেন এবং মাঝে মাঝেই রব উঠত – “হোরি হ্যায়” । গানের সাথে সাথে ঢোলের বাদ্যতে আঙিনা মুখরিত থাকত। আর উঠোনের একপ্রান্তে সিদ্ধির দেদার আয়োজন থাকত। সুতরাং দোল উৎসবের সাথে সিদ্ধি বা ভাঙ খাওয়ার চলকে উপেক্ষা করার উপায় থাকেনা। শুধু যুগ বদলের সাথে সাথে এই শরবতেরও বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন হয়েছে। রসনা তৃপ্তির সাথে যোগ হয়েছে স্বাস্থের চিন্তা ভাবনাও। আজ দোল উপলক্ষে তাই এই রকমই কিছু ঠাণ্ডাই রেসিপি দেওয়া হল।



সিদ্ধি বা ভাঙঃ





উপকরণঃ
  • সিদ্ধি— ৪ টেবিল চামচ
  • দুধ— ৪ কাপ
  • আমন্ড— ২ টেবিল চামচ
  • গরম মশলা গুঁড়ো— ১/৮ চা চামচ
  • আদা গুঁড়ো— ১/৪ চা চামচ
  • গোলাপ জল— ১ চা চামচ
  • চিনি— ১ কাপ
  • জল— ২কাপ
  • কনডেন্সড মিল্ক— ১ কাপ

প্রণালীঃ

  • জল গরম করে ফুটতে থাকলে সিদ্ধি দিয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে দশ মিনিট রেখে দিতে হবে।
  • এবার একটি পাতলা মসলিনের কাপড়ে জলটা ভালো করে ছেঁকে নিতে হবে। অবশিষ্ট সিদ্ধি ভালো করে হাত দিয়ে চেপে চেপে বাকি থাকা রসটুকুও নিংড়ে নিয়ে অন্য একটি পাত্রে ওই সিদ্ধিপাতার সঙ্গে দু’চামচ গরম দুধ মিশিয়ে ভালো করে চামচ দিয়ে ফেটিয়ে নিতে হবে।
  • দুধটা ধীরে ধীরে সিদ্ধির সঙ্গে মিশে গাঢ় হয়ে আসবে।
  • একটি বড় পাত্রে দুধ গরম করে এর মধ্যে চিনি আর কনডেন্সড মিল্ক মিশিয়ে ভালো করে ফোটাতে হবে। দুধ ফুটে এলে নামিয়ে আমন্ড কুচি, গরম মশলা গুঁড়ো, আদা গুঁড়ো আর গোলাপ জল মেশাতে হবে।
  • সিদ্ধি ছাঁকা জল এবং সিদ্ধি মেশানো দুধ একসাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ভালো করে সমস্ত তরল মিশে গেলে ফ্রিজে অন্তত ৩০ মিনিট রাখতে হবে।
  • ভাঙ লস্যি বরফ কুচি মিশিয়ে পরিবেশন করতে হবে।


পানবাহারঃ




পান-বাহার বা পান ঠাণ্ডাই অত্যন্ত সুস্বাদু পানীয়। এই পানীয় তৈরিতে ব্যবহার করা হয় “গুলকন্দ”, যা নানা রোগ প্রতিকার করতেও সাহায্য করে।


উপকরণঃ

  • পান পাতা— ১৫টি
  • দুধ— ৬ কাপ
  • জল— ২ কাপ
  • আমন্ড— ১/২ কাপ
  • গোলাপ জল— ৪ ফোঁটা
  • রোজ সিরাপ— ২ টেবিল চামচ
  • গুলকন্দ— ১০ চামচ
  • কাজুবাদাম— ২ টেবিল চামচ
  • পেস্তা— ২ টেবিল চামচ
  • গোলাপের পাপড়ি— কয়েকটি
প্রণালীঃ

  • প্রথমে আমন্ড, কাজু আর পেস্তা ভাল করে বেটে রাখতে হবে।
  • দুধ আর জল ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডা করে নিয়ে এর মধ্যে পান পাতা কমপক্ষে ১ ঘণ্টা চুবিয়ে রাখতে হবে।
  • মিক্সিতে পান পাতা আর সামান্য ঠাণ্ডা জল দিয়ে ভাল করে বেটে নিতে হবে।
  • একটি বড় পাত্রে ৬ কাপ ঘন ঠাণ্ডা দুধ, দু’কাপ ঠাণ্ডা জল আর বাদাম বাটা মিশিয়ে এর মধ্যে একে একে পানপাতা বাটা, গুলকন্দ, গোলাপ জল আর রোজ সিরাপ ভাল করে মেশাতে হবে।
  • উপর থেকে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে পরিবেশন করতে হবে পান-বাহার।




চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন