"আমরা দু'টি ভাই, শিবের গাজন গাই,
ঠাকমা গেছেন গয়া কাশী, ডুগডুগি বাজাই।"
ছোটবেলায় ছড়ার বইতে এই ছড়া আমরা প্রত্যেকেই পড়েছি।
ইংরেজি বছরের এপ্রিল মাসে যেমন বাংলার নতুন বছর শুরু হয় এবং সেই উপলক্ষ্যে নববর্ষ
উদযাপন করা হয়, ঠিক তেমনি চৈত্র মাসের সমাপনও বটে। চৈত্র মাসের সঙ্গে দেবাধিদেব শিব বিশেষভাবে
যুক্ত। কারণ এই মাসেই নীল পুজো অর্থাৎ নীল ষষ্ঠী, এই মাসেই গাজন, এই মাসেই চড়ক।
বাংলার গ্রামেগঞ্জে নীলষষ্ঠীর সঙ্গেই নীলাবতীর বিবাহের দিনটিও সমানভাবে পালিত হয়ে থাকে। এর আগের দিন অধিবাস। এইদিন রাত্রিবেলায় হয় হাজরা পূজা অর্থাৎ বিয়ে উপলক্ষ্যে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা হয়। হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূতপ্রেতের দেবতাকে পোড়া শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয়। নীলাবতীর বিয়ের দিনে আড়ম্বর কম কিছু থাকে না। গ্রামের সকলে মিলে নানারকম সেজে থাকে যাকে বলা হয় সঙ সাজা। শিব এবং পার্বতী তো সাজেই, এছাড়াও শিবের চ্যালাদের মত ভূতপ্রেত সেজে বর কনের সঙ্গে বরযাত্রীরা হুল্লোড় করে। সাধারণভাবে একটি বিবাহের সমস্ত অনুষ্ঠান তিন দিন ধরে চলে। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা নেই। নীলাবতীর বিয়ের অনুষ্ঠানও তিনদিনের। এই তিনদিনের অনুষ্ঠানকে বলে গাজন। অনেকে মনে করেন, গ্রাম শব্দ থেকে ‘গা’ শব্দটি এসেছে এবং জনসাধারণ থেকে ‘জন’ সুতরাং এটি গ্রাম জনগণের উৎসব তাই একে বলা হয় গাজন। অন্য মতে, 'গ্ৰামজন' থেকে 'গাজন' শব্দের উৎপত্তি। আবার কেউ কেউ বলেন, শিবভক্ত গাজন সন্ন্যাসীদের আনন্দ উল্লাসরূপ গর্জন থেকে 'গাজন' কথাটা এসেছে।
গাজনের মূলে রয়েছেন দুই দেবতা শিব ও ধর্মঠাকুর।
এছাড়া মনসা এবং কালীর গাজনও হয়ে থাকে। শিবের অন্যতম নাম 'গম্ভীর'। উত্তরবঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ 'গম্ভীরা' গান বাংলার লোকসঙ্গীতে জনপ্রিয় যা গাজনেরই নামান্তর। পরাধীন ভারতে রঙ্গলাল, অমৃতলাল প্রমুখ কবিরা স্বদেশী
ভাবধারায় গাজনের বহু গান রচনা করেছেন। পূর্বেই উল্লিখিত, গাজন প্রধানত বাংলার কৃষিজীবী
মানুষদের উৎসব। গ্ৰীষ্মের দাবদাহে উদ্বিগ্ন কৃষকেরা বর্ষা, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং ভালো
ফসলের প্রার্থনা জানিয়ে গাজন উৎসব পালন করেন। হিন্দুধর্মের সকল সম্প্রদায়ের
মানুষেরই উপাস্য মহাদেব। ব্রাহ্মণ পূজারীরা সারাবছর শিবের পুজো করলেও চৈত্র মাসে
সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর সন্ন্যাসীদের মহাদেবকে উপাসনা করতে কোনো বাধা থাকতো না। আর
এটাই গাজনের বৈশিষ্ট্য। সঙ্কীর্ণ গন্ডীর বেড়াজাল ভেঙে জাতপাতের ঊর্ধে উঠে গাজন
উৎসবে অংশ নিতে পারেন বাংলার প্রতিটি মানুষ।
চৈত্রের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পুজো।লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিব আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ
থাকলেও চড়ক পুজোর উল্লেখ নেই। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের
বর্ষক্রিয়াকৌমুদী ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বেও এই পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে
পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এটি প্রচলিত ছিল। উচ্চস্তরের লোকদের মধ্যে
এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। জনশ্রতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ
ঠাকুর নামের এক রাজা এই পুজো প্রথম শুরু করেন।
চড়ক পুজো চৈত্র সংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ
দিবসে পালিত হয়। আগের দিন একটি শাল গাছকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। লম্বা এই
শাল গাছের গুঁড়ি মাটিতে পুঁতে দু'দিকে বাঁশের সঙ্গে ভক্তরা দড়ি বেঁধে ঘোরে। এই শাল
গাছটিকে চড়ক বলে। কালীপ্রসন্ন সিংহ 'হুতোম প্যাঁচার নকশা'তে চড়কের চমৎকার বর্ণনা
দিয়েছেন-
"ঢাকের
বোল বাজছে, গোলাপী খিলির দোনা বিক্রি
হচ্ছে। একজন চড়কী পিঠে কাঁটা ফুঁড়ে নাচতে নাচতে এসে চড়কগাছের সঙ্গে কোলাকুলি
কল্লে–মৈ়ঁয়ে করে তাকে উপরে তুলে পাক দেওয়া হতে লাগল। সকলেই আকাশ পানে চড়কীর
পিঠের দিকে চেয়ে রইলেন। চড়কী প্রাণপণে দড়ি ধরে কখনো ছেড়ে পা নেড়ে নেড়ে ঘুরতে
লাগল। একজনের পিঠ ফুঁড়ে ঘোরানো হচ্ছে, হাজার লোক মজা দেখছেন।"
দৈহিক যন্ত্রণা চড়ক পুজোর একটি বিশেষ অঙ্গ। পিঠ
ফোঁড়ার সঙ্গে অন্যান্যগুলির মধ্যে রয়েছে কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত কয়লার ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং হাজরা পুজো
করা। দৈহিক নির্যাতন ও কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে দেবতাকে তুষ্ট করাই এই পুজোর মূল
উদ্দেশ্য। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, বাণ রাজা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দ্বৈরথে ক্ষতবিক্ষত হয়ে
মহাদেবের আরাধনায় মগ্ন হন এবং নিজের রক্ত দিয়ে নৃত্যগীত পরিবেশন করে শিবকে
সন্তুষ্ট করেন। সেই কারণে চড়ক উৎসবে নানাবিধ দৈহিক যন্ত্রণা পুজোর অঙ্গ বলে
বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কো দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে
দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য
অঙ্গে বাণশলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে
দেওয়া হয়। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের
সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে।
বর্তমানে অধিকাংশ জায়গা থেকেই চড়ক হারিয়ে যেতে
বসেছে। দৈহিক যন্ত্রণার প্রথাগুলি বাদ দিয়ে পূজা অর্চনার মাধ্যমে এবং মেলার
বন্দোবস্ত করে এটি উদযাপন করাই যায়। চড়কের অন্যতম আকর্ষণ, এই পুজোর উদ্যোক্তারা কয়েকজনের
একটি দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। সেই দলে থাকে একজন শিব ও দু'জন সখী। একজনকে সাজানো হয়
লম্বা লেজ দিয়ে, তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে
থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে নীল পাগলের
দলও বলা হয়ে থাকে। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন
করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পুজো। এই উৎসবকে
কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা চড়ক সংক্রান্তির মেলা নামে অভিহিত।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নববর্ষের প্রাক্কালে গাজন-চড়ক এক সামাজিক
মেলবন্ধন ও সম্প্রীতির প্রসার ঘটাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন