মানুষ
দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না – একটি অত্যন্ত প্রচলিত কথা যা আমরা হামেশাই শুনে
থাকি। কিন্তু একখানি গুরুতর বিষয় আমরা বড়রা হেলাফেলা করি, শিশুদের দাঁতকে আমরা গুরুত্ব দিই না। এই হেলাফেলা শুরু হয় শিশুদের দুধের দাঁত
দিয়ে। আমাদের মধ্যে অধিকাংশের মনে শিশুদের দুধের দাঁত সংক্রান্ত একটি অত্যন্ত ভুল
ধারণা আছে। অনেকেই মনে করেন এই দাঁত তো পড়ে যাবে, তাই তেমন যত্ন না নিলেও চলবে।
আর এই কারণেই baby stage থেকে toddler stage-এ যেতে
যেতে বাচ্চাদের দাঁতে বিভিন্নরকম সমস্যা দেখা দেয়। কোনো শিশুর দাঁতে পোকা (cavity) ধরে সেটি কালো বর্ণ ধারণ করে, সে বেচারা যন্ত্রণায় কষ্ট পায়। কারুর দাঁত আবার
ক্ষয়ে যায়, একটুতেই ভেঙে যেতে থাকে। শিশুটির বাবা মা তখন
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বাচ্চাকে নিয়ে দন্তচিকিৎসকের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে
হয়।
একটি
শিশুর জন্মের পর থেকে তার ছয়মাস বয়স পর্যন্ত সে শুধু দুগ্ধ পান করে, সেটি মাতৃদুগ্ধ হতে পারে কিংবা ফর্মূলা মিল্ক। ছয়মাস বয়সের পর থেকে ধীরে
ধীরে semi-solid খাওয়া থেকে শুরু করে সে solid food-এর দিকে যায়। শিশুদের আট-দশ মাস বয়সের মধ্যে অধিকাংশেরই দাঁত ওঠে না।
সেক্ষেত্রে যে ভুলটা আমরা করি তা হলো, আমরা ভাবি যে ও তো শুধু দুধ খায়
বা ওর তো এখনও দাঁত ওঠেনি, তাই মুখ পরিষ্কারের কোনো প্রয়োজন নেই। বাস্তবটা
কিন্তু একেবারেই আলাদা। বাচ্চার মুখের ভেতর এবং মাড়ি নিয়মিত পরিষ্কার না করলে
ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। ফলস্বরূপ, মুখে দুর্গন্ধ দেখা দেয় এবং
মাড়ির স্বাস্থ্যহানি ঘটতে থাকে।
অন্যতম
সমস্যা হলো, অনেক শিশুরই রাত্রিবেলায় মায়ের দুধ বা বোতলের
ফর্মূলা দুধ পান করতে করতে ঘুমোনোর অভ্যাস থাকে। সেই অভ্যাস দুই বা আড়াই বছর বয়স
অবধিও থাকতে পারে। মুশকিলটা সেখানেই। এরকম হলে মুখের ভেতরটা পরিষ্কার না করা
অবস্থাতেই শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে এবং দাঁতের ও মাড়ির সংক্রমণ দ্রুত হয়।
আপাতদৃষ্টিতে দুধের দাঁতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও এগুলি যদি সুস্থ ও সুরক্ষিত
না থাকে তাহলে পরবর্তীতে স্থায়ী দাঁতগুলিতেও সমস্যা হতে পারে। কারণ দুধের দাঁতের
স্থানেই স্থায়ী দাঁত গজায়। দুধের দাঁতের শিকড়ে প্রদাহ অনেকদিন স্থায়ী থাকলে
স্থায়ী দাঁতের ক্ষতি হয়।
তাহলে
করণীয়? শিশুর দাঁত ওঠার আগের পর্যায়ে একটি পাত্রে ঈষদুষ্ণ
জল নিয়ে তাতে একটি পরিষ্কার নরম কাপড় ভিজিয়ে শিশুটির মাড়ি আলতো করে মুছতে হবে। এটি
করতে হবে দিনে দু'বার। ছোট শিশুরা তখনও কুলকুচি করতে শেখে না।
সেক্ষেত্রে প্রতিবার খাওয়ার পর বাচ্চার মাড়ি ও মুখ পরিষ্কার করে দেওয়া একটি
অত্যন্ত সুঅভ্যাস। শিশুর ছ'মাস বয়স সম্পূর্ণ হলে তাকে পান করার জন্য জল দেওয়াই
যায়। সেইসময় থেকে প্রত্যেকবার তার খাওয়ার পর (তরল অথবা অর্ধতরল) কোনো পরিষ্কার
নরম সুতির কাপড় জলে ভিজিয়ে মাড়ি এবং জিভ অবশ্যই পরিষ্কার করা উচিত।
অনেকক্ষেত্রে রাতের বেলায় শিশুরা ব্রেস্টফিড বা বটলফিড করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
সেরকম হলে তাকে বোতলে করে হোক অথবা বাটি চামচে, জল খাইয়ে দিতে হবে যাতে মুখের
ভেতরটা পরিষ্কার থাকে।
শিশুর
মাড়িতে দাঁত দেখা দেওয়ার পর কাপড় দিয়ে প্রথম প্রথম পরিষ্কার করলেও সময় বুঝে
তার জন্য finger toothbrush কিনতে হবে। শিশুদের জিনিসপত্র পাওয়া যায় এমন দোকানে
অথবা অনলাইনে সহজেই এমন টুথব্রাশ মেলে। তারপর কিনতে হবে তাদের জন্য baby toothbrush। এই টুথব্রাশগুলির বিশেষত্ব হলো এগুলির থাকে ছোট্ট মাথা, লম্বা হাতল এবং নরম ব্রিসলস। সঙ্গে কিনতে পারেন তাদের জন্য বানানো বিশেষ মাজন।
বাজারে অনেক নামীদামি কোম্পানির বেবি টুথপেস্ট পাওয়া যায়। এইসব মাজনে ক্ষতিকর কোনও
রাসায়নিক থাকে না এবং বাচ্চা অল্প গিলে ফেললেও তার কোনও ক্ষতি হয় না। ব্রাশটি ভালো
করে জলে ভিজিয়ে নিয়ে একটি চালের দানার পরিমাণ বেবি টুথপেস্ট লাগিয়ে বাচ্চার দাঁত
আলতো হাতে ব্রাশ করে নিন। তিনবছর বয়সের উপর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মাজনের পরিমাণ হবে
একটি মটরশুঁটি দানার মতো।
বাচ্চা
যতদিন পর্যন্ত নিজে নিজে মুখে জল নিয়ে কুলকুচি করে মাজনের ফেনা ফেলতে না শেখে, ততদিন বাড়ির বড়দের ওকে সাহায্য করতে হবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে এবং রাতে
খাওয়ার পর অর্থাৎ দিনে দু'বার নিয়মিত ব্রাশ করাতে হবে। বাচ্চার শিশুবয়স থেকে
এই অভ্যাস বজায় রাখলে তার ভবিষ্যতের অভ্যাসও ভালো হবে, দাঁত এবং মাড়িও ভালো থাকবে। ছোট থেকে দাঁতের যত্ন নেওয়া শুরু করলে সেই অভ্যাস
তার মধ্যে সারাজীবন ধরে থাকবে। বাচ্চা একটু বড় হয়ে গেলে তার জন্য ফ্লস ব্যবহার করা
যায়। এতে দাঁতের ফাঁকে যেসব ময়লা ব্রাশ করে বেরোয় না, সেগুলি বেরিয়ে যায়।
ছোট
শিশুদের মুখের ভেতর পরিষ্কার করানো বা দাঁত ব্রাশ করানোর কাজটি বড়রাই করিয়ে দেন।
কিন্তু বাচ্চা একটু বড় হলে তাকে তো নিজের কাজ নিজে করতে শেখাতে হবে। দাঁত ব্রাশ
করার ক্ষেত্রে ছোটবয়স থেকে দিনে দু'বার তার দাঁত ব্রাশ করালে সে
জানবে খাওয়া ও ঘুমোনোর মতো দাঁত পরিষ্কার করা একটি অতি প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন কাজ।
সে যাতে নিজে নিজে দাঁত ব্রাশ করে তার জন্য তাকে উৎসাহ দিতে হবে। দাঁতের
স্বাস্থ্যরক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধির উপর ছোটদের জন্য বিভিন্ন রকমের কার্টুন ভিডিও
পাওয়া যায়। প্রয়োজনে সেসবের সাহায্য নিতে হবে। খেলাচ্ছলে বাচ্চাকে দাঁত ব্রাশ
করার প্রয়োজনীয়তা বোঝান। ওর খেলনা পশুপাখি বা পুতুলদের ব্রাশ করাতে বলুন।
বাচ্চার ব্রাশ করার সময় ওর সঙ্গে একসাথে ব্রাশ করুন। ছোটরা কিন্তু বড়দের অনুসরণ
করেই শেখে। এর সাথেই প্রত্যেকবার খাওয়ার পর কুলকুচি করার অভ্যাস বাচ্চার মধ্যে
গড়ে তুলুন। বিভিন্ন মিষ্টি বা আঠালো জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বাচ্চাকে যতটা পারা
যায় বিরত রাখুন। বিস্কুট বা চকলেট খেলে সেগুলির অবশিষ্টাংশ দাঁতের মধ্যে বহুক্ষণ
আটকে থাকে, এমনকি কুলকুচি করলেও সহজে যেতে চায় না। সে কারণে
এগুলি খাওয়া এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
তবে
দাঁতের জন্য ক্ষতিকর খাবার যেমন আছে, তেমনি এমন খাবারও রয়েছে যেগুলি
দাঁতের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে। ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার দাঁতের পক্ষে খুবই উপকারী। তার জন্য
খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে দুধ, দই, পনীর ইত্যাদি দুগ্ধজাতীয় খাবার, বিনস, বাদাম, মুরগীর মাংস, ডিম, আলু, সবুজ সবজি, পাতিলেবু, কমলালেবু। এগুলি দাঁতের স্বাস্থ্যরক্ষায় সাহায্যকারী। আমরা অধিকাংশই মনে করি, দাঁতের কোনো সমস্যা হলে তবেই শুধুমাত্র দন্তচিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। এটি
কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ভুল ধারণা। ছোট হোক বা বড়, সকলের জন্যই বছরে অন্তত দু'বার দাঁতের স্বাস্থ্য-পরীক্ষার উদ্দেশ্যে ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া উচিত। সাথেই
প্রত্যেকবার খাওয়ার পর ভালো করে কুলকুচি এবং দিনে দু'বার সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ করা, এতেই দাঁতের স্বাস্থ্য সুন্দরভাবে বজায় থাকবে।
চিত্র সৌজন্যঃ আন্তর্জাল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন