অটিজম নিয়ন্ত্রণে নতুন পথের দিশা - ডঃ শ্রীময়ী চক্রবর্তী

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অটিজম শব্দটির সাথে আমরা হয়তো কম বেশি সকলেই পরিচিত। অটিজম, আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, বলতে এমন কিছু স্নায়বিক এবং মানসিক  উপসর্গকে বোঝায় যার প্রভাবে একটি শিশুর সামাজিক সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা অথবা অন্য কোনো মানুষের সংস্পর্শে থাকার ইচ্ছে উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়। যদিও অটিজম রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনও স্পষ্ট ভাবে উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি, তবুও এই রোগের নেপথ্যে জিন এবং পরিবেশের যে বিশেষ ভূমিকা আছে সেটুকু আজ স্পষ্ট ভাবে প্রমানিত। স্নায়ুর এই বিকাশজনিত সমস্যা শুধুমাত্র যে জন্মগত তাই নয়, উপরন্তু বংশপরম্পরায় তা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যেও প্রকাশিত হতে পারে।

 


 

 হাজারো উপসর্গের ভিড়েঃ

 

এখনো পর্যন্ত উপসর্গের ওপর নির্ভর করেই অটিজম রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনোসিস করা হয়। অথচ উপসর্গের মধ্যেও এত বৈচিত্র্য যে এই রোগের শুরু অথবা শেষ কোথায় তা বুঝতে বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। আবার বিভিন্ন রোগীর মধ্যে এই রোগের প্রকাশের মাত্রাও ভিন্ন। তাই সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে সঠিক ভাবে এখনো বলা সম্ভব নয় যে কোনো ব্যক্তি অটিজম রোগে আক্রান্ত কি না। বরং চিকিৎসক বা মনোবিজ্ঞানীরা অটিজম রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আচরণ সংক্রান্ত কিছু সর্বস্বীকৃত পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এই পদ্ধতিতে আক্রান্ত রোগীকে তার রোগের উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন নিয়মাবলী মেনে একটি স্কোর দেওয়া হয়। সেই স্কোর ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করে গেলে, চিকিৎসকেরা প্রাথমিক ভাবে মনে করেন যে রোগী অটিজমের মত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তার পরেও এই রোগ সুনিশ্চিত করার জন্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী, স্পিচ ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথলজিস্ট অথবা অকুপেশনাল থেরাপিস্টের মত বহু বিশেষজ্ঞের সাহায্য একান্ত ভাবে প্রয়োজন।

 

বুদ্ধিমত্তার অভাব না কি প্রতিভার বিচ্ছুরণ:

 

অটিজম শব্দটির উৎপত্তি ১৯১১ সাল নাগাদ, ওয়গেন ব্লয়লার নামে এক সুইস মনোবিজ্ঞানীর হাত ধরে। যদিও সেই সময় উনি স্কিজোফ্রেনিয়া রোগের কিছু উপসর্গ বোঝাতেই এই শব্দের ব্যবহার করেন। পরবর্তী কালে সামাজিক এবং মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের কথা বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে। অন্যদিকে, ১৯৯৪ সালে ডা. হ্যান্স  অ্যাসপারগার অটিজম রোগের উপসর্গের সাথে সাদৃশ্য আছে এমন কিছু রোগের সন্ধান পেলেন যা "অ্যাসপারগার্স সিনড্রোম" বলে পরিচিত হয়। অ্যাসপারগার্স সিনড্রোম সমষ্টিগতভাবে কিছু রোগকে বোঝায়, যা প্রধানত স্নায়বিক বিকাশজনিত ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে সৃষ্টি হয়। যদিও প্রথম দিকে এই অ্যাসপারগার্স সিনড্রোমকে অটিজম বলেই মনে করা হতো কিন্তু পরবর্তী কালে এই রোগটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি শারীরবৃত্তীয় অস্বাভাবিকতা হিসাবে ব্যখ্যা করা হয়। কিন্তু এটি আসলে অটিজম রোগেরই ভিন্ন কোনো অবস্থা কিনা তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত 'Diagnostic and statistical manual of mental disorder'-এ অটিজম এবং অ্যাসপারগার্স সিনড্রোমকে একসাথে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) হিসাবে অভিহিত করা হয়।

 

 



 

অপরদিকে, অটিজমের সাথে অ্যাসপারগার্স সিনড্রোমের মৌলিক একটি পার্থক্য রয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধির বিকাশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে থাকে। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার সাধারণের থেকেও অতিরিক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি দেখা যায় যারা অ্যাসপারগার্স রোগের শিকার।আর এই কারণেই চার্লস ডারউইন, মেরি কুড়ি, আইনস্টাইন অথবা নিউটনের মতো অসামান্য ব্যক্তিত্বকে এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে, কিন্তু এঁরা কেউই কথাকথিত “অটিজম” রোগে আক্রান্ত ছিলেন না। তবে দুটি রোগের ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তির সবথেকে বড় সমস্যা হলো, 'social interaction' 


এছাড়া অ্যাসপারগার্স রোগের প্রধান কিছু উপসর্গ আছে যার সাথে আপনি অটিজম রোগের উপসর্গের পার্থক্য করতে পারবেন না যেমন -

 

১. সামাজিক সচেতনতার অভাব।

২. সামাজিক যোগসূত্র তৈরী করার অক্ষমতা।

৩. এমনকি বন্ধু বানাতে পারা অথবা বন্ধুত্ব বা অন্য যে কোনো সম্পর্ক ধরে রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা।

৪. অন্যের অনুভূতি, চিন্তা অথবা আবেগ কে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারার অপারগতা।

৫. অপর মানুষের দিকে খুব গভীর ভাবে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অথবা চোখে-চোখ রেখে কথা বলা কে সম্পূর্ণ ভাবে উপেক্ষা করা।

৬. মুখমণ্ডলে অত্যধিক অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ অথবা তার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি।

৭. শব্দ, স্পর্শ, ঘ্রান অথবা স্বাদের প্রতি অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা।

৮. ইশারার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করতে না পারা।

৯. পরিবর্তনের প্রতি অনমনীয়তা অথবা নিয়মের প্রতি অকারণ ও অত্যধিক নির্ভরশীলতা।

১০. গতানুগতিক কিছু 'motor pattern' যেমন, ক্রমাগত হাত নাড়ানো।

 

 

অর্থাৎ, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকদের কাছে এ কথা পরিষ্কার যে অন্যান্য রোগের মত গুটি কয়েক সাধারণ উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয়। তবুও এই উপসর্গের বৈচিত্রের মধ্যে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে বেশ কিছু সাধারণ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়; যেমন

 

১. সামাজিক প্রতিবন্ধকতা

২. নিজের অনুভূতি অথবা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারার অক্ষমতা

৩. সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ ক্রমাগত ভাবে করতে থাকা অথবা অস্বাভাবিক মনোযোগ সহকারে খুব সাধারণ কিছু ঘটনার খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করা

 

অটিজম রোগের ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির ইন্দ্রিয় এতটাই সজাগ এবং সুতীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিটি অনুভূতিই হয়ে ওঠে তীব্র। গাছের পাতা নড়া অথবা আকাশের বুকে নীল মেঘের আনাগোনার মত অতি স্বাভাবিক, অতি তুচ্ছ ঘটনাগুলো এদের কাছে হয়ে ওঠে চলচ্চিত্রের মত আকর্ষণীয়। কিন্তু একই ভাবে ছোট খাটো সমস্যার ক্ষেত্রেও এরা হয়ে ওঠে অতি সংবেনশীল। কোনো অপছন্দের খাদ্য, গন্ধ অথবা বর্ন কিংবা বিশেষ কম্পাঙ্কের কোনো শব্দও হয়ে উঠতে পারে তাদের কাছে বিভীষিকা স্বরূপ। স্বাভাবিক ভাবেই ক্রমাগত এই সমস্ত অনিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়ংকর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে থাকে।

 

রোগের সাত সতেরোঃ

 

এই রোগের উপসর্গ যেরকম জটিল ধাঁধার মত, কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঠিক ততটাই ধোঁয়াশায় আছেন বিজ্ঞানীরা। পরিবেশের প্রভাব থেকে শুরু করে জিনগত সমস্যা, বিভিন্ন টক্সিনের উপস্থিতি এমনকি ক্ষুদ্রান্ত্রে অবস্থিত আণুবীক্ষণিক ব্যাকটেরিয়ার সামান্য ভারসাম্য বিঘ্নিত হলেও এই রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হতে পারে।

 

পরিবেশের প্রভাব

 

অটিজম রোগের কারণ হিসাবে আমাদের চারপাশের পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন ঠিক কতটা দায়ী, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে বেশ অবাক করার মত তথ্য। গর্ভাবস্থার তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে মা যদি ওজন গ্যাসের দূষণের সংস্পর্শে আসে তাহলে তা বহুক্ষেত্রে শিশুর মধ্যে অটিজমের মত রোগের লক্ষণ প্রকাশ করে। এছাড়াও বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার দূষণের (particulate matters) প্রভাবে একটি শিশুর পরবর্তী জীবনে অটিজমের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। “এপিডেমিওলজি" নামক এক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এই যুগান্তকারী আবিষ্কার।

 

জিনগত প্রভাব:

 

অটিজম রোগের জন্য ঠিক কোন জিন বা জিনগুলো দায়ী তা সন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৫,৫৮৪ জন মানুষের ওপর  একটি সমীক্ষা চালান, যার মধ্যে ১১,৯৮৬ জন ছিলেন অটিজম রোগে আক্রান্ত। সমীক্ষার ফলাফলস্বরূপ বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন যে ১টি বা ২টি নয় বরং বিস্ময়কর ভাবে ১০২ টি জিন অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী। এর মধ্যে প্রায় ৫৩ টি জিন অন্য কোনো মানসিক বিকাশগত সমস্যা নয়, বরং শুধুমাত্র অটিজম রোগের কারণ। আমাদের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স নামক একটি অংশে উপস্থিত এই জিনের ভ্যারিয়েন্ট এক নিউরোনের সাথে আর এক নিউরোনের সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা অন্য কোনো জিনকে 'অন' অথবা 'অফ' করার মাধ্যমে অটিজমের মত রোগের বহিঃপ্রকাশ করাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

 

শরীরের অভ্যন্তরীণ জীবাণুর প্রভাব:

 

আমাদের অন্ত্রে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার (gut microbiota) বৈচিত্র্যের সামান্য ভারসাম্যহীনতা অটিজমের সাথে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবেই সম্পর্কিত। ২০১৭ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, অটিজম রোগে আক্রান্ত শিশুদের মাইক্রোবায়োটা ট্রান্সফার থেরাপির মাধ্যমে অন্ত্রে থাকা অপরিহার্য ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা এবং বৈচিত্র্যের তারতম্য ঘটানো হয়, যা অটিজমের মত রোগের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করেছে। এই চিকিৎসা অটিজম আক্রান্ত শিশুদের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা থেকে শুরু করে ভাষার ব্যবহার, সামাজিক সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা এবং আচরণের উন্নতি ঘটাতেও সক্ষম হয়েছে।

 

সাম্প্রতিক অপর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে CNTNAP2 নামের একটি জিন অটিজমের জন্য দায়ী আবার অন্যদিকে এই জিনের ঘাটতিই অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়ার বৈচিত্রের তারতম্যের কারণ। এমনকি এই জিনের অনুপস্থিতিতে রোগীর মধ্যে সামাজিক সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে অক্ষমতা প্রকাশ পায়। এই সমস্ত রোগীদের ক্ষেত্রে লাক্টবেসিলাস মত উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে আশাব্যঞ্জক ফলাফল লাভ করাও সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের পেট থেকে মস্তিষ্ক, ডিএনএ থেকে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ সবই কোথাও একটা গিয়ে একই সুতোয় বাঁধা।

 

রুপোলি রেখার সন্ধানে:

 

সবশেষে একটা কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে অটিজম রোগের ক্ষেত্রে একটি জিনকে টার্গেট করে বা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট উপসর্গের ওপর নির্ভর করে রোগ নির্ণয় করা কখনোই সম্ভব নয়। এই রোগের হাজার একটা ভিন্ন উপসর্গ, আবার তাদেরই নেপথ্যে আছে শ'খানেক জিনের কলকাঠি। তাই কোন শিশুর ক্ষেত্রে কোন উপসর্গ কী মাত্রায় প্রকাশিত হবে, অথবা ঠিক কী কারণে এই রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে তা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। তাই, যতদিন না পর্যন্ত বিকল্প কোনো চিকৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়, ততদিন পর্যন্ত সামগ্রিক ভাবে এই রোগের সুনির্দিষ্ট একটি চিকিৎসা করার পরিবর্তে ব্যক্তি বিশেষ উপসর্গ ভিত্তিক চিকিৎসা করাই শ্রেয়। 

 

 







তথ্যসূত্র

https://www.autism.org.uk

https://www.medicalnewstoday.com

 


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন