সেসময় সাহিত্যজগতে এক নবীন কবির লেখা কবিতা আলোড়ন ফেলেছে। ছদ্মনাম "অপরাজিতা"। সকলের মুখে মুখে প্রশ্ন, এই কবি আসলে পুরুষ না নারী! সবাই একযোগে বলল, এ কোন পুরুষের লেখা। মেয়েরা আবার এত লেখাপড়া শিখল কবে! এদিকে কবিতাগুলি প্রকৃতিতে, মাধুর্যে, অলঙ্কারে আর পাঁচজন পুরুষ কবির রচনার তুলনায় একেবারে আলাদা। সেই বিতর্ক শেষপর্যন্ত এসে পৌঁছল স্বয়ং কবিগুরুর কানে। অনেকে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে বললেন, "এ কবি নিশ্চিত পুরুষ"। এদিকে প্রমথবাবুর মত, 'এ রচনা যারই লেখা হোক, পুরুষের হতে পারে না। এ মেয়ের লেখা নিঃসন্দেহে।" তখন রবীন্দ্রনাথ নিজে কবিতাগুলি পড়লেন এবং মুগ্ধ হলেন। ডেকে পাঠালেন রাধারাণী দেবীকে।
তাঁকে ডেকে পাঠানোর একমাত্র
কারণ – "অপরাজিতা দেবী" ছদ্মনামে লেখা "পুরবাসিনী" কাব্যগ্রন্থটির
উৎসর্গ অংশে উল্লেখিত হয়েছে "রাধারাণী দেবী ও নরেন্দ্র দেবের করকমলে
অর্পিত" কথাটি। সুতরাং অপরাজিতা দেবীর প্রকৃত পরিচয় রাধারাণী দেবীর জানার
কথা। অগত্যা রাধারাণী দেবী কবিগুরুর কাছে গেলেন। কিন্তু সত্যটা প্রকাশ করতে পারলেন
না। আত্মপ্রকাশের সঠিক সময় যে এখনও আসেনি। নিরুপায় হয়ে জানালেন, অপরাজিতা তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী।
পরে অবশ্য অপরাজিতা দেবীর
প্রকৃত পরিচয় প্রকাশিত হয়েছিল, কবিগুরুর কাছেই। এই কবিসমাজেই রাধারানীর প্রেমে পড়েছিলেন কবি নরেন্দ্র দেব।
অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে একসময় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন দু'জনে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিষ্যাকে চিঠি পাঠিয়ে বললেন, "আজ থেকে তুমি নতুন জীবনে আনীতা হলে, তাই তোমার নাম নবনীতা।"
কিন্তু রাধারানী ছিলেন নিজের
মতে চলা তেজস্বিনী মহিলা। তিনি উত্তরে লিখেছিলেন, "আমি আপনার আশীর্বাদটুকু নিলাম। কিন্তু নামটা নিতে পারলাম না। আমি ২৮ বছর ধরে
রাধারাণী। ওই নামে আমার দু'টো বই আছে। কাজেই
আমি এই নাম নিতে পারব না। তবে আপনার দেওয়া নবনীতা নামটা আমি তুলে রাখলাম আমার মনের
মনিকোঠায়।"
হ্যাঁ, সেই নাম তিনি সযত্নে তুলে রেখেছিলেন। তাইতো নিজের
মেয়ের নাম রেখেছিলেন ওই নামে। নবনীতা, নবনীতা দেবসেন। কে না চেনেন তাঁকে! আর রাধারাণী দেবী! নবনীতা দেবসেনের মা।
"মানুষ
মেয়ে"র বাল্যবিবাহ এবং বৈধব্য :
১৯০৩ সালের ৩০শে নভেম্বর রাধারাণী দেবীর জন্ম। ছবিরউন্নিসা বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তেন তিনি। সেখান থেকেই মাইনর পর্যন্ত পাস করেন। ছোট থেকেই তাঁর মধ্যে একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল আত্মমর্যাদা, স্বাভিমান। আর সে কারণেই সহপাঠিনীরা "মেয়েমানুষ" বললেই তিনি সটান প্রতিবাদ করে উঠতেন, "খবরদার, মেয়েমানুষ বলবি না, বলবি মানুষ মেয়ে। আগে মানুষ, পরে মেয়ে।" এমন "মানুষ মেয়ে"কে মায়ের কথায় নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বসতে হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে। তবে নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে নয়।
নরেন্দ্র দেব প্রেমে পড়েছিলেন
রাধারাণী দেবীর। সেযুগে এক বিধবার প্রেমে পড়েছিলেন। আর সেই নিয়ে বেঁধে গিয়েছিল
হুলুস্থূল। পুনরায় বিয়ের স্বপ্ন দেখা তো দূরের কথা! ত্রিশের দশকে মাত্র তেরো বছর
বয়সে রাধারাণী দেবীর বিয়ে হয়েছিল ভবানীপুরের বাসিন্দা বছর চব্বিশের ইলেকট্রিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর সঙ্গে। পাত্রর কর্মস্থল উত্তরপ্রদেশ। বিয়ের
কয়েকমাস যেতে না যেতেই এশিয়াটিক ফ্লুতে রাধারাণীর স্বামীর মৃত্যু হয়। নতুন সংসার
ধুলোয় মিশে গেল।
পাশে পেলেন নতুন মাকে :
রাধারাণী দেবীর মা ছিলেন পুরাতন ধ্যানধারণার মানুষ। স্বামীবিয়োগের পর রাধারাণী দেবী কলকাতা থেকে বাপেরবাড়ি মাথাভাঙায় ফিরলেন। পাতে পড়ল হবিষ্যান্ন। মাথা প্রায় ন্যাড়া করে দেওয়া হল। গায়ে উঠল থান। বৈধব্যযাপনের নিয়মকানুন তাঁকে তাঁর মা বিশদে বুঝিয়ে দিলেন। কঠোর আদেশ জারি করলেন, রঙিন শাড়ি আর আমিষ আহার চলবে না।
পুত্রবধূর এমন রূপ দেখে হতবাক
শাশুড়ি মা সুশীলাবালা। এতটুকু মেয়ের মাথার উপর পাহাড়প্রমাণ নিয়মকানুনের কথা
জানতে পেরে বড়ো কষ্ট পেলেন। একমুহূর্ত দেরি না করে রাধারাণী দেবীর বাপেরবাড়ি
থেকে তাঁকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। আদরের বৌমার গায়ে ফের উঠল ইঞ্চিপাড়
কাপড়, হাতে দু’গাছি
চুড়ি, গলায় কানে সোনা।
রাধারাণীর মনোকষ্ট কমানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে নিযুক্ত করে দিলেন নানাবিধ কাজকর্মে।
সংসারের আয়ব্যয়ের যাবতীয় হিসেবরক্ষার দায়দায়িত্ব বর্তাল তাঁর উপরে। বৌমাকে
সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দিলেন তিনি। বন্দোবস্ত করলেন টেবিল, চেয়ার, খাতা, দোয়াত ও কলমের।
সাহিত্যচর্চায় একাকিনী
রাধারাণী :
শাশুড়ি মায়ের ভাবনার যথেষ্ট বাস্তবতা ছিল। মনোকষ্ট ও একাকিত্ব ভুলতে রাধারাণী আত্মমগ্ন হয়ে গেলেন সাহিত্যচর্চায়। ১৯২৪ সালে তাঁর লেখা প্রথম গল্প "বিমাতা" প্রকাশিত হয় "মাসিক বসুমতী"তে। প্রথম প্রবন্ধ পুরুষ" প্রকাশ পায় "কল্লোল"এ। এর পাঁচবছর পর রাধারাণী দেবীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "লীলাকমল" প্রকাশিত হল।
শিলং পাহাড়ে হাওয়াবদলের জন্য
গেলেন তিনি। মনে উদ্ভব হল নতুন ভাবনার। এবার থেকে ছদ্মনামে লেখা শুরু করবেন।
অপরাজিতা দেবী নামে "ভারতবর্ষ"য় দু’টি কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে
সাহিত্যমহল যারপরনাই উত্তাল। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হল অপরাজিতা দেবীর প্রথম
কাব্যগ্রন্থ "বুকের বীণা"। ধীরে ধীরে সাহিত্য জগতে প্রভাব বিস্তার শুরু
হল তাঁর। আরো রচনা প্রকাশ পেতে থাকল।
দ্বিতীয় বিবাহে আত্মসম্প্রদান
:
রাধারাণী দেবীর দ্বিতীয় বিবাহ সেযুগের সমাজে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। একে তো বিধবার পুনর্বিবাহ, তাও আবার তখনকার রক্ষণশীল সমাজে। তাহলেও চেনা-অচেনা মানুষের কটূকথা ম্লান করতে পারেনি রাধারাণী ও নরেন্দ্রনাথের ভালোবাসাকে। রাধারাণীর মতোই নরেন্দ্রনাথ দেব ছিলেন একজন সাহিত্যিক। সাহিত্যমহলেই দু'জনার আলাপ। নরেন্দ্রনাথের ‘কাব্য-দিপালী’ পত্রিকার সম্পাদনায় সাহায্য করতে গিয়ে তাঁদের মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক বিবাহে গড়িয়ে যায়। এদিকে আবার দু’জনের বয়সে পনেরো বছরের ব্যবধান। তার উপর রয়েছে পারস্পরিক প্রতিকূল আবহ।
সব প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে মনে
জোর নিয়ে এগিয়ে গেলেন রাধারাণী। কন্যাসম্প্রদানে নজির তৈরি করলেন তিনি, নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করলেন। ১৯৩১ সালের ৩১শে মে
সেই বিবাহের পরবর্তী দিন সংবাদপত্রে লেখা হল – "রাধারানি-নরেন্দ্র দেব বিবাহ:
কন্যার আত্মসম্প্রদান"। এই ঘটনায় বাঙালি সমাজের একাংশে শোরগোল পড়ে যায়।
কিন্তু লিলুয়ার "দেবালয়" বাড়িতে প্রমথ চৌধুরী, জলধর সেন, হেমেন্দ্রকুমার রায়, যতীন্দ্রমোহন
বাগচী, প্রেমাঙ্কুর
আতর্থী-সহ সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের নমস্য ব্যক্তিগণের উপস্থিতিতে বিবাহপর্ব
নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হয়।
নবনীতার আগমন :
রাধারাণী ও নরেন্দ্রর সুখের সংসার। রাধারাণী সন্তানসম্ভবা। কিন্তু এমনই অদৃষ্ট, তাঁদের প্রথম সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারল না। সন্তানের অকালপ্রয়াণের পর ব্যথিতহৃদয় নরেন্দ্র দেব কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কে ‘ভালো-বাসা’ নামে নতুন এক আবাস গড়ে তুলে স্ত্রীকে সেখানে নিয়ে আসেন। অবশেষে আট বছর পর রাধারাণী ও নরেন্দ্রর একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। রাধারাণী মেয়ের নাম রাখেন "নবনীতা", কবিগুরুর দেওয়া আশির্বাদী নাম। অনেক কষ্ট ও প্রতিকূলতাকে জয় করে অবশেষে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করার স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছিল রাধারাণী দেবীর।
রাধারাণী দেবী ঘরে ও বাইরে
সমানভাবে দক্ষ ছিলেন। সংসারের কাজকর্ম ও মেয়ের দায়িত্ব সামলানোর সাথে সাথে নিজের
সাহিত্যচর্চা, "মিলনের
মন্ত্রমালা" কাব্যানুবাদ, স্বামীর সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় গল্প সংকলন "কথা-শিল্পে"র কাজ করেছেন।
সাহিত্যচর্চায় প্রাপ্ত করেছেন ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক, লীলা পুরস্কার এবং রবীন্দ্র পুরস্কার। স্বামী
নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে "পাঠশালা" পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন তিনি। ওই
পত্রিকার উপরে লেখা থাকত – পাঠশালার এই আটচালাতে চলবে দেশের মানুষ গড়া। আর ঠিক
সেভাবেই নিজের সন্তানকে সবদিক থেকে যোগ্য "মানুষ" হিসেবেই তিনি তৈরি
করেছিলেন।
রাধারাণীর দেবীর নারীবাদী
চেতনার পরশ তাঁর কন্যা নবনীতার মধ্যেও প্রবহমান ছিল, কিন্তু তার উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ কখনও ঘটেনি। তা ছিল মার্জিত এবং রুচিশীল। ১৯৮৯
সালের ৯ই সেপ্টেম্বর অমৃতলোক যাত্রা করেন রাধারাণী দেবী। তাঁর তেজস্বী এবং দৃঢ়
ব্যক্তিত্ব যা তাঁকে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, আশা রাখি ভারত তথা পৃথিবীর প্রত্যেকটি মেয়ে যেন এমন
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই এগিয়ে যেতে পারে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন