দৈবাদিষ্ট - চেনা কাহিনীর অচেনা দৃষ্টিকোণ - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়




বই – দৈবাদিষ্ট
লেখক – সৌরভ মুখোপাধ্যায়
প্রকাশনী – মিত্র ও ঘোষ
প্রকাশকাল – জানুয়ারী ২০২৩
প্রচ্ছদ – সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ – রৌদ্র মিত্র
মুদ্রিত মূল্য – ৩৫০ /-
পৃষ্ঠা - ২৪৩



মহাভারত। পৃথিবীর বৃহত্তম মহাকাব্য। এমন এক গ্রন্থ যার কাহিনী যুগ যুগ ধরে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে লিখিত হয়ে আসছে। এই গ্রন্থের রচয়িতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর সহযোগী শ্রুতিলেখক বিঘ্নহরণ গনেশকে মহাভারত প্রসঙ্গে বলেছিলেন –

"আচখ্যু কবয়োঃ কেচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পরে। আখ্যাস্যান্তি তথৈবান্যে ইতিহাস মিমং ভসি" - অর্থাৎ এ মহা ইতিবৃত্ত বহুভাবে বহুবার বর্ণিত হবে এই পৃথিবীতে। যুগে যুগে কবিরা এ ইতিহাস নিজ নিজ ভাষ্য অনুযায়ী বলবেন।

পরবর্তীকালে যুগে যুগে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও মতবাদে এই আখ্যানের বিনির্মাণ করে আসছেন। সাম্প্রতিককালে সৌরভ মুখোপাধ্যায় লিখিত “দৈবাদিষ্ট” উপন্যাসটিও এই আখ্যানের এক বিশেষ অংশকে নতুন আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে।

উপন্যাসের শুরু হয়েছে কুরু ও পাণ্ডব কিশোর রাজপুত্রদের অস্ত্রবিদ্যার শিক্ষক রূপে গুরু দ্রোণের নিয়োগকাল থেকে। নিয়োগ পরবর্তী সময়ে গুরু দ্রোণ কিভাবে রাজপুত্রদের অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলেন, কিভাবে শ্রেষ্ঠ শিষ্য নির্বাচন করেন, কিভাবে সেই শিষ্যকে পৃথিবীর অদ্বিতীয় প্রমাণ করার তাগিদে নির্দ্বিধায় অপর এক নিরীহ প্রতিভাবান ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবীকারী কিশোরকে পঙ্গু করে নিজ প্রিয় ছাত্রের পথকে নিষ্কণ্টক করে তোলেন এবং সেই ঘটনা পরবর্তী ভবিষ্যতকে কিভাবে প্রভাবিত করে তারই বিস্তারিত বিবরণ এই উপন্যাসের উপপাদ্য।


♦️ কিশোর একলব্যের ধনুর্বিদ্যার পারদর্শীতা দেখে মুগ্ধ ও একই সাথে ভীত গুরু দ্রোণ তাঁর দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ গুরুদক্ষিণারূপে দাবী করেন। গুরুর বিনা অনুমতিতে প্রাপ্ত অর্জিত বিদ্যা যাতে চৌর্যবৃত্তির দায়ে দুষ্ট না হয়, তাই ব্যাধপুত্র একলব্য নির্দ্বিধায় নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কর্তন করে গুরুকে অর্পণ করেন। এবং চিরজীবনের জন্য ধনুর্বিদ্যায় অক্ষম হয়ে যান। পরবর্তীকালে কৃষ্ণের রুক্মিণী হরণের সময় তাঁকে বাধা দিতে গিয়ে কৃষ্ণের হাতে মৃত্যু বরণ করেন। কিন্তু সত্যিই কি তিনি মৃত্যু বরণ করেছিলেন?

♦️ প্রচারিত ছিল রাণী কুন্তী গুপ্ত মন্ত্রবলে দেবতাদের আমন্ত্রণ করে পুত্র লাভ করেছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি পাঁচ পাণ্ডব দেব সন্তান?

♦️ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কি ধর্মরাজেরই সন্তান? বিদুর কেন তাঁকে পুত্র স্নেহে সর্বদা কণ্টকমুক্ত রাখতে ব্যগ্র থাকেন?

♦️ পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ পুত্রেষ্টি যজ্ঞের মাধ্যমে প্রাপ্ত সন্তান কৃষ্ণা তথা দ্রৌপদী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন কি প্রকৃত পক্ষেই যজ্ঞকুণ্ড থেকে জন্ম নিয়েছিলেন? কি ছিল তাঁদের প্রকৃত পরিচয়?

♦️ এই সমস্ত ঘটনা প্রবাহকে কেউ কি অন্তরাল থেকে চালনা করছিলেন? তিনি কে ছিলেন? কেনই বা তিনি এই সুদীর্ঘ পরিকল্পনা করেছিলেন এবং কি ভাবে তা বাস্তবায়িত হয়ে এই মহাকাব্যকে রূপদান করতে সমর্থ হয়েছিল ?

♦️ মহাভারতের সমস্ত ঘটনা বলীতে বিষ্ণুবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রকৃত ভুমিকাই বা কি ছিল??


এই সমস্ত জটিল প্রশ্নের ততধিক জটিল ব্যাখ্যা লেখক এই উপন্যাসে দিয়েছেন নিজের মতানুযায়ী। বিনির্মাণ করেছেন মহাভারতের একটি অংশের, যা আজকের যুগের দৃষ্টিকোণে বাস্তবোচিত। এই কাহিনী বিন্যাসের কার্যকর্ম যুক্তিবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত।

এর আগে সৌরভ মুখোপাধ্যায় লিখিত “প্রথম প্রবাহ “ উপন্যাসটিও এই একই ঘরানায় লিখিত এবং বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয়। অনুরূপে এই উপন্যাসও এর কাহিনীর নতুন আঙ্গিকে নিরমানের জন্যই পাঠকমহলে অত্যন্ত বিতর্কিত। বইয়ের বিষয়বস্তু মহাভারতের মূল কাহিনীকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে লেখা। নতুন আঙ্গিকে লিখিত এই রচনা পড়তে খারাপ না লাগলেও এর ভাষার গুরুচণ্ডালী দোষ ও কিছু কথোপকথনের ধারা বেশ বিরক্তি উৎপাদন করে। তাই এই বই “প্রথম প্রবাহ” উপন্যাসের মত মুগ্ধতা তৈরি করতে পারেনা। এই উপন্যাস মূলত একলব্যের প্রতিশোধস্পৃহার উৎপত্তি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্তৃক দ্রোণবধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘনীভূত হয়েছে। কিছু কিছু অংশে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা উপন্যাসের গতিরোধ করে দেয়। বইয়ের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা চলনসই। পৃথকভাবে উল্লেখের দাবী রাখেনা। এই উপন্যাসটি আনন্দবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার সময় শিল্পী রৌদ্র মিত্র অলংকরণ করেন। যা অত্যন্ত মনোগ্রাহী ও আকর্ষণীয়। মহাকাব্যের আখ্যানকে রক্ষণশীলতার আবরণ থেকে মুক্ত করে বাস্তবোচিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা লেখক করেছেন। রক্ষণশীল বাঙালি তথা ভারতীয়দের এই কাহিনী আত্মস্থ করতে অসুবিধা হওয়াটা স্বাভাবিক হলেও কাহিনীকে শুধু মাত্র কাহিনীরূপে পড়তে মুক্তমনা পাঠকদের খুব খারাপ লাগবে না।




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন