বাংলা লোকসংগীত-এর একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ধারা হল 'বাউল সংগীত'। 'বাতুল' শব্দটি থেকে 'বাউল' কথাটি এসেছে। ধীরে ধীরে একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। বাউল সম্প্রদায়। যাদের মূল লক্ষ্য 'মনের মানুষ' বা ঈশ্বরের সন্ধান করা। এরা একেশ্বরবাদী। এদের মতে ঈশ্বর বা 'মনের মানুষ' নিরাকার। ফলে তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়া বা তাকে দর্শন করা সহজ নয়। নিজের শরীরের মধ্যেই ঈশ্বরের অবস্থান হিসাবে তারা দেখেন। রূপক অর্থের আড়ালে বাউল সাধকেরা বাউল গান পরিবেশন করে থাকেন। এই গানে বাংলার আধ্যাত্মিকতা, আচার-অনুষ্ঠান, শরীর-সাধনা তথা দেহবাদ সমস্তকিছুই প্রত্যক্ষ করা যায়। হিন্দু-মুসলিম দুই জাতের মানুষ এই বাউল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। মূলত যারা মুসলিম তাদেরকে 'ফকির' ও যারা হিন্দু তাদেরকে 'বাউল' বলা হয়। এরা গেরুয়া পোশাক পরিধান করে, এক হাতে একতারা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নেচে নেচে বাউল গান পরিবেশন করে থাকেন। এই বাউল সম্প্রদায় মূলত গুরুমুখী হন। গুরুর কাছ থেকে সমস্ত জ্ঞান অর্জন করে বাউল হয়ে ওঠেন। নির্দিষ্ট আখড়ায় তারা থাকেন। এই বাউল সাধকদের সাধন সঙ্গিনী থাকে। জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে প্রত্যক্ষ প্রমাণ বিশ্বাসী। বাউল প্রকৃত অর্থেই মানবতাবাদি হন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে ঘুরেও বাউল সাধক- সাধিকারা গান পরিবেশন করে থাকেন। অতি প্রাচীন এই গানের ধারা। মধ্যযুগের কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজের 'চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে বাউল শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্যদেব নিজেকে বাউল ভাবতে ভালোবাসতেন। বাউলরা মূলত উদাসীন ধরনের হয়ে থাকে। ত্যাগী, সংসার সুখ বঞ্চিত। তবে এখন সংসারের মধ্যে থেকেও বাউল সাধনা করে থাকেন বাউল সাধক- সাধিকারা।
বাংলার বিশিষ্ট
বাউল সাধকদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নাম হল---- ১) লালন ফকির, ২) পঞ্চ শাহ, ৩) হাউড়ে গোঁসাই,৪)গোঁসাই গোপাল, ৫) চন্ডীদাস গোঁসাই, ৬) এরফান শাহ,৭) পূর্ণদাস বাউল, ৮)কার্তিকদাস বাউল প্রভৃতি।
বাংলার বুকে এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বাউল সাধক হলেন লালন ফকির। ১৭৭৬ সালে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় লালনের জন্ম হয়। তিনি জন্মসূত্রে মুসলিম হয়েও জাতপাত- এ বিশ্বাস করতেন না। রূপক ও তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি যে গানগুলি লিখেছেন তার মূল বিষয় পড়শী, মনের মানুষ বা ঈশ্বরের সন্ধান। একই দেহের মধ্যে তার ও ঈশ্বরের অবস্থান। তবুও ঈশ্বরকে তিনি একদিনের জন্যেও দেখতে পাননি। তিনি উপলব্ধি করেছেন ঈশ্বরের এত কাছে অবস্থান করেও তাদের মধ্যে লক্ষ যোজন দূরত্ব। তিনি তাঁর একটি গানে বলেছেন,
"আমি একদিনও না দেখিলাম তারে/ আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর/ সেথা এক পড়শি বসত করে।"
লালন ফকিরের আরো বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বাউল গান হল --
১) খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায় / ধরতে পারলে মনো বেড়ি দিতাম পাখির পায়।
২) সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
৩) মিলন হবে কত দিনে? আমার মনের মানুষেরও সনে।
৪) বেঁধেছে এমন ঘর শূন্যের উপর পোস্তা করে / ধন্য ধন্য বলি তারে।
৫) এমন মানব জনম আর কি হবে / মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।।
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরদের বাংলাদেশের জমিদারির এলাকাভুক্ত ছিল কুষ্টিয়া। সেই সূত্রে লালন ফকির
তাঁদের প্রজা ছিলেন। তাঁর জন্মের সাতষট্টি বছর আগে লালন ফকির জন্মেছিলেন। দুজনের
দেখা হয়েছিল কিনা সেটা জরুরি নয়। ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় এই লালন ফকির প্রবেশ
করেছিলেন অনেক আগে থেকেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গুনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুজনেই লালন ফকিরের প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের বাউলাঙ্গের গানের মধ্যে লালনের বাউল-এর প্রভাব লক্ষিত। তিনি বাংলার বাইরে
লালন ফকিরের নাম ও গানের গুরুত্ব 'ভারতী' ও 'হিতবাদী' পত্রিকার মধ্যে
দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউল প্রেমে মজেছিলেন। তিনি নিজেকে 'রবীন্দ্র বাউল' বলতেন। 'ফাল্গুনী' ও 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে তিনি বাউলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। 'ফাল্গুনী' নাটকের গানে রবীন্দ্রনাথ বাউল চেতনার পরমতত্ত্বে ভর করেই প্রকাশ করেছেন- সেই অরূপ সন্ধান, মনের মানুষ অচিন পাখিকে-
"তুই ফেলে এসেছিস
কারে মন মন রে আমার
কেমন করে ফিরবি
তাহার দ্বারে মন মন রে আমার।"
বাউলরা এমন একজনকে অনুসন্ধান করেন, যিনি নীরবে মানুষের হৃদয়েই থাকেন। উপনিষদের সেই নিরাকার জীবন দেবতা, অন্তরের অন্তর্যামীও কবির কাছে সমান। তাই বাউলদের জীবনদর্শন তাঁর গানে, কবিতায়, নাটকে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। তাই মনের মানুষ তাঁর 'রিলিজিয়ন অফ ম্যান' গ্রন্থেও প্রকাশিত।
পরিশেষে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের জন্মের বহু পূর্বে লালন ফকিরের আবির্ভাব হলেও দুজনেই বাঙালির খুব প্রিয়, একেবারে মনের মানুষ। দুজনের গানের অসাধারণ ক্ষমতা বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়
পূর্বসূরী লালনের বাউল এর প্রভাব রবীন্দ্রসঙ্গীতে যে পড়েছে, তা রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং স্বীকার করেছেন। জমিদার ও প্রজা হলেও দুজনের মধ্যে
সম্পর্ক যে অত্যন্ত মধুর ছিল সে কথা বলাই যায়।
কলমে - মিঠুন মুখার্জী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন