উদ্ভাসিত রবির আলোয় - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী

 

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা রবীন্দ্রনাথ


"হে নূতন,

দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ

তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন

সূর্যের মতন।"

 

২৫শে বৈশাখ – এই শুভদিনটি এসে উপস্থিত হলে রবিস্নাত বাঙালিহৃদয় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। আজ যে রবীন্দ্রজয়ন্তী! বছর বছর নিজেদের জন্মদিন পালনের থেকেও অনেক বেশি আবেগ অনেক বেশি স্মৃতি জড়িয়ে থাকে ২৫শে বৈশাখে কবিগুরুর জন্মদিন উদযাপনকে ঘিরে। সেই ছোট্টবেলা থেকে এই দিনটিতে স্কুলে এবং পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে করতে ক্রমশ বড়ো হওয়া এবং পরবর্তীতে সেই অনুষ্ঠানগুলিরই দায়িত্ব নেওয়া, মনে হয় যেন রবি ঠাকুরই আমাদের বড়ো করে তুললেন। অনুষ্ঠানে মালা ও চন্দন পরানো সুসজ্জিত ছবির মধ্যে তিনি যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসেন

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবস অতীত থেকে সানন্দে উদযাপিত হয়ে আসছে এবং সেই রীতি আনন্দানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বর্তমানের পথ ধরে আগামীর দিকে প্রবহমান। তবে অনেকেরই হয়তো অজানা, তাঁর জন্মদিন প্রথমবার উদযাপন করা হয়েছিল তাঁর ২৬ বছর বয়সে এবং এই শুভকার্যখানি সম্পাদন করেছিলেন তাঁর ভাগ্নি সরলা দেবী। সময়টা ছিল ১৮৮৭ সাল। ২৬ বছর বয়সে প্রথমবার জন্মদিন পালন করা হলেও নিজের জন্মদিন সম্বন্ধে কবির আত্মসচেতনতা দেখা গিয়েছিল তার আগের বছর, অর্থাৎ ১২৯৩ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ (৭ই মে ১৮৮৬)। শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের উদ্দেশ্যে এক পত্রে তিনি লিখেছিলেন –


 

" আজ আমার জন্মদিন - পঁচিশে বৈশাখ। পঁচিশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এখন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন।" 

 


কবির প্রথম জন্মদিন উৎসব পালনের উল্লেখ তাঁর ভাগ্নি সরলা দেবীর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইটিতে পাওয়া যায়। সরলা দেবী লিখেছিলেন – 


" রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে নিঃশব্দে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন। পাশেই নতুন মামার ঘর। রবির জন্মদিন বলে সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।"

 


পরবর্তী বাইশ বছর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলেই উদযাপিত হয়েছে কবির জন্মদিন। পরিবারের সদস্য এবং অত্যন্ত নিকটস্থানীয় কিছু মানুষ ব্যতীত বাইরের কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। এরপর ১৯০২ সালে কবি যখন শান্তিনিকেতনে, তখন জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কলকাতা থেকে অনেকে শান্তিনিকেতন যান। পরবর্তীতে জনসমক্ষে রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রথম পালিত হয় ১৯১০ সালে এবং শান্তিনিকেতনেই। কবি তখন পা দিয়েছেন ঊনপঞ্চাশ থেকে পঞ্চাশে। ‘আত্মীয়দের উৎসব’ এই আনুষ্ঠানিক নামে বিপুল উৎসাহে আশ্রমিকরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯১১ সাল থেকে মহা সমারোহে রবি ঠাকুরের জন্মোৎসব পালিত হয়ে আসছে। নৃত্য, গীত, অভিনয় এবং আবৃত্তিতে উৎসবমুখর হয়ে উঠতো দিনটি। আশ্রমবাসী সকলে মিলে দিনটি পালন করতেন। রবীন্দ্রজয়ন্তীকে সফল করার জন্য বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ প্রশান্ত মহলানবিশের নেতৃত্বে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন কলকাতার বেশ কিছু গুণীজন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায় ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। বেদ-উপনিষদ পাঠ করে এবং মালা পরিয়ে কবিকে বরণ করা হয়েছিল

 

শুধু শান্তিনিকেতনেই নয়, কাজের সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেখানেই রবীন্দ্রনাথ যেতেন, তাঁর জন্মদিনের উৎসব সেখানে পালিত হতো। বাদ পড়েনি বিদেশও। শুভেচ্ছা বার্তা পেয়েছেন বিলেতে, জাপানে, জার্মানিতে এবং প্যারিসেও। জন্মদিন উপলক্ষ্যে না হলেও এই দিনে তিনি বিভিন্ন জায়গায় সম্বর্ধনা পেয়েছেন। বলতে গেলে দিনটি তাঁর কাছে অত্যন্ত শুভক্ষণ। আবার চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্য দিয়েও কেটে গেছে দিনটি। ১৯১৩ সালের ২৫শে বৈশাখ শিকাগো ও হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখাকে কেন্দ্র করে কবিগুরু যারপরনাই ব্যস্ত ছিলেন। ১৯১৬ সালে এইসময় তোসামারু জাহাজে জাপানের পথে তিনি রেঙ্গুনে এসে পৌঁছেছিলেন। সাথে ছিলেন পিয়ার্সন, মুকুল দে এবং এন্ডরুজ। বিকেলে রেঙ্গুনের জুবিলি হলে কবিকে সংবর্ধনা জানানো হয়। বাঙালিদের পক্ষ থেকে সেদিন কবির হাতে যে মানপত্রটি তুলে দেওয়া হয়েছিল সেটি রচনা করেছিলেন স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়




তবে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন , রবীন্দ্রনাথ সর্বদা স্মরণে রেখেছিলেন তাঁর পরমপ্রিয় আশ্রমবাসীদের। ১৯২১ সালে কবির জন্মদিন উদযাপিত হয়েছিল জার্মানিতে। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে জার্মানির মনীষীগণ কবিকে সংবর্ধনা জানিয়ে অভিনন্দনপত্র এবং জার্মানির আধুনিক লেখকদের গ্রন্থাবলী উপহার দেন। অনুষ্ঠানের পর বিশ্রামের সময় এক চিঠিতে তিনি লেখেন, আজ তাঁর জন্মদিন, কিন্তু তিনি তা অনুভব করছেন না। কারণ দিনটি তো তাদেরই যারা তাঁকে ভালোবাসে। তাদের থেকে দূরে থাকায় ২৫শে বৈশাখ তাঁর কাছে পঞ্জিকার একটি তারিখ মাত্র। ১৯২৪ সালে জন্মদিনে কবি পিকিং শহরে ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন, ডঃ কালিদাস নাগ এবং নন্দলাল বসু। কবির জন্মদিন উপলক্ষে ক্রিসেন্ট মুন সোসাইটির উদ্যোগে ডঃ হু সি-র পৌরহিত্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কবিকে ‘চু-তেন-তান’ উপাধি দেওয়া হয় যার অর্থ ভারতের মেঘমন্দ্রিত প্রভাত। উৎসব শেষে চীনা ভক্তরা কবিকে সুন্দর সুন্দর চিত্র, বহুবিধ সামগ্রী এবং একটি চীনা মাটির পেয়ালা উপহার দেন। পরের বছর কবিগুরুর ৬৫ তম জন্মোৎসব পালন উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রণপত্র ছাপা হয়েছিল। এই বছর মহাত্মা গান্ধী তাঁকে জন্মোৎসবে অভিনন্দন জানান। ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ পত্রিকায় কবির জন্মদিনের অনুষ্ঠানের খবর প্রকাশিত হয়েছিল

 

১৯৩১ সালে মহা সমারোহে উদযাপিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ৭০ তম জন্মজয়ন্তী। সেই রবীন্দ্রজয়ন্তীর মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন অমল হোম। উদযাপন কমিটির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, প্রশান্ত মহলানবিশ, সি.ভি.রমণ, রাজশেখর বসু, নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা দেবী, কালিদাস নাগ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রথিতযশা ব্যক্তিরা। কবির সম্বর্ধনা উপলক্ষে দু'টি বই প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা আর ইংরেজিতে। ইংরেজি বইটির নামকরণ করেছিলেন রঁমা রঁলা। নাম দিয়েছিলেন 'গোল্ডেন বুক অফ টেগোর’। বইটিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিবন্ধ লিখেছিলেন কবির গুণমুগ্ধ আইনস্টাইন, ন্যুট হামসুন, হ্যারল্ড ল্যাসকি’র মত বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিরা

 

১৯৩৮ সালে তাঁর জন্মদিন ছিল অন্যবারের তুলনায় কিছুটা আলাদা। কবি তখন কালিম্পঙে। সেদিন জনবিরল কালিম্পঙের গৌরীপুর লজে সকাল থেকেই তুমুল ব্যস্ততা। কবিকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাতে মংপু থেকে এসেছেন মৈত্রেয়ী দেবী, মনমোহন সেন। কলকাতা থেকে এসেছেন প্রবোধকুমার সান্যাল, সঙ্গে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা আর অমল হোমের পাঠানো উপহার, একটি সুদৃশ্য কলম। সকাল থেকেই মাঝে মাঝে ফুল হাতে আসছেন স্থানীয় পাহাড়ি মানুষ। আজ তো কেবল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন নয়, কালিম্পঙের ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই দিন। আজ প্রথম টেলিফোন সংযোগ স্থাপিত হবে এই পাহাড়ি শহরে এবং তাতে প্রথম কথা বলবেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। ৭৮ তম জন্মদিনে আকাশবাণী কলকাতা এবং টেলিফোন দফতর এমন করেই জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে কবিকে। স্থির হয়েছে, জন্মদিন উপলক্ষ্যে সদ্যরচিত একটি কবিতা আবৃত্তি করবেন রবীন্দ্রনাথ। টেলিফোনে উচ্চারিত সেই কবিকণ্ঠ প্রথমে ধারণ করবে কলকাতা রেডিও স্টেশন, তারপর সেখান থেকে বেতারমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। সেই সংক্রান্ত ব্যবস্থা করতে ততক্ষণে এসে গেছেন অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা কেন্দ্রের স্টেশন ডিরেক্টর নিরঞ্জন মজুমদার। যন্ত্রবিদ অশোক সেন আগেই বন্দোবস্ত করে গেছেন সব যান্ত্রিক ব্যবস্থা। পূর্ব নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। কাঁচের দরজা দেওয়া ধ্বনি-নিরোধক ঘরে নির্দিষ্ট যন্ত্রের সামনে এসে বসলেন রবীন্দ্রনাথ। পরনে গাঢ় নীল রঙের দীর্ঘ জোব্বা। ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান, ভেসে উঠল লাল আলোর সঙ্কেত। সঙ্গে সঙ্গেই বেতার তরঙ্গে ধ্বনিত হল কবিকণ্ঠ –


 

“ আজ মম জন্মদিন/ সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে/ ডুব দিয়ে উঠেছে সে/ বিলুপ্তির অন্ধকার হতে/ মরণের ছাড়পত্র নিয়ে।”

 


১৯৪১ সালে অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে শান্তিনিকেতনে পালিত হয়েছিল বিশ্বকবির জীবনের শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী। তখন কবি রোগশয্যায়। সন্ধ্যায় কবিকে উদয়নের চত্বরে আরামকেদারায় বসিয়ে অনুষ্ঠান পালন করা হয়েছিল। উৎসব উপলক্ষ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল। যতদূর জানা যায়, ১৯৩৭ সাল থেকে এটি চালু হয়। আশ্রমের সংঘের উদ্যোগে কলকাতায় একবার তাঁর জন্মোৎসব হয়েছিল। সেখানে কবি আইসক্রীম খেয়ে বলেছিলেন



শুধু গান, আবৃত্তি আর বক্তৃতায় জন্মোৎসব সার্থক হয় না। সঙ্গে একটু মিষ্টিমুখের ব্যবস্থাও থাকা দরকার।" 



সেই থেকে আজও কবির জন্মোৎসবে মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা করা হয়ে আসছে। 

 

রবীন্দ্রজয়ন্তী শুধু কোনো একটি অনুষ্ঠান নয় যা কেবলমাত্র রীতি মেনে বছর বছর পালিত হয়ে আসছে। রবীন্দ্রজয়ন্তী বাঙালির কাছে আবেগ, ঠিক যেমন রবি ঠাকুর আমাদের মনে প্রাণে সদাসর্বদা বিরাজমান হয়ে রয়েছেন। তাঁর জন্মতিথি সমগ্র বাঙালি ভাষাভাষী মানুষের কাছে উৎসবের সমকক্ষ, যে উৎসব মনে করিয়ে দেয় এক চিরউজ্জ্বল নক্ষত্রের কথা, তাঁর সৃষ্টির কথা, বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কথা, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তাঁর অনস্বীকার্য অস্তিত্বের কথা। বিশ্ববরেণ্য মহান এই ব্যক্তিত্বের জন্মদিবস উপলক্ষ্যে তাঁর প্রতি রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম

 

কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী    

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন