তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে—
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।”
- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রপ্রেমী প্রতি বাঙালির কাছে ২৫শে বৈশাখও বছরের অন্যান্য উৎসবের মতই সমাদরে উদযাপনের দিন। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের এই দিনেই মহান কবি ও স্বপ্নদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। ২৫ শে বৈশাখ সর্বত্র এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরেও রবীন্দ্র জয়ন্তী হিসাবে পালিত হয়। কবিগুরু একজন কবি, শিল্পী এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও ছিলেন একজন মহান ভোজনরসিকও। সমগ্র বাঙালি জাতির উপর ঠাকুর পরিবারের ব্যাপক প্রভাব ছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাওয়ারচিখানার পর, রবীন্দ্রনাথ বিদেশ সফরে ইউরোপীয় খাবারের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, সেই সময়েও ঠাকুর পরিবারের মহিলারা উচ্চ শিক্ষিত এবং দুঃসাহসিক ছিলেন- অন্তত রন্ধনসম্পর্কীয় ক্ষেত্রে। এবং তাঁদের নিত্যনৈমত্তিক রান্নার পরীক্ষা নিরীক্ষা বহু সুস্বাদু পদের জন্ম দিয়েছিল।
১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশভ্রমণে বেরোন। তারপর বাকি জীবন ধরে বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। গ্রহণ করেছেন অসংখ্য গুণমুগ্ধের আতিথেয়তা। বিভিন্ন ভোজের নিমন্ত্রণ এবং প্রসিদ্ধ রেস্তোরাঁর মেন্যু কার্ড সংগ্রহ করা তাঁর শখে পরিণত হয়েছিল। আর নানা দেশের ভালো লাগা খাবারগুলো বাড়ি ফিরে জানাতেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা সেই সব রান্না করতেন এবং অনেক সময়ই সেই রান্নার মধ্যে নিজেদের সৃজনশীলতার মাধুরী মিশিয়ে নতুন পদ তৈরি করে পরিবেশন করতেন। ইউরোপ ভ্রমনের পর অখাঙ্কার এক বিশেষ ধরণের ফ্রুট স্যালাড ঠাকুরবাড়িতে বানানো শুরু হয়, যা কবি প্রতিদিন মধ্যাহ্নভোজনের সময় খেতেন।
খাদ্যরসিক কবিগুরুর যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন মৃণালিনী দেবী। মৃণালিনী দেবীর রান্না ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তার হাতের রান্না খেতে সবাই খুব পছন্দ করতেন। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন নতুন পদ তৈরি করতেন। কথিত আছে রান্নাঘরের পাশে বসে কবি রন্ধন বিষয়ে মতামত দিতেন এবং মৃণালিনী দেবী সেই অনুসারে রান্না করতেন। এমনকি মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে কবির খাওয়ার ইচ্ছা জাগলে মৃণালিনী সেই সময়েই রান্না করে খাবার বানিয়ে দিতেন। ঠাকুরবাড়িতে প্রায়শই খামখেয়ালি সভা বসতো। সেই সভায় কবি থাকতেন মধ্যমণি। সেই খামখেয়ালিপনা থেকেই হয়তো তিনি রাত দুটোর সময় মৃণালিনী দেবীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কিছু রান্না করে খাওয়াতে বলতেন।
কবিগুরুর 'খামখেয়ালী সভা'র সভ্যরা প্রতি মাসে নিজেদের বাড়িতে সভার আয়োজন করতেন পালাক্রমে। সেখানে গান-কবিতা-অভিনয় ছাড়াও বিপুল ভোজনের ব্যবস্থা থাকত। এই বিষয়ে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড় সুন্দর স্মৃতিচারণা করেছেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
'বাবার যেবার নিমন্ত্রণ করার পালা পড়ল, বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। মাকে ফরমাশ দিলেন খাওয়ানোর সম্পূর্ণ নতুন রকম ব্যবস্থা করতে হবে। মামুলি কিছুই থাকবে না, প্রত্যেকটি পদের বৈশিষ্ট্য থাকা চাই।’
তিনি আরও লিখেছেন,
‘বাবা মনে করতেন খাওয়াটা উপলক্ষ মাত্র, রান্না ভালো হলেই হল না— খাবার পাত্র, পরিবেশনের প্রণালী, ঘর সাজানো, সবই সুন্দর হওয়া চাই। যেখানে খাওয়ানো হবে তার পরিবেশে শিল্পীর হাতের পরিচয় থাকা চাই। মা রান্নার কথা ভাবতে লাগলেন, অন্যরা সাজানোর দিকে মন দিলেন।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীও খুব ভালো রান্না করতেন। তিনিই প্রথম এঁচোড় দিয়ে
খাসির মাংস রান্না করে গুরুদেবকে খাইয়েছিলেন।
কবিগুরুর অপর ভাইঝি ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী নিজে
রন্ধন পটিয়সী ছিলেন এমন নয়, কিন্তু দেশে বিদেশে যেখানেই ভালো কোনও খাবার খেতেন তার
রেসিপি লিখে রাখতেন। এই ভাবে রেসিপি জমতে জমতে ভরে উঠেছিল খাতা। সেই অমূল্য খাতা তিনি দিয়ে গেছিলেন পূর্ণিমা ঠাকুরকে। পরবর্তীকালে
পূর্ণিমা ঠাকুর সমস্ত রান্না একত্রিত করে “ঠাকুরবাড়ির রান্না” বইটি লেখেন। বিভিন্ন সময়ে
শান্তিনিকেতনের আশ্রমে থাকা শিক্ষকদের স্ত্রীরা অনেকটা প্রতিযোগিতা করে তার জন্য
রান্না করতেন। প্রতিদিন সকালে উঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক গ্লাস
নিমপাতার রস খেতেন। আশ্রমের শিক্ষক অনিল চন্দের স্ত্রী রানী চন্দ প্রায়ই রান্না
করে আনতেন। পায়েস বা বাদামজাতীয় মিষ্টি রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন। জাপানি চা ও
বিভিন্ন ধরণের ফল ছাড়াও কবিগুরু পছন্দের খাবারের মধ্যে দুধ শুক্তনি, কাটলেট, সজনে
ডাঁটা দিয়ে মুগের ডাল, বিভিন্ন ধরণের কাবাব, নারকোল চিংড়ি, বিভিন্ন ধরণের স্যুপ
প্রভৃতি। তবে খাদ্যবিলাসী কবিগুরুর মিষ্টি খাবারের প্রতি বিশেষ দুর্বলতার কথা
বারবার বিভিন্ন লেখায় উঠে আসে। মিষ্টির অভাবে কবি মধু খেয়ে নিজের স্বাদ পূরণ
করতেন।
কবির জন্য প্রায়ই নানা ধরনের মিষ্টি তৈরি করতেন মৃণালিনী – চিঁড়ের পুলি, দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিঠাই ইত্যাদি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“বাবার
ফরমাশ মতো নতুন ধরনের মিষ্টি মাকে প্রায়ই করতে হত। সাধারণ গজার একটা নতুন সংস্করণ
একবার তৈরি হল। তার নাম দেওয়া হল ‘পরিবন্ধ'।“
আগামী ২৫ শে বৈশাখ কবিগুরু জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর প্রিয় দুটি
মিষ্টি তৈরির প্রণালী দেওয়া হল।
কবি সম্বর্ধনা বরফিঃ
কবিগুরু নিজের জন্মদিন পালনে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। গুরুদেবের
পঞ্চাশতম জন্মদিনে ফুলকপি এবং ক্ষীর
একসাথে মিশিয়ে এক বিশেষ ধরনের সুস্বাদু মিষ্টি তৈরি করে তাঁকে
খাইয়েছিলেন, তাঁর ভাইঝি প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। নাম দিয়েছিলেন “ কবি সম্বর্ধনা বরফি”।
ছবি সৌজন্যঃ কুকপ্যাড
উপকরণঃ
- ফুলকপি - ৩ টে ছোট মাপের
- দুধ - ১/৪ কাপ
- খোয়া ক্ষীর- ১/২ কাপ
- জাফরান- একদম সামান্য
- ময়দা – ১ চামচ
- ঘি - ১ টেবিল চামচ
- চিনি - স্বাদ অনুসারে
- নুন - স্বাদ
অনুসারে
- কাজু বাদাম, আমন্ড ও পেস্তা – ইচ্ছামত
প্রণালীঃ
- দুধে এক চিমটে জাফরান দিয়ে অন্তত ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- প্রথমে
ডাঁটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ফুল কেটে নিয়ে জলে
সামান্য নুন দিয়ে ৫-৭ মিনিট ফুলকপিটা সেদ্ধ করে নিতে হবে। সেদ্ধ
হয়ে গেলে জল ঝরিয়ে নিতে হবে।
- সেদ্ধকরা ফুলকপি একটু চটকে নিয়ে তার মধ্যে অল্প নুন ও দুধ মেশানো জাফরান মিশিয়ে দিতে হবে।
- কড়াইতে ঘি গরম করে তাতে ফুলকপি দিয়ে ৩-৪ মিনিট হালকা আঁচে ভেজে নিতে হবে।
- আঁচ একেবারে কমিয়ে ৫ মিনিট রান্না করার পর খোয়া ক্ষীর যোগ করে ভালো করে মেশাতে হবে।
- অনবরত নাড়তে
হবে, যাতে কড়াইয়ের নীচ থেকে পোড়া না লেগে
যায়।
- চিনি ও ময়দা মিশিয়ে ভালো করে ভাজতে হবে যতক্ষন না কড়াই থেকে উঠে আসে।
- পরিমাণ মতো
আমন্ড-পেস্তা-কাজু কুঁচি যোগ করে নামিয়ে নিতে হবে।
- থালায় ঘী মাখিয়ে তৈরি করা মণ্ড সমান ভাবে বিছিয়ে বরফির আকারে কেটে নিতে হবে। তৈরি কবিগুরুর প্রিয় 'কবি সম্বর্ধনা বরফি'।
মানকচুর জিলাপিঃ
কবি পত্নী মৃণালিনী দেবী অত্যন্ত রন্ধন পটীয়সী ছিলেন।
রান্না করতেও ভালবাসতেন এবং খাওয়াতেও পছন্দ করতেন। একবার কবিগুরু মজার ছলে কচুর
জিলাপি খাওয়ার আবদার করেন। মৃণালিনী দেবী সাথে সাথে মানকচু দিয়ে জিলাপি বানিয়ে
কবিকে পরিবেশন করে চমকিত করে দেন।
উপকরণঃ
- মানকচু – ২৫০ গ্রাম
- পানিফলের আটা – ১৫০ গ্রাম ( এমনি ময়দাও ব্যবহার করা যায়)
- ঘী – ৫০০ মিলি
- চিনি – ৭৫০ গ্রাম
- এলাচ গুঁড়ো – প্রয়োজন মত
- জাফরান – এক চিমটে
- পাতিলেবুর রস – এক চামচ
প্রণালীঃ
- চিনির সাথে অল্প জল মিশিয়ে এক শিরা রস তৈরি করে রাখতে হবে। এর মধ্যে লেবুর রস মিশিয়ে দিতে হবে। এর মধ্যে জাফরান মিশিয়ে দিতে হবে।
- মানকচু খোসা ছাড়িয়ে ভালো করে ধুয়ে সেদ্ধ করে চটকে নিতে হবে।
- এর সাথে পানিফলের আটা, অল্প জল, জাফরান ও এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে ঢাকা দেওয়া কৌটোর মধ্যে অন্তত ৬-৮ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। সম্ভব হলে কৌটো রোদে বা গরম জায়গায় রাখতে হবে।
- মিশ্রণ ফুলে উঠলে ফুটো বাসনে বা প্লাস্টিকের কোনে মিশ্রণ নিতে হবে।
- কড়াইতে ঘী মাঝারি গরম হলে জিলাপির আকৃতিতে ভাজতে হবে। ভাজা জিলাপি গরম চিনির রসে দিয়ে ৫ মিনিট রেখে তুলে নিতে হবে।
- গরম গরম পরিবেশন করতে হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন