লেখক – কৌশিক মজুমদার
প্রচ্ছদ – কামিল দাস
অলংকরণ – গৌতম কর্মকার
প্রকাশক – বুকফার্ম
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারী ২০২৩
পৃষ্ঠা – ২৪৮
মুদ্রিত মূল্য – ৩৭৫/-
অগ্নি অর্থ আগুন । নিরয় অর্থ নরক। অগ্নিনিরয় অর্থাৎ নরকের আগুন।
২০২০ সালের অতিমারির বন্দীদশায় সূর্যতামসী বইয়ের আগমন এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠককুলে রীতিমত হৈ হৈ রই রই করে গরম কচুরির মতই হৃদয় দখল করে নেওয়া। সেই শুরু মেসন সিরিজের রমনপাষ্টির খেলার (আজ্ঞে শব্দের উচ্চারণটি ম্যাসন নয়, মেহস্-সন)। যে খেলা নিবারসপ্তক হয়ে অগ্নিনিরয়-এ এসে সমাপ্তি ঘোষণা করে। কিন্তু সত্যিই কি খেলা সমাপ্ত হয়?
শুরুতেই বলা ভালো এই বিখ্যাত সিরিজের প্রথম দুটি খণ্ড না পড়া থাকলে তৃতীয় বা শেষ (?) খণ্ডটি না পড়াই উচিত। কারণ তাহলে কিছুই বুঝতে পারা যাবে না। প্রতিটি খণ্ডের কাহিনীই একটির সাথে অপরটি দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত। এতদিনে বা বিগত কয়েক বছরে পাঠক জেনে গেছেন যে এই সিরিজের কাহিনী সমান্তরালভাবে দুটি ভিন্ন সময়ে বয়ে চলে। সেই সাথেই জুড়ে যায় দুই সময়েরই কিছু বাস্তব ও কিছু কাল্পনিক চরিত্ররা। সমগ্র সিরিজে আছেন তারিণীচরণ, গণপতি, তুর্বসু রায়, সাইগারসন, মরিয়ার্টি, হ্যালিফ্যাক্স, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, রাণী ভিক্টোরিয়া, উর্ণা, সুপর্ণা, লখন, শৈলচরণ, প্রসন্নকুমার, রবার্ট লুই স্টিভেনশন, ডঃ গোপাল দত্ত, এলি হেনকি, হ্যালিডে এবং আরও অনেকে।
সূর্যতামসীতে শুরু হয় এক অদ্ভুত নৃশংস খুন। খুনের রহস্য সমাধানে নেমে শখের গোয়েন্দা তুর্বসু রায় নিজেই জড়িয়ে পড়েন এক গোলকধাঁধাসম জটিল রহস্যে।
নিবারসপ্তক-এ সেই রহস্য ঘনীভূত হয়। আরও নৃশংস খুন, গুপ্ত সমিতির জটিল ক্রিয়া কলাপ, রহস্যময় চরিত্রের আনাগোনা সাথে বাংলার প্রবাদপ্রতিম কয়েকজন ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের রহস্যময় জীবন। কাকতলীয়ভাবে সাথে জুড়তে থাকেন বর্তমানের তাঁদের উত্তরপুরুষরাও।
শেষ পর্ব অগ্নিনিরয় বইয়ে সেই সমস্ত রহস্যের যবনিকাপাত হয়। প্রায় একশ বছর আগে ঘটে যাওয়া কিছু রহস্যময় মৃত্যুর ঘটনা। এক গুপ্ত সমিতি। ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের রক্তের ধারা অব্যাহত রাখার ব্রতে দীক্ষিত। সেই লক্ষ্য পূরণে সামনে আসা যাবতীয় বাধা তাঁরা অবলীলাক্রমে নির্দয়ভাবে সরিয়ে দিতে বধ্য পরিকর। এদের নিষ্ঠুরতা হার মানে যাবতীয় পাশবিক প্রবৃত্তির কাছেও।
বইয়ের গল্প সম্পর্কে এর থেকে বেশি কিছু বলা উচিত হবে না। যা্ঁরা পূর্বের দুটি খণ্ড পড়েছেন তাঁদের তৃতীয় খণ্ডটি পড়ে রসাস্বাদনে ব্যাঘাত ঘটানোর ইচ্ছা আমার নেই। আমি শুধু সম্পূর্ণ সিরিজ সম্পর্কে আমার নিজস্ব কয়েকটি মতামত জানাতে চাই.
১. পাঠক ও গুণীজন মতে এতদিনে বাংলা সাহিত্যপ্রেমী সকলেই জেনে গেছেন যে এটি সিম্বলজি অর্থাৎ প্রতীকবিদ্যা নিয়ে বাংলায় লেখা প্রথম রহস্য উপন্যাস।
২. বইয়ের প্রথম খণ্ড সূর্যতামসী রীতিমত টানটান রহস্যের বুনটে রচিত, পাঠক রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলতে বাধ্য হন। বাংলা সাহিত্যে নতুন গোয়েন্দার জন্ম হয় - তুর্বসু রায়। যিনি প্রথম বাঙালি গোয়েন্দা তারিণীচরণ রায়ের উত্তর পুরুষ। এনার সাথে যুক্ত হন বাংলার কিংবদন্তী জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী ও পৃথিবীর অন্যতম এক সেরা গোয়েন্দা। সব মিলিয়ে মুগ্ধতা আকাশ ছুঁয়ে যায়। যদিও এই বইয়ে দ্বিতীয় খণ্ডের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু কাহিনী পাঠককূলে অসম্পূর্ণতা জাগায়নি। যেখানেই গল্প শেষ হোক না কেন তার জন্য পাঠক হাঁপিয়ে মরেননি।
৩. এরপর আসে দ্বিতীয় খণ্ড নিবারসপ্তক। প্রথম খণ্ডের রুদ্ধশ্বাস গল্পের কথা মাথায় রেখে পাঠক আবারও ঊর্ধ্বশ্বাসে বই পড়া শুরু করেন। কিন্তু এখানেই একটু ‘অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটে’! সম্ভবত গরম কচুরিকে আরও গরম ও মুচমুচে করার অভিপ্রায়ে এই খণ্ডে গল্প প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। তথ্যের বিপুল ভারে ভারাক্রান্ত পাঠক তাও তার মধ্যেই রহস্যের জটাজাল আবিষ্কার করে “শেষে কি হইল? শেষে কি হইল? গণপতি কই গেল? শৈলকে কে বা কেন এত নিষ্ঠুরভাবে মাইর্যা গেল? আজকেই দেখিব। এখুনি জানিব। অদ্যই শেষ রজনী!” - করে নিঃশ্বাস আটকে ছুটতে লাগলেন। মানে পড়তে লাগলেন আরকি। ছুটতে ছুটতে অবশেষে হঠাৎ যখন মনে হচ্ছে এই তো প্রায় ধরে ফেলেছি, এই তো সব জেনে গেছি, আর তো দশ পাতা, আর তো ২ পাতা, এই তো শেষ – ঠিক তখন গ্যাস বেলুন ফুটো হয়ে ফুউস করে হাওয়া বেরিয়ে যাওয়ার মত মুখ থুবড়ে পড়ছেন। কারণ দুম করে বইয়ের শেষ বাক্যটি পড়া হচ্ছে।
B.H.U.T … – ( আগামী খণ্ডে সমাপ্য) ।
এবার পাঠক পুরো ব্যোমকে গিয়ে দম আটকে গেলেন। এটিকে বিদগ্ধ পাঠক সমাজ ক্লিফ হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দেওয়া বলে থাকেন। সুতরাং পাঠক ঝুলতে থাকলেন!! অগত্যা …
৪. সামাজিক মাধ্যমে লেখকের পিছনে ধাওয়া করা শুরু। কবে শেষ করবেন? কবে আগামী খণ্ড আসবে? কতদুর লেখা হল?
৫. পাঠক প্রত্যুত্তর পেলেন আসবে, লেখা হচ্ছে, আজ এই কটা পৃষ্ঠা লিখেছি, এইটা একটা ছবি, এইটা প্রচ্ছদ, দেখা যাক কতদিনে শেষ হয়, সামনের মাসে আসবে, নাহ হয়ত পিছিয়ে যাবে, হয়েই এসেছে, অগাস্ট মাসে হয়ত আসবে, ডিসেম্বর হতে পারে, বইমেলা নাহ নভেম্বর এবং আরও আরও অনেক রকম … !!!
৬. একসময় এত কিছু বক্তব্যের ঘূর্ণিপাকে পড়ে পাঠকও হতোদ্যম হয়ে পড়ে ভাবেন “ধ্যুত! যবে আসবে তবে আসবে। নিজের কাজ করি।“ হয়ত এই বক্তব্য অনেকের খুব অপছন্দ হবে, কিন্তু আমি আমার পরিচিত অন্তত চারজনের থেকে একই প্রতিক্রিয়া পেয়ে তবেই বলছি, এই প্রায় একছরের অপেক্ষা অনেক পাঠককেই বেশ খানিকটা হতাশ করেছিল। অনেকে বই আর পড়েনও নি।
৭. দ্বিতীয় খণ্ডটিতে মূলত শুধু রহস্য তৈরি করা হয়েছে। সাথে যুক্ত হয়েছেন আরও অনেক চরিত্র ও তাঁদের ঘিরে ঘটনা সমূহ। সমাধান তৃতীয় খণ্ডে হবে এই আশা দিয়ে বিপুল এক চাহিদা তৈরি করার উদ্দেশ্যে প্রকাশনা সংস্থা একশ শতাংশ সফল। বানিজ্যিক বুদ্ধির তারিফ অবশ্যই করা উচিত।
৮. অতঃপর শেষ ও অন্তিম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়। যারা এখনও হাঁপিয়ে গিয়ে হাল ছাড়েননি তাঁরা ‘ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো’-এর মত লেখকের সইসহ প্রীবুকিং করে ঝাঁপিয়ে পড়ে বই সংগ্রহ করেন। কিন্তু একটু হোঁচট খান কারণ ততদিনে আগের গল্প প্রায় পুরোই ভুলে গেছেন।
৯. অতএব পুনরায় প্রথম দুই খণ্ড পড়তে হয়। এবং তৃতীয় খণ্ড শেষ হয়। তৃতীয় খণ্ড আরও একগুচ্ছ রহস্যের ঘেরাটোপে ঘিরে শেষমেশ প্রায় সব রহস্যের জাল কেটে সমাধান দেখায়। প্রায় বললাম কারণ এখানেও “শেষ হইয়াও হইল না শেষ” দশা রয়ে গেল। যদিও এটি অন্তিম খণ্ড তবুও একটু খুঁতখুঁতানি রয়ে গেল … হয়ত আবার ভুত জেগে উঠবে।
১০. অগ্নিনিরয় পড়ার সময় আমার কি হাল হয়েছিল সেটা একটু বলি। আমি জাম্প কাটের ঠ্যালায় ব্যাতিব্যস্ত হয়ে গেছিলাম। সাথে গুগল দাদাকে সঙ্গী করেছিলাম। খুব সাধারণ মানের পাঠক বলেই হয়ত বেশ কিছু বিষয় বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। বইয়ে বর্ণিত “ অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়ে ভয়ঙ্কর” কথাটা যে কি মারাত্মক তা এই বই পড়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু একটি বিষয় অনস্বীকার্য এই বই পড়ার মাধ্যমে একজন প্রকৃত পাঠক প্রচুর নতুন বিষয় ও তার আনুষঙ্গিক আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন।
১১. গল্পের জটিলতা যে কোনও রহস্যপ্রেমীকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। প্রতি অধ্যায়ের শেষে অসাধারণ একটি টুইস্ট রয়ে যাচ্ছিল। যা রীতিমত চমক দিতে বাধ্য। এছাড়া পুরো সিরিজে লেখক বাস্তব ও কল্পনার, সত্যের সাথে অর্ধসত্যের যে মেলবন্ধন ঘটানোর যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তার জন্য কুর্নিশ জানাতে হয়। কিছু সময় বোঝা মুশকিল হচ্ছিল কোনটা প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্য এবং কোনটা সম্পূর্ণ কল্পনা।
১২. বইয়ের প্রচ্ছদ, গল্পের সাথে সাথে যুক্ত ইলাস্ট্রেশন, সমকালীন বিজ্ঞাপনের ছবি সমস্ত কিছুই খুব মনকাড়া। বিশেষ করে ইলাস্ট্রেশন গল্পের গতিতে পৃথকভাবে রোমাঞ্চ জাগিয়ে দেয়। বইয়ে বেশ কিছু মানচিত্র দেওয়া হয়েছে যা খুবই আকর্ষণীয়। কেন দেওয়া হয়েছে কি প্রয়োজন তা জানতে অবশ্যই বই পড়া দরকার।
১৩. বেশ কিছু বানান ভুল এবার নজরে এল। যেমন – ১৭৪ পৃষ্ঠায় দুরকম ‘দেবাশিস’ বানান, ১৫৩ পৃষ্ঠায় ঢাকের বদলে ‘ডাক’ প্রভৃতি।
১৪. সবশেষে একটা ছোট্ট আক্ষেপ রয়ে যায় - তুর্বসু রায়ের আর গোয়েন্দাগিরি করা হল না। ওনার রহস্য সমাধানের গতি প্রকৃতি দেখার পর ওনাকে দিয়ে ওই পরকীয়া প্রেমের খোঁজ খবর নেওয়ার কাজটুকুই দেওয়া যেতে পারে। তারিণীচরণের উত্তরপুরুষ তাঁর পূর্বপুরুষের নাম ডোবালেন। বেচারা প্রেমিক হয়েই রয়ে গেলেন।
অনেক ধন্যবাদ
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন