আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে প্রতিবছর রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়। উড়িষ্যার পুরীধাম জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব পালনের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। রথযাত্রা উৎসবে পূজার্চনা, জাঁকজমক ও অন্যান্য অনুষ্ঠান পালনের সাথে সাথে দেব ত্রয়ীকে ভোগ নিবেদনও করা হয়ে থাকে। পুরীধামের গুণ্ডিচা মন্দিরের ভোগ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বরাবরই এক পৃথক মাহাত্ম্য বহন করে আসছে।
পুরীর
জগন্নাথ মন্দিরের
সবচেয়ে অবিশ্বাস্য
বৈশিষ্ট হল প্রভু
জগন্নাথের "প্রসাদ"।
সারাবছর ধরেই
সমপরিমান ভোগ
রান্না করা
হয়। কিন্তু
ওই একই
পরিমান ভোগ
প্রসাদ কয়েক
হাজার মানুষই
হোক বা
কয়েক লক্ষ
মানুষই হোক গ্রহণ করেন। তবু
প্রসাদ কখনও
নষ্ট হয়
না বা
কখনও কম
পড়ে না।
মন্দিরের
ভোগ রান্না করা হয় এক অভিনব পদ্ধতিতে। রন্ধনশালায়
একটি পাত্রের
উপর আর
একটি এমন
করে মোট
৭টি মাটির
পাত্র আগুনে
বসানো হয়
রান্নার জন্য।
এই পদ্ধতিতে
যে পাত্রটি
সবচেয়ে উপরে
বসানো থাকে
তার রান্না
সবার আগে
হয়। তার
নিচেরটি তারপরে।
এভাবে রান্না হতে হতে
সর্বশেষে
সবচেয়ে নিচের
পাত্রের রান্না
হয়। মা লক্ষীর কৃপায় প্রতিটি মাটির পাত্রের ভোজ্য বস্তু সমানভাবে সুসিদ্ধ হয়।
আসন্ন রথযাত্রা উপলক্ষ্যে আমাদের পত্রিকার পক্ষ থেকে তাই এবারের পঞ্চব্যঞ্জনে জগন্নাথ দেবের কিছু প্রিয় খাবারের প্রণালী নিবেদন করা হল।
আভাদা মিঠা ডালিঃ
স্কন্দপুরাণে আছে - "যদ্যান্ন্যাং পাচতে লক্সমী ( লক্ষী ) ভোক্তা স্বয়ং জনার্দন তৎ অন্ন ব্রাহ্মণস্যঃ দেবতারোপি দুর্লভ্যঃ।"
মনে করা হয়. পুরীর মন্দিরের বিশাল ভোগ ঘরে মহালক্ষী স্বয়ং জগন্নাথ দেবের জন্য অন্নভোগ সহ বিবিধ প্রকারের ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেন। দেব-দ্বিজের পক্ষেও দূর্লভ এই মহাপ্রসাদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার অন্ন, দুধরনের ডাল, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের বড়া, শাক ভাজা ও নানা প্রকারের মিষ্টি। ডালের মধ্যে অন্যতম হলো মিষ্টি অড়হর ডাল, যা “আভাদা মিঠা ডালি” নামে খ্যাত।
উপকরণঃ
- অড়হর ডাল – ২৫০ গ্রাম
- আখের গুড় – ১০০ গ্রাম
- আদা – ১ চামচ
- হিং – ১ চামচ
- জিরে – ১/২ চামচ
- ঘি – ১/২ চামচ
- নারকোল কোড়া – ৫০ গ্রাম
- সৈন্ধব লবণ – স্বাদানুসারে
- এলাচ গুঁড়ো – ১/২ চামচ
- দারচিনি গুঁড়ো - ১/২ চামচ
প্রণালীঃ
- ডাল ভালো করে দু’তিন বার ধুয়ে অন্তত ১ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- একটা পাত্রে ডালের সাথে আদা ও নুন মিশ্রিত করে ভালো করে সেদ্ধ করে নিতে হবে।
- কড়াইতে ঘী গরম হলে তাঁর মধ্যে জিরে ও হিং ফোড়ন দিয়ে একটু অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে হলুদ দিয়ে একটু মিশিয়ে তার মধ্যে সেদ্ধ ডাল মিশিয়ে দিতে হবে।
- ডাল ফুটতে শুরু করলে এর মধ্যে গুড়, এলাচ ও দারচিনি গুঁড়ো এবং নারকোল কোড়া মিশিয়ে দিতে হবে।
- গুড় ভালো করে গুলে গিয়ে পুরো ডাল গাঢ় হয়ে এলে নামিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
বেসরঃ
জগন্নাথদেবের প্রিয় ছাপ্পান্ন ভোগের মধ্যে অন্যতম হল খিচুড়ি। এছাড়াও থাকে নারকেল নাড়ু, খোয়া ক্ষীর, দই, ফল, ঘি ভাত, শুকনো খিচুড়ি, শাক ভাজা, ডাল, পান্তা ভাত, পিঠে পুলি, মনোহরা, লুচি, সুজি, নানারকম পিঠে-সহ আরও অনেক রকম খাবার। পুরীর মন্দিরে দুপুরে যে ‘ছত্রভোগ’ দেওয়া হয় সেই ভোগে থাকে প্রভুর প্রিয় ‘বেসর’ বা ‘বেসরা’।
উপকরণঃ
- বরবটি - ১০০ গ্রাম
- কুমড়ো - ১৫০ গ্রাম
- কাঁচকলা - ২ টো
- রাঙাআলু - ১টা
- পটল - ২০০ গ্রাম
- সাদা ও কালো সরষে - ৩ চামচ
- গোলমরিচ - ২ চামচ
- পাঁচফোড়ন - ১ চামচ
- নারকেল কোড়া - ৩ চামচ
- জিরে গুঁড়ো - ২ চামচ
- ধনে গুঁড়ো - ২ চামচ
- ঘি - ২ চামচ
- গুড় - ২ চামচ
- নুন – স্বাদমতো
- হলুদ গুঁড়ো - ২ চামচ
- বড়ি - ৬টা
- আদা - ১ ইঞ্চি
- ছোলা ভেজানো - ২ চামচ
- কসৌরি মেথি - ১ চামচ
প্রণালীঃ
- সবজি ছোট ছোট করে কেটে টুকরো করে নিতে হবে। কড়াইতে ঘি দিয়ে প্রথমে বড়ি ভেজে তুলে রাখতে হবে।
- ঘী এর মধ্যে পাঁচফোড়ন, কসৌরি মেথি আর সর্ষে বাটা দিয়ে অল্প কষিয়ে নিতে হবে।
- এর মধ্যে গোলমরিচের গুঁড়ো, হলুদ, নুন, মিশিয়ে দু’ মিনিট কষিয়ে সবজি, ছোলা ও বাকি মশলা দিয়ে সব একসাথে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে।
- মশলা ও সব্জি একসাথে ভালো করে মিশে গেলে দু’কাপ জল দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
- প্রায় ১৫ মিনিট একেবারে কম আঁচে ঢাকা দেওয়া অবস্থায় রান্না হতে দিতে হবে।
- সবজি সেদ্ধ হয়ে এলে গুড় আর নারকেল কোড়া মিশিয়ে ১০ মিনিট আবার ঢেকে রাখতে হবে যাতে গুড় গলে গিয়ে তরকারির সাথে মিশতে পারে।
- অন্য একটি কড়াইতে ঘি গরম করে কালো সরষে ফোড়ন দিতে হবে। সর্ষে ভালো করে ফুটে গেলে ঘি ও সর্ষে একসাথে বেসরের উপর ঢেলে দিতে হবে।
- এর মধ্যে ভেজে রাখা বড়ি মিশিয়ে দিতে হবে।
- সদ্য প্রস্তুত বেসরের উপর নারকেল কোড়া দিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
- জগন্নাথ দেবকে নিবেদন করার ক্ষেত্রে এর উপর তুলসী পাতা দেওয়া হয়।
দুগ্ধতুম্বী:
সান্ধ্য ধুপভোগে জগন্নাথ স্বামীকে ‘দুগ্ধতুম্বী’ নিবেদন করা হয়। কথিত আছে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবেরও এই মিষ্টি বড়ই প্রিয়।
শ্রী বৃন্দাবন দাস ঠাকুর রচিত চৈতন্য ভাগবতের মধ্যম খন্ডে বিবৃত আছে যে, নিমাইয়ের সন্ন্যাস গ্রহণের সংবাদ পেয়ে ভক্তরা তাঁর দর্শনে আসেন বিভিন্ন উপহার সহযোগে। তাঁদের মধ্যে শ্রীধর তার সাধ্য মতো আনে এক বিশাল লাউ ও অন্য কিছু ভক্তরা আনে দুধ। সেই দেখে মহাপ্রভু প্রীত হয়ে শচী মায়ের কাছে ‘দুগ্ধতুম্বী’র অর্থাৎ লাউয়ের পায়েসের আবদার করেন । মহাপ্রভুর খুব প্রিয় এই খাবার তাঁর সখা জগন্নাথ দেবেরও বড় প্রিয় হিসাবে গণ্য কোড়া হয়। তাই সন্ধ্যাবেলাঢ় ভোগে গুণ্ডিচা মন্দিরে দেবত্রয়ীকে এই মিষ্টি পরিবেশন কোড়া হয়।
উপকরণ:
- লাউ (সরু সরু মিহি করে কুচানো) – ৩০০ গ্রাম
- ঘি – ১০০ গ্রাম
- দুধ – ১ লিটার
- আমন্ড, কাজুবাদাম, কিশমিশ – ইচ্ছানুযায়ী
- আখের গুড় – ১০০ গ্রাম
- তেজপাতা – ১ টা
- এলাচ গুঁড়ো – ১/২ চামচ
প্রণালী:
- সরু করে কুচানো লাউ হাত দিয়ে চেপে ভালো করে জল ঝরিয়ে নিতে হবে।
- মাঝারি আঁচে ঘি গরম করে তার মধ্যে তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে লাউ ঢাকা দিয়ে ভেজে নরম করে নিতে হবে।
- অন্য পাত্রে দুধ ফুটিয়ে ঘন করে নিতে হবে। দুধের পরিমাণ ১ লিটার থেকে ৭৫০ মিলি হয়ে গেলে লাউয়ের মধ্যে মিশিয়ে দিতে হবে।
- এর মধ্যে গুড়, বাদাম, কিশমিশ ও এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে ভালো করে ফুটতে দিতে হবে।
- ঘন ঘন পায়েস তৈরি হলে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে পরিবেশন করতে হবে।
চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন