গরমে ত্বকের যত্ন - পৌষালী ব্যানার্জী

 



বসন্তকাল বিদায় নিতে না নিতেই মহা সমারোহে গ্রীষ্মের আগমন এবং প্রায় তৎক্ষণাৎই তার দাবদাহে সকলের অবস্থা কাহিল। প্রচন্ড গরমে শরীরকে সুস্থ রাখতে সারাদিন ধরে পর্যাপ্ত পরিমাণ জলপান, সরাসরি প্রখর রোদ এড়িয়ে চলা, বাইরে বেরোনোর সময় ছাতা এবং রোদচশমা ব্যবহার করা যেমন জরুরী, ঠিক সেভাবেই যত্ন নিতে হবে ত্বকেরও। গ্রীষ্মের চড়া রোদের প্রভাবে এবং অতিরিক্ত ঘামের ফলে ধুলোবালি এসে ত্বকে জমা হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের ত্বক, আর ত্বকের প্রতি উদাসীনতা ক্ষতি করে আরো বেশি। সূর্যালোকের ভিটামিন-ডি ত্বকে পুষ্টি জোগালেও দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকলে ত্বকে ট্যান পড়ে এবং সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য নষ্ট করে। সেই কারণে এই ঋতুতে ঘাম, ধুলোবালি এবং আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করা অত্যন্ত অপরিহার্য

ত্বকের ধরণ সকলের ক্ষেত্রে সমান নয়। প্রকারভেদ অনুযায়ী এটি বিভিন্ন রকমের হতে পারে যেমন শুষ্ক ত্বক, তৈলাক্ত ত্বক, স্বাভাবিক ত্বক ও মিশ্র ত্বক। তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারিনীদের সমস্যা এই সময়ে একটু বৃদ্ধি পায়। ত্বক থেকে এক ধরণের তৈলাক্ত নির্যাস নিঃসৃত হয় যা ত্বককে আরো তেলতেলে করে তোলে। একে বলে সিবাম। গরমে ত্বকে অতিরিক্ত সিবাম নির্গত হওয়ার ফলে ফাঙ্গাল অ্যাকনে, সানট্যান, ব্ল্যাকহেডস, লালচে ভাব ইত্যাদির সমস্যা বেশি দেখা দেয়। যাঁদের ত্বক শুষ্ক, তাঁরা ঘাম এবং নিঃসৃত সিবাম দেখে মনে করেন ত্বকের আর আলাদাভাবে যত্ন নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই উপর গরমে শরীর বেশি ডিহাইড্রেট হয় বলে এর প্রভাব শুষ্ক ত্বকে অপেক্ষাকৃত প্রকট হয় বেশি। সেই কারণে গ্রীষ্মকালে ঠিকমতো ত্বকের যত্ন নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ


১) ফেসওয়াশ:


প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে অতিরিক্ত ঘামের ফলে ধুলোবালি এসে ত্বকে জমা হয়। এর ফলে রোমকূপগুলি বন্ধ হয়ে যায় এবং ভেতরে ঘাম ও সিবাম জমে তৈরি হয় বিভিন্ন সমস্যা। এই জন্য গরমের দিনে ত্বক পরিষ্কার করার ব্যাপারে বেশি যত্নশীল হতে হয়। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় তো অবশ্যই, যদি এমন হয় সারাদিন বাইরে বেরোনো হয়নি তবুও রুটিন করে ত্বক পরিষ্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে ত্বকের ধরণ অনুযায়ী ক্লিনজার। শুষ্ক ত্বক যাঁদের তাঁরা ময়েশ্চারাইজিং ক্লিনজার ব্যবহার করতে পারেন। তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারিনীদের ক্ষেত্রে তৈলগ্রন্থিগুলি এসময় সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণে অতিরিক্ত তেল বের হয়। তাঁরা সকালে ও রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অয়েল কন্ট্রোল ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে পারেন


২) টোনারঃ


টোনার ত্বকের রোমকূপ বন্ধ ও ত্বককে শীতল রাখতে সাহায্য করে। ভালো কোম্পানির যেকোনো অ্যালকোহলমুক্ত টোনার ব্যবহার করা যায়। ঘরোয়া টোনার হিসেবে গোলাপজল ভালো কাজ করে। একটি স্প্রে বোতলে গোলাপজল ভরে ফ্রিজে রেখে দেওয়ার পর মাঝেমধ্যে মুখে ও গলায় স্প্রে করলে বেশ আরাম পাওয়া যায়


৩) ময়েশ্চারাইজার :


শুষ্ক ত্বকের খসখসে ভাব দূর করার জন্য এবং বলিরেখা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে অবশ্যই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত। বেবি লোশনও ব্যবহার করা যায়। তবে এসময় অয়েল বেসড ময়েশ্চারাইজারের তুলনায় ওয়াটার বেসড ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা বেশি উপযোগী। নতুবা অতিরিক্ত তেল গরমে আরো বেশি সমস্যা তৈরি করবে


৪) এক্সফোলিয়েশন :


গরমকালে ত্বকের মৃত কোষ দূর করে রক্তসঞ্চালন বাড়ানোর জন্য ত্বককে এক্সফোলিয়েট করা জরুরী। কারণ এসময় ধুলোময়লা জমে ত্বক অপরিচ্ছন্ন হয় বেশি। বাজারচলতি ভালো মানের কোনো এক্সফোলিয়েট ক্রিম ব্যবহার করা যায় অথবা বাড়িতেও বানিয়ে নেওয়া যায়। চার-পাঁচ চামচ বেসনের সাথে এক চামচ হলুদ, পাঁচ-ছয় ফোঁটা গোলাপজল ও পরিমাণ মত দুধ মিশিয়ে পেস্টের মতো তৈরি করে ত্বকে লাগিয়ে রেখে আধঘণ্টা পর ভিজে আলতো হাতে ম্যাসাজের মাধ্যমে ঘষে তুলে ফেলতে হবে এবং মুখ ধুয়ে নিতে হবে


৫) সানস্ক্রিন:


গরমের দিনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হলো সানস্ক্রিন। দিনের বেলায় ঘরের মধ্যে কম spf সানস্ক্রিন যুক্ত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহৃত হলেও বাইরে বেরোনোর অন্তত কুড়ি মিনিট আগে উচ্চ spf যুক্ত সানস্ক্রিন লোশন অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত। এর সাথে ২-৩ ঘন্টা পর পর পুনরায় মাখতে হবে। তৈলাক্ত ত্বকের জন্য তেলবিহীন সানস্ক্রিন ব্যবহার করা ভালো। যাঁদের ঘাম বেশি হয় তাঁরা ওয়াটারপ্রুফ সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে পারেন



ত্বকের যত্নে কয়েকটি কথা :


ক) গরমে ত্বক শীতল রাখা খুব প্রয়োজন। এক টেবিল চামচ কোরানো শসার সাথে এক টেবিল চামচ টক দই মিশিয়ে ত্বকে লাগিয়ে রাখার ১৫-২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে। এটি ত্বককে সতেজ অনুভব করায়


খ) গরমকালে ভারি মেকআপ এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। যতটা সম্ভব কম এবং হালকা প্রোডাক্ট মুখে প্রয়োগ করতে হবে। নয়তো রোমকূপ বন্ধ হয়ে ত্বকে সমস্যা দেখা দেবে


গ) বাইরে যেহেতু ঘন ঘন মুখ ধোওয়া সম্ভব নয়, তাই সঙ্গে ফেসিয়াল টিস্যু রাখা ভালো। কাজের ফাঁকে ফেসিয়াল টিস্যু দিয়ে আলতো করে চেপে চেপে মুখ মুছে নিলে গরমের প্যাচপ্যাচে ভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং তরতাজা অনুভূত হয়


ঘ) বাইরে থেকে আসার পর ত্বকে বরফ লাগালে একটা শীতল ও সতেজ ভাব আসে। একটা পাতলা কাপড়ে বরফের টুকরো মুড়ে নিয়ে ত্বকে দেওয়া যায়। বরফের জায়গায় কেউ চাইলে আইসড অ্যালোভেরা জেলও ব্যবহার করতে পারেন


ঙ) ত্বকের জন্য অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টকে বলা হয় সুপারস্টার ইনগ্রেডিয়েন্ট। অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের প্রভাবে ত্বক উজ্জ্বল হয়। ত্বকের উপর রোদের প্রভাবে যে দাগছোপ পড়ে সেসবও উঠে যায় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের প্রভাবে৷ তাই এই সময়ে ভিটামিন, রেটিনল, নিয়াসিনামাইড আছে এমন ত্বকসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে। 


চ) গরমে যাঁদের ত্বকে ঘামাচি হয় তাঁরা নিমপাতার রস লাগালে উপকার পাবেন। এসময় তেঁতো জাতীয় খাবার খাওয়া ভালো। ঘাম বেশি হলে ট্যালকম পাউডারের সাথে এক চিমটি খাবার সোডা ব্যবহার করতে হবে


ছ) শুধু বাহ্যিক যত্ন নয়, আমাদের প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ যত্নেরও। গরমে সুস্থ থাকতে প্রচুর শাকসবজি এবং ফলমূল খেতে হবে। এসময় আমাদের পরিপাকতন্ত্র দুর্বল থাকে, সেই কারণে গুরুপাক খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। টক, ভাজাভুজি এবং খুব বেশি গরম খাবার না খাওয়াই ভালো


জ) জল শুধু শরীরে আর্দ্রতা জোগায় না, ত্বককে সজীব রাখতেও সাহায্য করে। তাই ত্বক সুন্দর রাখার জন্য প্রচুর জল পান করা উচিত


ঝ) গরমের পানীয় হিসাবে ডাবের জলের কোনো তুলনাই নেই। এর পাশাপাশি লেবুর শরবতও অত্যন্ত উপযোগী। শরবতে একটু নুন ও চিনি মিশিয়ে নিতে হবে। চিনি শক্তি জোগাবে এবং নুন পূরণ করবে শরীর থেকে ঘামের সাথে বেরিয়ে যাওয়া নুনের অভাবটুকু। লেবুতে থাকে ভিটামিন সি যা আমাদের ত্বকের সাথে গোটা শরীরের জন্যই উপকারী। এছাড়া দইয়ের ঘোল বা লস্যিও উত্তম পানীয়


ঞ) ঋতুভেদে কারুর না কারুর সমস্যা লেগেই থাকে। বেশি ঠান্ডা কারুর কাছে ভীষণ অপছন্দ, কেউ আবার গরমকালকে অত্যন্ত কষ্টকর ও ক্লান্তিদায়ক বলে মনে করেন। এদিকে বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই রয়েছে। গরমের জন্য তো আর আনন্দের দিনগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘরে বসে থাকা চলে না, দৈনন্দিন কাজকর্মও বিরত রাখা চলে না। তাই এসবের সঙ্গে শরীরের উপযুক্ত খেয়াল রাখলে অতি সাবলীলভাবে প্রত্যেকটি দিনকে করে তোলা যায় কর্মঠ ও প্রাণবন্ত। সেই কারণে নিজের যত্ন নিন এবং প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করুন হাসিমুখে



কলমে - পৌষালী ব্যানার্জী

 

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন