"খিড়কি
থেকে সিংহদুয়ার,
এই তোমাদের পৃথিবী
এর বাইরে জগত আছে তোমরা মাননা।"
মধ্য যুগে মেয়েদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। একসময় মেয়েরা নিজেরাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই বোধহয় ওদের জগৎ। এর বাইরে যেতে নেই। যেমন সার্কাসে পশুরা মনে করে! এর বাইরেও যে জগৎ আছে, মেয়েরা অনেক কিছু কাজ করতে পারে তা মা সারদা বুঝিয়েছিলেন। আপাত দৃষ্টিতে এক সাধারণ গ্রাম্য বধূর মধ্যে যে কী অপার দূরদৃষ্টি বিরাজ করত তা সিস্টার নিবেদিতা ও স্বামীজী আমাদের দেখিয়েছিলেন। 'মা' সারদাকে কেউ বলেন মানবী আবার কেউবা বলেন দেবী। আবার কারো কাছে তিনি শুধুই 'মা'! যে যেমন ভাবে তাঁকে ভাবে তিনি তাঁর কাছে তেমনভাবেই ধরা দেন।
সকলকে ভালোবাসা দিয়েছেন, তবে কখনও অন্যায় সহ্য করেন নি। সদা হাস্যময়ী মৃদুভাষী মা প্রয়োজনে কড়া কথাও বলেছেন। সকলেই মায়ের প্রিয় ছিল। নিবেদিতা ও নরেন (স্বামীজী) ছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নিবেদিতার মৃত্যুতে মা খুবই ব্যাথিত হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীকালে যখনই তাঁর কথা বলতেন মায়ের চোখে জল আসত। জনৈকা ভক্ত-মহিলাকে বলেছিলেন,'যে হয় সুপ্রাণী, তার জন্য কাঁদে মহাপ্রাণী (অন্তরাত্মা), জান মা?'
তিনি ছিলেন প্রাচীন ও আধুনিকতার এক আশ্চর্য মিশ্রণ। কুসংস্কার মনে স্থান দিতেন না। কাজেও করতেন না। অযথা জাতপাতের বিচার করতেন না।
জন্মবৃত্তান্ত
:
সারদা মায়ের জয়রামবাটির বাড়ি
বাঁকুড়া জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম জয়রামবাটি। গ্রামটি ব্রাহ্মণপ্রধান। গ্রামের পূর্বদিকে সীমা বরাবর এঁকেবেঁকে ক্ষীণ স্রোত নিয়ে দামোদর নদ বয়ে চলে। এই গ্রামে মুখোপাধ্যায় বংশ কবে থেকে যে বসবাস করছেন তা কেউ বলতে পারে না। পুরুষানুক্রমে রামচন্দ্রের উপাসক কার্তিকরাম মুখোপাধ্যায় এই গ্রামে বাস করতেন। কার্তিকরামের পুত্রের নাম রামচন্দ্র। ধর্মপ্রাণ রামচন্দ্রের সামান্য যজনযাজন ছিল। এছাড়া কিছু চাষযোগ্য জমি ছিল ফলে সংসার মোটামুটি চলে যেত।
পাশের
গ্রামের নাম শিহড়। সেই গ্রামে বাস করতেন হরিপ্রসাদ মজুমদার। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের
পদবী ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্ধমানের মহারাজ তাঁদের এক পূর্বপুরুষকে খুশি হয়ে
মজুমদার উপাধি দান করেছিলেন।
হরিপ্রসাদের কন্যার নাম শ্যামাসুন্দরী দেবী। রামচন্দ্রের সঙ্গে দেবীপ্রতীম শ্যামাসুন্দরীর শুভ পরিণয় হয়। দীর্ঘদিন এই মুখার্জি-দম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান। সন্তানের আশায় তাঁরা গ্রামের জাগ্রতা দেবী সিংহবাহিনী, ত্রিমূর্তি ও অন্যান্য দেবদেবীর চরণে বারংবার আকুল হয়ে প্রার্থনা করেন।
সমাজে তখন নগরায়নের দিকে ঝোঁক। গ্রাম থেকে অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষ নগরমুখী। রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য কলকাতায় উপস্থিত হলেন। স্বামী কাজের খোঁজে শহরে গিয়েছেন, শ্যামা সুন্দরী তাই বাপের বাড়ি শিহরে। জয়রামবাটির কাছেই এই শিহর। সেখানে শ্যামাসুন্দরী দেবীর এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। একদিন অসুস্থ অবস্থায় অন্যান্য গ্রাম্যবধূর মতোই পুকুরের পাড়ে শৌচে গেছেন শ্যামাসুন্দরী দেবী। এমন সময় কুমোরদের পোয়ানের (মাটি শুকোবার স্থান) কাছে ঝন্ ঝন্ শব্দে সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি। তাকিয়ে দেখলেন, সামনের বেলগাছ থেকে একটি শিশুকন্যা নেমে এল এবং তার নরম কোমল দুটি হাত দিয়ে শ্যামাসুন্দরী সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফিরলে অনুভব করলেন ঐ কচি মেয়েটি যেন তাঁর গর্ভে প্রবেশ করেছে! পরম কৃপাময়ী জগদম্বা স্বয়ং এই বিশুদ্ধচিত্ত ব্রাহ্মণের ঘরে প্রথম সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করেন। সেটা ছিল ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার এবং কৃষ্ণা সপ্তমীর পবিত্র সন্ধ্যা।
নামকরনঃ
শিশুকন্যার
জন্মপত্রিকা অর্থাৎ ঠিকুজি অনুযায়ী নাম রাখা হয় ঠাকুরমণি। মা নাম রাখলেন
ক্ষেমঙ্করী। কিন্তু কন্যার জন্মের সময় উপস্থিত ছিলেন কন্যার এক মাসিমা। এর আগে
সেই মাসিমার 'সারদা' নামে এক শিশুকন্যা মারা যায়। তাই তিনি আবদার করে বললেন, দিদি তুমি এই মেয়ের নাম রাখো সারদা, তাহলে
আমার সারদা তোমার কাছেই তো আছে ভেবে বেদনা ভুলে থাকতে পারব। সেই থেকে ক্ষেমঙ্করীর
নাম বদলে সকলে বলতে লাগল সারদামণি। আদর করে সকলে ডাকে 'সারু' 'সারু'।
সরল প্রকৃতিঃ
সারদাদেবীর
বাল্যসঙ্গিনী অঘোরমণির মুখ থেকে জানা যায়, সারদাদেবী
ছিলেন অত্যন্ত সরল প্রকৃতির। সঙ্গীদের নিয়ে পুতুলখলা খেলেছেন, কিন্তু কারও সঙ্গে কোনোদিন একটুকু ঝগড়া হয়নি তাঁর। বরং অন্য কোনো
মেয়েদের মধ্যে ঝগড়া হলে তাদের ভাব করিয়ে দিতেন। তিনি লক্ষী ও কালীমূর্তি তৈরি
করে ফুলবেলপাতা দিয়ে পূজা করতে বেশি ভালবাসতেন।
পুণ্য
পরিণয়ঃ
বিয়ে ব্যাপারটা ভারী অদ্ভূত একটা বিষয়। ব্যক্তির মতাদর্শন অনুযায়ী এর অর্থও পাল্টে যায়। নিবেদিতার লেখা থেকে জানতে পারি, একদিন তর্কস্থলে তিনি ( স্বামীজী ) স্বীকার করেন," বিবাহের পারে যাবার জন্যই বিবাহ করা, এর বিরুদ্ধে আমার কিছুই বলার নাই।" তাঁহার গুরুদেবের, তাঁহার গুরু ভ্রাতা যোগানন্দের এবং তাঁহার শিষ্য স্বরূপানন্দের যে প্রকার বিবাহ হয় তাঁহার বিবেচনায় উহাই আদর্শ বিবাহ।
সারদামণি তখন খুবই ছোট্ট। তিনি মামাবাড়ি শিহর গিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাগ্নে হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায়েরও বাড়ি শিহরে। সেই সময় গ্রামে এক ধর্মীয় সংগীতানুষ্ঠান হচ্ছিল। বাকি গ্রামবাসিদের সাথে শিশু সারদা, রামকৃষ্ণদেব, ভাগ্নে হৃদয়রামও সেখানে উপস্থিত ছিল। শিশু সারদা গ্রামের এক মহিলার কোলে বসেছিলেন। গান শেষ হলে ওই মহিলা মজা করে সারদাকে জিজ্ঞাসা করলেন,' এই যে এত লোক এখানে রয়েছে, এদের মধ্যে কাকে তোর বিয়ে করতে ইচ্ছে হয়, বল তো?' অমনি শিশু-সারদা দুহাত তুলে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিয়ে দিলেন।
এইরূপে
কোন এক দৈব প্রেরণায় এঁরা দুজনই দুজনকে নির্বাচন করে নিয়েছিলেন। পৃথিবীও সাক্ষী
থাকল এক পূণ্য পরিণয়ের। ১২৬৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসের শেষে ২৪ বছরের গদাধরের সঙ্গে
ছয় বছরের সারদামণি বিবাহ সম্পন্ন হল।
মর্যাদাঃ
তাঁরা একে অপরকে খুবই ভালোবাসতেন। তাঁদের প্রেম ছিল দেহাতীত স্বর্গীয়। সেখানে কামনা-বাসনা ছিল না। দক্ষিণেশ্বরে একদিন সন্ধ্যার পর শ্রীমা শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে খাবার রাখতে গিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন খাটের উপর চোখ বুজে শুয়েছিলেন। লক্ষ্মীদি খাবার রেখে গেল মনে করে তিনি বললেন,' দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাস।' মা বললেন,'হ্যাঁ বন্ধ কল্লুম।' মার গলা বুঝতে পেরে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্কুচিত হয়ে উঠলেন, 'আহা তুমি? আমি ভেবেছিলুম লক্ষ্মী, গোলমরি কিছু মনে করোনি।'
শ্রীমা-কে শ্রীরামকৃষ্ণ এমনই মর্যাদা দিতেন সবসময়। সেই জন্য পরবর্তীকালে মা বলতেন আমি এমন স্বামীর কাছে পড়েছিলুম যে, তিনি কখনও আমাকে "তুই" পর্যন্ত বলেননি।' 'ঠাকুর আমাকে কখনও ফুলটি দিয়েও ঘা দেননি।'
মা সারদা সম্পর্কে রামকৃষ্ণদেব বলতেন,'ও সারদা - সরস্বতী - জ্ঞান দিতে এসেছে। রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লোকের অকল্যাণ হয়, তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে।'
' ও
জ্ঞানদায়িনী, মহাবুদ্ধিমতী। ও কি যে সে! ও আমার
শক্তি।'
সংসার ধর্মঃ
সংসার ধর্ম বড় না সন্ন্যাস ধর্ম বড় - এই নিয়ে তর্ক হয়ে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। আমরা অবশ্য সেইসব তর্কে যাব না, বরং জেনে নেব মা সারদা আমাদের সংসার ধর্ম নিয়ে কী শিখিয়ে গিয়েছেন।
'সংসারে কেমন করে থাকতে হয় জান? - যখন যেমন তখন তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন।'
গৃহস্থালির
কাজে শ্রীমায়ের অসাধারণ নিপুণতা দেখা যেত। মা চাইতেন, সংসারে যারা থাকবে ছোট-বড় প্রতিটি কাজ শ্রদ্ধা সহকারে করবে। তিনি
নিজেও তা-ই করতেন। ঝাঁটাটিকে পর্যন্ত সম্মান করার শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। কোন
আত্মীয়া কাজের শেষে ঝাঁটাটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে শ্রীমা তাঁকে বলেছিলেন,' যাকে রাখো সেই রাখে। আবার তো ওটি দরকার হবে? তা ছাড়া, এই সংসারে ওটিও তো একটি অঙ্গ।
সেদিক দিয়েও তো ওর একটা সম্মান আছে। যার যা সম্মান, তাকে সেটুকু দিতে হয়। ঝাঁটাটিকেও মান্য করে রাখতে হয়। '
সংসারে
অপচয় হোক মা চাইতেন না। ঠাকুর তাঁকে পাট দিয়েছিলেন শিকে করার জন্য। শিকে পিকে
তৈরির পর যে ফেঁসোগুলো রয়ে গেল, তা ফেলে না
দিয়ে বালিশ তৈরির কাজে ব্যবহার করলেন। তরি - তরকারির খোসা সব সময় গরু - ছাগলকে
খেতে দিতেন। বলতেন, ' যার যেটি প্রাপ্য সেটি তাকে
দিতে হয়। যা মানুষে খায়, তা গরুকে দিতে নেই; যা গরুতে খায়, তা কুকুরকে দিতে নেই; গরু ও কুকুর না খেলে পুকুরে ফেললে মাছ খায় - তবু নষ্ট করতে নেই।'
এক
ভক্ত চুবড়ি করে ফল পাঠিয়েছে। অন্যেরা ফলগুলি নিয়ে চুবড়িটা ফেলে দিতে বলল।
শ্রীমা কিন্তু চুবড়িটা ধুয়ে যত্ন করে রেখে দিলেন - পরে সেটা কোন কাজে যদি লাগে।
একবার ঠাকুরের ভোগের দুধে ছোট মাছ ধরা পড়ল। সেবক সেই দুধ ফেলে দিতে চাইলেন।
শ্রীমা বললেন,' ফেলবে কেন ঠাকুরের ভোগে না
দিলেও বাড়ির ছেলেপিলে আছে, তারা তো খেতে পাবে।'
মেয়েদের উন্নয়নে মায়ের আগ্রহঃ
মেয়েদের শিক্ষা লাভ হোক - এ শ্রীমা খুব চাইতেন। বিদ্যার উপর তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। নিবেদিতার স্কুলের উদ্বোধন করেছিলেন মা (১৩ নভেম্বর ১৮৯৮) এবং আশীর্বাদ করে বলেছিলেনঃ 'আমি প্রার্থনা করছি, যেন এই বিদ্যালয়ের ওপর জগন্মাতার আশীর্বাদ বর্ষিত হয় এবং এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েরা যেন আদর্শ বালিকা হয়ে ওঠে।'
এক স্ত্রী-ভক্ত তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিতে পারছেন না বলে দুশ্চিন্তা করলে মা বলেছিলেনঃ 'বে দিতে না পার, এত ভাবনা করে কি হবে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দিও - লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে!'
মাদ্রাজের
দুটি মেয়ে নিবেদিতা বিদ্যালয়ে ছিলেন, তাঁদের
বয়স বিশ-বাইশ বছর। তাঁদের কথা উল্লেখ করে মা বলেছিলেন,' আহা, তারা কেমন সব কাজকর্ম শিখেছে। আর
আমাদের! এখানে পোড়া দেশের লোকে কি আট বছরের হতে না হতেই বলে, পরগোত্র করে দাও,পরগোত্র করে দাও। আহা, রাধুর যদি বিয়ে না হত, তাহলে কি এত
দুঃখ-দুর্দশা হত?'
একদিন
রাধুদি সামনের মিশনারী স্কুলে যাবেন বলে খেয়েদেয়ে কাপড় পরে প্রস্তুত, এমন সময় গোলাপ-মা এসে মাকে বললেন, ' বড়
বড় হয়েছে মেয়ে, এখন আবার স্কুলে যাওয়া কি?' এই বলে রাধুকে যেতে নিষেধ করলেন। রাধু কাঁদতে লাগল। এই সময় মা বললেন, 'কি আর বড় হয়েছে, যাক না। লেখাপড়া, শিল্প এসব শিখতে পারলে কত উপকার হবে। যে গ্রামে বিয়ে হয়েছে - এসব
জানলে নিজের ও অন্যেরও কত উপকার করতে পারবে, কি বল
মা?' রাধুদি মায়ের কথায় স্কুলে গেলেন।
বাস্তববাদী মাঃ
শ্রীমায়ের
বাস্তববুদ্ধি ও সাধারণ জ্ঞান (common sense) ছিল
অসাধারণ। এক ভক্ত শ্রীমাকে চিঠিতে জানিয়েছেন, তিনি
যে চাকরি করেন, তাতে মিথ্যা কথা বলতে হয় সময় সময়, সেজন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে চান। কিন্তু সাংসারিক অসচ্ছলতার জন্য তা
করতে পারছেন না, - এক্ষেত্রে তাঁর কি করা উচিত। - মা
চিঠিটা শুনে একটু ভাবলেন তারপর সম্মুখে উপবিষ্ট পত্র লেখক কে বললেন,
' তাকে লিখে দাও চাকরি না ছাড়তে।… আজ একটু সামান্য মিথ্যা
কথা বলতে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু চাকরি ছেড়ে অভাবে
পড়লে তখন চুরি-ডাকাতি পর্যন্ত করতে ভয় পাবে না ' - এই কথাটি জোর দিয়ে দু-তিনবার বললেন। পত্রলেখক মায়ের দূরদৃষ্টি দেখে অবাক
হলেন।
ঠাকুরের দেহত্যাগের পরঃ
১৮৮৬
সালের আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে শ্রীশ্রীঠাকুরের লীলাবসান হল। মাকে ঠাকুর নির্দেশ
দিয়ে গিয়েছিলেন,' তুমি কামারপুকুরে থাকবে। নিজের হাতে শাক বুনবে। শাক ভাত খাবে। হরিনাম করবে।' মা তাই করেছিলেন। কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন নি।
ঠাকুরের
দেহত্যাগের পরদিন মা এয়োস্ত্রীর সাজ খুলে বৈধব্যের সাজ পরতে গেলে ঠাকুর শ্রীমাকে
দর্শন দিয়ে বলেছিলেন,' আমি কি মরেছি যে, তুমি এয়োস্ত্রীর জিনিস হাত থেকে খুলে ফেলছ?' মা আর বালা খুললেন না। আর তিনি বিধবার বেশ পরেননি। সরু লালপেড়ে কাপড়
পড়তেন, আর হাতে ঐ দু-গাছা বালা থাকত। আর ঠাকুর
দর্শন দিয়ে মাকে বলেছিলেন, ' তুমি হাতের বালা ফেলো
না। বৈষ্ণব তন্ত্র জান তো? 'ঠাকুরের জন্য মায়ের মন খারাপ
করত। নিজের দেহ আর রাখতে পারবেন কী না ভাবতেন। তখন ঠাকুর আবার আর্বিভূত হয়ে একটি
লাল কাপড়-পরা দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠাকুর তাকে দেখিয়ে
বলেছিলেন,' একে আশ্রয় করে থাক।' পরে মায়ের ভাইয়ের ছোট্ট মেয়েকে দেখিয়ে ঠাকুর বলেছিলেন, ' এই সেই মেয়ে, একে আশ্রয় করে থাক, এটি যোগমায়া।' এরপর থেকে মা 'রাধু! রাধু!' করতেন। নিজেই একবার
বলেছিলেন, যেদিন রাধুর ওপর থেকে মন উঠে যাবে, সেইদিন এই দেহ আর থাকবে না।
সঙ্ঘজননীরূপে মাঃ
মঠ
প্রতিষ্ঠার পর স্বামীজী মাকে সঙ্ঘজননীরূপে পূজা করেছিলেন। সন্ন্যাসীদের মাতৃস্নেহে
ভালোবেসেছেন বলেই তিনি সঙ্ঘজননী নন, সংঘের
আদর্শকে পরিপুষ্ট করেছেন, প্রয়োজনে পথনির্দেশ
দিয়েছেন সঙ্ঘের দিক্ পাল সন্ন্যাসীদের - এইজন্যই তিনি সঙ্ঘজননী। সঙ্ঘের সব
সন্ন্যাসীর কাছে মায়ের আদেশই ছিল শেষ কথা - এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের কাছেও তাই।
সকলের মাঃ
এক
জায়গাই তিনি বলেছেন, 'আমি সতেরও মা আমি
অসতেরও মা'।সত্যিই 'মা' কী ছেলেদের মধ্যে ভেদাভেদ করেন! মা
তো মা'ই হন! পৃথিবীর প্রত্যেক সন্তানের তিনি 'মা'। সকলের মা।
শ্রীমায়ের
মা শ্যামাসুন্দরী দেবী প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতেনঃ 'এমন পাগল জামাইয়ের সঙ্গে আমার সারদার বে দিলুম! আহা! ঘর-সংসারও করলে
না, ছেলেপুলেও হল না, "মা" বলাও শুনলে না।' শ্রীরামকৃষ্ণ
তাঁর আক্ষেপ শুনে বলেছিলেন, 'শাশুড়ি ঠাকরুন, সেজন্যে আপনি দুঃখ করবেন না; আপনার
মেয়ের এত ছেলেমেয়ে হবে, শেষে দেখবেন,
"মা" ডাকের জ্বালায় আবার অস্থির হয়ে উঠবে।' ঠাকুরের দেহত্যাগের পরে সেই ছেলেরা আসতে শুরু করে এক এক করে -
পিঁপড়ের সারির মতো। কিন্তু মা কখনও 'মা' ডাক শুনে অস্থির হননি।
আমাদের
অভয় দিয়ে বলেছেন,'যখন দুঃখ পাবে, আঘাত পাবে, বিফলতা আসবে তখন নিশ্চিত জেনো
আমি তোমাদের সঙ্গে রয়েছি। ভয় পেয়ো না, হতাশ হয়ো
না,..... আমি থাকতে তোমাদের ভয় কী? আমি তোমাদের মা - সত্যিকারের মা। আমি মা থাকতে কে তোমাদের কী করবে? জেনো, বিধাতারও সাধ্য নেই যে, আমার সন্তানদের কোনও ক্ষতি করেন। আমার ওপর ভার দিয়ে নিশ্চিত হয়ে
থাকো। আর সর্বদা জেনো যে, তোমাদের পেছনে এমন একজন
রয়েছেন যিনি সর্বদা তোমাদের রক্ষা করছেন এবং করবেন। জেনো, তোমাদের মা রয়েছেন।'
শ্রীমা
নিজের পরিবারের মানুষের স্নেহের অত্যাচার, ভক্তদের
অত্যাচার সব হাসি মুখে সহ্য করতেন। অনেক সময় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুখ দিয়ে কটু
কথা বের হলেও সাথে সাথে নিজেকেই ধিক্কার দিতেন। তারপর ঈশ্বরের কাছে তাঁর মঙ্গলের
জন্য কামনা করতেন।
ভক্তরা
বেশি বেশি কৃপার আশায় মায়ের পায়ে মাথা ঠুকে দিত জোরে, কেউ বা বুড়ো আঙুলে কামড়ে দিত। তবুও সকলকে কৃপা করে গেছেন। একবার
গোলাপ-মা অভিযোগ করে বলেছিলেন,' তোমার যেমন হয়েছে -
যে আসবে মা বলে, অমনি পা বাড়িয়ে দেবে!' মায়ের উত্তর : কি করব, গোলাপ? মা বলে এলে আমি যে থাকতে পারি নে।'
আমরা
সাধারণ মানুষেরা বাহ্যিক সৌন্দর্য্য দেখি। আর তিনি দেখতেন অন্তরের সৌন্দর্য্য।
একদিন ঘাটাল থেকে একদল লোক পদব্রজে এসেছে উদ্বোধনে মাতৃদর্শনে। অতি দীনহীন বেশ, অমার্জিত রুক্ষকেশ। দেখে মনে হয়, একেবারেই
নিঃসম্বল। তাদের বেশভূষা দেখে সেবক কিছুতেই ভিতরে যেতে দিতে চায়ছিলেন না। মা কে
সঙ্কুচিত চিত্তে বললেন, ' মা, ওরা যে এক পঙ্গপাল, আর ভারী নোংরা। আপনি
ভিতরে আসতে বলছেন? '
ব্যাথিত
হয়ে মা বললেন,' পৃথিবীর সবাইকে আমি দেখা
দিচ্ছি, আর কত কষ্ট করে ওরা এসেছে, ওদের দেখা দেবো না! নিয়ে এসো ওদের। বাইরে নোংরা হলে কি হবে বাবা, ওদের ভেতরটা পরিষ্কার।' মায়ের
স্নেহ - করুণার স্পর্শ পেয়ে সেই দরিদ্র নিঃস্ব সন্তানরা মর্মে মর্মে অনুভব করল :
ইনি সত্যিই দীনদুঃখীর মা, তাদের করুণাময়ী জননী।
স্বামী
বিবেকানন্দ বলতেন -
ছোট
ছোট ঘটনাতেই মানুষের চরিত্রমাহাত্ম্য বেশী ফুটে ওঠে। মায়ের মাতৃরূপটিও উজ্জ্বলতর
হয়ে উঠেছিল এইরকম অসংখ্য প্রাত্যহিক ঘটনায়। বেড়াল, টিয়া পাখি গঙ্গারাম, গরু দেখাশোনা করার
জন্য গোবিন্দ নামের ছেলেটি, বিপ্লবী, বিধর্মী প্রত্যেকের জন্যই ছিল তাঁর অপত্য স্নেহ। যেন মনে হয়
গর্ভধারিনী মা ছাড়াও আমাদের আর একটি 'মা' আছে! সব বিপদ থেকে অলক্ষ্যে আগলে চলেছেন।
শেষ
জীবনঃ
"হাসি
নয়, অশ্রু নয়, উদার
বৈরাগ্যময় বিশাল বিশ্রাম।"
সাধারণ
মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু যাঁরা
মহাপুরুষ হন তাঁরা দেহত্যাগ করেন। আমরা মরতে ভয় পাই, অন্তিম সময়েও হাজার কামনা-বাসনা মনে উদয় হয়, তাই আমাদের আবার জন্ম হয়। আমরা আবার সংসার জ্বালা ভোগ করি। অন্যদিকে
মহাপুরুষদের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা হয়। তাঁরা দেহ ধারণের জন্য ফল ভোগ করেও
দেহত্যাগ করেন হেসে হেসে। তাঁদের কাছে মৃত্যুটা একটা খেলা মাত্র!
১৯১৭
সাল থেকেই ধীরে ধীরে মায়ের শরীরের অবস্থার অবনতি হতে লাগল। হোমিওপ্যাথি, কবিরাজী, এলোপ্যাথি কোনো চিকিৎসা আর
কাজে দেয় নি। ২১ শে জুলাই ১৯২০ সাল(বাংলার ৪ ঠা শ্রাবণ ১৩২৭), মঙ্গলবার, রাত্রি দেড়টার সময় শিবযোগে
শ্রীশ্রীমা আমাদের সকলকে ছেড়ে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ
চরণে গিয়ে মিলিত হলেন। তখন মায়ের বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।
মায়ের
দেহত্যাগের পর মিস ম্যাকলাউড বলেছিলেন,
"সেই নির্ভীক, শান্ত, তেজস্বী জীবনের দীপটি তাহলে নির্বাপিত হল - আধুনিক হিন্দু নারীর কাছে রেখে গেল আগামী তিন হাজার বছরে নারীকে যে মহিমময় অবস্থায় উন্নীত হতে হবে, তারই আদর্শ!"
শ্রীমা রেখে গেলেন জীবন পথে চলার শিক্ষা, ভালোবেসে আপন করে নেওয়ার শিক্ষা আর জগতের সবাইকে আর্শীবাদ করে গেলেন :
"যারা এসেছে, যারা আসেনি, আর যারা আসবে, আমার সকল সন্তানদের জানিয়ে দিও মা - আমার ভালোবাসা আমার আশীর্বাদ সকলের উপর আছে। "
কিছু বাণীঃ
"যদি শান্তি চাও মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগতকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা,জগৎ তোমার। "
" ভাঙতে সববাই পারে, গড়তে পারে কজনে? নিন্দা; ঠাট্টা করতে পারে সবাই - কিন্তু
তাকে ভাল করতে পারে কজনে?"
"অপ্রিয়
বচন সত্য কদাপি না কয়।"
"পৃথিবীর
মতো সহ্যগুণ চাই। পৃথিবীর উপর কত রকমের অত্যাচার হচ্ছে, অবাধে সব সইছে; মানুষেরও সেই রকম
চাই।"
"সময়ে
সবই সহ্য করতে হয়; সময়ে ছাগলের
পায়েও ফুল দিতে হয়।"
মায়ের
কথা বলে শেষ করা যায় না। তাঁর কর্মের গভীরতা এত বিস্তৃত যে আমি আমার লেখার খেই
হারিয়ে ফেলছি। আমার লেখা তাঁর গভীরতা স্পর্শ করতে পারছেই না। তাও আমি আমার সাধ্য
মতো শ্রীমাকে আমার লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম!
"প্রকৃতিং পরমামভয়াং বরদাং ,
নররূপধরাং জনতাপহরাম্ ।
শরণাগত-সেবকতোষকরীং ,
প্রণমামি পরাং জননীং জগতাম্ ।।"
কলমে
- সো মা
লা ই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন