এমআরকেএইচ সিনড্রোম: এক বিরল রোগের ইতিবৃত্ত - ডঃ শ্রীময়ী চক্রবর্তী



শতাব্দী প্রাচীন এক বিরল রোগের ইতিহাস:

সালটা ১৮২৯ থেকে ১৯৬১। এই এক শতাব্দীরও বেশি সময় কালে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিরল এক অস্বাভাবিকতার সন্ধান পান চিকিৎসকেরা।  জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং সুইডেন থেকে ততদিনে এমন চারটি কেস নথিভুক্ত হয় যার সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা সম্পর্কে সেই সময় অবগত ছিলেন না সমগ্র চিকিৎসক এবং বৈজ্ঞানিক মহল। জার্মান শরীরতত্ত্ববিদ অগাস্ট ফ্রাঞ্জ জোসেফ কার্ল মায়ার  (১৮২৯), অস্ট্রিয়ান এনাটোমিস্ট কার্ল ভন রোকিতানস্কি (১৮৩৩), জার্মান গাইনোকোলজিস্ট হারমান কুস্টার (১৯১০) এবং সুইস গাইনোকোলজিস্ট  জর্জেস আন্দ্রে হউসার (১৯৬১) প্রত্যেকেই তাদের ক্লিনিকে এমন কিছু রোগীর সংস্পর্শে আসেন যাদের জন্মগত ভাবে জরায়ু অর্থাৎ ইউটেরাস এবং যোনি অর্থাৎ ভ্যাজাইনা অনুপস্থিত। সেই সময় এই চার চিকিৎসকের পক্ষে যদিও এই অস্বাভাবিকতার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া সম্ভব হয়নি, কিন্তু এই তাঁদের  নাম অনুসারে পরবর্তী কালে এই রোগকে মায়ার-কুস্টার-রোকিতানস্কি-হউসার (Mayer–Rokitansky–Kuster–Hauser, MRKH) অথবা সংক্ষেপে এমআরকেএইচ সিনড্রোম নামে অভিহিত করা হয়।

 



ইতিহাস ঘেঁটে এই অস্বাভাবিকতায় আক্রান্ত নারীদের যে উপসর্গগুলো সম্পর্কে জানা যায় তা থেকে সহজেই অনুমেয় যে এমআরকেএইচ সিনড্রোম আসলে জন্মগত (congenital) ত্রুটি, যা প্রধানত স্ত্রী জননতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।  বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভ্যাজাইনা এবং জরায়ু অনুপস্থিত থাকে অথবা সম্পূর্ণ বিকশিত অবস্থায় থাকে না।  অস্বাভাবিকতার প্রথম লক্ষণ প্রকাশিত হয় বয়ঃসন্ধির সময় থেকে, যখন মেন্সট্রুয়েশন বা নারীদেহের ঋতুচক্রের স্বাভাবিক সূত্রপাত ঘটে না।  এই ঘটনাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় প্রাইমারি আমেনোরিয়া (primary amenorrhea)। অথচ এই রোগে নারীদেহের ওভারি বা ডিম্বাশয়ের গঠনগত বা কার্যক্ষমতায় কোনো ত্রুটি থাকে না।  এমনকি ক্রোমোজোম সংখ্যা (৪৬, XX) অথবা বয়ঃসন্ধির সময় যে সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তার  নিরিখেও একজন সুস্থ স্বাভাবিক নারীর সাথে তাদের কোনো পার্থক্যই  লক্ষ্য করা যায় না। জরায়ুর অনুপস্থিতি অথবা তাদের সম্পূর্ণ বিকাশ না হওয়ার দরুন, বলাই বাহুল্য, স্বাভাবিক ভাবে আক্রান্ত নারী গর্ভধারণে অক্ষম (Uterine Factor Infertility (UFI)।  কিন্তু অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া এবং স্বাভাবিক ডিম্বাশয়ের উপস্থিতির জন্য বিশেষ উপায় এই নারীরাও প্রজননে সক্ষম হয়ে উঠতে পারেন।

 

উপসর্গের তারতম্য:

ব্যক্তি বিশেষে এই অস্বাভাবিকতার আবার দু’টি ভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়ঃ

১. এমআরকেএইচ টাইপ ওয়ান : এক্ষেত্রে ভ্যাজাইনা বা জরায়ু ছাড়া অন্যান্য কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অস্বাভাবিকতা থাকে না। ফলতঃ প্রাইমারি এমেনোরিয়া এবং ভ্যাজাইনার আকৃতিগত পরিবর্তন ছাড়া অন্য উপসর্গ খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না।

২. এমআরকেএইচ টাইপ টু : চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, এই প্রকার এমআরকেএইচ সিনড্রোমের ক্ষেত্রে জননতন্ত্রের অস্বাভাবিকতা ছাড়াও মুলেরিয়ান আজেনোসিস, রেনাল আজেনোসিস এবং সার্ভিকোথোরাসিক সোমাইট এনোমালিস দেখা যায়।  অর্থাৎ সহজ ভাষায়, ইউটেরাস বা ভ্যাজাইনা ছাড়াও ফ্যালোপিয়ান টিউব, কিডনি, শ্রবণ ক্ষমতা, হৃদপিন্ড এবং মেরুদন্ড সহ স্কেলেটনের যে কোনো স্থানে গঠনগত সমস্যা তৈরী হতে পারে।


ধোঁয়াশার অন্তরালে...

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে এই অস্বাভাবিকতার সঠিক ভাবে শনাক্ত করা সম্ভব ঠিকই, কিন্তু এর কারণ সম্পর্কে জানতে গিয়ে যে গবেষণা আজ অবধি হয়েছে তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই রোগের সাথে কিছু জিনের যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে যা মাতৃ গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় ভ্রূণের বিকাশ এবং গঠনগত ত্রুটির জন্য দায়ী।  কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য যে সমস্ত আক্রান্ত নারীদেহে জিনের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নি। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু জিনের সাথে এই রোগের সংযোগ যে ১০০% নির্ভুল তা নিশ্চিত ভাবে কখনোই বলা যায় না।  এছাড়া এই জিনগুলি ঠিক কোন পদ্ধতিতে নারীদেহের জননতন্ত্রের গঠনকে প্রভাবিত করে, সেই ব্যাপারেও ধোঁয়াশার অন্ত নেই।

তবে এই রোগের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট করে বলা যায় যে এমআরকেএইচ সিন্ড্রোমে আক্রান্ত নারীর মুলেরিয়ান ডাক্ট, ভ্রূণ অবস্থায় সম্পূর্ণ বিকশিত হয় না।  এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মুলেরিয়ান ডাক্ট থেকেই ফ্যালোপিয়ান টিউব, জরায়ু , সার্ভিক্স এবং স্ত্রী জননতন্ত্রের অন্যান্য অংশ গঠিত হয়। এই অস্বাভাবিক গঠনের কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা না পাওয়া গেলেও, অনেক বৈজ্ঞানিকের মতে পরিবেশগত কিছু প্রভাবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো যোগসূত্র রয়েছে। গর্ভবতী অবস্থায় মায়ের শারীরিক অসুস্থতা অথবা নির্দিষ্ট কিছু ড্রাগের উপস্থিতিও এই রোগের অন্যতম কারণ হয়ে থাকতে পারে।  বলাই বাহুল্য যে ঠিক কী ধরণের শারীরিক অসুস্থতা বা কোন ধরণের ড্রাগ এই রোগের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে তার স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া এখনো সম্ভব হয় নি।  এছাড়াও জিনগত বা পরিবেশগত প্রভাব ঠিক কী ভাবে এই গঠনগত অস্বাভাবিকতার সাথে কিডনি বা হৃদপিণ্ডের সমস্যাকে ডেকে আনছে সেই ব্যাপারেও সমগ্র বিজ্ঞানী মহল অন্ধকারে।

 

কারণ অনুসন্ধান ছাড়াও, বিজ্ঞানীদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল যে এই রোগ বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয় কি না, অর্থাৎ এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে গিয়ে উত্তরাধিকারীদেরও একই ভাবে প্রভাবিত করে কি না তা সঠিক ভাবে উদ্ঘাটন করা। কিন্তু এক্ষেত্রেও যে  বার বার প্রকট হয়ে উঠেছে সামঞ্জস্যের অভাব।  প্রাথমিক ভাবে এই রোগের সাথে পারিবারিক কোনো  যোগসূত্র পাওয়া না গেলেও, বিরল থেকে বিরলতম ক্ষেত্রে অটোসোমাল ডমিনেন্স ইনহেরিটেন্সের একটা আভাস ঠিকই পাওয়া যায়।  এই অটোসোমাল ডমিনেন্স কী তা সহজ ভাষায় বোঝাতে গেলে বলা যায় যে বাবা এবং মায়ের থেকে আসা জিনের একটি কপিতেও যদি কোনো সমস্যা থাকে তাহলে তা পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানের মধ্যে প্রকাশিত হবেই।


ছায়ার সাথে যুদ্ধ 

যে রোগের কার্য কারণ সম্পর্ক নিয়ে এখনো এতো প্রশ্ন, এতো দ্বন্দ্ব এবং প্রামাণ্য তথ্যের থেকে অনুমান ভিত্তিক ধ্যান ধারণাই বেশি, সেই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি যে ব্যাপক ভাবে প্রসারিত নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি, বিজ্ঞানের নতুন নতুন চমক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্রুত অগ্রগতি এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথেষ্ট সফল।  যেহেতু ব্যক্তি বিশেষে এই রোগের লক্ষণ পরিবর্তিত হয় তাই উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করা হয়। উইটেরাস ট্রান্সপ্লান্ট বা অপারেশনের মাধ্যমে কৃত্তিম উপায় ভ্যাজাইনা (vaginoplasty) তৈরি করে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সন্তোষজনক ফলাফল লাভ সম্ভব হয়েছে। সামনে এখনো বহু ক্রোশ পথ অতিক্রম করা বাকি ঠিকই। কিন্তু এই আশাও হারালে চলবে না যে, বহু মানুষের নিরলস চেষ্টা, অধ্যাবসায়, গবেষণা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উদ্ধাবন এবং সর্বোপরি মানুষের শুভবুদ্ধি, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা নিশ্চিত ভাবে আমাদের এই রোগ জরা ব্যাধির বৈতরণী পার করার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠবে।

 



তথ্যসূত্রঃ

১. medlineplus.gov/genetics

২. www.pennmedicine.org


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন