মন, বড় অবুঝ এই মন -

 



হাসির অন্তরালে....


খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। মাস খানেক আগের কথা হবে। ‘মিম’-সর্বস্ব’ এই দশকেরই কোনো এক অলস দুপুরে মোবাইলের স্ক্রিন স্ক্রল করতে করতে চোখ আটকে গেলো মজাদার একটি পোস্টে। পোস্টটি ছিল, মেন্সট্রুয়েশন অর্থাৎ নারীদেহের ঋতুচক্রের সাথে সাথে তার মন মেজাজ ঠিক কী রকম ভাবে প্রভাবিত হয় সেই সম্পর্কে কিছুটা অতিরঞ্জিত এবং ব্যঙ্গাত্মক একটি প্রকাশ।

অথচ শুধুমাত্র যে এই পোস্টটি তাই- নয়, বরং সামাজিক মাধ্যমের আনাচে-কানাচে একটু সুলুক সন্ধান করলে এই সম্পর্কিত হাজার একটা মজার পোস্ট দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু আপাত হাস্যকর এই সম্পর্কিত পোস্টগুলোকে, অতিরঞ্জিত ভাবে প্রকাশ করার একটা ব্যর্থ প্রয়াস বলে যতই মনে করা হোক না কেন, কোথাও গিয়ে আমরা নিজেদের সাথে সত্যিই এই কথাগুলোর কম-বেশি সাদৃশ্য খুঁজে পাই না কি? বরং আমরা নিজেরাই, এই ব্যঙ্গাত্মক, হাস্যকর পোস্টগুলো প্রকাশের সাথে সাথে নিজেদের অজান্তে বেশ কিছু ক্লিনিক্যাল রোগ-ব্যাধি এবং উপসর্গের কথা স্বীকার  করে চলেছি। এমনই এক অস্বাভাবিকতা হলো প্রিমেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার (পিএমডিডি)



পিএমএস এবং পিএমডিডি: অকারণ চিন্তা না কি অত্যধিক উদাসীনতা : 


পিএমডিডি সম্পর্কে জানতে হলে, সবার আগে জানা প্রয়োজন প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম (পিএমএস) সম্পর্কে।  বলাই বাহুল্য, পিএমএস এর পোশাকি নাম সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো অবগত নই, অথচ এর উপসর্গ সম্পর্কে জানলে দেখবো যে আমরা সকলেই কিছুটা হলেও ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। আমাদের মেনস্ট্রুয়েশন শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক থেকে দুসপ্তাহ আগে থেকে আমাদের মানসিক এবং শারীরিক অবস্থার নানারকম পরিবর্তন হতে দেখা যায়।  বিরক্তি, সাময়িক বিষন্নতা, ছোট খাটো কথায় অযথা উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ অথবা মন মেজাজের খামখেয়ালি পরিবর্তন, এদের মধ্যে খুব সাধারণ উপসর্গ। আবার যদি শারীরিক উপসর্গের কথা ভাবা যায় তাহলেও সেক্ষত্রে পেট, বিশেষত তল পেট স্ফীত হয়ে যাওয়া, মাথা ব্যথা বা স্তনের বিভিন্ন পরিবর্তন, যেমন ব্যথা অথবা কোমলতা বৃদ্ধি পাওয়ার মতো সমস্যার সম্মুখীন আমরা সকলেই হামেশাই হয়ে থাকি।  তবে মনে রাখতে হবে যে, এই সমস্ত উপসর্গ ব্যক্তি বিশেষ যেমন পরিবর্তিত হয়, তেমনি উপসর্গের মাত্রাও সকলের ক্ষেত্রে সমান হয় না।  


সংক্ষেপে বলতে গেলে পিএমডিডি হলো, পিএমএস এর আরও ভয়ঙ্কর এবং গুরুতর একটি রূপ, কিছু ক্ষেত্রে প্রাণনাশকও বটে। পিএমএস ঠিক যতটা সাধারণ, পিএমডিডিডি কিন্তু মোটেই তা নয়।  গুগল যদিও বা বলছে যে এই অস্বাভাবিকতার হার এতটাই বেশি যে তা প্রায় লক্ষ লক্ষ নারীকে আক্রান্ত করে, কিন্তু বিভিন্ন গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে বলা যায় যে মাত্র % থেকে ১০% নারী এই অস্বাভাবিকতা প্রতক্ষ্য করে চলেছেন প্রতি মাসে। অন্যদিকে পিএমএস জনিত সমস্যায় আমরা সাধারণত যে সমস্ত মানসিক এবং শারীরিক সমস্যাগুলো প্রতক্ষ্য করি, পিএমডিডির ক্ষেত্রে সেই সমস্যাগুলোই, বিশেষত মানসিক উপসর্গগুলো আরও কয়েকগুন তীব্র ভাবে প্রকাশিত হয়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ভয়ঙ্কর ভাবে ব্যাহত করার ক্ষমতা রাখে।

 


উপসর্গেরাই যখন পথ নির্ধারক  



উদরের স্ফীতভাব, ঘুম এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, স্তনের অস্বাভাবিক কোমলতা বৃদ্ধি, ত্বকের পরিবর্তন যেমন অত্যধিক ব্রণ এবং ক্লান্তিভাব ছাড়াও পিএমডিডির ক্ষেত্রে তীব্রভাবে যে মনস্ত্বাত্তিক লক্ষণগুলো প্রকাশিত হয় তা হলো,


  • ডিপ্রেশন বা অবসাদ
  • উদ্বেগ
  • হতাশা
  • অকারণ উত্তেজনা
  • চরম রাগ বা বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ 
  • হটাৎ হটাৎ প্যানিক এটাক
  • আত্মহত্যার চিন্তা 
  • মনঃসংযোগের অভাব 
  • অস্বাভাবিক ক্লান্তিভাব 
  • বিভ্রান্তি
  • বিস্মৃতি
  • আত্মমর্যাদা এবং আত্মসম্মান বোধের ঘাটতি 
  • বারবার এবং অনিয়ন্ত্রিত খাবার খাওয়ার প্রবণতা
  • অনিদ্রা এবং মাথা ব্যথা 
  • যে কোনো কাজে আগ্রহের অভাব 
  • যৌন মিলনে অনীহা 
  • মন মেজাজের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন 

 

কিন্তু তো গেলো মনের গল্প। অন্যদিকে শারীরিক সমস্যার তালিকাটাও কিন্তু নেহাত ছোট নয়। যে সমস্ত শারীরিক সমস্যা এই অস্বাভাবিকতার সাথে সংযুক্ত তা হলো - 


  • গোড়ালিহাত এবং পায়ের পাতার স্ফীতভাব 
  • পর্যায়ক্রমিক ওজন বৃদ্ধি 
  • শ্বাসকষ্ট এবং এলার্জির সমস্যা 
  • চোখ বা অন্যান্য কোনো অঙ্গে সংক্রমণ
  • দৃষ্টির সমস্যা  
  • কোষ্ঠকাঠিন্য 
  • পেটে ব্যথা, বমিবমি ভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুধামান্দ্য
  • ত্বকের প্রদাহ 
  • পেশিতে টান ধরে যাওয়া বা স্প্যাসম 
  • শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাময়িক অসাড়তা 
  • সংজ্ঞাহীনতা  

 

তবে সব থেকে আশঙ্কার বিষয় এই যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই পিএমডিডির উপসর্গ মেনোপজের আগে পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এছাড়া, যেহেতু এই অস্বাভাবিকতার প্রতিটি উপসর্গ অন্য অনেক রোগের উপসর্গের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তাই আপনার সমস্যা আসলে পিএমডিডি না কি অন্য কোনো রোগের বহিঃপ্রকাশ সেই সম্পর্কে সঠিক ধারণার প্রয়োজন। 


কারণের অনুসন্ধানে: 


অন্যান্য অনেক রোগের মতোই পিএমডিডির সঠিক কারণ নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন যে ওভ্যুলেশন বা ডিম্বাণু নিঃসরণের পরে এবং মেনস্ট্র্যুয়েশনের আগে নারীদেহে প্রোজেস্টেরন এবং ইস্ট্রোজেন কমে গিয়ে এই ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

এছাড়া আমাদের ব্রেনের বিশেষ একটি নিউরোট্রান্সমিটার, সেরোটোনি, যা ঘুম এবং ক্ষিদে নিয়ন্ত্রণ করতে বিশেষ একটি ভূমিকা পালন করে, সেই রাসায়নিকের বিঘ্নিত ভারসাম্যও এই ধরণের সমস্যাকে, বিশেষত পিএমডিডি সম্পর্কিত অবসাদকে ডেকে আনে।

তবে বহুক্ষেত্রে অন্যান্য অসম্পর্কিত কিছু ফ্যাক্টর এই রোগের প্রধানকারণ হিসাবে উঠে আসতে দেখা গেছে বহুক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে,


  • আগে থেকেই উপস্থিত ডিপ্রেশন বা উদ্বেগজনিত সমস্যা বা অন্য কোনো মুড ডিসঅর্ডার  বা মেজাজের পরিবর্তনজনিত সমস্যা
  • পিএমডিডির পারিবারিক ইতিহাস 
  • ব্যক্তিগত কোনো ট্রমা বা স্ট্রেস 
  • প্রসবোত্তর অবসাদ 
  • ধূমপান বা অন্যান্য কোনো মাদকে আসক্তি 

 

পিএমডিডির প্রতিটা উপসর্গ এতটাই সাধারণ যে এই রোগ নির্ধারণ করাটাই  সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।  চিকিৎসকেরা সাধারণত ক্ষেত্রে রোগীকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে, অন্যান্য রোগের সম্ভাবনাকে নাকচ করে এই রোগ নিশ্চিত ভাবে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন।  যেমন:


  • ঋতুচক্রের মধ্যে, অর্থাৎ এক পিরিয়ড শেষ হওয়া এবং  অন্য পিরিয়ডের সাইকেল শুরু হওয়ার মাঝে সময়ের ব্যবধান কত ?
  • এক একটি সাইকেল ঠিক কতদিন স্থায়ী হয়?
  • মেন্সট্রুয়েশনের আগে এবং পরে ঠিক কী কী উপসর্গ দেখা যায় এবং সেই উপসর্গ কি পর্যায়ক্রমে আসে এবং চলে যায়?
  • ঠিক কোন সময় এই উপসর্গ তীব্র ভাবে প্রকাশ পায়?
  • এই যাবতীয় উপসর্গ আক্রান্ত নারীর দৈনন্দিন জীবনকে ঠিক কতটা প্রভাবিত করে?

 

সদিচ্ছাই যখন একমাত্র আশার আলো:  



পিএমডিডি একদিকে যেরকম গুরুতর একটি সমস্যা, তেমনই এই রোগের সঠিক কোনো চিকিৎসাও নেই। তবে একথাও সত্যি যে, সেরকম কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি ছাড়াও শুধুমাত্র লাইফস্টাইল মডিফিকেশনের মাধ্যমেও এই রোগের উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যেমন:

  • প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেটের সংমিশ্রনে বানানো সুষম খাদ্যের উপস্থিতি 
  • চিনি, নুন, ক্যাফিন এবং অ্যালকোহলের যথাসম্ভব কম ব্যবহার

  • নিয়মিত যোগ-ব্যায়াম
  • স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
  • ভিটামিন সম্পূরক খাদ্য (যেমন ভিটামিন বি6, ক্যালসিয়াম, এবং ম্যাগনেসিয়াম) গ্রহণ; গবেষণা প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন ,00 মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে পিএমএস এবং পিএমডিডি এর উপসর্গ অনেকটাই উপশম হতে পারে। ভিটামিন বি6, ম্যাগনেসিয়াম এবং এল-ট্রিপটোফ্যানও উপসর্গ উপশমে সাহায্য করতে পারে, তবে কোনও সম্পূরক গ্রহণ করার আগে পরামর্শের জন্য অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলা একান্ত প্রয়োজন।
  • অসহনীয় ব্যথা উপশমের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে পেইন কিলার বা ব্যথানাশক ওষুধের ব্যবহার

  • সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর(SSRI) এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা কন্ট্রাসেপ্টিভ পীল জাতীয় ওষুধের চিকিৎসা সাপেক্ষ এবং পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার. 
  • কিছু কিছু গবেষণা আবার হার্বাল ওষুধ ব্যবহারের স্বপক্ষে যুক্তি প্রদান করে থাকে। যেমন চ্যাস্টবেরি জাতীয় হার্বাল সাপ্লিমেন্ট মেজাজের পরিবর্তন, স্তনের কোমলতা, স্ফীতভাব, ক্র্যাম্প এবং অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি প্রলোভন কমাতে সাহায্য করে, তবে কথা অনস্বীকার্য যে এই তথ্যে বৈধতার সিলমোহর পড়তে এখনও বহু গবেষণা প্রয়োজন। 

 

এছাড়াও পর্যাপ্ত ঘুম এবং নার্ভ পেশী শিথীল করার বিভিন্ন কৌশলগুলি ব্যবহার করে , যেমন মননশীলতা, ধ্যান এবং যোগব্যায়াম শুধুমাত্ৰ পিএমডিডিই নয়, আমাদের সার্বিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। 




কলমে - ডঃ শ্রীময়ী চক্রবর্তী 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন