“কলকাতায় এসে বড় লাটকে চিঠি লিখেচি যে আমার ঐ ছার পদবীটি ফিরিয়ে নিতে।...বুকের মধ্যে অনেক ব্যাথা জমে উঠেছিল, তারই ভার আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেচে– সেই ভারের উপরে আমার ঐ উপাধির ভার আর বহন করতে পারছি নে, তাই ওটা মাথার উপর থেকে নামিয়ে দেবার চেষ্টা করচি।” - রাণু অধিকারীকে লেখা তাঁর 'ভানুদাদা'র চিঠি, ১লা জুন, ১৯১৯
লর্ড হার্ডিঞ্জ
১৯১২ সাল। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। তখন ভারতের বড়োলাট চার্লস হার্ডিঞ্জ। ২৩শে ডিসেম্বর দিল্লির চাঁদনি চকে লর্ড হার্ডিঞ্জকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়েন বাঙালি বিপ্লবী বসন্তকুমার বিশ্বাস। বোমার আঘাতে গুরুতর জখম হন বড়োলাট। কবিগুরু তখন আমেরিকায়। ভাইসরয়কে হত্যার প্রচেষ্টার খবর পেয়ে বিচলিত হন তিনি। হামলার খবর পেয়ে শান্তিনিকেতনে জগদানন্দ রায়কে ২৫ ডিসেম্বর একটি চিঠিতে তিনি লেখেন,
“কাল হঠাৎ সকালে খবরের কাগজে পড়া গেল লর্ড হার্ডিঞ্জ এর উপর একজন বোমা ছুঁড়ে মেরেছে। পড়ে আমার মনটা অত্যন্ত পীড়িত মনে হচ্ছে। আমরা মনে করি পাপকে আমাদের কাজে লাগাতে। কাজতো গোল্লায় যায়, তারপরে সেই পাপটাকে সামলায় কে?”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯০১ থেকে ১৯১২-১৩ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনার এক আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই চিঠির বয়ানে ছিল তারই প্রতিফলন। সন্ত্রাস এর পথে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যে দেশের মঙ্গল সাধন করতে পারে না এ বিষয়ে এই সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু সচেতন ছিলেন। তাই বড়োলাটের কুশল জিজ্ঞাসার থেকেও সন্ত্রাসবাদী জাতীয় আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অনাস্থাই চিঠির বক্তব্যে বেশি করে ফুটে ওঠে।
চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ
যাইহোক, দিল্লিতে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন সময়ে লর্ড হার্ডিঞ্জের সাথে পরিচিতি ঘটে রবীন্দ্র-শুভানুধ্যায়ী চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজের। অচিরেই, হার্ডিঞ্জ ও অ্যান্ড্রুজের মধ্যে একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে। অ্যান্ড্রুজের মাধ্যমেই বড়োলাট এবং তাঁর স্ত্রীর কবিগুরুর সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচয় ঘটে, বা বলা ভালো, হার্ডিঞ্জ ও রবীন্দ্রকাব্যের যোগসূত্রটি ছিলেন চার্লস অ্যান্ড্রুজ। অ্যান্ড্রুজের উদ্যোগেই হার্ডিঞ্জ ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে আসেন। এইসময় কবি বিদেশে। অ্যান্ড্রুজের তাগিদ ছিল তাঁর স্বদেশবাসীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাজকর্মের প্রত্যক্ষ পরিচয় করিয়ে দেবার। এই উদ্দেশ্যে সিমলার রাজভবনে হার্ডিঞ্জের অনুরোধে অ্যান্ড্রুজ “বাংলার নবজাগরণ ও রবীন্দ্রনাথ” নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ওই সভাতেই হার্ডিঞ্জ তার ভাষণে বলেন,
“The sovereignty of abindranath Tagore had already passed far beyond the bounds of Bengal and had reached to Western as well as Eastern shores. He might be named, without fear of any rival claim, as the poet laureate of Asia.”
স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর,২৬ ডিসেম্বর ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি.লিট. উপাধি প্রদান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে এই অনুষ্ঠানেও হার্ডিঞ্জ কবির প্রশংসা করে বলেন,
“Upon the modest brow of the last of these the Nobel prize has but lately set the the laurels of a world wide recognition and I can only hope that the the retiring disposition of our Bengali poet will forgive us for dragging him into publicity once more and recognise with due resignation that he must endure the penalties of greatness.”
রবীন্দ্র প্রতিভায় আপ্লুত এই হার্ডিঞ্জই ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করার জন্য ইংল্যান্ডে সরকারের কাছে আবেদন করেন। অবশ্য এই আবেদনের আগে ভাইসরয়ের অফিস থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অ্যান্ড্রুজের কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি আসে। সেই চিঠিতে নাইট উপাধির প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করা হয়, তবে রবীন্দ্রনাথ আদৌ বিদেশী শাসকদের হাত থেকে কোনো খেতাব নেবেন কিনা, সে নিয়েও চিঠিতে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। ভাইসরয়ের এই দ্বিধার সংগত কারণ ছিল। অবশ্য, হার্ডিঞ্জ হয়তো এটাও ভেবেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের আত্মসচেতন মনন সরাসরি প্রত্যাখ্যানের বিরোধী। বস্তুত পক্ষে, হার্ডিঞ্জ এবং অ্যান্ড্রুজ এদের দুজনের উপরোধ রবীন্দ্রনাথ ফেরাতে পারেননি। ফলত, ১৯১৫ সালের ৩রা জুন, পঞ্চম জর্জের জন্মদিন উপলক্ষে ‘birthday honours’ এ Knighthood-এর তালিকায় ‘Dr. Rabindranath Tagore of bolpur, Bengal’ এর স্থান হয়।
অবশ্য, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে, কবিকে Knight Bachelor খেতাব প্রদানের মানপত্রে তাঁর কাব্য প্রতিভার কথা সম্পূর্ণ উহ্য ছিল। এমনকি, রবীন্দ্রনাথ যে কবি, সে কথাও মানপত্রের কোথাও বলা নেই। এছাড়াও, ৮ ডিসেম্বর ১৯১৫, স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত সে বছরের সরকারি খেতাব প্রদানের অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে খেতাবপ্রাপ্তদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয় তাতে রবীন্দ্রনাথের নাম ছিল অনুপস্থিত। ফলত, ইংল্যান্ডের দরবার থেকে এই সম্মান স্বহস্তে গ্রহণ করার সুযোগ কবিগুরুর হয়নি।
কবির এই Knighthood খেতাব কিছুটা ব্যক্তিগত সখ্যতার সূত্র ধরেই এসেছিল বলা যায়। অযাচিত দান প্রত্যাখ্যান না করার স্বভাব সুলভ ভদ্রতা ও সংবেদনশীল মনের পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তা গ্রহণও করেছিলেন, যদিও পরবর্তীকালে খ্যাতির বিড়ম্বনায় বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। সম্মান পাওয়ার পর দেশ এবং বিদেশ থেকে বহু অপরিচিত পাঠকের অভিনন্দনপত্র তাঁর কাছে আসতে থাকে। সেসব চিঠির জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত কবি শেষে পিয়ারসনকে এক চিঠিতে বলেই ফেললেন “letters letters everywhere never a moment to think..”
তবে এত শুভেচ্ছার মধ্যে কিছু বক্রোক্তিও ছিল। ৫ জুন তারিখে অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে রবীন্দ্রনাথের Knighthood প্রাপ্তি সম্পর্কে লেখা হয়,
“We mast, however, confess that the old familiar names Dr. Rashbehari and Robi Babu sound sweeter in our ears than Sir Rashbehari and Sir Rabindranath.”
এরই মধ্যে, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। এই মহাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্ব এবং সেই সূত্রে ভারতবর্ষেও দ্রুত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন শুরু হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং তার সাথে জড়িত উগ্র জাতীয়তাবাদের দুর্লক্ষণগুলো রবীন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই সচেতন এবং মুখর ছিলেন। ১৯০১ সালে ‘বিরোধ মূলক আদর্শ’ প্রবন্ধে জাতি প্রেম সম্বন্ধে কবি লিখলেন,
“ মিথ্যার দ্বারাই হউক, ভ্রমের দ্বারাই হউক নিজেদের কাছে নিজেকে বড় করিয়া প্রমাণ করিতেই হইবে এবং সেই উপলক্ষে অন্য নেশনকে ক্ষুদ্র করিতে হইবে, ইহা নেশনের ধর্ম, ইহা প্যাট্রিয়টিজমের প্রধান অবলম্বন। গায়ের জোর, ঠেলাঠেলি, অন্যায় ও সর্বপ্রকার মিথ্যাচারের হাত হইতে নেশন-তন্ত্রকে উপরে তুলিতে পারে এমন সভ্যতার নিদর্শন তো আমরা এখনও য়ুরোপে দেখিতে পাই না।”
অনুরূপে, ১৯১৪ সালে ‘সবুজপত্র’তে প্রকাশিত ‘লড়াইয়ের মূল’ প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
“য়ুরোপের সেই প্রভুত্বের ক্ষেত্র এশিয়া ও আফ্রিকা। এখন মুশকিল হয়েছে জার্মানির। তাহার ঘুম ভাঙিতে বিলম্ব হইয়াছিল। সে ভোজের শেষ বেলায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত। ক্ষুধা যথেষ্ট, মাছেরও গন্ধ পাইতেছে অথচ কাঁটা ছাড়া আর বড় কিছু বাকি নাই। এখন রাগে তার শরীর গমগম করিতেছে। সে বলিতেছে আমার জন্য যদি পাতা পাড়া না হইয়া থাকে আমি নিমন্ত্রণ পত্রের অপেক্ষা করিব না আমি গায়ের জোরে যার পাই তার পাত কাড়িয়া খাইব।”
স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের কাছে সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের ব্যাপারে জার্মানে ব্রিটিশে খুব একটা ভেদাভেদ নেই। এই প্রবন্ধের একেবারে শেষেরদিকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,
“কিন্তু জার্মান পন্ডিত যে তত্ত্ব আজ প্রচার করিতেছে এবং যে তত্ত্ব আজ মদের মতো জার্মানীকে অন্যায় যুদ্ধে মাতাল করিয়া তুলিল সে তত্ত্বের উৎপত্তি তো জার্মান পণ্ডিত এর মগজের মধ্যে নহে, বর্তমান য়ুরোপীয় সভ্যতার ইতিহাসের মধ্যে।”
উগ্রজাতিপ্রেমজাত হিংসা ও তাঁর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বলপ্রয়োগের নীতি ইউরোপীয় দেশগুলিকে যে দুর্বলের প্রতি অত্যাচারে প্রলুব্ধ করছে, এবিষয়ে কবি নিঃসংশয় তা উপরের লেখাগুলি থেকেই স্পষ্ট। এই চিন্তা সূত্রটি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পরবর্তীকালে ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের হিংসাকে বিশ্লেষণ করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যখন এই কথা বলছেন তখন দেশে জাতীয় আন্দোলনের নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ প্রায় পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশদের সহায়তায় তৎপর। আবার অন্যদিকে চরমপন্থী আন্দোলনের নেতারা ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ – এই নীতি অবলম্বন করে জার্মানির সাহায্য প্রাপ্তির আশা করছেন।
এই প্রসঙ্গে দেশের মধ্যে ঘটে চলা বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত বিশ্লেষণ করাটা জরুরী। যুদ্ধ চলার সময়েই রবীন্দ্রনাথ জাপান আমেরিকা ঘুরে আসেন। এই দুই দেশে দেওয়া ন্যাশনালিজম সংক্রান্ত বক্তৃতাগুলি এদেশের সংবাদপত্রে আংশিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ওই বক্তৃতাগুলির বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন, এমনকি স্বয়ং চিত্তরঞ্জন দাশ পর্যন্ত প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভামঞ্চ থেকে কবির বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। ১৯১৭ সালে ১৬ জুন অ্যানি বেসান্ত কারারুদ্ধ হলে, রবীন্দ্রনাথ সংবাদপত্রে তার প্রতিবাদ করলেন। এর কয়েকদিন বাদেই (আগস্ট, ১৯১৭) ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টই ভারতের জাতীয় আত্মকর্তৃত্বের দাবি তোলেন।
“মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড় কথাটাই এই যে কর্তৃত্বের অধিকারই মনুষ্যত্বের অধিকার। …অতএব ভুলচুক এর সমস্ত আশঙ্কা মানিয়া লইয়াও আমরা আত্মকর্তৃত্ব চাই। আমরা পড়িতে পড়িতে চলিব, দোহাই তোমার, আমাদের এই পড়ার দিকে তাকাইয়া আমাদের চলার দিকে বাধা দিও না।…মানুষ আগে সম্পূর্ণ যোগ্য হইবে তারপর সুযোগ পাইবে এই কথাটাই যদি সত্য হয় তবে পৃথিবীতে কোন জাতিই আজ স্বাধীনতার যোগ্য হয় নাই । ডিমক্রেসির দেমাক করিতেছ! কিন্তু য়ুরোপের জনসাধারণের মধ্যে আজও প্রচুর বীভৎসতা আছে -সেসব কুৎসার কথা ঘাঁটিতে ইচ্ছা করে না। যদি কোন কর্ণধার বলিত এই সমস্ত যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ডিমক্রেসি তার কোনো অধিকার পাইবে না, তবে বীভৎসতা তো থাকিতই, আবার সেই পাপের স্বাভাবিক প্রতিকারের উপায়ও চলিয়া যাইত।”
এত স্পষ্ট ভাষায় আত্মকর্তৃত্বের কথা রবীন্দ্রনাথ কখনো উচ্চারণ করেননি এর আগে। সম্ভবত আমেরিকায় ন্যাশনালিজম বক্তৃতাগুলির পর্বে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কোন সদর্থক দিক তার চোখে পড়েনি, যা দেশে ফিরে জাতীয় প্রেক্ষাপট দেখে তার মনে হতে শুরু হয়।
এদিকে ১৯১৮ সালের জুন মাসে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এবং এর অল্পদিন পরেই ৮ জুলাই রাওলাট কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন পেশ হয়। এই প্রতিবেদনে ভারতের গণ-আন্দোলন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে দমন করার সুপারিশ ছিল। ফলে রিপোর্ট প্রকাশের সাথে সাথেই ইংরেজদের গূঢ় উদ্দেশ্যটি প্রকাশ হয়ে পড়লো। ১১ নভেম্বর সকাল ৫-টায় জার্মানি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করলো এবং এর ৬ ঘন্টা পর থেকে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হল। যুদ্ধোত্তর পর্বে দেশে নানা কারণে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই এর কারণে শ্রমিক অসন্তোষ, তুরস্কের ভবিষ্যৎ ও খিলাফত সমস্যায় এদেশীয় মুসলিমদের বিক্ষোভ দেশকে প্রায় বারুদের স্তূপের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। দেশব্যাপী প্রচণ্ড আন্দোলনের ইঙ্গিত পেয়ে ইংরেজ সরকার রাওলাট বিল পাস করানোর উদ্যোগ নিল। ৬ ফেব্রুয়ারি স্যার উইলিয়াম ভিন্সেন্ট কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভায় বিলটি উত্থাপন করেন। সভার ভারতীয় সদস্যগণের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ২১ মার্চ বিলের প্রথম খসড়াটি পাস হয়ে যায়।
রাওলাট আইনের প্রতিবাদে ৩০ এপ্রিল সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। দিল্লিতে শোভাযাত্রাকারি জনতার সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। কলকাতা অমৃতসর, বোম্বাই, আমেদাবাদে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। দিল্লি ও পাঞ্জাবের অবস্থা শান্ত করার উদ্দেশ্যে গান্ধীজি ৭ এপ্রিল বোম্বাই থেকে দিল্লি হয়ে অমৃতসরের দিকে রওনা হন কিন্তু পথিমধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং বোম্বাইতে ফিরিয়ে আনে। গান্ধীজীর গ্রেপ্তারে ক্রোধে ক্ষিপ্ত জনতা আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। অমৃতসরে ১০ এপ্রিল ড. কিচলু ও ড. সত্যপালকে পুলিশ অমৃতসরের জেলাশাসকের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে এবং অজানা জায়গায় অন্তরীণ করে রাখে। এই ঘটনায় অমৃতসর, কাসুর ও গুজরানওয়ালায় পুলিশের সাথে জনতার তীব্র সংঘাত শুরু হয়। পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার মাইকেল ও’ডায়ার কঠোর হাতে এই আন্দোলনকে দমন করতে উদ্যোগী হন। ১০ এপ্রিলেই পাঞ্জাবে মার্শাল ল’ জারি করা হয়।
পাঞ্জাব তখন কার্যত অবরুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনকে দূর থেকে, প্রায় একটি birds eye view থেকে লক্ষ্য করছিলেন। যখন দেখা গেল আন্দোলন সুশৃঙ্খল নেতৃত্বাধীন পথ ছেড়ে সহজাত বিপ্লবী প্রতিক্রিয়ার পথে চলতে শুরু করল তখন রবীন্দ্রনাথ ১২ এপ্রিল গান্ধীজিকে এক খোলা চিঠি লিখলেন। ১৬ এপ্রিল ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ পত্রিকায় ওই চিঠি প্রকাশিত হয়। অত্যন্ত মূল্যবান এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আশংকা প্রকাশ করলেন যে, অসংগঠিত গণসংগ্রামকে অশিক্ষিত জনতার হাতে ছেড়ে দিলে গণসংগ্রাম হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে শাসক তার নখ দন্ত বের করলে তার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। যাই হোক আন্দোলন যখন নেতৃত্বের হাত থেকে জনতার হাতে চলে গেল তখনই ১৩ এপ্রিল ১৯১৯, ঘটে গেল সেই বীভৎস জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। রবীন্দ্রনাথের আশংকাই সত্যি হল।
সেদিন প্রায় কুড়ি হাজার জনতার উপর জেনারেল ডায়ার অবিশ্রাম গুলি বর্ষণ করে। সরকারি হিসাবেই ৪০০ র কাছাকাছি নিহত ও ১২০০ জন আহত। বেসরকারি মতে এই সংখ্যাটা প্রায় চার গুণ। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ চেপে রাখতে চেয়েছিল। বিদ্রোহীদের ওপর অত্যাচার চলতে থাকে। প্রকাশ্যে চাবুক মারা, হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তা পার করানো, রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখা, ইউরোপীয় দেখলেই সেলাম ঠুকতে বাধ্য করানো ইত্যাদি সব চলছিল। এরই মধ্যে ১৫ এপ্রিল, লাহোরের নিকটস্থ গুজরানওয়ালায় বিক্ষোভকারীদের উপর বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করা হয়। সংবাদ সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় অমৃতসর শহর দেশের বাকি অংশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়েছিল।
সংবাদপত্রে দিল্লিতে পুলিশি অত্যাচারের খবর পড়লেও পাঞ্জাবে সংবাদপত্রের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ কোনো খবর পাচ্ছিলেন না। অবশ্য তাঁর সন্দেহ হয়েছিল সেখানে ভয়ানক কিছু নিশ্চয় ঘটেছে! রবীন্দ্রনাথ ও অ্যান্ড্রুজ তখন শান্তিনিকেতনে। যেটুকু খবর পাওয়া যাচ্ছিল তাতেই তিনি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলেন। ১৭ এপ্রিল, রবীন্দ্রনাথের সাথে পরামর্শ করে অ্যান্ড্রুজ দিল্লি চলে যান। ২০ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড্রুজকে পত্র লিখলেন। এই চিঠিটি পড়লে বোঝা যায় যে তখন পর্যন্ত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তেমন কিছু জানতেন না। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ স্মৃতিচারণে জানাচ্ছেন-
“.. পাঞ্জাবে যে কাণ্ড ঘটেছে তা নিয়ে সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে একজন লোকও প্রতিবাদ করবে না এটা কবির পক্ষে অসহ্য। অ্যান্ড্রুজ সাহেবকে মহাত্মাজীর কাছে পাঠালেন এক প্রস্তাব নিয়ে। তখন বাইরে থেকে পাঞ্জাবে লোক প্রবেশ করা নিষেধ হয়েছে। কবির ইচ্ছা যে মহাত্মাজী যদি রাজি থাকেন তবে মহাত্মাজী আর কবি দুজনে দিল্লিতে গিয়ে মিলবেন। সেখান থেকে দুজনে একসাথে পাঞ্জাবে প্রবেশ করার চেষ্টা করবেন। ওদের দুজনকেই তাহলে গ্রেপ্তার করতে হবে। এই হবে ওদের প্রতিবাদ। অ্যান্ড্রুজ সাহেব গান্ধীজীর কাছে চলে গেলেন।”
অ্যান্ড্রুজ সাহেব অসুস্থ শরীর নিয়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। রবীন্দ্রনাথ সুশীল রুদ্রের চিঠিতে দিল্লির আরো কিছু খবর পেয়ে ২৪ এপ্রিল অ্যান্ড্রুজ সাহেবকে একটি চিঠি লিখলেন। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে উদ্বিগ্ন কবি ব্রিটিশ সরকারের বিচার ও সততা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে একই দিনে দ্বিতীয় আর একটি চিঠি লিখলেন অ্যান্ড্রুজ সাহেবকেই। পরের দিন ব্রিটিশের সত্য গোপন আচরণকে ধিক্কার দিয়ে আবার একটি চিঠি লিখলেন অ্যান্ড্রুজ সাহেবকে। অ্যান্ড্রুজ সাহেব তখন শান্তিনিকেতনের বাইরে দিল্লির পথে।
উদ্বিগ্ন কবি তাতেও থাকতে না পেরে ২৬শে এপ্রিল মর্ডান রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে লিখলেন,
“এন্ড্রুজ দিল্লিতে। সেখান থেকে দুই একটা চিঠি যা লিখেচেন তাতে মনটাকে উত্তপ্ত করেছে। আমার মনের তাপমানযন্ত্র আমার কলম। সুতরাং তার ভাষাটা চড়ে উঠেচে। বর্তমান চিঠিখানি আজ লিখে মনে করলুম আপনার সম্পাদকী দরবারে তার নকল পাঠাই। এটা বর্ত্তমান দুর্য্যোগের দিনে প্রকাশযোগ্য হবে কিনা জানিনে। আপনি যা ভাল মনে করবেন”।
চিঠিটি যে খুব দ্রুত লেখা হয়েছিল এবং কবি চিত্ত যে ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিল, চিঠির ভাষায় তা বেশ বোঝা যায়। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ‘Sir Rabindranath Tagore’s letter to a friend’ শিরোনামে সেই চিঠি ‘Notes’ [The Modern Review May]- মাসের সংখ্যায় সেটি প্রকাশ করে দেন-
“I believe our outcry against the wrongs inflicted upon us by our governing power is becoming more vehement than is good for us. We must not claim sympathy or kind treatment with too great an insistence and intensity.”
ওদিকে অ্যান্ড্রুজ দিল্লিতে গান্ধীজিকে না পেয়ে পাঞ্জাবে ঢুকতে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাঁকে আটকায়। পুলিশ অ্যান্ড্রুজ সাহেবকে পরদিন বিকেলে দিল্লির ট্রেনে তুলে দেয়। তখন তিনি গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে বোম্বাই চলে যান। ১৬ মে গান্ধীজির সঙ্গেই বোম্বাই থেকে তিনি আমেদাবাদে ফেরেন। ৯ মে অ্যান্ড্রুজ সাহেবও কলকাতায় ফেরেন। ২২ মে রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো চলে আসেন। এই সময় একটি চিঠিতে তিনি রানু অধিকারীকে লেখেন,
“আকাশের এই প্রতাপ আমি একরকম সইতে পারি কিন্তু মর্ত্যের প্রতাপ আর সহ্য হয় না, তোমরা ত পাঞ্জাবে আছো, পাঞ্জাবের দুঃখের খবর বোধহয় পাও। এই দুঃখের তাপ আমার পাঁজর পুড়িয়ে দিলে। ভারতবর্ষে অনেক পাপ জমেছিল। তাই অনেক মার খেতে হচ্ছে। মানুষের অপমান ভারতবর্ষে অভ্রভেদী হয়ে উঠেছে।”
কলকাতায় আসার পর রবীন্দ্রনাথ পাঞ্জাবের খবর আরো বেশী করে পেতে থাকলেন। এতে তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তার নীলরতন সরকার তাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দিলেন। এদিকে ভারত রক্ষা আইন এর কবলে পড়ে দেশ নেতারা প্রায় সকলেই চুপচাপ। এরপরের ঘটনাও জানতে পারি প্রশান্তচন্দ্রের স্মৃতিচারণ থেকে,
“সকালবেলা পুরানো বাড়ির দোতলায় পশ্চিমদিকের বারান্দায় কবি বসে আছেন। অ্যান্ড্রুজ সাহেব আসতেই অন্য সব কথা ফেলে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি হলো? কবে যাবেন?’ অ্যান্ড্রুজ সাহেব একটু আস্তে আস্তে বললেন ‘বলছি সব’ – গুরুদেব কেমন আছেন, এইসব কথা পাড়ছেন কবি আবার বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন যে কি হলো? তখন অ্যান্ড্রুজ সাহেব বললেন যে গান্ধীজি এখন পাঞ্জাবে যেতে রাজি নন- “I do not want to embarrass the government now” – শুনে কবি একেবারে চুপ হয়ে গেলেন এ সম্বন্ধে আর কোন কথা বললেন না।”
এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। প্রশান্তচন্দ্র লিখছেন,
“… রাতে ভালো ঘুম হলো না। ভোর হয়নি হয়তো চারটে হবে উঠে স্নান করে বেরিয়ে পড়লুম। জোড়াসাঁকোয় গিয়ে দেখি দোতলার ঘরে আলো জ্বলছে। গরমের দিন দারোয়ানরা বাইরে খাটিয়াতে শুয়ে। তাদের জাগিয়ে দরজা খুলিয়ে উপরে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সিঁড়ির উপরের জানলা দিয়ে দেখলুম বসবার ঘরের উত্তর-পূর্বের দরজার সামনে টেবিলে বসে কবি লিখছেন। পূব দিকে মুখ করে বসে আছেন। পাশে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। আকাশ একটু ফর্সা হয়েছে কিন্তু ঘর তখনো অন্ধকার। আমি ঘরে যেতেই মুখ ফিরিয়ে বললেন, কী এসেছ? এই বলে আবার লিখতে আরম্ভ করলেন। দু তিন মিনিট। তারপরেই একখানা কাগজ হাতে দিয়ে বললেন পড়ো। বড়লাটকে লেখা নাইটহুড পরিত্যাগ করার চিঠি। আমি পড়লুম।
কবি তখন বললেন সারারাত ঘুমাতে পারিনি। বাস্ এখন চুকল। আমার যা করবার তা হয়ে গিয়েছে। মহাত্মাজি রাজি হলেন না পাঞ্জাবে যেতে। কাল তাই নিজেই গিয়েছিলুম চিত্তরঞ্জন এর কাছে। বললুম যে এই সময় সমস্ত দেশ মুখ বন্ধ করে থাকবে এ অসহ্য। তোমরা প্রতিবাদ সভা ডাকো, আমি নিজেই বলছি যে আমি সভাপতি হব। চিত্ত একটু ভেবে বললে,বেশ। আর কে বক্তৃতা দেবে? আমি বললুম সে তোমরা ঠিক করো। চিত্ত আর একটু ভাবলে,বললে, আপনি যদি সভাপতি হন তবে তার পরে আর কারুর বক্তৃতা দেওয়ার দরকার হয় না। আপনি একা বললেই যথেষ্ট। আমি বললুম, তাই হবে। এবার তবে সভা ডাকো। তখন চিত্ত বললে, আপনি একা যখন বক্তৃতা দেবেন, আপনিই সভাপতি, তখন সবচেয়ে ভালো হয় শুধু আপনার নামে সভা ডাকা। বুঝলুম ওদের দিয়ে হবে না। তখন বললুম আচ্ছা আমি ভেবে দেখি। এই বলে চলে এলুম। অথচ আমার বুকে এটা বিঁধে রয়েছে। কিছু করতে পারবো না, এ অসহ্য। আর আমি একাই যদি কিছু করি তবে লোক জড়ো করার দরকার কি? আমার নিজের কথা নিজের মত করে বলাই ভালো। এই সম্মানটা ওরা আমাকে দিয়েছিল। কাজে লেগে গেল। এটা ফিরিয়ে দেবার উপলক্ষ করে আমার কথাটা বলার সুযোগ পেলুম।”
প্রশান্তচন্দ্রের এই স্মৃতিচারণ থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত সেদিন এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদ করতে জাতীয় স্তরের কোন নেতাই রবীন্দ্রনাথের পাশে এসে দাঁড়াননি। দ্বিতীয়ত চিরকালের খেতাব বিমুখ রবীন্দ্রনাথ ইংরাজের দেওয়া এই খেতাব টিকে ব্যবহার করলেন তার নিজের কথাগুলি জোর দিয়ে বলার জন্য। খেতাবটা একটা উপলক্ষ মাত্র। ওটা আগেও তার কোনো কাজে আসেনি, বরং এখন নিজের কথাগুলো শোনানোর কাজে এসে যাওয়ায় কবি যেন খেতাবের একটা সার্থক ব্যবহার দেখতে পেলেন।
পরদিন সাত সকালে অ্যান্ড্রুজ সাহেব হাজির হলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। চিঠির ফাইনাল কপি লেখা শেষ হলে কবি পড়তে দিলেন অ্যান্ড্রুজকে। অ্যান্ড্রুজ চিঠিখানি পড়ে চিঠির ভাষা আর একটু মোলায়েম করে দেবার অনুরোধ করলেন কবিকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিলেন, অ্যান্ড্রুজ সাহেব রবীন্দ্রনাথের চোখে সেইরকম দৃষ্টি আর কোনোদিন দেখেননি। অ্যান্ড্রুজ লিখেছেন,
“Such a look as I had never seen in the eyes of Gurudev before or after.”
৩১ মে ১৯১৯ বড়লাট চেমসফোর্ডকে লেখা সেই অবিস্মরণীয় চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“হতভাগ্য পাঞ্জাবীদিগকে যে রাজদণ্ডে দণ্ডিত করা হইয়াছে, তাহার অপরিমিত কঠোরতা ও সেই দণ্ডপ্রয়োগবিধির বিশেষত্ব, আমাদের মতে কয়েকটি আধুনিক ও পূর্বতন দৃষ্টান্ত বাদে সকল সভ্য শাসনতন্ত্রের ইতিহাসে তুলনাহীন।… অন্ততঃ আমি নিজের সম্বন্ধে এই কথা বলিতে পারি যে, আমার যে সকল স্বদেশবাসী তাহাদের অকিঞ্চিৎকরতার লাঞ্ছনায় মনুষ্যের অযোগ্য সম্মান সহ্য করিবার অধিকারী বলিয়া গণ্য হয়, নিজের সমস্ত বিশেষ সম্মান-চিহ্ন বর্জন করিয়া আমি তাহাদেরই পার্শ্বে নামিয়া দাঁড়াইতে ইচ্ছা করি। রাজাধিরাজ ভারতেশ্বর আমাকে ‘নাইট’ উপাধি দিয়া সম্মানিত করিয়াছেন, সেই উপাধি পূর্বতন যে রাজপ্রতিনিধির হস্ত হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম তাঁহার উদার-চিত্ততার প্রতি চিরদিন আমার পরম শ্রদ্ধা আছে। উপরে বিবৃত কারণবশতঃ বড় দুঃখেই আমি যথোচিত বিনয়ের সহিত শ্রীলশ্রীযুক্তের নিকট অদ্য এই উপরোধ উপস্থাপিত করিতে বাধ্য হইয়াছি যে, সেই ‘নাইট’ পদবী হইতে আমাকে নিস্কৃতিদান করিবার ব্যবস্থা করা হয়।” (রবীন্দ্রনাথ কৃত বাংলা অনুবাদ)।।
৩রা জুন, ১৯১৯ সালে কলকাতার ইংরেজি ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ‘Honour Unwanted’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড সম্মান ত্যাগের সেই জ্বলন্ত পত্রটি। অন্যান্য ইংরেজি কাগজগুলো একই খবর ছেপেছিল। ভাইসরয়কে লেখা ওই পত্রের অনুবাদ দৈনিক বসুমতী সহ অন্যান্য বাংলা সংবাদপত্র ২ জুন প্রকাশ করেছিল। পত্রের বঙ্গানুবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তৎকালীন পত্রপত্রিকায় কিছু টীকা টিপ্পনিও বেশ কিছুদিন ধরে সংবাদ পত্রের পাতায় চলেছিল। সমালোচনার বয়ানে শোনা গেল, তাঁর ওই উপাধি গ্রহণ করাই গোড়ায় গলদ ছিল এবং তা ত্যাগ করে তিনি নাকি প্রায়শ্চিত্ত করলেন। ৩রা জুন তারিখে নায়ক নামের এক পত্রিকা সম্পাদকীয়তে লেখে,
“রবীন্দ্রনাথ উপাধী বর্জ্জন করিয়া নিজের সুবিধা কি করিয়াছেন তাহা জানি না, দেশের ও জাতির যে কোন সুবিধা করতে পারেন নাই, তাহা বলিবই। আমরা তাঁহার কার্য্যরে সমর্থন করিতে পারিলাম না।”
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সীতাদেবী লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বলেছিলেন,
“আমাকে এমন অপমান কেউ কখনও করে নি”।
খেতাব ত্যাগের পত্রটি সারা পৃথিবীর প্রতিবাদের ইতিহাসে একটা উজ্জ্বল মাইলফলক। নেপাল মজুমদার অপূর্ব মরমী ভাষায় সেই চিঠির মর্মবাণী বিশ্লেষণ করেছেন,
“সেদিনের সেই ঘোর দুর্যোগের অন্ধকারে দেশবাসীর সমস্ত অপমান ও লাঞ্ছনার কালিমা সবটুকুই কবি যেন একাই দুই হাতে সর্বাঙ্গে মাখিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের এই প্রতিবাদ পত্র সেদিন সারা দেশের মানুষের বুকে যে কি আশা-ভরসা ও সাহসের সঞ্চার করিয়াছে – যে কি বিপুল স্বজাত্যবোধ ও আবেগের সৃষ্টি করিয়াছে তা বলিয়া প্রকাশ করা যায়না। এই একটিমাত্র প্রতিবাদের মাধ্যমে সমগ্র জাতি যেন বিশ্বের দরবারে বিচার ও প্রতিকার মাগিয়াছে।”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অমল হোমকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,
‘‘দেশের বেদনার মধ্যে আমরা যেন নতুন করে পেলাম রবিবাবুকে। এবার একা তিনিই আমাদের মুখ রেখেছেন।’’
রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই প্রতিবাদপত্রটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। দেশের তৎকালীন নরমপন্থী রাজনীতির যে দৈন্যতা, হীনতা- তাকে রবীন্দ্রনাথ কোনদিনই সহ্য করতে পারেননি। আবার চরমপন্থী রাজনীতিকেও তিনি কখনো সমর্থন করেননি। স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয় আন্দোলনের যে স্বভাবজাত নৈরাজ্য সে বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি গান্ধীজিকে চিঠি লিখেছেন, আবার সহজাত কবিমন রবীন্দ্রনাথকে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পিছন থেকে টেনে রেখেছে। এইসব টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে তিনি যখন দীর্ণ হচ্ছেন তখন এই প্রতিবাদপত্রটি যেন সমস্ত দ্বন্দ্বের জাল ছিন্ন করে তাকে এক মুক্তির আশ্বাস এনে দিল।
অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এই লড়াইয়ে তিনি আক্ষরিক অর্থেই একা। দীর্ঘকাল ধরে পাঞ্জাবের সেই বীভৎস ঘটনার কোন প্রতিবাদ ভারতবর্ষের আর কোথাও হলো না। গান্ধীজীর নীরবতাও বড় অদ্ভুত। ইংরেজদের এই দমননীতি যে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের একটি বিশেষ ফলশ্রুতি তা গান্ধীজী মানতে চাইলেন না। অথচ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা এর ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতে দেখি। পরবর্তীতে জালিয়ানওয়ালাবাগের স্মরণদিবস উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ মহম্মদ আলি জিন্নাহকে যে লিখিত ভাষণটি পাঠান, তাতে তিনি লেখেন,
“আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে পাঞ্জাবে এক মহা পাপাচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মত পাপের এইরকম ভীষণ আকস্মিক প্রকাশ তাদের পশ্চাতে রেখে যায় – আদর্শের ভগ্নস্তূপের ও ভস্মাবশেষের আবর্জনা। চার বছর ধরে যে দানবীয় সংগ্রাম বিধাতার সৃষ্টিজগতকে আগুনে দগ্ধ ও বিষে জর্জরিত করেছে তারই আসুরিক ঔরস্য হলো এই জালিয়ানওয়ালাবাগ। …গত যুদ্ধে মানুষ সত্য ও সম্ভ্রমবোধকে যেভাবে পদদলিত করে আপন স্বভাবের মহত্বের প্রকাশকে নিয়তি লাঞ্ছিত করেছে তাতেই সম্ভব হয়েছে এই কাপুরুষতা। ... এই যে ক্ষমতাবানের কাপুরুষতা, তা এতটুকু লজ্জাবোধ করেনি অস্ত্রহীন ও অসতর্কিত গ্রামবাসীদের ওপর মারণাস্ত্র চালনার নিষ্ঠুরতায়, কিংবা কুৎসিত বিচার-প্রহসনের যবনিকার অন্তরালে, অকথ্য অবমাননা প্রয়োগে।”
জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাকে ভারতের আর কোন নেতৃবৃন্দই রবীন্দ্রনাথের মত এই বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করেছেন কিনা সন্দেহ। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের জন্য শাসক তথা সমগ্র সাম্রাজ্যবাদীশক্তিকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। অথচ, ১৯১৯-এর অমৃতসর কংগ্রেসে ইংরেজির অত্যাচার ও বর্বরতার বিরুদ্ধে সভা কাঁপানো অনেক বক্তৃতা হয়েছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উপাধি ত্যাগ এবং সেই ঐতিহাসিক প্রতিবাদপত্রটি সম্পর্কে একটি বাক্যও কাউকে বলতে শোনা যায়নি। অমল হোম এই বিষয়ে একটি ধন্যবাদ সূচক প্রস্তাব গ্রহণ করানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই মর্মে তিনি যথাক্রমে কংগ্রেস সভাপতি মতিলাল নেহেরু, জিতেন বাঁড়ুজ্জে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, লালা মনোহর লাল, জওহরলাল নেহেরু, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, বিপিনচন্দ্র পাল, কামিনী কুমার চন্দ, অখিল চন্দ্র দত্ত প্রমুখদের সাথে আলোচনাও করেন। কিন্তু সবাই সুকৌশলে ব্যাপারটিকে এড়িয়ে। এমনকি, ৬ জুন শ্রীনিবাস শাস্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের জ্বলন্ত প্রতিবাদকে ‘Premature’ আখ্যায়িত করেন ও পরবর্তী বেশ কিছু লেখায় তিনি কবিগুরুর নামের আগে ‘Sir’ ব্যবহার চালিয়ে যান।
বিদেশেও এই নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। সেখানের পত্রপত্রিকায় অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ডেইলি হেরাল্ড লেখে ‘কবি ্রো.-জার্মান বা অ্যান্টি-ব্রিটিশ নন। ভারতীয় নেতারা যে উপাধির খাতিরে তাদের জন্মগত অধিকার ত্যাগ করবে না, রবীন্দ্রনাথ এর চিঠিপত্র থেকে তা স্পষ্ট হচ্ছে।’ ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান লিখলো ‘কবি যে সব কথা বলেছেন সে সম্পর্কে অবিলম্বে ভারত সরকারের তদন্ত করা প্রয়োজন।’ আবার Englishman পত্রিকা ব্যাঙ্গের সুরে লিখল,
“It will not make a ha’porth worth of difference. As if it mattered a brass farthing whether Sir Rabindranath Tagore approved of the Government’s policy or not! As if it mattered to the reputation the honour and the security of British rule and justice whether this Bengali poet remained a knight or a plain Bengali Babu”
তবে এই ঘটনায় ইংল্যান্ডে কবির কিছু বন্ধুবিচ্ছেদও হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীকে লিখেছিলেন,
“ওদের ওটা খুব অপমান লেগেছিল। তারপর ইংল্যান্ডে গিয়ে দেখলাম ওরা সে কথা ভুলতে পারছে না। ইংরেজ রাজভক্ত জাত। রাজাকে প্রত্যাখ্যান তাই আঘাত দিয়েছিলো ওদের।”
রবীন্দ্রনাথ উপাধি ত্যাগ করলেও ব্রিটিশরা সরকারি ভাবে উপাধি ফেরত নেয়নি কোনো দিন। কারণ তারা বুঝেছিল ফেরত নেওয়া হলে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে মান্যতা দেওয়া হবে। চতুর চেমসফোর্ড সেই ঝুঁকি নিতে চাননি। ১১ জুন ১৯১৯, একটি ‘ প্রাইভেট’ টেলিগ্রাম এ তিনি ভারত সচিব মন্টেগুকে জানান,
“A letter dated 31st May, has been addressed to me by Rabindranath Tagore announcing his desire to resign Knighthood, Which was conferred on him in June 1915, as a protest against by policy followed by Government in dealing with the recent troubles in the Punjab….. I propose to reply, in view of the advertisement that would be given to Tagore and of the fact that grant of his request might be interpreted as admission of mistaken policy in the Punjab, that I am unable myself to relieve him of his title and in the circumstances, do not propose to make any recommendation to His Majesty on the subject.”
Macmillan কোম্পানি উপাধি ত্যাগের বেশ কিছু বছর পরেও তাদের প্রকাশিত বইতে কবির নামের আগে স্যার উপাধি বসাতে থাকে। এই সব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মাঝে উজ্জ্বল রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ঘটনাটি। উপাধি ত্যাগের পরে পরেই, রামেন্দ্রসুন্দর তখন মৃত্যুশয্যায়, রবীন্দ্রনাথকে তিনি জানালেন-
‘আমি উত্থানশক্তিরহিত, আপনার পায়ের ধুলা চাই।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন ও তাঁর অনুরোধে প্রতিবাদপত্রটি পড়ে শোনান।
রামেন্দ্রসুন্দর কবির পায়ের ধুলা মাথায় নিয়ে তন্দ্রায় নিমগ্ন হলেন। তার সেই তন্দ্রা আর ভাঙ্গেনি। উপাধি আছে না নেই এই বিতর্ক যখন মাঝে মাঝেই কবিকে বিব্রত করে চলেছে, তখন ১৯২৬ এর ফেব্রুয়ারি মাসের মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে এই বিতর্কে যবনিকা টেনে দেন। সেই চিঠিতে তিনি জানালেন,
“Being aware that if discussion has been raised in regard to my Knighthood. I feel it right to put clearly my own view of it before the public. It is obvious that it was solely to give utmost emphasis to the expression of my indignation at the Jaliwanwalabag massacre and other deeds of inhumanity that followed it that I asked lord Chelmsford to take it back from me…… I was driven to it when I hoplessly failed to persuade our political leaders to launch an adequate protest against what was happening at that time in the Punjab.”
এই বিতর্কে তাঁর এই শেষ চিঠি। এখানেও তিনি দ্ব্যর্থহীন। প্রতিবাদে ও প্রত্যাখ্যানে একাকী কিন্তু একক।
কলমে - কমলেন্দু সূত্রধর
তথ্যসূত্রঃ-
1. রবীন্দ্রনাথ ও নাইটহুড; প্রাপ্তি পরিত্যাগ প্রতিক্রিয়া - অত্রি গোলুই
2. জালিয়ানওয়ালাবাগ : পদত্যাগে দেরী কেন? - শিবানন্দ পাল
3. রবিজীবনীঃ সপ্তম খণ্ড - প্রশান্ত কুমার পাল
4. মংপু তে রবীন্দ্রনাথ - মৈত্রেয়ী দেবী
5. চিঠিপত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
6. ‘মর্তের প্রতাপ আর সহ্য হয় না’ - অভীক কুমার দে, পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, রবীন্দ্র সংখ্যা ১৪০৫.
7. The STATESMAN An Anthology Compiled by Nilanjan Majumdar, The Statesman, 1975.
8. প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ - ড. মিল্টন বিশ্বাস
9. প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ - হাবিবুর রহমান স্বপন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন