প্রতিবারের মত এবারও প্ল্যাটফর্মে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা। সমান্তরাল লাইনের উপর দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল। সময়ের সাথে সে পৌঁছে যাবে তার গন্তব্যে। মুখ বের করে পিছনে ফিরে তাকাল নীপা। প্ল্যাটফর্মের সাথে দূরত্ব বাড়ছে। বাবার শরীরটা আড়াল হতে হতে এক সময় মিলিয়ে গেল। গতি বাড়ছে ট্রেনের। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে। অপ্রত্যাশিত এক বাস্তবের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে নীপা। মাকে সেই কথাটা বলতেই বাড়িতে এসেছিল । সারারাত নিজের সাথে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানাতে পারেনি। তাই হয়ত, এই পালিয়ে আসা। প্রতিনিয়ত একটা অপরাধবোধ আর আত্মগ্লানি ভেঙ্গে চুড়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে তাকে। অনেকক্ষণ কষ্টটাকে নিজের মধ্যে আটকে রেখে ছিল। আর পারল না। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। প্রতি মূহুর্তে পিছনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের ছায়া ঘেরা মেঠোপথ। মাটির ঘর, দড়িতে শুকাতে দেওয়া ছেঁড়া কাঁথা, জীর্ণ বাঁশের বেড়া, পুকুরের জলে হাঁসের দল, আবার কোথাও ফেলা রাখা অসমাপ্ত পাকা বাড়ী। শ্যাওলা জমা পুকুর ঘাট, পুরোনো বটগাছ, মজা পুকুর, জলে ডোবা খাল-যেমন ছিল, সব তেমনই আছে। শুধু বদলে গেছে নীপা। অতীত তার সামনে । সেই পুরানো স্মৃতি …।
ইউনিভারসিটি এলাকার পূবের রাস্তাটা প্রায় সময়ই নিস্তব্ধ। শীতের সকাল। কুয়াশায় ঢাকা চারিদিক। নিপা সেদিন একাই ছিল। ফুটপাতে ঘিরে থাকা কিছু মানুষ দেখে উৎসুক হয়ে এগিয়ে যায় সে। পড়ে আছে বিবস্ত্র, ধর্ষিত মৃত এক কিশোরীর শরীর। অন্য সবার মত সেও অপ্রস্তুত। দাঁতের কামড়ে ক্ষত বিক্ষত নেতিয়ে পড়া শীর্ণ স্তন। গলায়, গালে নখের আঁচড় । দুই উরুর মাঝ থেকে রক্ত গড়িয়ে জমাট বেঁধে আছে ফুটপাতে। হোক না মরা, তাকে কি? মেয়ে ছেলের শরীর তো। তার উপর নিশ্চয় খারাপ মেয়ে ছেলে!
- দেখ, দেখ ভালো করে দেখে নে।
- একেবারে লাইভ। এমন সুযোগ কদাচিৎ মেলে।
- বুকটা একটু হাত দিয়ে দেখা যায় না।
এমনি আরো কত কথা। কত গুঞ্জন। হঠাৎই
একটা ছেলে এগিয়ে আসে।
- আপনার গায়ের চাদর টা দেবেন বোন।
সানন্দে গায়ের চাদরটা খুলে দিয়েছিল নীপা। সেই মূহুর্তে তার মনে হয়েছিল, কামনা আর লালসায় জর্জরিত, হিংস্র লোলুপ অমানুষ গুলোর গালে সজোড়ে যেন চড় কষে দিয়েছে ছেলেটি। চাদরটা নিয়ে মৃত সেই শরীরটা ঢেকে দিয়েছিল সে। নাম পরিচয় জানার ইচ্ছা থাকলেও সেদিন সুযোগ হয়নি। ক্লাসের অবসরে, হোষ্টেলে ফেরার পথে মনের মাঝে ছেলেটির মুখ এসে উঁকি দেয়। দেখা হোক, আরো একবার।
কয়েকটা দিন যেতে না যেতে সত্যি আবার দেখা হয়। শীতের সাথে এবার নিম্নচাপ, ২/৩ দিন টানা বৃষ্টি। সাথে ঝড়ো হাওয়া। বৃষ্টিতে ভিজে ছেলেটি হাঁটছিল ফুটপাতে। রিক্সা থামিয়ে নীপা তুলে নিয়েছিল তাকে। এরপর …। বাড়ে ব্যাকুলতা। ইমনের চোখে চোখ রাখার ব্যাকুলতা, কথা বলার ব্যাকুলতা। দেখা হয়, কথা হয়। ইচ্ছায়-অনিইচ্ছায়। বেলা-অবেলায়। ইউনিভার্সিটির করিডোরে, শান বাঁধানো পুকুর পাড়ে, কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে। নীপা তাকে একদিন লিখে পাঠিয়েছিল,
“প্রহর শেষের রাঙা আলোয়,
সেদিন চৈত্র মাস।
তোমার চোখে দেখেছিলাম, আমার সর্বনাশ।”
প্রতি উত্তরে সে, যে চিরকুটটা পেয়েছিল তাতে লেখা
ছিল,
“যদি থাকি কাছাকাছি
দেখিতে না পাও ছায়ার মত আছি না আছি-
তবু মনে রেখো।
যদি জল আসে আঁখি পাতে,
একদিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।”
রেল লাইনের পাশেই বস্তি। তার মালিকানা
নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ। অন্ধকারাচ্ছন্ন
গলি। গলির ওপারে গলি। গলির দু'পাশে খুপরি ঘর। ঘরের চার পাশ- টিন,
কাঁঠ, ইট সব মিলিয়ে। আর উপরের ছাদটুকু নীল পলিথিনে ছাওয়া। ফাঁক ফোকর দিয়ে দিনের
যেটুকু আলো আসে সেটুকুই। তাছাড়া ঘরের মধ্যে দিন রাতের কোন পার্থক্যে নেই। যত্রতত্র
ছড়িয়ে থাকা ময়লার দুর্গন্ধে ভারী হয়ে ওঠা বাতাসে অনবরত মাছি ঘোরে। সন্ধ্যায় মশা নামে। অবৈধ লাইনে ঘরে ঘরে বাতি
জ্বলে। বেশির ভাগ পুরুষ রাতে মদ খেয়ে ঘরে ফিরে টাকা পয়সা নিয়ে বৌ-এর সাথে ঝগড়া করে। বৌকে পরপুরুষের সাথে সন্দেহ করে। গায়ে হাত তোলে। রান্না, খাওয়া, ঘুমের সাথে সাথে প্রজন্ম থেকে
প্রজন্মের বাস -এক ঘরে। শুধু তাই নয়, দিনের আলোতে দড়িতে ঝুলতে থাকা কাপড়ের আড়ালে ঘরের এক কোণে কাপড় বদলানো কিংবা রাতের অন্ধকারে শারীরিক চাহিদা পূরন-সবই এক ঘরে। গভীর এই
রাতটুকু ছাড়া সকাল হতে না হতেই আবার সরগরম হয়ে উঠে বস্তি। কলতলা থেকে আগে জল নেওয়া
নিয়ে শোরগোল, লাইনে দাড়ানো নিয়ে, কলসি-বালতি সরানো নিয়ে শোরগোল। ময়লা ফেলা নিয়ে শোরগোল -কোন দিনই এর ব্যত্যয় ঘটে না। এই বস্তির বেশীর ভাগ পুরুষ
রিক্সা চালায়। বাসের হেলপার, কন্ট্রাকটারগিরি ও করে কেউ কেউ।
আটটা বাজার আগেই গামের্ন্টেসের মেয়েরা দুপুরের খাবার টিফিন বক্সে নিয়ে বাস ধরে।
অবশ্য যে সব বৌ ঝি রা বাসা বাড়িতে কাজ করে তারা বের হয় সবার আগে। যখন সময় সুযোগ
আসে, স্বামী কিংবা পরিচিত কারো কারো সাথে কনস্ট্রাকশনের
কাজে যায় যোগালে হিসাবে। সপ্তাহে দুদিন এন.জি ও থেকে মেয়েরা আসে। বাচ্চাদের তাদের
স্কুলে পাঠাবার কথা বলে। গর্ভবতী মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে টিকা
নেওয়ার কথা বলে। আর বৌদের জন্ম নিরোধক বড়ি দিয়ে যায় যাতে করে বছর বছর তাদের পেটে
বাচ্চা না আসে। উঠতি বয়সের ছেলেদের রকে বসে মেয়েদের শরীর নিয়ে আড্ডা দেওয়াই এদের
একমাত্র কাজ। আরো আছে নেশা। বস্তির আশে পাশের এলাকায় - পঁচা ডোবা, রেল কর্তৃপক্ষের পরিত্যক্ত ভবন, চায়ের টং ঘর। চায়ের দোকানে সিগারেটের আড়ালে বিক্রি হয় হেরোইন। বিকাল হতে না
হতেই এই সব ভবনে বসে- গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনের আসর। বিকাল গড়িয়ে
সন্ধ্যা নামে। অন্ধকার গাঢ় হয়। চায়ের দোকানে ইয়াবা বেচা কেনা বাড়ে। ফেনসিডিলের
বোতল গড়াগড়ি খায়। স্ট্রীট ল্যাম্পের উপরে আলোর প্রখরতা বাড়ে। পতঙ্গ এসে জমা হয়, আর নীচে তার ক্ষীন আলোয় বস্তির রাশেদ,
হামিদুল, মিনু, শিখা, স্বপ্না, মানিক, রাজা আর তুহিনাকে নিয়ে পড়াতে
শুরু করে ইমন। আজ চারদিন হল, মিনু মেয়েটা অনুপস্থিত।
আইসক্রিমের লোভ দেখিয়ে নির্মাণাধীন বিল্ডিং এ নিয়ে গিয়ে ২/৩ জন মিলে সারা রাত ধরে
ধর্ষন করে বস্তির কাছে ঐ বড় রাস্তার ধারে ফেলে রেখে গেছে। হাসপাতালের বারান্দায়
শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে মেয়েটি।
কলাভবনের বকুলতলা থেকে ফুল কুড়িয়ে এনে ইমন দিয়েছিল নীপাকে। সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে শুকনো বকুলের তীব্র গন্ধ। জানালার কাছে এসে দাড়ায় নীপা। দেওয়ালের কার্নিশে বিদায়ী রোদ। বিদ্যুতের তারে বসে আছে সারি সারি কাক। নীপার প্রতিটি ক্ষন, প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি একা থাকার মূহুর্তে মিশে এক হয়ে আছে ইমন। কখনো ক্লাস, কখনো পরীক্ষা শেষে ওরা গিয়ে বসে বিজ্ঞান অনুষদের কৃষ্ণচূড়া কিংবা চারুকলার ছাতিম গাছের নিচে। মন্ত্র মুগ্ধের মত ইমনের বলা প্রতিটি কথা শোনে নীপা। ইমন বলে, বস্তির কথা। বস্তির মানুষের দুঃখ, কষ্ট, আশা-আকাঙ্খার কথা। যেখানে প্রতিনিয়ত ক্ষুধা আর দারিদ্রতার কাছে হেরে যায় ভালবাসা, বিশ্বাস, ন্যায়নীতি, মূল্যবোধ আর বেঁচে থাকার স্বপ্ন। বাঁচার জন্য এদের সংগ্রাম প্রতিনিয়ত। নিরুত্তাপ দীর্ঘ জীবন শুধু কাটে এক চিলতে রোদ্দুদের অপেক্ষায়। শৈশবে স্কুলে গিয়ে বই এর সাথে পরিচয় হবার পরিবর্তে শিশুদের পরিচয় হয় ক্ষুধা আর বঞ্চনার সাথে। শৈশব চাপা পড়ে ভিক্ষাবৃত্তি আর শিশু-শ্রমের আড়ালে। অনাহার, অপুষ্টি, রোগ এদের নিত্য সঙ্গী। আধিপত্য, লোভ আর লালসার কাছে জিম্মি বস্তির অসহায় মানুষ। ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার, বস্তির দখল নেওয়া, ভাড়া তোলা নিয়ে দ্ব›দ্ব- এই সব কারনে আগুন লাগায় বস্তির মালিকেরা। অতিকষ্টে জমানো সঞ্চয় নিঃশেষ হয়। মায়ের কোল খালি হয়। বস্তির ভালবাসাহীন কিশোর, তরুন জীবন গুলোকে নেশার জগতে নিয়ে আসে কখনো রাজনৈতিক নেতা। কখনো মাদক ব্যবসায়ী। চাকুরীর প্রলোভনে মেয়েরা পাচার হয় দেশের বাইরে কিংবা হারিয়ে যায় পতিতালয়ের অন্ধকার জগতে। এ এক বিশাল চক্র। ভোট আসে, ভোট যায়। ক্ষমতা বদল হয়, শুধু ভাগ্যে বদল হয় না বস্তির মানুষের। ইমনের চিন্তা, চেতনা, তার কথা শুনতে শুনতে মগ্ন হয় নীপা। বুঝতে পারে শুধুমাত্র রক্ত মাংসের শরীরকে আশ্রয় করে কিংবা গৎ বাঁধা সংসারে আটকে থাকার ছেলে নয় ইমন। বাতাস বয়ে যায়। অনতি দূরে চারুকলার পুকুরের জলে নীল আকাশের ছায়া ভাসে । বর্ষার জল পেয়ে পুকুরের গাঁ ঘেষে তরতরিয়ে বেড়ে উঠা হেলেঞ্চা, কলমিলতার ডগায় জড়িয়ে থাকে ঢেঁড়া সাপ। উড়ে চলে জল ফড়িং। বাতাসে মাটির গন্ধের সাথে আরও এক বুনো গন্ধ। নীপার পরনে নীল শাড়ী, কপালে কালো টিপ, ইমনের হাতটা ছুঁয়ে সে বসে থাকে ছাতিম গাছের নীচে। দুজনেই নির্বাক। যেন নিস্তবদ্ধতার মাঝে বয়ে চলে দুটি হৃদয়ের অব্যক্ত কথা। দিন ফুরায়। পাখি ফেরে। ডালে ডালে তার কলতান। গোধূলির শেষ আলোটুকু নিয়ে সূর্য ডোবে পশ্চিম আকাশে। সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু মিশে যায় অন্ধকারে। বর্ষার পর বৃষ্টি ধোয়া শরতের আকাশে এক ফালি চাঁদ উঠে।
আগামী সপ্তাহ থেকে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু নীপার। শরীরটা ভাল নেই। টেবিলে বই নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর- স্বপ্নটাও ফিরে এসেছিল। একই স্বপ্ন। মেঘে ঢাকা দিনের মত অন্ধকার। ছাই রঙা আকাশ। কুয়াশা আর মেঘ এর এক সাথে মাখামাখি। উতলা বাতাস। নেশা ধরানো মহুয়া ফুলের গন্ধ। মেঘ সরে যেতেই দেখা যায় পাহাড়। সেই পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে খরস্রোতা ঝর্না। ছোট ছোট পাথর, নুড়ি ডিঙ্গিয়ে জলের বয়ে চলার শব্দ। সামনে অতলান্ত খাদ। শুধুই শূন্য। একই সাথে ছিল ওরা দুজন। হঠাৎই যেন হারিয়ে যায় ইমন। আর সেই খাদের সামনে দাঁড়িয়ে নীপা চিৎকার করে খুঁজে ফেরে ইমনকে। তবে আজ এই স্বপ্ন এখানেই শেষ হয় না। নীপার কপালে একটা চুমু দেয় ইমন। তারপর বলে,
-বলেছিলাম তো, আমৃত্যু থাকব তোমার সাথে। আমৃত্যু নয়,
... একজনম ও
নয়, জন্ম জন্মাত্তর আমি শুধু তোমার।
ঘুম ভেঙ্গে যায় নীপার। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমেছে। উর্মি, সীমা কেউই ফেরেনি এখনো। ঘর অন্ধকার। নীপা উঠে গিয়ে আলো জ্বালায়। জল খায়। বই
নিয়ে বসে। তার দেখা স্বপ্ন, ইমনের কন্ঠস্বর, সেই স্পর্শের উষ্ণতা- সব কিছুর আবেগ এখন ও ঘিরে আছে তাকে। তবুও- কোন এক
অজানা আশঙ্কায় মনটা বিষিয়ে আছে তার। পরীক্ষা শেষে আতিক,
শাওন ওরা দুজনেই এখন
বাড়িতে। ইমন আজ একাই গিয়েছে বস্তিতে পড়াতে । চেনা কন্ঠস্বর শোনার আশায় ইমনকে ফোন
দেয় নীপা।
বস্তির এই ঘর গুলো অন্য ঘরের মত নয়। শরাফতের এই দু/তিনটে ঘরে টিভি, ফ্রিজ, শোকেস, দামী পর্দা সবই আছে। এই এলাকার কাউন্সিলারের সাথে মাদকের ব্যবসা তার। তাই ত থানা পুলিশ থাকলেও তার ব্যবসা চলে নির্বিঘ্নে। কিন্তু আজ হঠাৎ-ই গোপন সূত্রের ভিত্তিতে বস্তিতে অপারেশন চালাতে আসে পুলিশ। বড় রাস্তায় পুলিশের দু/তিন খানা জীপ দাঁড়িয়ে। পুলিশ দেখেই শরাফতের লোকজন ইট পাটকেল ছোঁড়ে পুলিশর দিকে। গলির ভিতরে মুদির আর ওষুধের দোকানে ভাংচুর চালায়। বস্তির ঘরের দরজাগুলো একে একে সব বন্ধ হয়। পুলিশ টিয়ার শেল, কাঁদুনে গ্যাস ছড়ায়। উভয় পক্ষের সাথে সংঘর্ষ । ছেলে মেয়ে গুলোকে যার যার ঘরে পৌঁছে দিয়ে রুনুদের ঘরের পাশ দিয়ে আসতেই পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ইমন। উত্তপ্ত সীসার গুলিটা তার বুকের মধ্যে। চারিদিকে রক্ত, কি অসহ্য কষ্ট। চোখের সামনে ভেসে আসছে মায়ের মুখ। রোদে পুড়ে সাইকেল নিয়ে বাবা ফিরছে স্কুল থেকে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ। লাল বেনারসী পড়ে ঘরের দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে নীপা। আবছা আবছা দৃষ্টিতে চোখের সামনে আরো ভাসছে মায়ের জঠরে কুন্ডলীকৃত একটি অপরিণত শিশু। আর চার পাশে ধ্বনিত হচ্ছে একটি শব্দ ... বা ... বা ... । অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিক। গভীর কালো অন্ধকার। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ইমনের। ঘুম পাচ্ছে তার। গভীর ঘুম।
বার বার ইমনকে ফোন করছিল নীপা। কিন্তু প্রতিবারই একই উত্তর -সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। একটা অজানা আশঙ্কা আর উদ্বেগে চাইলেও বইয়ের পৃষ্ঠায় মন বসাতে পারেনি। রাতে ডাইনিং হলে গিয়ে চোখ আটকে গেল টিভির ব্রেকিং নিউজ এ। সব চ্যানেলে একই খবর। একই চিত্র। যে বস্তির ছেলে মেয়েদের ইমন পড়াতে যায়, সেই বস্তির ঘটনা। মাদক ব্যবসায়ীর সাথে পুলিশের বন্দুক যুদ্ধ। সফল অভিযান সম্পন্ন। অজ্ঞাত পরিচয় এক মাদক ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার। পাগলের মত চ্যানেলগুলো পরিবর্তন করতে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি আহত দুই জনের নাম দেখাচ্ছে। কিন্তু ইমনের নাম নেই সেখানে। আর কোন কিছুই দেখা বা শোনার অবস্থায় থাকে না নীপা। পুরো পৃথিবীটা যেন কেঁপে উঠে তার সামনে। নিজের অজান্তেই তলপেটটা চেপে ধরে সে।
ঘরে ফিরে আবারও ফোন। একে একে পরিচিত সবার কাছে খোঁজ নেওয়া শেষ। কিন্তু ইমনের কোন সংবাদ নেই। অফিসরুমে গিয়ে বাইরে বের হতে চায় নীপা। কিন্তু অনুমতি মেলে না। ঘরে ফিরে আসে। একই শহরে তারা দুজন। অথচ ইমনের, কোন খোঁজ সে পাচ্ছে না। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে ওর কন্ঠস্বর টা শোনার জন্য বুকের মধ্যে হাহাকার। পাগলের মত সে কিছুক্ষণ পরপর চেষ্টা করেই চলে। হ্যঙারে ইমনের দেওয়া শাড়ী ঝুলছে। টেবিলে রাখা আছে ওর দেয়া চুড়ি, কানের দুল। জানালার কাছে গিয়ে দাড়ায় নীপা। বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি। চির চেনা পিচ ঢালা পথটা এখন নিরব নিস্তব্ধ। কোন কোলাহল নেই। ইমনকে হারাবার ভয় ধীরেধীরে গ্রাস করতে থাকে নীপাকে। দুঃসহ এক যন্ত্রনা। সময়টা যেন থমকে আছে। এই কারনেই কি ইমনকে হারিয়ে ফেলার ভয় সব সময় ঘিরে থাকত তাকে? এই কারনেই কি গভীর খাদের সেই স্বপ্ন বার বার ফিরে আসে তার কাছে। আজ ইমনের ঐ আকুতি ভরা চোখ দুটো কি বলতে চেয়েছিল তাকে? জোড়ে বৃষ্টি শুরু হয়। সেই বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিতে থাকে নীপাকে। স্মৃতি বিস্তৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া নয়। মাস দুয়েক আগেকার একটি ঘটনা সামনে এসে দাঁড়ায় তার। কদিন বেশ জ্বরে ভুগছিল ইমন। ক্লাস শেষে দুপুরে নীপা গিয়েছিল ওর সাথে দেখা করতে। সারা আকাশ জুড়ে সমুদ্রের ঢেউ এর মতে একর পর এক মেঘ জমেছিল। নিভে গিয়েছিল দিনের সব আলো। মধ্য দুপুরেই নেমে এসেছিল মধ্য রাতের অন্ধকার। সেদিন ও এমন গভীর বৃষ্টি নামে। ঝাপসা হয়ে উঠে জানালার কাঁচ। বিদ্যুতের অনুপস্থিতিতে ঘরের বাতি নেভে। বাইরের বৃষ্টির সাথে ঝড় সেদিন ওদের দুজনের হৃদয়ে আবেগের ঝড় তোলে। এক অমোঘ আকর্ষণে মোহবিষ্ঠ দুজনে। অসংযমী হয়ে পড়ে দুটি মন। আবেগের আচ্ছন্নতায় ভেসে যায় ন্যায়-অন্যায়। বৈধ-অবৈধ। নিপাত যায় গোটা দুনিয়ার বারণ।
বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে মেঘ ডাকার শব্দে বাস্তবে ফিরে আসে নীপা। ঘড়ির দিকে
তাকায় সে। রাত তিনটা । আবার ফোন দেয় সে ইমনকে। উত্তর নেই। চোখের সামনে বার বার
ফিরে আসছে টিভিতে দেখানো সেই একই দৃশ্য। চাটাই এ পেঁচানো লাশ নিয়ে পুলিশের গাড়ি
ছুটে চলেছে রাজপথ ধরে। নীপার মনের মধ্যে দ্বৈত স্বত্তার যুদ্ধ। তার বুদ্ধি, যুক্তি, সাক্ষ্য প্রমান সব কিছু বলছে
চাটাই এর আড়ালে লাশটি অন্য কারো নয়। সে ইমন। মনের অন্য একটি স্বত্তা সব আশঙ্কা
অবদমিত করে সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে শুধু বলছে “এ মিথ্যা, এ হতে পারে না।“ মনের
কোনে ইমনের বেঁচে থাকার বিশ্বাস আর আশা নিয়ে রাত শেষ হবার প্রতীক্ষায় জানালার কাছে
দাঁড়িয়ে থাকে নীপা।
আকাশ জুড়ে ছেয়ে থাকা মেঘ আজ সকালের আলো ছড়াতে দেয়নি। ভোর রাত পর্যন্ত বৃষ্টি
হয়েছে। এখনো ভিজা বাতাস বইছে। থম-থমে আকাশ। গত কালের ঘটনার পর ধর পাকড়ের ভয়ে
বস্তির ঘরগুলো আজ পুরুষ শূন্য। তাই মেয়েদের কলঘরের সামনে আজ ফাঁকা। তবে, আশে পাশের উঁচু ভবনের কেউ কেউ মেয়েদের স্নান এর স্নিষিদ্ধ দৃশ্য দেখার
আকর্ষনে আজও দাঁড়িয়ে। ঘরের উনুন গুলোতে কালিওয়ালা তলা থ্যবড়ানো এলুমিনিয়ামের
হাড়িতে কোথাও সাদা ভাত ফুটছে টগবগিয়ে, কোথাও বা চায়ের জল। শুধু আজও
আগুন জ্বলেনি শিরিনের ঘরে। বিলাপ করে কাঁদছে সে। চার বছরের রুগ্ন নির্জীব সন্তান
দুটি দাঁড়িয়ে আছে মায়ের শরীর ঘেঁসে। প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করত শিরিনের স্বামী।
কারখানায় লাগা আগুনে পুড়ে মারা গেছে। লাশ চেনার উপায় নেই। ডিএনএ পরীক্ষা চলছে। লাশ
পেতে এখনো ১৫/২০ দিন বাকী। ছয় মাসের ঘর ভাড়া বাকী পড়ে আছে ওদের। মালিক দৈনিকই এসে
তাগাদা দেয়। অভাব, ক্ষুধা, আশ্রয় সব কিছু বাঁচাতে দুই মাসের সন্তানকে শিরিন বিক্রি করেছে ৬০ হাজার
টাকায়। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা দালাল নিয়ে গেছে।
জল, কাদা উপেক্ষা করে দিশে হারা হয়ে মিতুলকে সাথে নিয়ে উদভ্রান্তের মত বস্তিতে এসে উপস্থিত হয় নীপা। এ বস্তি তার অপরিচিত নয়। ইমনের সাথে সে মাঝে মাঝে এখানে এসেছে ছেলে মেয়েদের পড়াতে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর তার। দুঃচিন্তা আর রাত্রি জাগরনের চিহ্ন চোখে মুখে। একটা চাপা উত্তেজনা। বৌ, ঝি-রা অনেকেই ঘিরে ধরে নীপাকে। তারপর একে একে বলতে শুরু করে।
বুকের ভিতরটা কেউ যেন সজোরে চেপে ধরে নীপার। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। অন্ধকার হয়ে যায় সব কিছু। সকল দুঃচিন্তা আর অপেক্ষার পালা শেষ। সারা রাতের আশা আর বিশ্বাসের ভাঙন, বাকী জীবনের স্বপনের ভাঙ্গন, নিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাঙ্গন- সব ভাঙ্গন একত্রিত হয়ে আকাশ বিদীর্ণ করা এক চিৎকার বের হয়ে আসে নীপার কন্ঠ থেকে। চিৎকার করে সে বলতে থাকে - ইমন মাদক ব্যবসায়ী নয়, বেওয়ারিশ নয়, ওর বাবার নাম, গ্রামের বাড়ি।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় নীপা। এগিয়ে যায় রানুদের ঘরের সামনে, সেখানে ইমনের লাশ পড়ে ছিল। উত্তর দিকের ঘরের দরজা খোলা। ক্ষুধার্ত এক নবজাতকের তীব্র চিৎকার ভেসে আসছে সেখান থেকে। কান্নার সাথে সাথে ওর বুকের নীল রগগুলি উঠানামা করছে। নবজাতকের সেই কান্না নীপাকে শুধু বাস্তবে ফিরিয়েই আনে না, আরো অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয় তাকে। মনে পড়লো, সেও মা হতে চলেছে। অশ্রুত একটি কান্নার শব্দ যেন তার শরীরের মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে। চোখের জলে ঝাপসা সবকিছু, অস্পষ্ট চারিদিক।সেই অস্পষ্টতার মাঝে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি মুখ। আধো-আধো, ভাঙা-ভাঙা এক কন্ঠস্বর,
- কী আমার পরিচয়, মা?
- জারজ?
- আর তোমার পরিচয়…?
এখন কোথায় ইমন? থানায়, মর্গে, না হিম ঘরের ড্রয়ারে? হাটতে শুরু করে নিপা। আকাশের
দিকে তাকায় সে। আরো অন্ধকার। নীপার মনে হয়,
স্বপ্নের কথা। বার বার
ফিরে ফিরে আসা সেই অতলান্ত গভীর খাদের কথা । শূন্য! শুধু শূন্য! সেই শূন্যের সামনে
সে আজ দাঁড়িয়ে। সেই স্বপ্নের মত তার সামনে এখন,
শুধুই আঁধার ঘন পথ ।
কলমে - শম্পা সাহা
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন