চন্দ্রগড়ের
সীমান্তে টিলাটির উপর বিশাল গম্বুজের ছায়া পড়িয়াছে। সুবিশাল স্তম্ভটি দেবগিরি
পর্বতের মানসকন্যা পাঁচটি দুর্গম পর্বতশৃঙ্গ বেষ্টিত চন্দ্রগড়ের ভুজঙ্গবংশের
বিজয়গাথার প্রতীক।
- কুমারী, আর কতক্ষন অপেক্ষায় থাকিবেন? প্রহর অতিবাহিত হইবার
সময় হইলো যে!!
রাজকুমারী
চন্দ্রশশী নিরুত্তর রহিলেন।
ভুজঙ্গ বংশের
রাজা জনহিতৈষী প্রজাপালক রাজপুততিলক কার্তবীর্যের প্রথমা পত্নী শশীরেখার দুই কন্যা
— চন্দ্রশশী আর চন্দ্রমুখী। কনিষ্ঠা চন্দ্রমুখী অপরূপা, নাম তাহার সার্থক। পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় নিটোল গৌরবর্ণ মুখমন্ডল, সুহাসিনী অধরদ্বয় স্ফুরিত হইলে যেনো বোধ হয় সুকোমল পদ্মপত্র উন্মোচিত হইতেছে, তাহার মেঘরাশির মত কেশবন্ধন যখন তাহার গ্রীবা ছুঁইয়া কটিদেশ স্পর্শ করিয়া
দোদুল্যমান হয় তখন হাজার হৃদয়ে অগ্নির সঞ্চার ঘটিয়া থাকে। জ্যেষ্ঠা চন্দ্রশশী
বিপরীত,
তিনি রাজকুমারী হইলেও কুরুপা, অমাবস্যার সূচনালগ্নে ঘনঘোর নিনাদের ন্যায় তাহার গাত্রবর্ণ ইষৎ তমসাচ্ছন্ন, কেশরাশি অসংবৃত, কখনো বা পরিচর্যার অভাবে খানিক রুক্ষ। তবে
আচরণ অতি মিষ্ট, সুহাসিনী না হইলেও তিনি সুভাসিনী। প্রজাদের
আপন মাতা,
সহোদরা কিংবা কন্যার ন্যায় তিনি রাজ্যের প্রতিটি ঘরে ঘরে
যাইয়া তাহাদের সংবাদ লইয়া থাকেন, প্রজারাও তাহাকে আপন পরিবারের ন্যায় ভালোবাসেন, তাহাদের আশীর্বাদ সর্বদা তাহাকে প্রাচীরের ন্যায় ঘিরিয়া থাকে, সকল হিংসা, কুটিলতা, পরশ্রীকাতরতা, অবহেলা আর অপমানের হস্ত হইতে, রাজমহলের সকলের
বক্রদৃষ্টি আর আপন ভগিনীর কটুবাক্য হইতে দূরে এই দারিদ্র্যপীড়িত পর্ণকুটিরের
ছত্রছায়ায় আসিয়া তিনি অপরিমিত শান্তিলাভ করিয়া থাকেন, আর শান্তি পাইয়া থাকেন তখন, যখন তাহার কুমারের
স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া তাহার সকল ক্লেদ পরিত্যাগ করিয়া দেন।
"ঐ যে কুমারী, সীমান্তরক্ষক অমরেন্দ্রের পত্রবাহক
কপোত..."
কুমারী
চন্দ্রশশীর কটিদেশের তরবারিটি স্পর্শ করিয়া বর্তমান তাহার কঠিন বাহুর স্কন্ধের
উপর আসিয়া কপোতটি বসিলো। অপর হস্তে ক্লান্ত খেচরটির সমীপে একমুষ্ঠি শস্যদানা
দিয়া তিনি টিলার উপর বসিয়া একমাত্র সহচরী সুবর্ণাকে ইঙ্গিত করিলেন পত্রটি
উন্মোচিত করিয়া তার নয়নের সমীপে ধরিতে। গত তিন মাস ধরিয়া যদ্যাবধি উত্তর
সীমান্তে সুজাগড়ের সামন্তরাজ ধনঞ্জয় আক্রমন করিয়াছেন, প্রতি সপ্তাহান্তে এই প্রহরে তিনি এইভাবেই তাহার বাল্যসখা, তাহার হৃদয়সম্রাট কুমারের এক একটি পত্রের প্রতীক্ষা করিয়া থাকেন। তাহার
কুমার,
সামন্তরাজ অমরেন্দ্র সীমান্তের প্রধান সেনাধ্যক্ষ, তাহার হস্তে রাজধানীর পরিখা রক্ষার ভার, তাহার
অনুগামীনীর কি দুর্বল হওয়া শোভা পায়!!! তবু মন যে মানে না।
পত্রপাঠ
কুমারীর চোখের দৃষ্টি বাষ্পাকুল হইয়া উঠে, প্রতিটি অক্ষর অগ্নিক্ষরা হয়ে তার গোলাপের ন্যায় হৃদয়ে কণ্টকের ন্যায় শেল
বেঁধাইতেছে, "কুমারী, আপনি যেই সময়ে এই পত্র পাইবেন, আপনার কুমার এই
ধরিত্রী ছাড়িয়া বহুদূর গমন করিয়াছে। কিন্তু আমার বীরগতির নিমিত্ত শোক করিবেন না, অগ্রে বিরাট কর্তব্য আপনার প্রতীক্ষা করিতেছে। রাজকুমারী চন্দ্রমুখী কুমার
ধনঞ্জয়ের সহিত মিলিত হইয়া আপনার পিতাশ্রীকে সিংহাসনচ্যুত করিবার পরিকল্পনা
করিয়াছেন। রাজকুমারী রাত্রি প্রথম প্রহরে পরিখা খুলিয়া দিতে উদ্যত হইবেন, রাত্রি পর্যন্ত উহাকে প্রতিরোধ করা আপনার কর্তব্য। কল্য প্রভাতে আপনার
বৈমাত্রেয় ভ্রাতা বীর কুমার ভবোদয় মাতুলালয় হইতে সৈন্য লইয়া আসিয়া পড়িবেন, ধনঞ্জয়ের ইতিমধ্যেই বহু সৈন্যক্ষয় করিয়াছি, কল্য প্রাতে রাজধানী দখল করিতে না পারিলে উহার পরাজয় সুনিশ্চিত। আমার স্থির
প্রত্যয়,
আমার হৃদয়ের দেবী ভবানী বেদনার সলিলে নিজের স্বদেশের
আহ্বান অগ্রাহ্য করিবে না। আমার গুরুদক্ষিণা আজও অসমাপ্ত রহিয়াছে, শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন করুন, আপনার ভূজায়
লুক্কায়িত অমিত শক্তির গোপন রহস্য উন্মোচিত করিবার মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। অদ্য, বিদায়।
- আপনার হৃদয়ধন্য কুমার অমরেন্দ্র।"
পত্র হইতে একটি
রক্তগোলাপ নিচে পড়িল। গোলাপের ওপর সূর্যের অন্তিম কিরণে ঐশ্বর্যের ন্যায়
শোভাবর্ধন করিল মুক্তোর ন্যায় শুভ্র একটি নীরবিন্দু।
এই ঘটনার পরদিন
প্রাতে এক সৈন্য পরিখার সমীপে দুই রাজকুমারীর দেহ উদ্ধার করিলেন। চন্দ্রমুখীর
শৃঙ্গার রক্তস্নাত, তার বক্ষ একাধিক তীরবিদ্ধ, তার কোমল মুখমণ্ডলে ভীতি আর বিস্ময়ের চিন্হ অতি সুস্পষ্ট। চন্দ্রশশীর বক্ষে
একটি তরবারি আমূল প্রোথিত, তরবারিতে রাজটিকার প্রতীক, আর তরবারির অগ্রে বক্ষে নিষ্পেষিত কুমকুমের ন্যায় রক্তে রঞ্জিত একটি
রক্তগোলাপ। রাজা কার্তবীর্য সংবাদ পাইয়া সত্বর আসিলেন।
এমন সময় সংবাদ
আসিলো,
কুমার ভবোদয় যুদ্ধজয়পূর্বক সামন্ত ধনঞ্জয়কে বন্দী করিয়া
রাজধানী অভিমুখে যাত্রা করিয়াছেন। রাজন দ্রুত তাহার বীরত্বের জন্য মহাসমারোহে
শোভাযাত্রা সহযোগে তাহাকে রাজপুরিকায় বরণ করিয়া লইবার উপযুক্ত ব্যবস্থা করিবার
নির্দেশ দিলেন। আর আদেশ দিলেন কন্যাদের শুভ্র বস্ত্রে ঢেকে মহারানী শশীরেখার কক্ষে
প্রেরণ করিতে। সেনাপতির উপর অনুসন্ধানের ভার দিয়া তিনি বীরপুত্রের আমন্ত্রণের
ব্যবস্থা করিতে প্রস্থান করিলেন, পশ্চাতে ফেলিয়া গেলেন
আপন কন্যাদের প্রাণহীন দেহ। কহিয়া যাইলেন, শান্তি
স্বস্তয়নের উপযুক্ত বন্দোবস্ত করিয়াই যেনো তাহাকে সংবাদ দেওয়া হয়, উনি পুত্রের সহিত ব্যস্ত থাকিবেন।
চন্দ্রশশীর দেহখানি রাজশকটে তুলিয়া লইবার সময় গোলাপের শুষ্কপত্রগুলি ঝরিয়া যাইলো, অবশিষ্ট পড়িয়া রহিল
উহার কণ্টকময় বৃন্ত। অসংখ্য প্রজার অশ্রুতে অন্তিমবারের জন্য অভিষিক্ত হইয়া কুমারীর দেহ কুমার ভবোদয়ের শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে ধীরে ধীরে হারাইয়া যাইলো।
কলমে - ইতিকথার পরিশেষে
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন