মধুচন্দ্রিমা - সঞ্চালী ভট্টাচার্য



চন্দ্রিমা আজ ভীষণ ব্যস্ত, সুশোভন আজ দিল্লি থেকে প্রায়  পাঁচ মাস বাদে ফিরছে। সকাল থেকে তাই ঘর গোছানোর সাথে সাথে নানা রকম রান্না করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে চন্দ্রিমা।সুশোভন চিংড়ি মাছের মালাইকারি খেতে ভীষণ ভালোবাসে। এদিকে চন্দ্রিমার চিংড়িতে অ্যালার্জি। তা সত্বেও  চিংড়ির খোসা ছাড়ানো থেকে রান্না সবটাই চন্দ্রিমা করে ফেলেছে। বারবার ঘড়ি দেখছে আর কাজ সামলাচ্ছে। এদিকে ওর দেড় বছরের মেয়ে খুশি একা একা খেলে চলেছে বিছানায় বসে। বাড়িতে শ্বশুর শ্বাশুরি থাকলেও তারা সেভাবে দেখভাল করতে পারেনা খুশির। চরম ব্যস্ততার মধ্যে চন্দ্রিমা, খুশিকে সামলে চলেছে। নিজের দিকে তাকানোর সময় নেই।ওজন বেড়েছে বেশ কিছুটা, রাত জেগে চোখের নিচে কালি, চুল গুলো রুক্ষ হয়ে গেছে। কেমন যেন অযত্নে বেড়ে ওঠা একটা অনামী গাছ, যার বর্ণ কিংবা গন্ধ কোনটাই নেই,কিন্তু তার কাঠ না হলে হেঁসেলে আগুন ধরেনা। 

 

বেলা গড়িয়ে এল, সুশোভনের আসার সময় হয়ে এল। চন্দ্রিমা তখন মেয়ের ন্যাপি পাল্টাচ্ছে, ওদিকে প্রেসার কুকারে খাসির মাংসে সিটি পড়ছে। কলিং বেল বাজতেই চন্দ্রিমা মেয়েকে কোলে নিয়ে দরজা খুলতে গেল। ওর সারা শরীর তখন ঘামে ভেজা,শাড়িতে হলুদের দাগ, যাকে বলে বিচ্ছিরি অবস্থা। দরজা খুলেই সুশোভনকে দেখে আনন্দে ফেটে পড়ে সে। সুশোভন অবাক চোখে চন্দ্রিমাকে মাপতে বসে যায়।  কি অবস্থা, গায়ে ঘামের গন্ধ, মুটিয়ে গেছে, চোখের কোণে কালি, এ কোন চন্দ্রিমাকে দেখছে সে! খানিক এড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যায় সুশোভন। এরপর সবাই এক সাথে দুপুরের  খাওয়া দাওয়া সারে, এক চন্দ্রিমা বাদেসবার খাওয়া হলে, নিজে খেয়ে, স্নান করে চন্দ্রিমা যখন নিজের ঘরে ঢোকে তখন দেখে সুশোভন ঘুমিয়ে নাক ডাকছে। ওর রান্নাগুলো কেমন হয়েছে সেটুকুও কেউ বলল না, প্রশংসা তো দূর। চন্দ্রিমা ভেবেছিল এতদিন পরে এসে সুশোভন নিশ্চয়ই ওকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করবে, নানা সুখ দুঃখের গল্প বলবে। নাহ্ এসব কিছুই হলো না।  

 

নিজেকে আয়নায় অনেকদিন ঠিকমতো দেখেনি চন্দ্রিমা। তাই হয়তো সুশোভনের আর কোন আকর্ষণ নেই ওর প্রতি। সকলের জন্য সময় বার করতে গিয়ে নিজের জন্য সময় ফুরিয়ে গেছে। তার জগৎ আজ সাড়ে নশো স্কোয়ারফিটের এই বাড়িটা। অথচ চার বছর আগে চন্দ্রিমা দাপিয়ে বেড়িয়েছে কর্পোরেট অফিসে। সেখানেই আলাপ সুশোভনের সাথে। বিয়ের পর থেকে আমূল বদলে ফেলেছে নিজেকে চন্দ্রিমা।  

 

কথায় কথায় সন্ধ্যা নেমে এলো। শ্বশুর মশাইয়ের চা দিতে গিয়ে পাশের ঘরে শুনতে পেল সুশোভনের কথোপকথন। কিছুক্ষণ পরে গায়ে দামী পারফিউম লাগিয়ে সুশোভন পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। চন্দ্রিমা মেয়েকে কোলে নিয়ে তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। শাড়ির ফাঁকে কোমড়ের ষ্ট্রেচ মার্ক উঁকি দিচ্ছে। 

 

বেশ কিছু সপ্তাহ পর এক আলো আঁধারি কফি শপে, শ্রেয়সীর সাথে বসে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে সুশোভনের চোখ চলে যায় কোণের একটা টেবিলে। পিছন থেকে মনে হচ্ছে যেন চন্দ্রিমা। না, তা কি করে সম্ভব, ওতো বাড়িতে বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত। এখানে তবে?? ফোন করে সুশোভন চন্দ্রিমাকে। কোণার টেবিলে বসে ফোন ধরে চন্দ্রিমা। হ্যাঁ সে এখানেই আছে, সুন্দর সেজেছে। অনেকদিন পর সে আবার নিজেকে আয়নায় দেখেছে। হ্যাঁ, চন্দ্রিমা আবার অফিস জয়েন করেছে। ওর গায়ের টাকার গন্ধ দূরে বসে সুশোভন টের পাচ্ছে। সব কিছুর থেকে দামী। তবে এই কি মিস সি সরকার, সুশোভনের ইমিডিয়েট বস? যার ফোন আজ সকালে সে পেয়েছিল। শ্রেয়সী তখন সুশোভনের ঠোঁটে ভালোবাসার চুম্বন এঁকে চলেছে, আঁশটে গন্ধে ভরে উঠেছে আশপাশটা। সুশোভনের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে, শ্রেয়সীর নখের আঁচড়ে জ্বালাভাব আরও গভীর হচ্ছে ওর শরীরে। 


কলমে - সঞ্চালী ভট্টাচার্য   

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন