বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা - তর্কে, বিতর্কে - কমলেন্দু সূত্রধর

চিত্র সৌজন্যঃ হ্যালি গোস্বামী  
 

অহং রাষ্ট্রী সঙ্গমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্।

তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্।।

আমি রাষ্ট্রের অধীশ্বরী, ধন উপস্থিত করেছি, জ্ঞানসম্পন্ন এবং যজ্ঞোপযোগী বস্তু সকলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এরূপে আমাকে দেবতারা নানা স্থানে সন্নিবেশিত করেছেন, আমার আশ্রয়স্থান বিস্তর, আমি বিস্তর প্রাণীর মধ্যে আবিষ্ট আছি।  ঋগবেদ ১০/১২৫/৩” 

কালচক্রের আপন নিয়মেই দেখতে দেখতে চলে এল আরও একটা শরৎকাল, ঘনঘোর বর্ষণের শেষে ধীরে সুস্থে বিদায় নিচ্ছে মেঘপুঞ্জ, নির্মল আকাশে ইতিউতি সাদা মেঘখণ্ডের আলস্য। শিশিরসিক্ত বাতাসে শিউলির সুগন্ধ, সূর্যকিরণে এখন স্বর্ণচাপার আভা, কাশবনের স্নিগ্ধ হাসিতে শারদোৎসবের আমন্ত্রণ পত্র। এই শোভন শরৎ ঋতু যেন আমাদের ভেতরের আলস্যেরই বহিঃপ্রকাশ। নীলাভ আকাশ থেকে শুরু করে দিনের উদাসী বাতাস– সবই যেন আমাদের ছুটির ডাক দেয়। আর সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় যে, এই ছুটির আলস্যের অবকাশেই ‘মা’ আসছেন– আসছে বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাঙালির মহোৎসব শারদোৎসবের অগ্রবর্তী হয়ে ইতিমধ্যে চলে এসেছে বছরের সেই বিশেষ দিনটি, যেদিন আপামর বাঙালি ভোর চারটেয় উঠে ঘুম চোখে রেডিও খুলে “আশ্বিনের শারদ প্রাতে...” শুনতে শুনতে দিন শুরু করেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গমগমে কণ্ঠে চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে সূচনা হয় দেবীপক্ষের। আর কয়েকদিন পরেই তো পুজো!

দুর্গাষষ্ঠীতে বিল্ববৃক্ষে বোধন হয় দেবীর। জীবন সাধনের আরেক নাম জাগরণ। সেজন্যই দুর্গোৎসবে সবার আগে পালিত হয় ‘বোধন’। এই বোধন কার? এই বোধন ঘুমন্ত প্রকৃতির, নিদ্রিত শক্তির।

বোধনের পর সপ্তমীতে ‘নবপত্রিকা’ স্নানের মাধ্যমেই দুর্গাপূজার যথার্থ সূচনা হয় বলা যায়। নবপত্রিকা প্রবেশের পরে দর্পণে দেবী দুর্গার মহাস্নান করানো হয়। এই মহাস্নান এক মহনীয় ব্যাপার। স্নানকালে উচ্চারিত মন্ত্রের অর্থ অনুধাবন করলে স্নানের মহত্ব বোঝা যায়। একেক সময়ে, একেক রকম রাগে, একেক রকম বাদ্যাদি সহযোগে অনুষ্ঠিত এই স্নান যথার্থ অর্থেই মহারাজকীয় ব্যাপার। স্নানের উপচার ও দ্রব্যাদির ফর্দও যেন অনন্যসাধারণ! কি নেই তাতে! নানান স্থান ও নদনদীর জল, নানাপ্রকার মৃত্তিকা, গন্ধদ্রব্য, নানারকম তৈল, চন্দন– আরও কত কি। তবে, এতকিছুর মধ্যে একটি বিশেষ দ্রব্য যুগযুগ ধরে নানান বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। সেটি হল– ‘বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা’।


দুর্গাপুজোয় বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা লাগে কেন

অন্য কোনো পুজোয় তো ওই বস্তুটির প্রয়োজন হয় না! লৌকিক ভাবনা এইরকম যে, বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা পুণ্যশোষী। বেশ্যাগমন করার সময় পুরুষ তার সবটুকু অর্জিত পুণ্য বেশ্যার দ্বারে ফেলে যায়। সেই পুণ্যবাহী মৃত্তিকা দুর্গামূর্তি তৈরির কাজে অতীব প্রয়োজনীয়, ইত্যাদি প্রভৃতি। বলাবাহুল্য, এই ধারণা সম্পুর্ণ লৌকিক ও ভিত্তিহীন। বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকা যদি এতই পুণ্যবস্তু হবে, তবে আর কোনো দেবীপুজোয় এর ব্যবহার নেই কেন?

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার, পৃথিবীর আদিসভ্যতাগুলিতে মাতৃশক্তি উপাসনার যে ধারা বিদ্যমান ছিল, তাতে যৌনতা, উর্বরতা এবং প্রজনন — এই তিনটি বিষয় বরাবরই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। অকুণ্ঠ এবং অবিমিশ্র যৌনতার স্বীকৃতি ও উদযাপন সমস্ত মাতৃধর্মের একটি মৌলিক চিহ্ন। মরজীবনে অকথ্য কৃচ্ছসাধনের পুরস্কার হিসেবে পরকালে এক পঞ্চ ‘ম’-কারে পূর্ণ স্বর্গলাভ — এমন ভাবনা কখনোই প্রাকৃত ধর্মগুলির মধ্যে স্থান পায়নি। বরং তাদের মধ্যে এই সজীব প্রাণচঞ্চলতা, সচল সমাজযূথতা, জৈবিক কামনার সহর্ষ উদযাপন অনেক বেশি স্পষ্ট। তাই পৃথিবীব্যাপী প্রাকৃত ধর্মগুলির মধ্যে যৌনতার ও মাতৃত্বের চিহ্ন অতি উগ্রভাবে প্রকট। মাতৃকার যৌনচিহ্ন-সমন্বিত মোটিফ বা কাল্ট বিভিন্ন দেশের আদিম ধর্মবিধির ইতিহাসে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। শাস্ত্রে তাই বলেছে,

মৈথুনং পরম তত্ত্বং সৃষ্টিস্থিত্যকরণম।”

অ্যাব্রাহামিক ধর্মের কৃত্রিম শুচিতার সংজ্ঞায় সেইসব পেগান/প্রাকৃত ধর্মকৃত্যের অধিকাংশই অতীব রুচিবিহর্গিত। তাই এ-সব গৃহ্যতত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে তন্ত্রের গোপন ক্রিয়াকলাপের আড়ালে, বিভিন্ন মন্দিরে, বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্যে।

উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় প্রাচীন আক্কাদীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মাতৃদেবী ইশতারের (ইনিও দেবী দুর্গার মতই সিংহবাহনা)। এই ইশতার মূলত শস্য, গিরি, প্রস্রবণ, উদ্ভিদ, যুদ্ধ, প্রেম, সৌন্দর্য এবং কামের দেবী। ব্যবিলনীয়রা জানতেন ও বিশ্বাস করতেন যে দেবী ইশতারই জীবজগতে কাম প্রবৃত্তি সঞ্চারিত করেন। তাঁর সম্পর্কে এমন বাক্যও প্রয়োগ করা হয়েছে যে তিনি “কটিদেশ উন্মোচনকারিণী এবং ভ্রূণনির্মাত্রী।”

দেবী ইশতারের মন্দিরে পুজোর একটি অত্যাবশকীয় অঙ্গ ছিল ritualistic prostitution বা ধর্মকৃত্যানুযায়ী বেশ্যাবৃত্তি। ইশতারের মন্দিরে এমন কিছু পূজারিণী থাকতেন, যাঁদের কাজ ছিল ইশতারের উপাসকদের সঙ্গে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে মন্দিরের জন্য কিছু উপার্জন করা। ওই ধর্মানুষ্ঠানের বিশদ বিবরণ বর্তমান পাঠকদের কাছে রুচিবিহর্গিত মনে হতে পারে; তাই সে-সব থেকে বিরত থাকা গেল। তাতে অংশগ্রহণকারী পূজারিণীদের বলা হত ইশতারিতাম, বা ইশতারিতু বা কাদিশতু। 'মেসোপটেমিয়া' নামক গ্রন্থে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের বক্তব্য উদ্ধৃত করে ব্যাবিলনের একটি প্রথার কথা বলা হয়েছে। সেখানে প্রতিটি নারীকেই স্বামী সহবাসের পূর্বে একবার অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করতে হত। তার দেহের প্রথম ফল বা দেহবিক্রয় করে উপার্জিত অর্থ ইশতারের মন্দিরে উৎসর্গ করাও নিয়ম ছিল। ফ্রেজারও এই প্রথার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ব্যাবিলনে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সব পরিবারের নারীকেই জীবনে একবার ইশতারের মন্দিরে পরপুরুষের কাছে দেহবিক্রয় করে সেই পবিত্র বারাঙ্গনা-বৃত্তির অর্থ দেবীর মন্দিরে উৎসর্গ করতে হত। ইশতারের মন্দির থাকত ব্যাবিলন এবং আসিরিয়ার সমস্ত শহরে। সেইসব মন্দিরে ইশতারিতাম নামের দেবদাসীরা বসবাস করত এবং এই ritualistic prostitution পালনে বিশেষ ভূমিকা পালন করত। এমনকি দেবী ইশতার স্বয়ং নিজেকে প্রেমিকা রমণী এবং মন্দিরের বারবণিতা বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি।

ইশতারের মন্দিরের এই পবিত্র বারাঙ্গনাবৃত্তিকে পশ্চিম এশিয়ার জনগণ মহাদেবীর পুজোর অন্যতম পবিত্র ধর্মাচরণ বলে মনে করত। এই প্রথার প্রচলন ছিল সাইপ্রাসেও, তবে সাইপ্রাসের দেবী ইশতারের বদলে অ্যাশটার্ট বা অ্যাফ্রোদিতি হওয়াই স্বাভাবিক। প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রেই হয়তো এই ইশতারপুজোর স্বর্গীয় বেশ্যাবৃত্তির ছায়া ভারতের মাতৃপুজোয় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ভারতীয় মৃত্তিকার প্রভাবে তার রূপ ও চরিত্রের বেশ কিছুটা বদল ঘটে। দেবীপুজোয় দেবদাসী তথা বেশ্যাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ রহিত হয়ে যায়, এই ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তির ছায়াটুকু রয়ে যায় দুর্গাপুজোয় বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা সংগ্রহের মধ্যেই।

কিন্তু, বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকা প্রয়োজন বলেই দুর্গোৎসব আর বেশ্যাবৃত্তিকে একাকার করে দেওয়ার চেষ্টা একান্তই হাস্যকর। দুর্গাপুজোতেই আরও চারটি উপকরণ লাগে যা অন্য কোনো পুজোয় লাগে না—

১.     অতসীফুল,

২.     দ্রোণফুল,

৩.     বিল্ববৃক্ষে বোধন এবং

৪.     নবপত্রিকা।


ঠিক কেন এই উপকরণগুলো দুর্গাপুজোয় প্রয়োজনীয়, কেনই বা এই জটিল উপচার ও প্রকরণের আয়োজন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উদ্যোগে ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে– তা বুঝতে গেলে পুজোর সম্পূর্ণ প্রকরণটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি এও স্পষ্ট হবে যে প্রজাপালনের জন্য যা-যা প্রয়োজন, তেমন সবক'টি উপাদানকে অঙ্গীভূত করা হয় এই পুজোয়। এই প্রতীকী প্রক্রিয়ার নিদর্শন থাকে জড়জগতের উপাদান পঞ্চভূতকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টায় পঞ্চশস্য, পঞ্চগব্য, পঞ্চপল্লব, পঞ্চকোষ, পঞ্চগৌড় (গুড়ি বা গুঁড়ো) ইত্যাদির ব্যবহারে। ঠিক সেভাবেই দেবীর দর্পণস্নানের সময় মোট দশ ধরনের মৃত্তিকা প্রয়োজন। সেগুলো হল,

১.     হাতির দাঁত থেকে নেওয়া মাটি,

২.     শুয়োরের দাঁত থেকে নেওয়া মাটি,

৩.     মোষের শিং থেকে নেওয়া মাটি,

৪.     গঙ্গামাটি(ও সরস্বতী-র মাটি),

৫.     গঙ্গার দু'পারের মাটি,

৬.     চৌরাস্তার মাটি,

৭.     প্রাসাদের মাটি,

৮.     পিঁপড়ে ঢিবির মাটি,

৯.     পাহাড়ের মাটি এবং অবশেষে

১০.বেশ্যাদ্বারের মাটি।

এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, পুজোর উদ্দেশ্য হচ্ছে চতুর্বর্গ-ফললাভ। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ— এই চারটি পুরুষার্থকে (পুরুষ শব্দ এখানে লিঙ্গবাচক নয়) জীবনে অভ্যাস করতে হয়। তার জন্য কী-কী প্রয়োজন? শস্যের সুফলন, রাজ্যের সুশাসন, বাণিজ্যের সুগতি। জানলে আশ্চর্য হবেন, দুর্গাপুজা ছাড়াও এই মহামৃত্তিকার উপচার রাজার রাজ্যাভিষেকে লাগে। অগ্নিপুরাণের ২১৮তম অধ্যায়ে পাওয়া যায়,

পর্বতাগ্র মৃদাতাবনূর্দ্ধানং শোধয়েৎ নৃপ।।

বল্মীকাগ্র মৃদাকর্ণৌ বদনং কেশবালয়াৎ।

ইন্দ্ৰালয় মৃদাগ্রীবাং হৃদয়ন্তু নৃপাজিরাৎ।।

করিদন্তোদ্ধৃতং মৃদাদক্ষিণন্তু যথা ভূজম।

বৃষ শৃঙ্গোদ্ভব মৃদা বামং চৈব যথা ভূজম।।

সরো মৃদা তথা পৃষ্ঠমুদরং সঙ্গমান্বদা।

নদীতীরদ্বয় মৃদা পার্শ্বে স শোধয়েৎ তথা।।

বেশ্যাদ্বার মৃদারাজ্ঞঃ কটিশৌচং তথা ভবেৎ।

যজ্ঞস্থানাত্তথৈবোরূ গোষ্ঠানাজ্জানুনী তথা।।

অশ্বস্থানাত্তথা জঙ্ঘে রথচক্র মৃদাঙ্ঘিকে।

মূর্ধানং পঞ্চগব্যেন ভদ্রাসন গতং নৃপ।।

অভিষিঞ্চেদমাত্যানাং চতুষ্টয়মথো ঘটেঃ।

পূৰ্ব্বতো হেমকুম্ভেন ঘৃতপূর্ণেন ব্রাহ্মণঃ।।

রৌপ্যকুম্ভেন বাম্যেচ ক্ষীর পূর্ণেন ভূমিপঃ।

দধ্নাত তাম্রকুম্ভেন বৈশ্য পশ্চিমগেন চ।।

মৃণ্ময়েন জলনোদক শূদ্রশ্চাপ্যভিষেচয়েৎ।

ততোঽভিষেকং নৃপতেৰ্ব্বচ প্রবরো দ্বিজঃ।।”

অর্থাৎ,

রাজা পর্বত-শিখরস্থ মৃত্তিকা দ্বারা মস্তক শোধন করবেন (শীতল মস্তিষ্কের দ্বারা পরিচালনা করবেন)।

বল্মীকাগ্রস্ত (উই) মৃত্তিকাদ্বারা কর্ণদ্বয় শোধন করবেন (আপাত তুচ্ছ ও সাধারণ বিষয়ও গোচর রাখবেন)।

মনুষ্যালয়ের মৃত্তিকাদ্বারা মুখমণ্ডল চর্চিত করবেন (মানুষের সঙ্গে সর্বক্ষণের সংযোগ বজায় রাখবেন)।

ইন্দ্রালয়ের (সোমরস প্রস্তুতি কেন্দ্রের) মৃত্তিকা প্রয়োগ করবেন গ্রীবাতে ( অর্থাৎ সত্য কথা বলবেন)।

নৃপালয়ের মৃত্তিকাদ্বারা হৃদয় শোধন করবেন (রাজকার্যের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে অবগত হবেন)।

হাতির দাঁতে লেগে থাকা মাটি দ্বারা দক্ষিণহাত মার্জিত করবেন (বাণিজ্যরক্ষা)।

ষাঁড়ের শিঙে লেগে থাকা মাটি দ্বারা বাম হাত চর্চিত করবেন (শক্তিবৃদ্ধি)।

বেশ্যাদ্বারের মৃত্তিকা লাগবে কোমরে (রূপ, সৌন্দর্য ও গুণের উৎকর্ষ সাধন করবেন)।

যজ্ঞস্থানের মাটি দ্বারা উরুদ্বয় মার্জিত করবেন (সাধু প্রতিপালন করবেন)।

সরোবর / হ্রদ / নদীর মাটির দ্বারা পিঠ (জলসম্পদ রক্ষা করবেন) এবং গোশালার মাটির দ্বারা জানুদ্বয় শোধিত করবেন (কৃষিকাজের উন্নতি)।

অশ্বশালার মাটির দ্বারা জঙ্ঘাদ্বয় (যুদ্ধ পরিচালনা করবেন) এবং রথচক্রোত্থিত মাটি দ্বারা চরণদ্বয় শোধন করে তিনি পঞ্চগব্যে স্নান করবেন (যুদ্ধক্ষেত্রের শিক্ষা লাভ করবেন)।

অতঃপর, পূর্ব থেকে ঘৃতপূর্ণ স্বর্ণকলস-সহ ব্রাহ্মণ, দক্ষিণ থেকে দুগ্ধপূর্ণ রৌপ্যঘট-সহ ক্ষত্রিয়, উত্তর থেকে দধিপূর্ণ তাম্রঘট-সহ বৈশ্য ও পশ্চিমে বারিপূর্ণ মৃন্ময়ঘট-সহ শূদ্র রাজাকে অভিষিক্ত করবে। অর্থাৎ রাজা বিদ্বানের থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত হন, ক্ষত্রিয়কে পরিচালনা করেন, জনতাকে রক্ষা করেন এবং শোচককে পালন করেন।”

এই উপচারগুলি সংগ্রহ করার পদ্ধতিও অতি অদ্ভূত। পর্বত-শিখরের মাটি আনতে হয় প্রণত হয়ে। উইমাটি সংগ্রহ করতে হয় আনত হয়ে। হস্তীদন্ত-মৃত্তিকা সংগ্রহ করতে হয় বর্ষাকালে। দ্বন্দ্বপ্রমত্ত বৃষের থেকে আহরণ করতে হয় বৃষশৃঙ্গ মৃত্তিকা। নৃপালয়ের মাটি নিতে হয় রাত্রির মধ্যযামে প্রহরীর চোখ এড়িয়ে, চুরি করে। বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা যাঞ্চা করতে হয় ভিক্ষুকের মতো। ঊষাকালে সংগ্রহ করতে হয় সরোবরের মাটি। অপরাহ্নে আহৃত হয় মনুষ্যালয় মৃত্তিকা। গোশালার মাটি সংগৃহীত হয় দুগ্ধদোহনের পর। অশ্বশালার মাটি নিতে হয় ঘোড়ার খুরের আঘাতে ওঠার পর!

বস্তুত, প্রতিটি মৃত্তিকা সংগ্রহ করতে বলা মানে আসলে অভিষেক-প্রার্থীকে বাস্তবের অভিজ্ঞতা লাভ করতে শেখানো। জ্ঞান, বুদ্ধি, রাজ্যশাসন, শক্তি, অর্থ, সামর্থ্য, কামনা, বাৎসল্য প্রভৃতি বৈচিত্র্যে ভরা যে জীবন আমাদের চারপাশে বহমান— তার সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর একটি প্রক্রিয়া এটি। রাজত্ব মানে যে শুধু রাজপ্রাসাদ আর রাজনটী নয়, বরং বহুজনহিতায়, বহুজনসখায় নিয়োজিত একটি কল্যাণকামী যন্ত্র — সেই কথাটি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন এই উপচার। তাই বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকার লাঞ্ছনে শুধু জনৈক প্রাচীন সেমেটিক দেবীপুজোর ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তির চিহ্নই নেই, সেটি একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রকল্পনার চিহ্নও বটে। দেবী দুর্গার যে শারদীয়া পুজো আমরা প্রতি বছর করে থাকি, তা শুধু শক্তি আরাধনা নয়, প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপুজোও। এই বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা সংযোজনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, এই পুজো শুধুমাত্র ধর্মীয় উপাসনা নয়। সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের একসঙ্গে মিলিত হওয়ার এক মহৎ উপলক্ষ্য এটি। সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের একসঙ্গে মিলিত হওয়ার এক মহৎ উপলক্ষ্য এটি। তাছাড়া, ঋগবেদোক্ত দেবীসূক্তে দেবী স্বয়ং ঘোষণা করছেন, “অহং রাষ্ট্রী” অর্থাৎ, “আমিই রাষ্ট্রের অধীশ্বরী”। কাজেই, দেবীর পূজায় তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধানের ন্যায় রাজকীয় অভিষেক করাটাই কর্তব্য। এই পুজোর মাধ্যমেও বহুজন-পূজ্যা, বহুজন-সেব্যা দেবী যেন স্বকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “আমি দুর্গা, আমিই রাষ্ট্র।”







চিত্র সৌজন্যঃ *[সমস্ত ছবির সূত্রঃ- হ্যালি গোস্বামী ও সমদর্শী অভিরূপ]


তথ্যসূত্রঃ-

১.     দুর্গাপুজো– মিথ, মিথ্যা, সত্যি– অভিক সরকার

২.     পৃথিবীর মাতৃসাধনা– নিগূঢ়ানন্দ

৩.     শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনা– উপেন্দ্ৰকুমার দাস

৪.     পূজা-পার্বণ– যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি

৫.     The roots of Hinduism– Asko Parpola



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন