বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তকে ভুলে যাচ্ছি - জগদীশ মন্ডল

 

 

১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে চারিদিকে প্রতিবাদের তুমুল ঝড় বইছে। এমন অশান্ত উত্তপ্ত সময়ে এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক ভারত বিদ্বেষী রাসেল বাঙালি জাতি সম্বন্ধে অতি কুৎসিত মন্তব্য করেন। এমন অপমান সহ্য করা যায় না। বারুদের স্তুপে আগুনের ফুলকির মতো ছাত্র মহলে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিল। সবার মনে একই প্রশ্ন  উদ্বেলিত করে বারবার। এর কী কোন নেই প্রতিকার! ভারত বিদ্বেষ ও বাঙালি ঘৃণার, সময় হয়নি তখনও জবাব দেবার। সময় এসেছে এবার। সেদিন একটা ক্লাসের ছুটি হয়েছে। ছাত্ররা বারান্দা দিয়ে অন্য ক্লাসে এগিয়ে চলেছে। এমন সময় শত কন্ঠে মুখরিত হলো বন্দেমাতরম ধ্বনি। আচমকা এমন ধ্বনিতে যে যেদিকে পারলো ছুটলো। শোনা গেল রাসেল সাহেবকে জুতোপেটা করেছে কেউ। কে কে ? ড. পি.কে. রায় তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম বাঙালি প্রিন্সিপাল। তবে অস্থায়ী। তিনি তৎপরতার সাথে ক্লাসে ক্লাসে রাসেলকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তখন রাসেলের মুখ ক্ষোভে,লজ্জায়, আরক্ত। জানা গেল কেমিস্ট্রি বিভাগের ছাত্র উল্লাস কর দত্ত এ কাজ করেছে। বাঙালি জাতিবিদ্বেষী কথা সে হজম করতে পারেনি। ঘটনার দিন সে এক পার্টি চটি জুতো খবরের কাগজে মুড়ে কলেজে এসেছিল। সুযোগ বুঝে সদ্ব্যবহার করে। পরিণতি হয় খুব করুন। কলেজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়

           পড়াশুনা থেমে যায় কিন্তু থামেনি বিপ্লবী কার্যকলাপ। যোগ দেন বারীন ঘোষ এর মানিকতলার যুগান্তর সমিতিতে। এখানে এসে উল্লাস কর দত্ত তার সমস্ত বুদ্ধি ও শক্তি নিয়োগ করেন বোমা আবিষ্কার করতে। যে বোমার ব পর্যন্ত জানতো না কোনদিন। কেমিস্ট্রির পাতাই ছিল যার ধ্যান জ্ঞান। সেই কেমিস্ট্রি বই পড়ে ও নানা পুস্তিকা ঘেঁটে বোমা তৈরীর রহস্য উদঘাটন করেন। তাঁকে কেউ এ ব্যাপারে উৎসাহ দেয়নি। বরং নিজের উদ্যোগে বাড়িতে একটি ছোট ল্যাবরেটরী ছিল তাতে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে বোমা তৈরির সূত্র বের করেন। নিজের তৈরি নতুন ফর্মুলা দিয়ে বানিয়ে ফেলেন পিকরিক অ্যাসিড বোমা। সেটি কতটা সফল হয়েছে তার প্রমাণ মেলে খুব শীঘ্র। তাঁর ফর্মুলায় প্রস্তুত  বোমা পরীক্ষার জন্য একদল বিপ্লবীকে বেছে নেওয়া হয়। দেওঘরের কাছে নির্জন দীঘারিয়া পাহাড়।দিনটা ঠিক হয় ১৯০৮ সালের ১লা মে। পরীক্ষার দিন বোমা ছুঁড়তে গিয়ে আহত হয়ে মারা যান বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তী। উল্লাস কর দত্ত হন মারাত্মক জখম। কলকাতায় গোপনে তাঁকে চিকিৎসা করেন ডাক্তার ও বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক। তাঁর বানানো বোমাই ব্যবহার করা হয়েছিল অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে মারার জন্য। যেটা নিক্ষেপ করেছিলেন ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী

           বোমা তৈরীর নতুন কারিগর উল্লাস কর দত্তের জন্ম হয় তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ গ্রামে। তাঁর ডাকনাম ছিল পালু। পিতা হলেন দ্বিজদাস দত্ত। পিতা ছিলেন বেথুন কলেজের অধ্যাপক।পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ। শেষে শিবপুর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক। অত্যন্ত তেজস্বী হলেও ছিলেন ইংরেজভক্ত

           উল্লাসকর দত্ত যেন পিতার ঠিক বিপরীত মেরুতে। অন্য ধাতুতে গড়া। ইংরেজদের গোলামী তিনি পছন্দ করতেন না। তবে বাঁশি বাজাতে পারতেন। দোতারায় ছিলেন পারদর্শী। জীবনের কঠিন দুঃখের সময়েও নিজেকে ধরে রাখতেন উদাত্ত গলায়। বিপিনচন্দ্র পালের অনুপ্রেরণায় তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। সে সময় থেকে বাঙালি পোশাক ধুতি পাঞ্জাবি পরা শুরু করেন। নাম লেখান যুগান্তর দলে। মুরারি পুকুর বোমা বিস্ফোরণে জড়িত থাকা সন্দেহে ১৯০৮ সালের ২রা মে মুরারি পুকুর বাগান বাড়িতে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় আলিপুর বোমার মামলা। ১৯০৯ সাল, বিখ্যাত আলিপুর বোমার মামলা চলছে। এই মামলার শুনানির দিকে নজর সবার। হাই প্রোফাইল মামলা। মুরারিপুকুর বাগানবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা কয়েকজন যুবকের বিরুদ্ধে মামলাটি। তাঁরা ছিলেন বিপ্লবী‌। 

           খবর পৌঁছায় একজন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ ছাড়া পেয়েছেন। অন্যদের কারো দ্বীপান্তর কারো ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়।ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয় উল্লাসকর দত্ত ও বারীন ঘোষের। তার মধ্যে একজন নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে কাঠগড়ায়। সাজা শোনার পর নড়েচড়ে বসলেন। বিচারকের কাছে একটি অনুরোধ রাখতে চান। কী সেই অনুরোধ! গান গাইবেন। অনুমতি পাওয়া গেল। তখন গলা ছেড়ে আদালত কক্ষে গান শুরু করলেন। তিনি আর কেউ নন বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। ভরা কক্ষে তাঁর শেষ আশ্রয় যেন রবি ঠাকুরের গান,' সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে।'

            গান গাওয়া শেষ হলে ফিরে এলেন জেলে। ফাঁসিটা মনে হল তার কাছে মজা‌ হাসতে লাগলেন। এক সময় হাত নেড়ে বলেই ফেললেন দায় থেকে বাঁচা গেল। আজ বাদে কাল যার ফাঁসি তার মুখে খিলখিল হাসি দেখে ইংরেজ প্রহরী অফিসাররা তো তাজ্জব বনে গেলেন। জেলে থাকা সাজা প্রাপ্ত বিপ্লবী বন্ধু নলিনীকান্ত গুপ্ত লিখছেন,' উল্লাসকর সার্থকনামা পুরুষ ছিলেন- সত্য সত্য উল্লাসের অফুরন্ত আকর। জেল থেকে আমাদের যখন প্রিজন ভ্যান এ করে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হত তখন সারাটি পথ গান গেয়ে দিক ফাটিয়ে আমরা চলে যেতাম- উল্লাসকর তার পাণ্ডা ছিলেন। মুখ্য গায়েন আর আমরা সব দোহারি। আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, বাংলার মাটি বাংলার জল, মেরা সোনেকি হিন্দুস্থান প্রভৃতি গান, এখনো কানে বাজে, এখনো কন্ঠস্থ। সে কলধ্বনী হঠাৎ শুনলে মনে হবে স্বদেশী প্রসেসন চলছে। কে বলবে কয়েদির দল ? সে সঙ্গীত এমন প্রাণমন মাতোয়ারা ছিল যে আমাদের পুলিশ প্রহরী বা গাড়িচালক কোনদিন কোন আপত্তি তোলেনি।'

           উল্লাসকর দত্তের জীবননাট্য অন্যদিকে মোড় নিল।ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হলো না। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আদালত ফাঁসির পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়।বারীন ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা হয়। অর্থাৎ সাক্ষাৎ নরক যাত্রা। এখানে যে পরিমাণ অত্যাচার ভোগ করতে হয়েছিল তাতে উল্লাসকর মনে করতেন ফাঁসির সাজাই শ্রেয় ছিল

কলকাতা থেকে আনা হল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে লোমহর্ষক কারাগারগুলির অন্যতম সেলুলার জেলে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পরই সুদূর আন্দামান-নিকোবর দ্বীপুঞ্জে বানানো হয় কারাগারটি। এখানে ভীতিকর পরিবেশ, রহস্যঘেরা জল জঙ্গল, নানামুখি নির্যাতনের কাহিনী।এ থেকে সেলুলার জেলের নামকরণ হয় কালাপানি। সেলুলার বলা হয় কারণ সেখানে বন্দিদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পৃথক সেল বা কক্ষে বন্দী করে রাখা হতো। এমন সেল এর সংখ্যা ছিল ৬৯৩ টি। উল্লাসকরের জীবনে নেমে আসে ভয়ংকর দিন। অমানুষিক খাটুনি। তার সঙ্গে অকথ্য অত্যাচার। ঘন্টার পর ঘন্টা কোন বিশ্রাম না দিয়ে ঘানি টানানো হতো। গাছ কেটে লোড়কি বানানো, প্রচন্ড রোদে দাঁড়িয়ে মাটি কেটে ইট তৈরি করতে হতো। একটু দাঁড়িয়ে পড়লেই মোটা মোটা লাঠি, চাবুক দিয়ে জানোয়ারের মতো পেটানো শুরু হয়ে যেত। তাতেও না হলে দু'হাত বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো গাছে। এত কষ্ট সহ্য করতে না পেরে উল্লাসকরের শরীর ও মন ভাঙতে আরম্ভ করে। একদিন ইটের গোলায় কাজ করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন ডাক্তার তার অবস্থা দেখে চিন্তিত হলেন কিন্তু ইংরেজরা তা শুনবে কেন, এই অবস্থায় জোরপূর্বক তাকে পাঠানো হলো ইটের গোলায় সেখানে তিনি জ্ঞান হারালেন। এই অবস্থায় সামান্য ভাতের মাড় খাইয়ে সারারাত ধরে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে। ডাক্তারের চেষ্টায় যখন জ্বর,শরীর খারাপ কমলো তখন উল্লাস করের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল অন্য বিপ্লবীরা। শরীর যদিও একটু ঠিক হলো কিন্তু মন গেল ভেঙে। সেই হাসিখুশি উল্লাস কর জড় পদার্থে পরিণত হলেন

           অত্যাচারের এখানেই শেষ নয় জেলের হাসপাতালে থাকার সময় একাধিকবার তাঁকে জোরালো ইলেকট্রিক শখ দেওয়া হয়েছিল। সে কথা পরে বর্ণনা করেছেন, 'সমস্ত শরীর বিদীর্ণ করিয়া সমস্ত স্নায়ু মন্ডলীকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিয়া ওই তড়িৎ নির্গত হইতে থাকে।' এক সময় পাগল হয়ে যান তিনি। মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হলে লোহার শিকলে হাত-পা বেঁধে তাকে সেলে ফেলে রাখা হয়। বেদনার চিৎকারে সেল কয়েদির ঘুম ভাঙলে তাকে প্রথমে আনা হয় আন্দামানের মানসিক হাসপাতালে। পরে ১৯১৪ সালে পাঠানো হয় মাদ্রাজের মানসিক হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসা হয় তাঁর। এখানে আট বছর আটকে রাখে ব্রিটিশ শাসক। এখানে থাকাকালীন আন্দামানের দুঃসহ যন্ত্রণা ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তাঁর স্মৃতিকথা, 'আমার কারাজীবন ' গ্রন্থে। এখান থেকে জানা যায় নারকেল তিল বা সরিষার দানা থেকে তেল বের করার জন্য আধুনিককালে ইঞ্জিন চালিত যন্ত্র ব্যবহার করা হয় যন্ত্র আসার আগে গরু বা মহিষের সাহায্যে তেলের মিল চালানো হতো। আন্দামানের তেলের মিল এ  ক্রাশিং চাকা ঘোরাতে যন্ত্র বা পশুর বদলে বন্দিদের ব্যবহার করা হতো। একটা মিল চালাতে তিনজন বন্দী ব্যবহার করা হতো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত তেল বের করার কাজ। এই অমানুষিক কাজে কোন বন্দী সামান্যতম ক্লান্তি প্রদর্শন করলে উপস্থিত জমাদার পেটানো শুরু করতো। লাঠির আঘাত পর্যাপ্ত মনে না হলে মিলের ঘূর্ণায়মান চাকা সাদৃশ্য অংশের হ্যান্ডেলের সাথে বন্দীকে বেঁধে বাকিদের বলা হত পূর্ণ গতিতে ঘোরানোর জন্য। ফলে মেঝের সাথে মাথা ক্রমাগত বাড়ি খেত, পাশাপাশি পুরো শরীরে পড়তো প্রচন্ড চাপ। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। নারকীয় অত্যাচারের ধকল সহ্য করতে না পেরে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন

           কারা জীবনে নরক যন্ত্রণার অবসান ঘটে ১৯২০ সালে। মুক্তি দেওয়া হয় উল্লাসকর দত্তকে। চেষ্টা করলেও আর ফিরতে পারেননি সক্রিয় বিপ্লবের ময়দানে। শরীর মন দুটোই যে ভেঙে পড়েছিল। যে হাতে করুণ সুরে বাজাতেন বাঁশি, সেই হাতেই বাঁধতেন বোমার রশি। তা আজ দুর্বল। তবু বিপ্লবী সত্তা যাবার নয়। তাঁকে আবার ১৯৩১ সালে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ মাস কারাবরণ করার পরে মুক্তি পান। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে তিনি নিজের গ্রামের বাড়ি কালিকচ্ছ ফিরে আসেন। তাঁর শেষ জীবন কাটে শিলচরে। এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৭ মে ১৯৬৫ সালে। ভারত স্বাধীনতার পর স্বাধীনতা দিবস এলে কয়েকজন বিপ্লবীকে স্মরণ করি, বরণ করি। কিন্তু ভুলতে বসেছি উল্লাসকর দত্তের মত সংগ্ৰামী জীবনের কথা। আমরা যদি আধুনিকতায় আসক্ত হয়ে চোরাবালিতে ডুবে যাই এবং বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তকে চর্চা না করি তবে ভবিষ্যৎকে ক্ষমা করতে পারব কী!আসুন সবাই মিলে দেশ দরদী আপন সন্তানকে বরণীয় করে তুলি

 




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন