একমুঠো খুশি - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী



-  "অ বৌদি, কোথায় গো?"


অয়ন্তিকা ল্যাপটপে কাজে ব্যস্ত। মহাষ্টমীর সকাল। পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে এসেই কাজে বসে যেতে হয়েছে। তাও রক্ষে যে অফিসে ডিউটি পড়েনি, ঘর থেকেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে ঘরের ভেতর থেকে হাঁক দেয়, "এইতো এখানে।"

নমিতা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়


- "আমি কালকে আসবো না।"


অয়ন্তিকা বলে, "ঠিক আছে। সে তো তোমার এমাসের ছুটি পাওনা রয়েইছে।" তারপরে শুধোয়, "আসবে না কেন গো? ঠাকুর দেখতে বেরোবে?"


নমিতা একগাল হাসে, "কাল আমাদের ফিস্টি আছে।"


- "দুর্গাপুজোর জন্য?"


- "হ্যাঁ.." নমিতা বলে। "তবে এই ফিস্টিটা কিন্তু অন্যগুলোর মতো নয়। মেয়েদের জন্য ইস্পেশাল।" 

- "মানে?" উৎসুক হয় অয়ন্তিকা

নমিতা বুঝিয়ে বলে, "এটায় রান্না, জোগাড়যন্ত সবকিছু ছেলেরা করবে। পুজোর চারদিনের মধ্যে ষষ্ঠী অস্টুমী থাকে, সেসব দিনে তো আর আমিষ খাওয়া যায় না। তাই নবমীতে হবে।"


অয়ন্তিকা কৌতূহলী স্বরে বলে, "বলো কী! তোমাদের সব মেয়ে-বউরা কালকে একসঙ্গে খেতে বসবে! কোথায় বসবে?"


- "আমার বাড়ির ঠিকানা তো তুমি জানোই। গিয়ে দেখে আসবে 'খন।" মুচকি হেসে নমিতা চলে যায়


অয়ন্তিকা আর তার স্বামী ইন্দ্রজিৎ কর্মসূত্রে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে সেখানে বসবাস করে। দু'জনেরই আদি বাড়ি মফস্বল এলাকায়। সেখান থেকে প্রতিদিন অফিস যাতায়াত অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। অগত্যা এখানে এসে সংসার পাতে তারা। বাড়ির লোকেরা মাঝেমধ্যে আসে, ছুটিছাটা পেলে তারাও যায়। এভাবেই চলছে আপাতত। অয়ন্তিকা ভারি মিশুকে মেয়ে, কথা বলতে ভালোবাসে। নমিতাকে খুব পছন্দ করে। একবার গল্প শুরু হলে তো আর কথাই নেই। নেহাত কাজের তাড়া থাকে, তাই বেশিক্ষণ গল্প করা হয়ে ওঠে না। পুজোর ক'দিন নমিতা সকালে এসে কাজ করে দিয়ে চলে যায়, রাতে অন্য সকলের মতোই ঠাকুর দেখতে বেরোয়। তবে কালকের ব্যাপারটা আলাদা, যার জন্য ছুটি নেওয়া। এর সাথেই নমিতা যখন অয়ন্তিকাকে তার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে, খুশিই হয় অয়ন্তিকা


সেদিন রাতে ঠাকুর দেখে ফেরার সময় অয়ন্তিকা স্বামী ইন্দ্রজিতকে বলে, "জানো তো, কাল না নমিতাদের পাড়ায় মহাভোজ আছে। সব মেয়েরা একসঙ্গে খেতে বসবে! আর তাদের জন্য রান্নাবান্না করবে ছেলেরা।"

ইন্দ্রজিত হেসে বলে, "তোমার তো মনে হচ্ছে যাওয়ার খুব ইচ্ছা।"


- "গেলে মন্দ হতো না। নমিতা তো আমাকে যেতেও বলেছে।" অয়ন্তিকা বলে। "কিন্তু অন্য যারা থাকবে তারা যদি কিছু মনে করে! তাই ভাবছি।"


- "কী করবো, কী করবো" ভাবতে ভাবতে পরেরদিন আর থাকতে না পেরে সকালে জলখাবার সারার পর অয়ন্তিকা নমিতাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। ওদের বাড়ির সামনাসামনি যেতেই ঘরের ভেতর থেকে নমিতা দেখতে পেয়ে ছুটে আসে, "আরে বৌদি যে! এসো এসো!"


- "তোমার ফিস্ট দেখতে এলাম।" অয়ন্তিকা একগাল হাসে


"হ্যাঁ হ্যাঁ চলো.."


যেতে যেতে অয়ন্তিকা লক্ষ্য করে নমিতা বেশ একটু সাজগোজ করেছে। পরিপাটি করে শাড়ি পরেছে। মুখে হালকা প্রসাধনী, কপালে টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে। তার সঙ্গে নমিতার মুখে প্রকাশ পাচ্ছে অন্যরকমের একটা খুশির আভাস। কিছুদূর গিয়ে দেখে একটা মাঠের উপর ত্রিপল টাঙানো হয়েছে, সেখানে ফ্যান চলছে। নীচে শতরঞ্জি পাতা, মহিলারা সেখানে জড়ো হয়ে মনের আনন্দে গল্প করছে। দেখে মনে হলো সকলেই নমিতার মতোই খেটে খাওয়া মানুষ


নমিতা হেসে বলে, "মেয়েদের কম কাজ বলো বৌদি! ঘরের কাজ, বাইরের কাজ। সারাবছর সকলকে আমরা যত্ন করে খাওয়াই, তাই এই দিনটা আমাদের জন্য। আমরা গরীব মানুষ, একার খরচে সবকিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেজন্য সকলে মিলে চাঁদা তুলে একসঙ্গে ফিস্টি করছি। আজ সব কাজকম্ম বাড়ির পুরুষমানুষদের। আগে আমাদের খেতে দেবে, তারপর নিজেরা খাবে।"


অয়ন্তিকা দুপুর অবধি রয়ে গিয়েছিল। প্রত্যক্ষ করেছিল সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষগুলোর একছটাক খুশি। যে শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে নমিতার মনোমালিন্যের গল্প সে নমিতার মুখেই বহুবার শুনেছে, সেই তিনিই স্নেহশীলতার সঙ্গে নজরে রেখেছিলেন বৌমার খাওয়াদাওয়া। নমিতার স্বামী পরিবেশন করতে এলে ছেলেকে দাবড়ানি দিয়ে বলেছিলেন নমিতাকে যেন সে বড়ো দেখে মাছের টুকরো দেয়। মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে ছেলের মুখ কাঁচুমাচু। হেসে উঠেছিল অন্যান্য মহিলারা। সকলের সঙ্গে বসে অয়ন্তিকাও তৃপ্তির সঙ্গে পাত পেড়ে খেয়েছিল। সে নিজে থেকে খেতে চায়নি অবশ্য, বেলা বাড়তে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু হইহই করে উঠেছিল মেয়ে-বউরা, অয়ন্তিকাকে না খাইয়ে কিছুতেই যেতে দেয়নি। অয়ন্তিকাও সাদরে গ্রহণ করেছিল তাদের এই আমন্ত্রণ। রান্নাবান্না, পরিবেশনা আর সকলের সহৃদয় ব্যবহার পাঁচতারা হোটেলের খাবারদাবারকেও হার মানায়


বাড়ি ফিরতে ফিরতে অয়ন্তিকা ভাবে আজ সকাল থেকে রান্নাবান্না কিছুই করেনি। ভেবেছিল বাড়ি ফিরে করবে। নমিতারা আটকে দেওয়ায় সে আর করা হলো না। ইন্দ্রজিতকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল সে যেন নিজের মতো রান্না করে খেয়ে নেয়। সন্ধ্যেবেলায় রান্নাটা বেশ জমিয়ে সেরে ফেলবে, তারপর সারারাত ঠাকুর দেখা। বাড়ি পৌঁছে দেখে ইন্দ্রজিত খেয়েদেয়ে দুপুরের ঘুম দিতে শুয়ে পড়েছে। অয়ন্তিকাও ঘুমোতে শুয়ে পড়ে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল খেয়াল নেই, উঠে দেখে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কান পেতে শোনে রান্নাঘর থেকে কেমন একটা আওয়াজ আসছে যেন। গিয়ে দেখে ইন্দ্রজিত রান্নায় ব্যস্ত। একগাল হেসে বলে, "তোমারও আজ স্পেশাল ভোজ হয়ে যাক, কী বলো!"


অয়ন্তিকা একগাল হেসে বলে, "আর শেষপাতে আইস্ক্রিম।"




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন