কিন্তু রাধারানী ছিলেন নিজের মতে চলা তেজস্বিনী মহিলা। তিনি উত্তরে লিখেছিলেন, "আমি আপনার আশীর্বাদটুকু নিলাম। কিন্তু নামটা নিতে পারলাম না। আমি ২৮ বছর ধরে রাধারাণী। ওই নামে আমার দু'টো বই আছে। কাজেই আমি এই নাম নিতে পারব না। তবে আপনার দেওয়া নবনীতা নামটা আমি তুলে রাখলাম আমার মনের মনিকোঠায়।" সেই নাম সত্যিই তিনি সযত্নে তুলে রেখেছিলেন। তাইতো নিজের মেয়ের নাম রেখেছিলেন ওই নামে।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন :
বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ নবনীতা দেবসেন ১৯৩৮ সালের ১৩ই জানুয়ারি দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্থান পার্কে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নরেন্দ্র দেব ও মাতা রাধারাণী দেবী ছিলেন বিশিষ্ট কবি দম্পতি। সেই কারণেই হয়তো ছোট থেকে বড় হওয়ার পথে সাহিত্যের সাহচর্যে তাঁর লেখিকা হিসাবে পরিস্ফুটন হওয়া ছিল অত্যন্ত সাবলীল। বাংলা ও ইংরেজিতে দখল থাকার পাশাপাশি হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, ফরাসী, জার্মান, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষাগুলি তিনি সমানতালে পড়তে পারতেন।
নবনীতা যে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কলকাতার গোখেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তী লক্ষ্য প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করা। এদিকে তাঁকে তাঁর পারিবারিক আত্মীয়েরা একটি শর্ত দিলেন, কো-এড কলেজে পড়লেও কফি হাউসে গিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে না। এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বুদ্ধদেব বসুর হাতে গড়া তুলনামূলক সাহিত্যে এম এ পড়তে এলেন। ১৯৫৮ সালে এম এ পরীক্ষায় শুধু তুলনামূলক সাহিত্য নয়, মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারীর স্বর্ণপদক অর্জন করে নিলেন তিনি। পরের বছরই তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম প্রত্যয়’ প্রকাশিত হল। পরবর্তীতে নবনীতা হাভার্ড থেকে পুনরায় এম এ করেন এবং ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন। তারপরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেমব্রীজ থেকে পোস্ট ডক করেন।
কর্মজীবন ও বিবাহ :
লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয় – নবনীতার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও গবেষণার ব্যাপ্তি ছিল সুদূর প্রসারিত। ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাঁর অধ্যাপনার সান্নিধ্য লাভ করেছিল। সেখানে বেশ কিছুকাল বিভাগীয় প্রধানও ছিলেন তিনি। এর সাথেই আমেরিকার কলোরাডো কলেজে মেটাগ প্রফেসর থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাধাকৃষ্ণণ স্মারক লেকচারার সর্বত্র বিদ্যাচর্চায় স্বমহিমায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন।
নবনীতা ছিলেন স্বাধীনচেতা, কিন্তু আত্মসংযমী। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর প্রেম নিবিড় হয়ে ওঠে। দু'জনে মাঝেমধ্যেই বন্ধুদের সঙ্গে কফি খেতে বা আড্ডা দিতে যেতেন। রাধারাণী দেবীর নির্দেশমতো কফির আড্ডা শেষে নবনীতাকে বাড়িও পৌঁছে দিয়ে যেতেন অমর্ত্য। একসময় অমর্ত্য বিলেতে পাড়ি দেন, কিছুদিন পরে নবনীতাও। টেমস নদীর ধারে নবনীতাকে বিবাহপ্রস্তাব দেন অমর্ত্য। ১৯৫৯ সালে দু'জনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিলেতেই শুরু হয় তাঁদের দাম্পত্যজীবন। সতেরো বছরের বৈবাহিক সম্পর্কের পর ১৯৭৬ সালে বিবাহবিচ্ছেদও ঘটে।
কিন্তু বিচ্ছেদ হলেও অমর্ত্যর প্রতি কখনও তিক্ততা দানা বাঁধেনি নবনীতার মনে। সর্বদা বন্ধু হয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে অমর্ত্যর পাশে থেকে গিয়েছিলেন তিনি। অমর্ত্য সেনের নোবেল পাওয়ার দিন সংবাদপত্রকে নবনীতা জানিয়েছিলেন, এই সম্মান তাঁর আরো আগে পাওয়া উচিত ছিল। লিখেছিলেন, অমর্ত্যর হাসি যেন চিরকাল অম্লান থাকে। সে সময় একটি ছোটগল্পও রচনা করেছিলেন তিনি – "জরা হটকে, জরা বাঁচকে, ইয়ে হ্যায় নোবেল মেরি জান"। ১৯৯৮ সালের ৩রা নভেম্বর অমর্ত্য সেনের জন্মদিনে নবনীতা তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন দীর্ঘ প্রবন্ধ এবং অমর্ত্যকে বলেছিলেন, "Treat this article as
flowers…"।
সাহিত্যিক নবনীতা :
নবনীতা দেবসেনের সাহিত্যিক রূপটির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। তাঁর রচিত গল্প, কবিতা, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনী প্রত্যেকটি তিনি অসম্ভব মুন্সিয়ানার সঙ্গে বুনেছেন। বিভিন্ন রচনায় তাঁর কলমে ঝরে পড়েছে হাসি, মজা, কৌতুক। ১৯৫৯ সালে "প্রথম প্রত্যয়" নামক কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে পা রাখেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস "আমি অনুপম"। "ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে" তাঁর উল্লেখযোগ্য একটি রচনা। হিন্দুস্থান পার্কে ছিল তাঁর সেই "ভালো-বাসা" বাড়ি, সেখানে তিনতলায় থাকতেন মা রাধারাণী দেবী এবং দোতলায় দুই মেয়ে সহ নবনীতা। এই বাড়ি ও তার পরিবেশ নিয়ে তিনি অনেক সরস গল্প লিখেছেন। তাঁর এক সাপ্তাহিক কলমের নামই ছিল "ভালো-বাসার বারান্দা"।
তবে সাহিত্যের প্রতি তাঁর এই অন্তহীন অনুরাগ নেহাতই আনকোরা ছিল না। অধ্যাপনার সময় থেকেই নবনীতার মননে সাহিত্য বিস্তার লাভ করেছিল। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল রামায়ণ। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের কবি চন্দ্রাবতীর সীতাকে নিয়ে লিখেছিলেন তিনি। চন্দ্রাবতীও রামায়ণ রচনার কাজ শুরু করেছিলেন। তবে এই বিষয়ে অনেকখানি এগোলেও সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন বিবাহবিচ্ছিন্না, তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রতি এক আত্মিক টান অনুভব করেছিলেন নবনীতা। আর সে কারণেই হয়তো চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে নিয়ে কাজ করেছিলেন তিনি। নবনীতার রচনায় সূর্পনখার বেদনার সহমর্মী সীতা। রামচন্দ্র ভাই লক্ষ্মণকে ঠকাচ্ছেন, আবার লক্ষ্মণ ঠকাচ্ছেন সূর্পনখাকে। লব কুশ বিগড়ে যাচ্ছে দেখে চিন্তিত মা সীতা ছেলেদের বসুমতীর কাছে রেখে এলেন। একে তাই সম্পূর্ণভাবে সীতার দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে রচিত রামায়ণ বলা যেতে পারে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সন্তানরা যে দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটায় তা নবনীতার রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর সাথেই বিচ্ছেদবেদনা সম্পর্কে তাঁর আবেগ অনুভূতির রেশ মিলেছিল একখানি নাটকে।
বাঙালি লেখিকাদের নিয়ে ‘সই’ নামে একটি সংগঠন করেছিলেন নবনীতা। সেই সংগঠনের প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছিল তাঁর এক নাটক "অভিজ্ঞান দুষ্মন্তম্", যে রাজা বালিকা প্রণয়িনীকে ছেড়ে যান তার অন্য পিঠ।
পুরস্কার ও পরলোকগমন :
নবনীতা দেবসেন ১৯৯৯ সালে আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনা "নটী নবনীতার" জন্য সাহিত্যে অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। রঙ্গকৌতুকে তাঁর যে কতখানি সাবলীলতা ছিল সেই প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত এই বইতে যেটি ছিল তাঁর প্রথম রম্যরচনার বই। অ্যাকাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সালে তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিতা হন।
অবশেষে ২০১৯ সালের ৭ই নভেম্বর নবনীতা দেবসেন ৮১ বছর বয়সে কর্কটরোগে আক্রান্ত হয়ে অমৃতলোক যাত্রা করেন। তবে বিদায়ের পূর্বে তিনি নিজের মৃত্যুকেও কৌতুক করতে ভোলেননি। "রোববার" পত্রিকায় শেষবারের মতো লিখেছিলেন – “যেসব মানুষ আমাকে একবারও চোখে দ্যাখেনি, দূর দূর গ্রাম থেকে ছুটে আসতে চাইছে একবার শেষ দ্যাখা দেখতে - আরে, এটাই শেষ দ্যাখা, তোমায় কে বলল? এই যে এত লম্বা জীবনটা কাটালুম, তার একটা যথাযথ সমাপন তো দরকার! পাঁজিপুঁথি দেখে, শুভ দিন, শুভ লগ্ন স্থির করে, স্বজনবান্ধবকে নেমতন্ন খাইয়ে তবে তো শুভযাত্রা!”
নবনীতা দেবসেন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একইসঙ্গে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, ভ্রমণকাহিনী রচয়িতা ও রম্যরচনা লেখিকা। বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সঙ্গে একই সারিতে সমানভাবে জ্যোতির্ময়ী তিনি। তীক্ষ্ণ রসবোধ ও সুগভীর পান্ডিত্যে পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বময়ী ও সদাহাস্যময়ী নবনীতা দেবসেনের প্রতি রইল প্রগাঢ় সম্মান ও সশ্রদ্ধ প্রণাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন