দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে মাতৃবন্দনার সাথে সাথে সমানতালে সবাই মেতে ওঠেন আহার বিলাসে। পুজোর উৎসব মুখর পরিবেশে নিরামিষ, উপোস, ফলাহার, ব্রত পালনের পাশাপাশি সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী আহার বিলাসের আয়োজনের প্রাচুর্যও দেখতে পাওয়া যায়। যদিও হিন্দু শাস্ত্রে পূজার ভোগেও আমিষ পদ নিবেদন করা হয়। তবুও উৎসবের মরশুমে ভিন্ন ভিন্ন দেব দেবীর উপাসনা প্রার্থনার অবসরে তাই খাবারের চিরাচরিত পদের সাথেই অজানা অচেনা কিছু পদ পরিবেশনের মাধ্যমে স্বাদ বদলানো হয়।
এক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
পাঁঠার মাংস বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পুজো উপলক্ষ্যে এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে থাকে নিরামিষ
মাংস। বলি দেওয়া পাঁঠার মাংসকে বিশেষ পদ্ধতিতে রান্নার মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। এছাড়া
আছে বড় বড় টুকরোর আলু বা কাঁচা পেঁপে সহযোগে পাঁঠার ঝোল বা কষা মাংস। কিন্তু অতি
পরিচিত পাঁঠার মাংসের আলু ঝোলের বদলে আমরা বানিয়ে ফেলতে পারি কিছু অনন্য স্বাদের ঐতিহ্যবাহী
পাঁঠার মাংসের পদ। যাদের ব্যুৎপত্তিতে জুড়ে আছে অজানা কিছু কাহিনী।
কীমা ভরে লাল ব্যায়গানঃ
মীরা আলি লিখিত এবং করম পুরীর তোলা অসাধারণ খাবারের অসংখ্য ফটো দিয়ে সাজানো 'Dining with the Nawabs' বইতে বহু হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী খাবারের বিষয়ে জানতে পারা যায়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী দশটি করোদ রাজ্যের নবাবী হেঁশেলের উল্লেখযোগ্য কিছু রান্না সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে এই বই রচিত। এখান থেকে জানা যায় যে তখনকার রাজপরিবারের বিত্তশালী সদস্যদের খাদ্যাভাস রাজ্যের সাধারণ মানুষের থেকে খুব একটা পৃথক ছিল না। কিন্তু তাঁদের বাঞ্জনে এক আঞ্চলিক ছোঁয়া থাকত যা প্রতিটি পদকে অসাধারণ করে তুলত। কথিত আছে তামিলনাড়ুর উত্তরে অবস্থিত আরাকাটের নবাব পরিবারের এক রাজকন্যার নিকাহ উপলক্ষ্যে সুস্বাদু কিছু নতুন পদ তৈরির কথা শুনে তদানীন্তন বাবুর্চি টমেটোর ভিতর পাঁঠার মাংস ভরে বিশেষ এক পদ প্রস্তুত করেন। যার নাম “ কিমা ভরে লাল বেয়গান” ( keema stuffed tomato) দেওয়া হয়। সেই সময় টমেটোকে লাল বেয়গন বা লাল বেগুন বলা হত।
উপকরণ:
- চিকেন কিমা - ১০০ গ্রাম
- পেঁয়াজ বাটা – ২৫ গ্রাম
- রসুন বাটা – ২ চামচ
- আদা বাটা - ১ চামচ
- পেঁয়াজ কুচি – ৫০ গ্রাম
- জিরে গুঁড়ো - ১/২ চামচ
- ধনে গুঁড়ো - ১/২ চা চামচ
- কাঁচালঙ্কা কুচি – পরিমাণ মত
- কাঁচালঙ্কা বাটা - ১
চামচ
- টমেটো সস – ৫০ মিলি
- হলুদগুঁড়ো - ১/২ চা চামচ
- নুন – পরিমাণ মত
- চিনি – ১ চামচ
- তেল – ১০০ মিলি
- জল – পরিমাণ মত
প্রণালীঃ
১. কড়াইয়ে তেল দিয়ে তাতে পেঁয়াজ কুচি, আদা রসুন বাটা, কাঁচালঙ্কা কুচি এবং কিমা দিয়ে তার সাথে স্বাদমতো নুন,হলুদ ও সামান্য টমেটো কেচাপ দিয়ে পুর তৈরি করে নিতে হবে।
২. টমেটোগুলোর ওপরের অংশ ছোটো করে কেটে ভেতরের শাঁসালো অংশ একটি চামচ দিয়ে সাবধানে এমনভাবে বের করে নিতে হবে যাতে টমেটোর বাইরের আবরণ নষ্ট না হয়।
৩. টমেটোর ভেতরে ছোট চামচ দিয়ে পুর ভরে নিতে হবে।
৪. বড় চওড়া প্যানে বা তাওয়ায় অল্প তেল দিয়ে পুর ভরা টমেটো বসিয়ে দিয়ে ঢাকা দিয়ে ন্যুনতম আঁচে ৫/৭ মিনিট রান্না করতে দিতে হবে।
৫. টমেটোর আবরণ নরম হয়ে এলে অন্য পাত্রে সব টমেটো তুলে নিতে হবে।
৬. কড়াইয়ে সামান্য তেল দিয়ে তাতে পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, রসুন বাটা, জিরে গুড়ো, ধনে গুড়ো, কাঁচালঙ্কা বাটা, পরিমাণমতো হলুদ ও স্বাদমতো নুন মিষ্টি দিয়ে এবং সামান্য জল দিয়ে মাখা মাখা ঝোল তৈরি করে নিতে হবে।
৭. তৈরি হওয়া গরম ঝোল টমেটোর ওপর দিয়ে ঢেলে দিতে হবে।
৮. ভাত, রুটি, পরোটা সহযোগে পরিবেশন করতে হবে।
Robert Maitland Brereton-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকার ভারতে রেল সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত
হবার পর, ১৮৬৭ সালের জুন মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি রেলওয়ের এলাহাবাদ - জব্বলপুর লাইনের মাধ্যমে শুরু
হল ট্রেনের পথ চলা। ট্রেনের দীর্ঘ যাত্রায় যাত্রীদের খাবারের
সমস্যা দূর করার অভিপ্রায়ে ১৯০৩ সালের প্রথম দিকে দূরপাল্লার ট্রেনে ডাইনিং কার চালু হয়। দিনের তিন বেলা এখানে রেল কর্তৃপক্ষের
পক্ষ থেকে খাবার পরিবেশন করা হত।
এই ট্রেনগুলোর মধ্যে Frontier Mail ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।
সেই যুগের তুলনায় এই ট্রেনে রীতিমত বিলাসবহুল সব রকম আধুনিক সুবিধা
ছিল। এই ট্রেনের রান্নাঘরেই জন্ম হয়েছিল
এক বিশেষ ধরণের কষা মাংসের। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যার
নাম হয়েছিল “রেলওয়ে মাটন কারী”।
কথিত আছে একবার এক ব্রিটিশ অফিসার গভীর রাতে খাবারের আশায় হঠাৎ ট্রেনের
রান্নাঘরে হাজির হন। কিন্তু তখন সবাইকে খাবার পরিবেশনের
পরে পাচকরা নিজেদের খাবারের যোগাড়ে ব্যস্ত । অল্প
বেঁচে থাকা মাংস দিয়ে কষা মাংস রান্না করা হচ্ছিল। মাংসের গন্ধে মুগ্ধ ব্রিটিশ সাহেব
সেই মাংস খেয়ে নেন এবং খুব খুশি হন। কিন্তু কষা মাংসের স্বাদ অত্যধিক ঝাল হওয়ায় পাচককে
অনুরোধ করেন আরেকটু কম ঝালের মাংস রান্নার। তাই পরবর্তী সময় সেই সাহেব
যখন পুনরায় ট্রেনে যাত্রার জন্য আসেন তখন
পাচক তাঁর জন্যই মাংসে বেশি করে জল ও টক দই মিশিয়ে রান্না করেন। সেই থেকে এই মাংস
“ রেলওয়ে মাটন কারী” নামে পরিচিত হয়।
এই মাংসের বিশেষত্ব হল প্রথমত, কষা মাংসকে একটু কম মশলাদার ও একটু হালকা পাতলা করে রাঁধতে হয়। কম মশলাদার হালকা করার জন্য এর মধ্যে দই ও নারকোলের দুধ মেশানো হয়।
সম্ভবত ভারতীয় রান্নায় সেই প্রথম দই ও নারকোলের দুধের ব্যবহার শুরু হয়।
দ্বিতীয়ত, রান্নার প্রণালীতে সামান্য পার্থক্য
আছে। সাধারণত কষা মাংস রান্নায় ম্যারিনেট করে কাঁচা মাংসকে কষিয়ে রান্না
করে তারপর সেদ্ধ করা হয়। কিন্তু রেলওয়ে মাটনকারীর
ক্ষেত্রে মাংসটা আগে সেদ্ধ করে, পরে মশলার সাথে মিশিয়ে রান্না করতে
হয়।
উপকরণঃ
- মাংস – ১ কেজি ( মাঝারি আকারের টুকরো )
- আলু - ৬ টুকরো ( খোসা ছাড়ানো, আধা করে কাটা )
- পিয়াজ কুঁচি - ২০০ গ্রাম
- আদা বাটা - ১ চামচ
- রসুন বাটা - ১ চামচ
- টমেটো বাটা - ১০০ গ্রাম
- টক দই – ১০০ গ্রাম
- সর্ষে তেল – ২৫০ মিলি
- নুন - পরিমাণ মত
- হলুদ - পরিমাণ মত
- শুকনো লঙ্কা - ২ টো
- গোটা জিরে - ১/২ চামচ
- তেজপাতা - ২ টো
- লবঙ্গ - ৪ টে
- দারচিনি – ১ ইঞ্চি
- গোলমরিচ – ৮-১০ টা
- ছোটো এলাচ - ২ টো
- ধনে গুঁড়ো -
১ চামচ
- জিরে গুঁড়ো - ১ চামচ
- কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো - ১ চামচ
- নারকেলের দুধ – ১০০ মিলি
- উষ্ণ জল – পরিমাণ মত
- ধনেপাতা কুচি – পরিমাণ মত
প্রণালীঃ
১. প্রথমেই মাংসকে
২ কাপ জল দিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে।
২. এবার কড়াইতে সর্ষে তেল দিয়ে তাতে ওপরে বর্ণিত গোটা গরম মশলা, তেজপাতা, জিরে,শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিতে হবে।
৩. ফোড়ন ভাজা হয়ে গন্ধ বের হলে এরপর এর মধ্যে পেঁয়াজ কুচি,আদা,রসুন ও টমেটো বাটা দিয়ে ভালো করে কষাতে হবে। নুন, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো মিশিয়ে যতক্ষণ না তেল ছাড়ছে ততক্ষণ কষাতে হবে।
৪. ভালো করে ধুয়ে রাখা খোসা ছাড়ানো দু’ভাগ করা আলু ও পরিমাণমত উষ্ণ জল দিয়ে সমস্ত মশলা ভালো করে মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে আলু সেদ্ধ হতে দিতে হবে।
৫. আলু প্রায় সেদ্ধ হয়ে এলে আগে থেকে সেদ্ধ করা মাংস মিশিয়ে ফুটতে দিতে হবে।
৬. সাথে মিহি করে ফেটানো টকদই মিশিয়ে অনবরত নাড়াতে হবে।
৭. নারকেলের দুধে অল্প উষ্ণ জল মিশিয়ে মাংসের মধ্যে মিশিয়ে দিতে হবে। (নারকেলের দুধ ইচ্ছা হলে না ও যোগ করা যাবে।)
৮. পুরো ঝোল ফুটে গেলে ৩ টে ছোট এলাচ একটু গুঁড়ো করে মিশিয়ে গ্যাস মধ্যম আঁচে রেখে চাপা দিতে হবে ১০ মিনিটের জন্য।
৯. রুটি, নান বা গরম ভাতের সাথে গরম গরম পরিবেশন করতে হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন