সাধারনত মুইঠ্যা ও চিতল মাছ পরস্পরের সমার্থকরূপেই উচ্চারিত হয়। বাঙালি রান্নাঘরের অতি পরিচিত নাম চিতল মাছের মুইঠ্যা । তাই স্বাভাবিক কারনেই ধারনা জন্মায় যে মুইঠ্যা হয়তো কেবলমাত্র চিতল মাছেরই হয়। এই পদের বেশ একটা আভিজাত্য ও গুরুগম্ভীর ব্যাপার আছে। তার কারন এর রন্ধন প্রণালী তুলনামুলক ভাবে জটিল ও সময়সাপেক্ষ। ইদানিং কালে চিতল মাছ প্রায় দুষ্প্রাপ্য ও একই সাথে ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যাওয়ায় বাঙালির পাতে ঐতিহ্যবাহী মুইঠ্যা দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যদি চিতল মাছের বদলে অন্য কিছু দিয়েও একই রকমের স্বাদু পদ রান্না করা যায়, তাহলে অনুষ্ঠানের বিশেষ চমক হিসাবে মুইঠ্যা পরিবেশন করা আর দুঃসাধ্যের বিষয় হবেনা। তাই আজ চিতল মাছ ছাড়া আর অন্য কোন কোন জিনিস দিয়ে মুইঠ্যা বানানো যায় তা নিয়ে লিখলাম।
"মুইঠ্যা" শব্দটির উৎপত্তি মুঠো থেকে। কোনও বস্তুকে (এক্ষেত্রে
কাঁটাহীন মাছ) মুঠোতে নিয়ে গোলাকার আকৃতির তৈরি করে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। তাই এই নামকরণ।
এবার আসি চিতল মাছ ছাড়া অন্য মাছের মুইঠ্যা হয় কিনা। হয়।
পোনা জাতীয় অনেক মাছেরই মুইঠ্যা বানানো যায়। যেমন রুই, কাতলা, ভেটকি প্রভৃতি। এমনকি ডিম, মুরগীর
মাংস ও চিংড়ি মাছেরও
মুইঠ্যা হয়।
যেহেতু মাছ, মাংস ও ডিম দিয়েই মুইঠ্যা তৈরি করা হয় তাই
হয়ত মনে হতে পারে যে শুধু আমিষাশীরাই এই রস আস্বাদন করতে পারেন। কিন্তু নিরামিষ মুইঠ্যাও তৈরি করা যায়।
আজ আমিষ মুইঠ্যা তৈরির বিষয়ে জানালাম।
রুই মাছের মুইঠ্যাঃ
উপকরণ:
- রুই মাছের গাদার টুকরো - ৫০০ গ্রাম
- সেদ্ধ আলু - ১টি বড় মাপের
- আলু - ২ টি (মাঝারি টুকরো করে কাটা)
- পেঁয়াজ বাটা - ১টা
- আদা বাটা - ৩ চামচ
- রসুন বাটা -২ চামচ
- জিরে গুঁড়ো - ১ চামচ
- ধনে গুঁড়ো - ১ চামচ
- গরম মশলা গুঁড়ো - ১ চামচ
- তেজপাতা - ২ টি
- শুকনো লঙ্কা - ১ টি
- কাঁচা লঙ্কা - ১ চামচ বাটা
- টমেটো - ২টি বাটা
- নুন - পরিমান মত
- হলুদ - পরিমান মত
- গোটা জিরে - ১ চামচ
- চিনি - ১ চামচ
- টক দই - ২০০ গ্রাম
- ধনেপাতা কুঁচি - পরিমান মত
- সর্ষে তেল - পরিমান মত
প্রণালীঃ
- প্রথমে মাছের কাঁটা বেছে মাছ মিহি করে বেটে নিতে হবে।
- বাটা মাছের সাথে আলু সেদ্ধ, অল্প নুন, অল্প পেঁয়াজ বাটা, অল্প আদা বাটা, অল্প গরম মশলা গুঁড়ো, কাঁচা লঙ্কা বাটা দিয়ে ভাল করে মেখে নিতে হবে।
- এরপর হাতে অল্প তেল মিশিয়ে এই মিশ্রণকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চেপে চেপে মণ্ডের আকার দিতে হবে।
- পাত্রে জল ফোটাতে হবে। ফুটন্ত জলে এই মণ্ডগুলো ছেড়ে দিয়ে ঢাকা দিয়ে ১০ মিনিট সেদ্ধ করতে হবে। সেদ্ধ হয়ে গেলে জল থেকে তুলে ঠাণ্ডা করে ছোট টুকরো কেটে নিতে হবে।
- কড়াইতে তেল গরম হলে মুইঠ্যার টুকরোগুলো ডুবো তেলে ভাল করে ভেজে নিতে হবে। এই সময় আঁচ কম রাখতে হবে।লাল রঙ ধরলে তুলে নিতে হবে।
- আলুর টুকরোগুলো ভেজে তুলে নিতে হবে।
- করাইতে ৪/৫ চামচ তেল দিয়ে তার মধ্যে তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, গোটা জিরে ফোড়ন দিতে হবে।
- এর মধ্যে এক এক করে পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, রসুন বাটা, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, নুন, হলুদ দিয়ে ভাল করে কষাতে হবে। এর মধ্যে টমেটো বাটা দিতে হবে।
- দই-এর মধ্যে চিনি দিয়ে ভাল করে ফেটিয়ে নিতে হবে। মশলায় মিশিয়ে দিতে হবে।
- কসানো মশলা থেকে তেল ছাড়তে শুরু করলে হাল্কা উষ্ণ জল দিতে হবে।গরম মশলা গুঁড়ো দিয়ে দিতে হবে।
- মুইঠ্যা ও ভাজা আলুর টুকরো ছেড়ে দিতে হবে। ঝোল মাখা মাখা হয়ে এলে ধনেপাতা কুঁচি মিশিয়ে নামিয়ে দিতে হবে।
- গরম ভাত বা পোলাও এর সাথে পরিবেশন করতে হবে।
চিংড়ি মাছের মুইঠ্যাঃ
উপকরণঃ
- চিংড়ি মাছ- ৫০০ গ্রাম
- আলু সেদ্ধ- ১৫০ গ্রাম
- ধনেপাতা কুচি- ২ চামচ
- রসুন বাটা- ১ চামচ
- লঙ্কা গুঁড়ো- আধ চামচ
- হলুদ গুঁড়ো- আধ চামচ
- লেবুর রস- ১ চামচ
- কাঁচালঙ্কা বাটা- ১ চামচ
- নুন- স্বাদমতো
- পেঁয়াজ কুচি- ১ কাপ
- রসুন- ৬-৭ কোয়া
- আদার টুকরো- আধ ইঞ্চি
- কাজু- ৮-১০টি
- টম্যাটো- ১টি
- গোটা গরম মশলা- পরিমাণ অনুযায়ী
- তেজপাতা- ১টি
- লঙ্কা গুঁড়ো- ১ চামচ
- হলুদ গুঁড়ো- আধ চামচ
- ধনে গুঁড়ো- ১ চামচ
- নারকেলের দুধ- ১ কাপ
- নুন ও চিনি- স্বাদমতো
- সর্ষের তেল- ৫ চামচ
প্রণালীঃ
- প্রথমে চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে ভাল করে পরিষ্কার করে নিয়ে চিংড়িগুলিকে মিক্সিতে ভাল করে বেটে নিতে হবে ।
- বড় একটি পাত্রে চিংড়িবাটা, আলু সেদ্ধ, ধনেপাতা কুচি, রসুন বাটা, লঙ্কা গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, লেবুর রস, কাঁচালঙ্কা বাটা ও নুন ভাল করে মিশিয়ে নিতে হবে।
- একটি কড়াইতে সামান্য তেল করে তার মধ্যে পেঁয়াজ কুচি, রসুন, আদার টুকরো, কাজু ও টোম্যাটো দিয়ে
ভাল করে কষাতে হবে।কষানো মশলা ঠান্ডা হলে মিক্সিতে বেটে নিতে হবে।
- কড়াইতে তেল গরম করে তার মধ্যে তেজপাতা ও গোটা গরম মশলা
ফোড়ন দিয়ে মিক্সিতে বেটে রাখা মশলা দিয়ে ভাল করে কষিয়ে নিয়ে একে একে গুঁড়ো মশলাগুলিও দিয়ে নাড়তে
থাকতে হবে।
- তেল ছেড়ে এলে নারকেলের দুধ দিতেহবে। এবার বেটে রাখা চিংড়ি মাছের
মিশ্রণ বড়ার মতো গড়ে নিয়ে ঝোলের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে।
- মিনিট পাঁচেক ঢাকা দিয়ে ফুটতে দিতে হবে। আঁচ বন্ধ করে উপর থেকে ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে নামিয়ে নিয়ে পরিবেশন করতে হবে চিংড়ির মুইঠ্যা।
মাংসের মুইঠ্যাঃ
মুরগীর মাংস দিয়েও মুইঠ্যা বানানো
যায়।
উপকরণঃ
- মুরগীর মাংস – ২৫০ গ্রাম
- আদা - ৫ গ্রাম
- নুন – পরিমাণ মত
- হলুদ – পরিমাণ মত
- রসুন – ৫ কোয়া
- কাঁচা লঙ্কা – ৪/৫ টি
- কর্ণ ফ্লাওয়ার – ২ চামচ
প্রণালীঃ
- মুরগীর মাংসের ছোট ছোট টুকরোর সাথে বাকি উপকরণ মিশিয়ে করে মিক্সিতে বেটে নিতে হবে।
- বড় পাত্রে জল ফুটতে দিতে হবে।
- মাংসের মিশ্রণে কর্ণ ফ্লাওয়ার মিশিয়ে চটকে মেখে নিতে হবে। বাটা মাংসকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ছোট ছোট বলের আকার দিয়ে ফুটন্ত জলে ছেড়ে দিতে হবে।
- পাঁচ মিনিট ফোটার পর সেদ্ধ মাংসের বল জল থেকে তুলে নিতে হবে।
- কড়াইতে তেল দিয়ে মাংসের বলগুলো ভেজে নিলে তৈরি মুইঠ্যা।
- উপরোক্ত প্রণালীতে ঝোল বানিয়ে তার মধ্যে ভাজা মুইঠ্যা দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে।
লইট্যা মাছের মুইঠ্যাঃ
উপকরণঃ
- লইট্যা মাছ – ৫০০ গ্রাম
- আলু সেদ্ধ – ১০০ গ্রাম
- পেঁয়াজ কুচি – ৫০ গ্রাম
- টোম্যাটো কুচি – ৫০ গ্রাম
- আদা বাটা – ১ চামচ
- রসুন বাটা – ১ চামচ
- চিনেবাদাম বাটা – ২/৩ চামচ
- হলুদ গুঁড়ো – পরিমাণ মত
- লঙ্কা গুঁড়ো – পরিমাণ মত
- জিরে গুঁড়ো – ১ চামচ
- ধনে গুঁড়ো- ১ চামচ
- গরম মশলা গুঁড়ো – ১/২ চামচ
- টক দই – ৫০ গ্রাম
- নুন – পরিমাণ মত
- চিনি – ২ চামচ
- সর্ষে তেল – ২৫০ মিলি
প্রণালীঃ
- তারপর কাঁটা বেছে একটা বাটিতে সেদ্ধ মাছ, আলু সেদ্ধ, নুন, হলুদ গুঁড়ো, আদা বাটা, রসুন বাটা, পেঁয়াজ কুচি, গরম মশলা গুঁড়ো সব একসঙ্গে চটকে মেখে নিতে হবে।
- এর সঙ্গে সামান্য বেসনও মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তাহলে মাছের বল তৈরি করতে সুবিধা হবে।
- মাছের এই মিশ্রণ থেকে অল্প অল্প করে নিয়ে বলের আকারে গড়ে নিতে হবে।
- কড়াইতে তেল গরম করে মাছের বলগুলো লালচে করে ভেজে তুলে নিতে
হবে।
- ওই তেলেই তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা এবং গোটা জিরে ফোড়ন দিয়ে, ফোড়ন একটু ভাজা ভাজা হলে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ভাজতে হবে।
- পেঁয়াজ লালচে হলে আদা বাটা, রসুন বাটা দিয়ে অল্প কষিয়ে ধনে গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো দিতে হবে।
- কিছুক্ষণ পর টোম্যাটো কুচি দিয়ে দিয়ে মশলা থেকে তেল ছেড়ে এলে বাদাম বাটা এবং ফেটানো টক দই দিতে হবে।
- মশলা কষানো হলে পরিমাণমতো গরম জল দিয়ে ঝোল ফুটে উঠলে ভেজে রাখা মাছের
বলগুলো দিয়ে কয়েক মিনিট ঢাকা দিয়ে ফুটিয়ে নিতে হবে।
- ঝোল একটু ঘন হলে ওপর থেকে ঘি এবং গরম মশলা গুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে।
- নিরামিষ মুইঠ্যার ক্ষেত্রে ছোলার ডাল, পটল, ছানা, সয়াবিন, এঁচোড় প্রভৃতি দিয়ে মুইঠ্যা তৈরি করা যায়। ঝোলের ক্ষেত্রে নিরামিষ ঝোল তৈরি করে নিতে হয়। আজ কয়েক রকমের আমিষ মুইঠ্যার বিষয়ে জানালাম। পরবর্তী সময়ে নিরামিষ মুইঠ্যা নিয়ে জানাবো।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন