সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ
বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত অংশুল এক জ্যোতিষ্কের নাম অদ্বৈত মল্লবর্মণ। নানাবিধ অনিবার্য এবং আয়ত্তাতীত তীক্ষ্ম কারণে বাংলা সাহিত্যের জন্য বেশি কিছু লিখে ওঠার সু্যোগ তিনি পাননি। যতদূর জানা যায় নিতান্ত স্বল্পদৈর্ঘের আয়ুষ্কালে তিনি তিনটি মৌলিক উপন্যাস লিখেছেন, - ‘রাঙামাটি’, ‘শাদা হাওয়া’ এবং ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। একটি অনুবাদ উপন্যাস, ইংরেজি থেকে –‘জীবনতৃষ্ণা’। ‘সাগরতীর্থে’ নামক একটি প্রতিবেদনমূলক ভ্রমণকাহিনী।
অপ্রকাশিত
এবং বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত কিন্তু অগ্রন্থিত অনেক কবিতা, মননশীল প্রবন্ধ এবং
বেশ কয়েকটি অনবদ্য ছোটোগল্প তিনি রচনা করেছেন। এইসব রচনার মধ্যে নিঃসন্দেহে তাঁর
শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি। মৃত্যুর ভ্রূকুটিতে অতি
কূণিত-আয়ু সেই লেখকের কলম-নিঃসৃত এই উপন্যাসটি পরাজিত করেছে মৃত্যুকে, কালজয়ী হয়ে
উঠেছে তাঁর এই সৃষ্টি।
অদ্বৈত
ছিলেন মানুষের জীবনীকার, সাধারণ মৎসজীবী দরিদ্র এবং নিতান্ত নীচুজাত বলে চিহ্নিত
মালো সম্প্রদায়ের মানুষের কথাকার। নদী-নির্ভর এই
উপন্যাসে নদী আর নদী-চুম্বিত মৃত্তিকা-লগ্ন মানুষের কথা তিনি বলতে চেয়েছেন,
– অসামান্য সার্থকতায় তা পেরেছেন। জীবন ও নদীকে তিনি মিলিত করেছেন তুলনাহীন
দক্ষতায়, নিবিড় সুগভীর জীবনবোধে। তাঁর কাহিনীতে এক আশ্চর্য অনাভরিত বাস্তব এবং
নির্মেদ দর্শন (Look)
গভীরভাবে বিথারিত -
‘...উঠানের একদিকে একটা ডালিম গাছ। পাতা শুখাইয়া গিয়াছে। গৌরাঙ্গসুন্দরের বউ লাগাইয়াছিল। বউ যৌবন থাকিতেই শুখাইয়া গিয়াছিল। গাল বসিয়া, বুক দড়ির মত সরু হইয়া গিয়াছিল। বুকের স্তন দুটি বুকেই বসিয়া গিয়াছিল তার। তারপর একদিন সে মরিয়া গিয়াছিল। সে মরিয়া গিয়া গৌরাঙ্গকে বাঁচাইয়াছে। তার কথা গৌরাঙ্গসুন্দরের আর মনে পড়ে না। তারই মত শুখাইয়া যাওয়া তারই হাতের ডালিম গাছটা চোখে পড়িতে আজ মনে পড়িয়া গেল। উঃ, বউটা মরিয়া কি ভালই না করিয়াছে!....’
অদ্বৈতের সাহিত্যজীবন শুরু হয়েছিল কবিতা রচনার মাধ্যমে। কবিতা লেখারও আগে তিনি স্থানীয় ‘জারি-গানে’র দলের জন্য কিছু গান রচনা করেছিলেন। ১৯১৪ সালের প্রথম মাসের প্রথম তারিখে তাঁর জন্ম হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম অধর চন্দ্র মল্লবর্মন। শৈশব অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে পৌঁছুবার আগেই করাল মৃত্যু পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর চারপাশে। বাবা, মা আর দুই ভাইকে হারিয়ে বাল্যেই নিতান্ত অনাথ হলেন তিনি। তবুও মৃত্যুর হুংকৃত তর্জনী উপেক্ষা করে, দারিদ্র্যের নাগপাশ তুচ্ছ করে তাঁর জীবন ধীরে ধীরে তিতাসের মতো গতিশীল হয়ে উঠল আলোকিত প্রান্তর খুঁজে।
সম্পর্কিত এক পিতৃব্য এবং এডওয়ার্ড হাইস্কুলের শিক্ষক সনাতন মল্লবর্মনের প্রত্যক্ষ সাহায্য ও উৎসাহে তাঁর শিক্ষাজীবন প্রাগ্রসরিত হতে থাকে। তখন থেকেই তাঁর কবিতা লেখা শুরু হয়। কবিতা তখনই তাঁকে দিয়েছিল খ্যাতি, পুরস্কার ও তৃপ্তি। তাই কি প্রত্যন্তবাসী আহরণজীবিদের দুঃখজর্জর বিশুষ্ক জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়েও কবিতার গাঢ় ছায়া ফিরে ফিরে আসে তাঁর অনন্য গদ্যভাষে -
‘...আমি ছিঁড়া খাঁথায় গাও এলাইয়া দিয়া পথের পানে চাইয়া থাকি। সে তখন পরের বাড়ি খাঁথা সিলাই করে, আর সে সূঁইচের ফোঁড় আমার বুকে আইসা বিন্ধে! তার আইতে আইতে রাইত গহীন হয় – আগ-আন্ধাইরা রাইত – দেখি আন্ধাইর গিয়া চাঁদ উঠ্ছে – ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে দিয়া রোশনি ঢুকে, - কেডায় যেমুন ফক ফক কইরা হাসে...’
চাঁদ আর চাঁদের কিরণ নিয়ে প্রথিতযশা বাঙালি লেখক ও কবিদের বহুবিধ এবং বহুমাত্রিক কাব্যিক এবং না-কাব্যিক কল্পনা আছে, - ‘দুধের বন্যা’ থেকে ‘ঝলসানো রুটি’ পর্যন্ত। কিন্তু চাঁদের আলো যখন দীর্ণ বেড়ার অসহায় ফাঁক দিয়ে অবাধে মুখ ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রবল তাচ্ছিল্য ও বিদ্রূপে ‘ফক ফক কইরা হাসে’ তখন পাঠকের মনে যে অতুল অনুভূতির সৃষ্টি হয় তা সঠিকভাবে বর্ণনাতীত। চন্দ্র বা চন্দ্রকান্তার এমন তীক্ষ্ণ তীব্র প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যে অতি বিরল।
(ক)- নদীনির্ভর একটি বিশেষ অঞ্চলের নিবিড় এবং বিস্তৃত পটভূমিতে উপন্যাসটি রচিত হবে।
(খ)- চরিত্র ও কাহিনির ঊপর সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জীবন-সমস্যা ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্টের সর্বাঙ্গীণ প্রভাব বিদ্যমান থাকবে।
(গ)- উপন্যাসের ভিত্তি আঞ্চলিক হলেও রসাবেদনে অবশ্যই সর্বজনীন হবে।
(ঘ)- গভীর জীবনবোধে সে উপন্যাসকে ঋদ্ধ হতে হবে।
এই ধরণের উপন্যাসের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলি বাঁকের ইতিকথা’, আব্দুল জব্বারের ‘ইলিশমারির চর’ উল্লেখযোগ্য। তবে এইসব উপন্যাসের সঙ্গে অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটির বিশেষ মূলগত পার্থক্য আছে।
যে
তিতাসজীবি মালো সম্প্রদায়ের তীব্র অভাবক্লিষ্ট সংঘাতবহুল বেদনাতুর জীবনের কথা
অদ্বৈত নিজ কলমে চিত্রায়িত করেছেন, তিনি সেই নিম্ন সম্প্রদায়েরই একজন। চোখের সামনে
নিঃশ্বাসের স্পর্শে তিনি তাঁদের দেখেছেন, অনুভব করেছেন। বিশিষ্ট শৈলীর এই উপন্যাসে
যাদের কথা বলা হয়েছে, তারাই তাদের কথা তাদের ভাষায় উত্থাপন করেছে – অদ্বৈত হয়েছেন
স্ব-সমাজের প্রতিনিধি। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ ভূমির নিভৃত জীবন-নির্ভর
উপন্যাস-শিল্পের নিজস্ব কায়া তিনি নির্মাণ করেছেন এক অভাবিত তুঙ্গিমা ছুঁয়ে,
স্বসৃষ্ট অনন্য ভঙ্গিতে।
স্থানাভাবে এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে কেবলমাত্র ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি সম্বন্ধে অতি সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হল। আরোপিত অলীক রোম্যান্টিক বিলাসহীন, রুক্ষ, ধূসর গদ্যময় জীবনের কাহিনীতে আকীর্ণ এই উপন্যাসটির কথাবস্তু অদ্বৈত চারটি খন্ডে বিভক্ত করেছেন। প্রতিটি খন্ড দুটি করে উপবিভাগে বিন্যস্ত আছে -
১. তিতাস একটি নদীর নাম, প্রবাস খন্ড।
২. নয়াবসত, জন্ম মৃত্যু বিবাহ।
৩. রামধনু, রাঙা নাও।
৪. দুরঙা প্রজাপতি, ভাসমান।
উপন্যাসের কথাবস্তুর সার্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে উপন্যাসের উক্ত খন্ডগুলি ভাবগত ভাবে দৃঢ়পিনদ্ধ নয়। কিন্তু খন্ডগুলি কোনোভাবেই পরস্পরের সঙ্গে অসম্পর্কিত বা শিথিল-সম্পর্কিত নয়। বিশাল পটভূমি জুড়ে তার বিস্তার – তিতাসের স্রোতের মতো দোলায়িত আর প্রবহমান। উপন্যাসের কাহিনীর ক্রম অগ্রগতি ঘটেছে নদীর ঢেউয়ের মতো। কাহিনী যেন কিছুটা বলয়াকার তবে কখনই পূর্ণ বৃত্তাকার নয়। তিতাস নদীর মতোই এই উপন্যাস মুক্তপ্রান্ত শৃঙ্খলের ব্যঞ্জনা বিশিষ্ট --
‘...এক পাকে শত শত পল্লী দুই পাশে রাখিয়া অনেক জঙ্গল অনেক মাঠ-ময়দানের ছোঁয়া লইয়া ঘুরিয়া আসে – মেঘনার গৌরব আবার মেঘনার কোলেই বিলীন হইয়া যায়।...অনেক দূর-পাল্লার পথ বাহিয়া ইহার দুই মুখ মেঘনায় মিশিয়াছে। পল্লীরমণীর কাঁকনের দুই মুখের মধ্যে যেমন একটু ফাঁক থাকে, তিতাসের দুই মুখের মধ্যে রহিয়াছে তেমনি একটুখানি ফাঁক – কিন্তু কাঁকনের মতই তার বলয়াকৃতি।...’
বিস্ময়কর
এক জীবন-প্রবাহে একাধিক প্রজন্ম কখনও কখনও মুখোমুখি বা পাশাপাশি চলে এসেছিল –
কিন্তু কেউই কাউকে চিনল না। মুক্তপ্রান্ত কাঁকনের দু’টি মুখের মতো তারা কত
কাছাকাছি এল কিন্তু কিছুতেই অন্বিত হল না।
তিতাস
নদীর প্রাকৃতিক বিন্যাসের সঙ্গে এক আশ্চর্য গঠনগত সাযুজ্যতায় সৃষ্ট হয়েছে ‘তিতাস
একটী নদীর নাম’ উপন্যাসের কাহিনী-বিন্যাস এবং চরিত্র চিত্রায়ণ। আর তিতাস! সে কি
শুধু একটি নদীমাত্র! ‘স্বপ্নের ছন্দে বহিয়া’ যাওয়া সেই তিতাস নদী অদ্বৈতের
যাদু-লেখনীর স্পর্শে প্রাণ পেয়ে হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত নদী। তার জলভরা সপ্রাণ বুকে
মায়া আছে, কত মমতা আছে, কত না স্নেহ আছে-
‘...তিতাসের বুকে ঝড় তুফানের রাতেও স্বামীপুত্রদের পাঠাইয়া ভয় করে না। বউরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে। মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়েরই বুকে মাথা এলাইয়া দিয়া শান্ত মনে মাছ-ভরা জাল গুটাইতেছে।...জলের উপরিভাগে বাষ্প ভাসে - দেখা যায়, বুঝি অনেক ধোঁয়া। তারা সে ধোঁয়ার নীচে হাত ডোবায়, পা ডোবায়। অত শীতেও তার জল একটু উষ্ণ মনে হয়, কাঁথার নীচে মায়ের বুকের উষ্ণতার দোসর এই মৃদু উষ্ণতাটুকূ না পাইলে তাহারা যে কি করিত!...’
নিষ্প্রাণ জলরাশি নিয়ে তিতাস-তীরের মানুষের কাছে তিতাস নদীর উত্তরণ ঘটেছে মানবত্বে – তারপরেও তিতাস তাদের কাছে প্রায় দেবত্বে উত্তরিত হয়েছে। মিথ্যাকথনের মাধ্যমে ভীষণ বিপদের হাত থেকে আত্মরক্ষা কবার কারণেও মালো-পুরুষরা তিতাসের জলে দাঁড়িয়ে কোনোরকম মিথ্যাকথনে অক্ষম। মালো-রমণী তিতাসের মীন-পুত্রকন্যাদের মধ্যে মানবসন্তানের সুস্পষ্ট ছায়া দেখতে পায় -
‘...ঘাটে কেহ নাই। সুবলার বউ আঁচল পাতিয়া কয়েকটি মাছ তুলিয়া ফেলিল। তারা পুঁটিমাছের শিশুপাল। কাপড়ের বাঁধনে পড়িয়া ফরফরাইয়া উঠিল...সে আঁচল আলগা দিয়া ছাড়িয়া দিল। খলসে বালিকারা কেমন শাড়ি পরিয়া চলিয়াছে। চাঁদার ছেলেরা কেমন স্বচ্ছ – এপিঠ ওপিঠ দেখা যায়।...ইঞ্চি পরিমাণ সরু সরু মাছ – রূপার মতো রঙ, ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো জীবন্ত...’
মাছগুলি তিতাসের ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো জীবন্ত !! এক্ষেত্রে, মাছগুলির মতো তিতাসের ঢেউগুলি জীবন্ত... এইরকম বর্ণনাই তো সাধারণ বুদ্ধিতে স্বাভাবিক ছিল! কিন্তু ঠিক এই অসাধারণ শৈল্পিক চেতনার জন্যই অদ্বৈতের সাহিত্যকীর্তি অনুপমেয়!
তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে যেমন লোক-সংস্কৃতির সর্বাঙ্গীণ ও আন্তরিক চিত্রায়ণ দেখা যায় তেমনটি অন্য কোনো নদী কেন্দ্রিক উপন্যাসে দেখা যায় না। লোক-সংস্কৃতির দৈনন্দিন বিধিবদ্ধ যাপনের মধ্যে কার্নিভাল (Carnival) জীবন হল তার বাইরের বিশেষ জীবন – উৎসবের, আনন্দের জীবন। তিতাসজীবিদের সে রকম কার্নিভাল জীবনের অন্যতম একটি হল নৌকা বাইচ।
তিতাসজীবিদের আর একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হল দোল-পূর্ণিমার উৎসব। দোল-পূর্ণিমার উৎসবেও শ্রমজর্জর প্রাত্যহিকতার বাইরে জীবন হয়ে ওঠে মধুময় – রমণীয় --
‘...চৈত্রের মাঝামাঝি! বসন্তের তখন পুরা যৌবন। আসিল দোল-পূর্ণিমা। কে কাকে নিয়া কখন দুলিয়াছে, সেই যে দোলা দিয়াছিল তাহারা তাহাদের দোলনায়, স্মৃতির অতলে তাহারই ঢেউ। অমর হইয়া লাগিয়া গিয়াছে গগনে পবনে বনে বনে, মানুষের মনে। মানুষ নিজেকে নিজে রাঙায়। তাহাতেও পূর্ণ তৃপ্তি পায় না। প্রিয়জনকে রাঙায়,...“খলাতে দোল পূর্ণিমায় খুব আরব্বা হয়। মাইয়া লোকে করতাল বাজাইয়া যা নাচে না! নাচে ত না, যেন পরীর মতো নিত্য করে। পায়ে ঘুঙরা, হাতে রাম করতাল। এ নাচ যে না দেখ্ছে সে মায়ের গর্ভে রইছে”...’
মালো পুরুষ-নারীরা কৃষ্ণদলে আর রাধার দলে ভাগ হয়ে পরস্পরের মধ্যে চলে বাক্যমূলক গান। ধীরে ধীরে কৃষ্ণের দলের গানের ধরণ ক্রমশ অসভ্য হয়ে উঠতে থাকে। লোক-জীবন এভাবেই খুঁজে পায় সামান্য মুক্তির ছোঁয়া – দৈনন্দিন গতানুগতিকতায় যা নেই, প্রাসঙ্গিক উৎসবে তারই উৎসার।
তিতাস তীরের আর একটি প্রচলিত লোক-সংস্কৃতি ছিল ‘শিলোক’ আর তার ‘মাণ্ডি’। এগুলি ছিল নানারকম ধাঁধা ও তার উত্তর প্রত্যুত্তরের জগৎ। ‘শিলোক’ আর তার ‘মাণ্ডি’ তিতাসসংলগ্ন মানুষের জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ। তিতাস নদীও সে ধাঁধার অন্তর্লীন...
‘...সু-ফুল ছিট্যা রইছে, তুলবার লোক নাই সু-শয্যা পইড়া রইছে, শুইবার লোক নাই...’
ধাঁধার মধ্যে এক রহস্যময়তার ছাপ থাকে। ধাঁধার মধ্যে কথিত সংস্কৃতি (Oral tradition)) প্রবহমান। একে এক ধরণের ভাষাতাত্ত্বিক পারঙ্গমতা (Linguistic competence) বলা যায়, যা তিতাস-পারের অন্যতম বিশিষ্ট সংস্কৃতি।
মালোজীবনে মনসা-পূজা এক দীর্ঘকালীন উল্লেখ্য উৎসব। মনসামঙ্গলের কাহিনীতে জলসম্পদের সঙ্গে মনসার সম্পর্ক সুস্পষ্ট। মনসা-পূজাতেও মালোপাড়ার নরনারীরা উৎসবে উদ্বেল হয়। মনসাপূজার এক বিশিষ্ট প্রথা – ভাদ্র মাসের পয়লা তারিখে হয় ‘জালা-বিয়া’। এখানে পুরুষের প্রবেশাধিকার থাকে না। এখানে নারীতে নারীতে ছদ্ম বিয়ে হয়। এটি প্রকৃতপক্ষে একরকমের শস্যোৎসব। ‘জালা বিয়া’র ব্যাপারটি মালো সমাজে একটি আগন্তুক প্রথা হলেও হতে পারে। কারণ মালোরা আহরণজীবি, - কর্ষণজীবি নয়।
প্রায় সর্বত্রই লোকসংস্কৃতি একটি জনগোষ্ঠীর অবিভাজ্য উত্তরাধিকার হিসাবে বর্তমান থাকে। সেখানে অন্য কোনো সংস্কৃতি এক দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। গানে গল্পে প্রবাদে এবং অন্যান্য উপাদানে ঋদ্ধ মালো সংস্কৃতির মূল অবয়বের বিপন্নতা ঘনিয়ে এসেছিল উচ্চবর্গের নব্য সংস্কৃতির আগমনে। অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর সমাজের লোকসংস্কৃতি কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর উচ্চবর্গের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে ক্রমে বিনষ্ট হয় তার সুনিপুণ উপস্থাপনা ঘটেছে অদ্বৈতের অনন্য কলমে।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে মূলত ‘কিশোর’ নামক চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে রোম্যান্টিক সৌন্দর্যাভিসারের দিকটি অপরূপতায় এবং গভীরতায় আস্থিত। মালো পাড়ার নবীন যুবক কিশোর যার মনে ‘সূক্ষ্ম শিল্পবোধ’ নিহিত থাকে। অন্যের, বিশেষ করে সম্পূর্ণ অজানা কোনো মানুষের সমৃদ্ধির সম্ভাবনায় প্রসন্ন হতে পারার দুর্লভ শক্তি তার আছে। তার ‘হৃদয়ের পর্দার মত মসৃণ’ গাছের নব পল্লব। ‘সুদূরের ইশারায়’ বসতিহীন ‘নির্জনতার’ মধ্যেও তার আবেপ্রবণ হৃদয়ে ‘আনন্দের ঢেউ’ ওঠে। গানের সুর ভেসে ওঠে -
‘ ...নদীর কিনারা দিয়া গেল বাঁশি বাজাইয়া
পরার পিরীতি মধু লাগে
কু-খেনে বাড়াইলাম পা’ খেয়াঘাটে নাইরে না
খেয়ানীরে খাইল লঙ্কার
বাঘে...’
প্রকৃতিপ্রেমিক কিশোর অচেনা ফুলের সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে গতিহারা হয়ে
পড়ে। মনের এই রকম অবস্থাতে কিশোর আচম্বিতে দর্শন পায় তার ইপ্সিত এক অজ্ঞাতপূর্ব
প্রেমিকার। তার আগে থেকেই অবশ্য তার নিজের গ্রামের মেয়ে বাসন্তীর সঙ্গে তার বিয়ের
কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু কিশোরের রোম্যান্টিক মনের ভাব হল –
‘...নারে
সুবলা, আমার মন যেমন কয়, কথাখান ঠিক না। যারে লেংটা থাইক্যা দেখতাছি, কাঁদাইছি, ডর
দেখাইছি,
ভেউরা বানাইয়া দিচ্ছি – তারে কি বিয়া করণ যায়! বিয়া করণ যায় তারে, যার লগে
কোনোকালে দেখা সাক্ষাৎ নাই।...’
অভিলষিত
কিন্তু অপরিচিত সেই সে মেয়ে, যে তার দিকে ‘সর্প-মুগ্ধের’ মতো কিশোর তাকিয়ে থাকে।
তার আনাড়ি শাড়ির আঁচল ‘শিশু স্তনদুটি’ আ-ঢাকা রেখে দেয়। শুকদেবপুরের সেই অপরূপা
মেয়ে তাকে চিনিয়েছে এক নতুন সুন্দর ফুল, জানিয়েছে সে ফুলের নাম। তারপর ‘পরণের
বসন–আঁচলে’ বুক ঢেকে নিয়ে ‘ভয় পাওয়া হরিণীর’ মতো কোনো ঘরের আড়ালে চলে যায়। রেখে
যায় ‘প্রেমের দেবতার’ ফাঁদে পড়া আত্মহারা কিশোরকে।
কিশোর
তখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র প্রেমাভিসারেই যথার্থ মগ্ন। দেহাভিসার তার পুরুষ-চেতনাকে
তখনও গ্রাস করে উঠতে পারেনি। তাই দোলের দিন সেই পঞ্চদশীর আবীর দিতে যাওয়া হাতের
স্পর্শেই তার শরীর শিহরণে কেঁপে ওঠে। অথচ একদিন তার নৌকায় উঠে আসা যুবতী
স্বাস্থ্যবতী বেদেনীর ‘দুর্বিনীতভাবে উঁচাইয়া’ ওঠা দুই স্তনের ইচ্ছুক সবল স্পর্শ
শেষ পর্যন্ত তার কাছে সাপের মতো ঠাণ্ডা মনে হয়েছে। সে কি ধূর্ত বেদেনির বুকে
ছিটেফোঁটা প্রেমের কবোষ্ণতা ছিলই না বলে? তার স্বৈরিণী বুকের নিছক মাংসের
অভ্যন্তরে শুধু্মাত্র স্থূল প্রয়োজন নিহিত ছিল বলেই কি কিশোরের প্রাপ্তযৌন শরীরেও
এমনটা মনে হয়েছিল?
শুকদেবপুরে
এক দোলের উৎসবে তার দয়িতাকে পেয়েছে কিশোর বড়ো চকিতে, আকস্মিকতার সমাপতনে। তারপর
একদিন শুকদেবপুরের মোড়ল আর মোড়ল-গিন্নীর উদ্যোগে বিবাহের মূল আচার মালাবদলের
মাধ্যমে সেই দয়িতার সঙ্গে তার বিয়ের প্রাথমিক পর্ব আচম্বিতে সম্পন্ন হয়েছিল।
মোড়লগিন্নীরই সহায়তায় তাদের দুজনের একটি মধু-নিশি যাপনও সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু কিশোর আবার হারিয়েছে তাকেই আরও নির্মম আকস্মিকতায়। ভয়ংকর বজ্রপাততুল্য সেই ঘটনায় একমাত্র পাগল হয়ে যাওয়া ছাড়া নিবেদিত-প্রাণ প্রেমিক কিশোর আর কী-ই বা করতে পারত! তিতাস নদীর গতির মতো জীবনের বলয় গতিতে একসময় উন্মাদ কিশোরের জীবনে আবার চলে এসেছিল অভাবিত ভাবে বেঁচে থাকা সেই একনিষ্ঠা নারী।
সেইরকম এক দোলের উৎসব উদ্দীপনার দিনে তার সেই বাঞ্ছিতা নারীর সপ্রেম স্পর্শে উন্মত্ত কিশোরের ছন্দহারা জীবন প্রায় স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসছিল। কিন্তু কাঁকনের সেই খোলা মুখে দুজনে এসে পড়ায় অনন্বয়ী দুই প্রান্তের অনিবার্য ব্যবধান স্থানীয় মানুষদের উত্তেজনার আকার পরিগ্রহণ করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা পারা কিশোরকে অকরুণ মৃত্যুমুখে ঠেলে দিল। সেই অনুল্লিখিত নারী যে প্রকৃতপক্ষে কিশোরের পত্নী ছিল, সেও কিশোরের অনুগমন করল মাত্র চারদিন পরেই।
তাদের দেখা হল – কাছেও এল, কিন্তু তবু ইহজীবনে তাদের আর মিলন সম্ভব হল না। উপন্যাসের বিভিন্ন ট্র্যাজিক মুহূর্ত সৃষ্টির সময় এক্ষেত্রেও অদ্বৈত উপন্যাসের চরিত্র বা পাঠকের প্রতি কোনোরকম দয়া দেখাবার চেষ্টা করেননি। কালজয়ী কোনো উপন্যাসের লেখকের এইরকম নিষ্করুণ অথচ নিরুপায় দায়বদ্ধতা হয়তো থাকেই।
ব্যক্তি-জীবনের সংঘাত-জর্জর ট্র্যাজিক দিক ধীরে ধীরে ব্যাপ্তি লাভ করেছে সমাজ-জীবনে। লোক-সাংস্কৃতিক বিপন্নতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং প্রাকৃতিক বিপন্নতা গভীর অনিবার্যতায় ঘনিয়ে এল তিতাসলগ্ন আহরণজীবিদের জীবনে। ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মত তিতাসের বুকে জেগে উঠল এক মহাঘাতক চড়া বা চর।
বিকল্প জীবিকাহীন আহরণজীবিদের তিতাসের বুক ফুঁড়ে ওঠা সেই সদ্যোজাত ভূভাগের দখল নিতে এগিয়ে আসতে লাগল কর্ষণজীবিরা। তিতাসের ঘনায়মান মৃত্যু মালোজীবনকে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন করে দিতে লাগল। সুগভীর ট্র্যাজিক চেতনায় অদ্বৈতের বর্ণনা অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠে –
‘...যারা মরিয়া গিয়াছে তারা রক্ষা পাইয়াছে। যারা বাঁচিয়া আছে তারা শুধু ভাবিতেছে আর কতদূর। তিতাসের দিক হইতে যেন উত্তর ভাসিয়া আসে, আর বেশিদূর নহে!...তিতাসে নূতন জল আসিলে উহাদের দগ্ধ হাড় একটু জুড়াইত। কিন্তু আর অপেক্ষা করিবার উপায় নাই। জীবনদীতে যে ভাঁটা পড়িয়াছিল, তারই শেষ টান উপস্থিত। তিল তিল করিয়া যে প্রাণ ক্ষয় হইতেছিল, তাহা এখন একেবারেই নিঃশেষ হইয়া আসিল।...’
গণট্র্যাজিক চেতনা বিধৃত উপন্যাসের ক্ষেত্রে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি এক বিরল সিদ্ধির ইতিবৃত্ত। কেননা এই উপন্যাস শুধু তিতাস-সিক্ত মালো-জীবনের প্রতত বিবরণ ও মর্মান্তিক পরিণামের কথাই বলে না – বলে নিত্য প্রবহমান মানব জীবনের এক চিরকালীন সত্য। আঞ্চলিক পটভূমিতে লেখা হলেও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ একটি আঞ্চলিক উপন্যাস হয়ে থাকে না। মানব জীবনের বিশাল পটভূমিতে আস্তীর্ণ থেকে হয়ে ওঠে এক সার্থক মহাকাব্যিক উপন্যাস।
সূত্রঃ
তিতাস একটি নদীর নাম – অদ্বৈত মল্লবর্মন।
বাংলা উইকিপিডিয়া।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন