বাংলা ছায়াছবি "হারানো সুর"এর "তুমি
যে আমার" গানটি প্রত্যেক বাঙালির কাছে যে কতখানি প্রিয়, কতখানি পছন্দের, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এটির রেকর্ডিংয়ের সময় সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে অনেকেই বলেছিলেন সুচিত্রা
সেনের লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছাড়া এই গান গাওয়ার মতো যোগ্য শিল্পী কেউ থাকতেই
পারেন না। সুতরাং তাঁকে দিয়ে গাওয়ানো হোক। কিন্তু হেমন্তবাবু সেদিন জবাব
দিয়েছিলেন, "এই গান গীতা
ছাড়া আর কেউ গাইতে পারবে না।" সেইমতো তাঁর কথা মেনেই বম্বে গিয়ে গানের
রেকর্ডিং করা হয়। তার পরের ঘটনা তো সকলের জানা। বাংলা সঙ্গীতের আকাশে উজ্জ্বল
নক্ষত্রের মতো স্বমহিমায় উজ্জ্বল গীতা দত্তের গাওয়া "তুমি যে আমার"।
বলিউডের সিনেমাগুলিতে প্রায় প্রতিটি নারীকন্ঠের গানেই স্বনামধন্যা দুই সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে এই দু'জনের কারুর না কারুর কণ্ঠ একসময় বাঁধাধরা ছিল। অন্য কোনো গায়িকার গাওয়া গান প্রায় শোনাই যেত না। বিস্ময়ের শেষ থাকে না যখন জানা যায়, গীতা দত্ত যখন নিজের সুধাকণ্ঠের জোরে বলিউড কাঁপাচ্ছিলেন তখন লতা মঙ্গেশকরও তাঁর মতো অতখানি জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেননি। আশা ভোঁসলের বম্বের গানের জগতে স্থান পাওয়া তো ছিল নেহাতই দুষ্কর। সেই গীতা দত্ত ব্যক্তিগত জীবনের ওঠাপড়ায় মানসিক অবসাদে চলে গিয়ে নিজের কেরিয়ার, নিজের জীবন শেষ করে দিলেন। চলে গেলেন অকালে, মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে।
ললাটলিখন মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়! তা
নাহলে জমিদার বংশের মেয়ে হয়েও আর্থিক অবস্থা পড়ে যাওয়ার কারণে গান শেখানোকে
রুজিরুটি করতে গেলে গানের দিদিমণি গরীব বলে তাঁকে মাটিতে বসতে বলা হয়! আদপে তা-ই
হয়েছিল গীতার সঙ্গে। ১৯৩০ সালের ২৩শে নভেম্বর ইংরেজশাসিত অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর
জেলায় ধনী জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ রায়চৌধুরীর
দশ সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে
চল্লিশের দশকের শুরুতে জাপানি সেনার ভয়ে বাংলাদেশের ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতা এবং অসমে
বসবাস করতে থাকেন ঘোষ রায়চৌধুরীরা। পরে ১৯৪২ সালে তৎকালীন বম্বেতে চলে যান।
জমিদারী গিয়ে ঠাঁই হলো বম্বের বস্তি এলাকায়। অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিল যে বারো
বছর বয়স থেকে গীতাকে গানের টিউশনি করতে হতো। বাসের পয়সা বাঁচানোর জন্য মাইলের পর
মাইল হাঁটতেন। অথচ জীবনটা হতে পারতো অন্যরকম। জমিদারকন্যা হয়ে জীবন কেটে যেত
রূপকথার মতো।
কিন্তু তাহলে ভারতীয় সঙ্গীতমহল এমন অসাধারণ
সম্ভাবনাময় সঙ্গীতশিল্পী পেতো কীকরে! একদিন বাড়ির বারান্দায় গুনগুন করে গান
গাইছিলেন গীতা। বারো বছর বয়স তাঁর। সেই গুনগুনানি কানে আসে পথচলতি বম্বের সুরকার
হনুমান প্রসাদের। এরপর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাঁরই নিজস্ব তত্ত্বাবধানে গীতার
সঙ্গীতের তালিম শুরু হয়। অবশেষে ১৯৪৬ সালে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। মাত্র ষোলো
বছর বয়সে সঙ্গীতশিল্পী রূপে গীতা দত্তের কর্মজীবন শুরু হয় সঙ্গীত পরিচালক হনুমান
প্রসাদের ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ ছবির হাত ধরে। যদিও সেখানে গান গেয়েছিলেন কোরাসে, তাও মাত্র দু'লাইন। তবে এই দু'লাইনেই বাজিমাত করে দিয়েছিলেন
তিনি। শচীন দেব বর্মণ পরের বছর তাঁর ছবি ‘দো ভাই’তে গীতাকে ন’টি গান গাইতে দেন।
নেপথ্যগায়িকা হিসেবে সেই তাঁর প্রথম কাজ। শচীন দেব বর্মণ গীতার মাথায় হাত
বুলিয়ে শুধু বলেছিলেন, “বম্বেতে
বাঙালিদের খুব নামডাক। মান রেখো মা।” তাঁর কথা রেখেছিলেন গীতা।
তারপর থেকে গীতা দত্তের কণ্ঠে আসতে শুরু করলো একের পর
এক সুপার ডুপার হিট গান। বাজি, দেবদাস, পেয়াসা, সি.আই.ডি., আর পার, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ, সাহেব বিবি গুলাম, একের পর এক বিখ্যাত বিখ্যাত
চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া চিরস্মরণীয় সব গান। সাথেই পাল্লা দিয়ে চলছে অমর হয়ে
থাকা বাংলা গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ এবং সুধীন দাশগুপ্তের সুরে অনেক গান
গেয়েছিলেন গীতা দত্ত। তাঁর মধুঢালা স্বরে যেকোনো গান অন্য মাত্রা পেতো। ক্রমে
ক্রমে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান তিনি। গরীব বলে গান শেখাতে গিয়ে যেসব বাড়িতে
তাঁকে মাটিতে বসতে বলা হতো, নামডাক হতে
সেই বাড়িগুলি থেকে নিমন্ত্রণ এলে গীতা সেখানে গিয়ে জোর করে মাটিতেই বসতেন।
এমন এক সময়েই বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা গুরু
দত্তের সঙ্গে প্রথমে প্রেম এবং পরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন গীতা। তখন তাঁর বয়স একুশ
আর গুরু দত্তর সাতাশ। সেসময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গুরু দত্তের ছোট বোন
চিত্রশিল্পী ললিতা লাজমি বলেন, “গীতাদিদি তখন বিরাট স্টার। নানা ভাষায় প্রায় ন’শোটা
গান গেয়ে ফেলেছেন। গলা তো মধুতে ডোবানো, নিখুঁত নাকমুখ। আমাদের বাড়ি আসতো বিদেশি
লিমুজিনে।" গীতা দত্তের বিবাহ প্রসঙ্গে তাঁর ছোট ভাই মিলন রায় বলেন, “১৯৫৩-য় ওই বিয়ে ছিলো বিগেস্ট
ওয়েডিং এভার। দু’মাইল গাড়ির লাইন। বৈজয়ন্তী মালা, নূতন, রফি, লতা, পি সি সরকার, গীতা বালি... কে আসেননি!’’
বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই গুরু দত্ত নিজের হোম
প্রোডাকশন ছাড়া গীতার অন্যত্র গান গাওয়া নিষিদ্ধ করলেন। স্বামী, সন্তান, কেরিয়ার নিয়ে গীতা যখন ভাবলেন
জীবনে এবার সুখ এসেছে, তখনই এলো
বিপর্যয়। গুরু দত্তের জীবনের আগমন ঘটলো অভিনেত্রী ওয়াহিদা রেহমানের। দু'জনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থেকে
ঘনিষ্ঠতর হওয়ার সব খবরই গীতা পেতেন। ক্রমে ক্রমে তিনি সরে আসেন গুরু দত্তের কাছ
থেকে, আলাদা থাকতে
শুরু করেন। সংসারজীবনে সম্পর্কের টানাপোড়েনের ফলে গানের রিহার্সালে অনিয়মিত হয়ে
পড়লেন গীতা। আর তখনই আশা ভোঁসলে বম্বের সঙ্গীতজগতে ধীরে ধীরে গীতার জায়গা দখল করতে
লাগলেন।
এদিকে বলিউডে সাফল্য পাওয়ার পরে ওয়াহিদা রেহমান গুরু
দত্তের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। ভেঙে পড়েন গুরু দত্ত। ১৯৬৪ সালের ৯ই
অক্টোবর রাতে সন্তানদের বার বার দেখতে চাইছিলেন গুরু। গীতা কিছুতেই পাঠাবেন না।
পরেরদিন সকালে পুরো একশিশি ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পর গুরু দত্ত চিরঘুমের দেশে চলে
যান। বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৯ বছর। সেদিন সকালে গীতা বারংবার ফোন করেছিলেন, তখনও জানতেন না গুরু দত্ত মারা
গেছেন। নিদারুণ খবরটি শোনার পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন তিনি। সুর ছেড়ে
তুলে নিলেন সুরা। দীর্ঘ একবছর নিজের তিন সন্তানকে চিনতে পারতেন না। তবে সুস্থ হয়ে
উঠে সন্তানদের জন্যই আবার সঙ্গীতজগতে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুযোগ একবার চলে
গেলে তা ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব, তাও আবার বম্বের মতো জায়গায়। গীতার ক্ষেত্রেও সেটাই
হয়েছিল।
এরপর চরম অর্থকষ্টে আবার সুরার নেশায় আসক্ত হয়ে
পড়েন গীতা। আর্থিক অনটন দূর করতে সেই সময়ে কলকাতার মঞ্চে তিনি প্রচুর অনুষ্ঠান
করেছেন। অভিনয় করেছেন বাংলা ছবি ‘বধূবরণ’-এ। শেষ কাজ বাসু ভট্টাচার্যের ‘অনুভব’
চলচ্চিত্রের গাওয়া গানে। ১৯৭২ সালের ২০শে জুলাই গলা দিয়ে সুরের বদলে বেরিয়ে
এসেছিলো ভলকে ভলকে রক্ত। লিভার সিরোসিসে মাত্র ৪১ বছর বয়সে জীবনদীপ নিভে গেলো
সঙ্গীতজগতের কালজয়ী গায়িকা গীতা দত্তের।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন